- বইয়ের নামঃ বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অচেনার মধ্যে এই ডেকে যাওয়া
মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে কি তোমার? প্রমাদের পাশাপাশি
থেকে তুমি নিজে
প্রমাদ গুনেছ কতবার, মনে পড়ে? উদ্ধার-রহিত তুমি
এবং স্বভাবদোষে প্রতিটি সকালবেলা সন্ধ্যা পান করো।
আনন্দোমেলাকে কালো ব্যাজ পরিয়ে বানাও দীর্ঘ শোকসভা
বারংবার আর
সমাজে থেকেও তুমি ভীষণ অসামাজিক, রুক্ষ হয়ে যাচ্ছ,
একাকীর চেয়েও একাকী।
তবে কি তোমার
নৈরাশের কেশপাশে বন্দি হতে ভালো লেগেছিল?
কী যে ভালো লাগে আর লাগে না তোমার, বোঝা দায়।
কখনো ফুলের পাশে দাঁড়াও এভাবে, যেন ফুল
ছাড়া কিছু আর নেই পৃথিবীতে, কখনোবা ক্রোধে
পুষ্পের ঘাতক হয়ে ঘোরো একা বাগানে বাগানে।
ঘোড়ার কেশরে হাত ডুবিয়ে দাঁড়াতে ভালো লাগে?
ভালো লাগে অন্ধকার ঘরে হুকে-আটকানো কোনো
কঙ্কালের দোলা কিংবা নীলিমায় বামন এবং
অপ্সরীর মেলামেশা? কোথাও ঘুণের কিছু চিহ্ন
দেখলে তোমার মুখ বিরক্তির কুশে ঢেকে যায়,
ভালোবাসাবাসি নিয়ে কেউ আদিখ্যেতা করলেই
তাকাও বঙ্কিম, ক্রূর হেসে ওঠো, আবার নিজেই
ভালোবাসা মানুষের প্রকৃত পতাকা জ্বলজ্বলে
বলে মগ্ন হও প্রেমে। টিন আর সিসার জঞ্জাল
ফুঁড়ে ক্লান্ত পরিবেশে একটি সারস এলে তুমি
ফিরিয়ে নেবে কি চোখ? হত্যাকারী হবে কি পাখির?
বুঝি ভালো লাগে খুব করোটিতে স্বপ্নের কম্পন।
এখানে তোমার কেউ নেই,
সেখানে তোমার কেউ নেই,
কোথাও তোমার কেউ নেই,
ব্যাপক ‘নেই’-এর মধ্যে যাকে
একান্ত তোমার বলে ভাব, সেও কি তোমার কেউ?
তুমি তো অবহেলিত অতিশয়, যেন বাংলা ভাষা। সেই কালো
অবহেলা মুছে নিতে পারে যে ওষ্ঠে অমাবস্যা দ্রুত
ঘনায় বেকলি।
তুমি তো বোতলে বাণী বন্দি করে দিয়েছ ভাসিয়ে লোনা জলে-
তরঙ্গে তরঙ্গে নেচে কোথায় যে যাবে কে তা জানে। কোনো দিন
হয়তো পড়বে
কারো আবিষ্কারপ্রিয় হাতে অথবা হারিয়ে যাবে দূরে চিরতরে।
এক্ষুণি বিদায় নিতে চাও? তুমি রুমাল উড়িয়ে চলে যাবে
এত শীঘ্র নিরুদ্দেশে? কেন যাবে এই পার্ক আর ঝলমলে
রেস্তোরাঁ বন্ধুর ডেরা, নিজস্ব চেয়ার,
বিমান, বলাকা ছেড়ে? অলৌকিক ঘণ্টার মতন
কারো কণ্ঠস্বর, বৃষ্টিভেজা নৈশ পথ, কত গীতিকবিতার
সোনালি কম্পন ছেড়ে নিরিবিলি সিঁড়ির গোলাপ
বারান্দা, পুরোনো চিঠি, ব্যাংক নোট, স্বপ্নময় টেলিফোন ছেড়ে
কেন যাবে এমন একাকী?
মৃত্যু ছাড়া সব কিছু মুঠি থেকে ঝরে যায় বলে
এক্ষুণি বিদায় নিতে চাও?
শহীদ মিনার আর ধারালো অস্ত্রের মতো মুক্তিযুদ্ধের গৌরব আর
স্বাধীনতা ছেড়ে দূরে বহুদূরে চলে যেতে চাও?
পুরোনো গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ডাকছ ক্রমাগত,
আকাশ বধির,
ডাকছ, ডাকছ তুমি গলা ছেড়ে, হাওয়া মুছে ফেলে ডাক,
তোমার প্রবল ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরে কিছুকাল, নদী উদাসীন,
নিয়ত ডাকছ তুমি, তোমার সে ডাক
খেয়ে ফেলে গাছ।
এ-ও কি তোমার ভুলে? না থেমো না, বেলাবেলি এই ডেকে যাওয়া
অচেনার মধ্যে এই ডেকে-যাওয়া গান হয়ে ঘুরবে
হয়তো মাঝে মাঝে।
অন্ধ দেয়ালের সাথে
তবে কি যাইনি ভুলে? এতদিনে সব কিছু ফিকে
হয়ে গেলে, খুব শূন্য পাখির বাসার মতো মন
হয়ে গেলে খড়কুটোহীন কার কী বলার ছিল?
সুদূর সকাল ডাকে, দুপুর হাঁপায় ঘন ঘন,
বিকেল হরিণ হয়ে আসে, খুরে তার বনস্থলী,
ঝিল, দিকচিহ্ন প্রকাশিত। রাত্রি, যেন ক্লিওপেট্রা,
অঙ্গবাস খুলে ফেলে অমর আকাঙ্ক্ষাগুলি করে
উন্মোচন, বুকে ক্ষুদ্র সাপের দংশন জেগে থাকে।
করতল থেকে কত বিশ্ব নিচে ভীষণ গড়ায়,
চোখের পাতায় ব্যেপে আসে সুনসান কত যুগ।
চায়ের সময় হল, সিগারেট কই? দেশলাই
প্রতিবার অতিশয় ব্যস্ত হয়ে খুঁজতেই হয়
পকেটে টেবিলে কিংবা একান্ত দেরাজে। সিগারেটে
আগুন ধরাতে গিয়ে অকস্মাৎ কী অন্যমস্ক
হয়ে পড়ি, পুনরায় তড়িঘড়ি ফস করে কাঠি
জ্বালাই এবং দূরে তাকাই ট্যুরিস্টবৎ আর
সহসা নিজের ট্রাউজারে, দেখি লেগে আছে কিছু
চোরকাঁটা কবেকার। মায়া লাগে, সস্নেহে বুলোই
হাত সেই শুকনো নৈসর্গিক কণাগুলির ওপর।
চায়ের পেয়ালা ঠাণ্ডা, আগুনের ফুলকি শিরাপুঞ্জে।
অতীত বাড়ায় গলা হৃদয়ের ভেতরে, যেন সে
রাজহাঁস, চঞ্চু ঘষে ঊরুতে আমার, ডানা তার
কেবলি আমাকে ডাকে মোহিনী স্বপ্নের ছায়াচ্ছন্ন
সুদূর নিবাসে, রাজহাঁসের নয়ন সারাক্ষণ
নিবদ্ধ আমার দিকে, বুঝি স্পষ্ট দেখে নিতে চায়
বেলাবেলি কতটুকু আমি আছি আমার ভেতরে?
তার গীতপ্রায় গ্রীবা ছুঁয়ে বলি-পথ যত দূরে
চলে যাক, হোক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের রাত্রির মতন,
হোক যত ভাঙাচোরা, পথ, তবু পথ চিরদিন
আমাকে শোনাও তুমি পান্থনিবাসের কলস্বর।
এখনও বিকেলে হেঁটে যেতে যেতে কেন বারংবার
পিছনে তাকাই ফিরে? কেন মন মরুর মতন
হয়ে যায় অকস্মাৎ? আছে কি এমন কেউ যার
শরীর স্পন্দিত হচ্ছে একা ঘরে এখন আমারই
পথ চেয়ে সারাক্ষণ? নাকি অন্তর্গত দুর্বলতা
ডেকে নিয়ে যেতে চায় যাত্রার বিন্দুতে পুনরায়?
উদ্দীপনা যত টেনে নিয়ে যাক দূরে মাঝে-মাঝে
পিছনে তাকাতে হয় আর কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলে
প্রতিবাদহীন চলে যেতে হয়-কোথায় যে যাওয়া-
অতিক্রম করে বৃক্ষশ্রেণী, ফুটপাত, লেক, সাঁকো।
কতিপয় উপরাজ ল্যাম্পপোস্ট পেরিয়ে এই যাওয়া
স্বপ্নের ভেতরে হেঁটে যাওয়ার মতন মনে হয়-
যেন আমি বড়ো বুনো লতাগুল্মময় পৌরাণিক
সমাধি ফলক থেকে সমাধি ফলকে যাচ্ছি একা!
যে-হাত এগিয়ে আসে করমর্দনের অভিলাষে,
সে-হাত বালির তৈরি, ঝরে যায় নিঃসীম সৈকতে।
ব্যাকুল আবৃত্তি করি প্রেমকথা কর্কশ আঁধারে
আর ভাবি আছে কেউ সুনিশ্চিত সেখানে আড়ালে,
অথচ পাই না সাড়া কিছুতেই। তবে কি এভাবে
অন্ধ দেয়ালের সাথে কথা বলে যাব একা একা?
অপরাহ্নে একদল মিউজিসিয়ান
অপরাহ্নে একদল মিউজিসিয়ান রকমারি বাদ্য নিয়ে
দাঁড়ায় গলির মাড়ে। যেন গলিতেই কনসার্ট
বিপুল ফুলের মতো পাপড়ি মেলে ভেসে যাবে মেঘে।
অকস্মাৎ একজন ড্রামে নাচায় নিপুণ কাঠি, অন্যজন
বাজায় ক্ল্যারিওনেট, কেউ স্যাক্সেফোন, ভায়োলিনে ছড় টানে কেউ,
কেউবা ট্রাম্পেটে তোলে সুর, শহরের চোখ স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়।
ঘর ছেড়ে লোক
সোৎসাহে বাইরে আসে, মানুষের বাগান সমস্ত গলিপথ।
সমাগত এইসব মিউজিসিয়ান কী রকম খায় দায়, সুখে আছে কিনা,
নাকি অন্তহীন স্বপ্নে ডুবে আছে নিজ নিজ বিশদ গুহায়?
ওরা কি কখনো ছুটি পায়? কে যোগায় ওদের বেতন
কিংবা কোথায় প্রকৃত ডেরা বেঁধে
এখানে এসেছে অপরাহ্নে? করে না এমন প্রশ্ন কেউ, শুধু
শোনে, বাদ্য শোনে!
মিইজসিয়ানগণ শাগালের ছরির মতন-কেউ কেউ
ভাসমান, সঙ্গে ঘোড়া অথবা বাছুর, ভায়োলিন
মালাসহ দোলে, কেউ পথে শোয়ানো লোকের পাশে
দাঁড়িয়ে চাঁদের নিচে ব্যাঞ্জো নিয়ে মাতে, গান গায়!
ড্রাম চায় জ্বলজ্বলে দুই বিঘা জমি,
স্যাক্সোফোন অরণ্যের অন্তর্গত স্বপ্নের প্রপাত,
এবং ক্ল্যারিওনেট চায় যাবতীয় কমলালেবুর
বাগানের একান্ত দখলীস্বত্ব আর
ভায়োলিন চায় স্তব্ধ নদীতীর, কবিতার বর্ণিল টেরেস,
সোনালি ট্রাম্পেট চায় একগুচ্ছ সতেজ গোলাপ,
ব্রাউন গিটার চায় তারে তারে সুন্দরীর ঘুমন্ত শরীর।
তিনটি বিয়ার ক্যান শহরের অনেক ওপরে, প্রায় মেঘমালা
ছুঁয়ে তীব্র মরুঘ্রাণ নিয়ে এ শহরে অবেলায়
কোত্থেকে হঠাৎ এক ভিড় উট এসে মিউজিসিয়ানদের
উদ্ভট ভঙ্গিতে দূরে, বহুদূরে হটাতে হটাতে
খাদের কিনারে নিয়ে যায়।
বিরান প্রান্তর থেকে, খাদের কিনার থেকে ফের
অপরাহ্নে ফিরে আসে একদল মিউজিসিয়ান।
এ-ও কি বিভ্রম নাকি? বাস্তবিকই একদল মিউজিসিয়ান
এসেছে এখানে অপরাহ্নে? কে আমাকে বলে দেবে এই অবেলায়?
আমি তো দেখছি আজরাইল রাশি রাশি ইশতাহার
বিলি করে অলিতে-গলিতে,
চৌরাস্তায়, বাস টার্মিনালে এবং চালান করে কালো চুমো
ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে, বেঘোর বস্তিতে।
কতিপয় কফিনের পাশে স্যাক্সোফোন, ট্রাম্পেট, গিটার আর
ভায়োলিন পড়ে আছে। তবে কি সকল স্পন্দমান
মিউজিসিয়ান মৃত? শত শত রক্তমাখা ইঁদুর এখানে
ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ সারাবেলা।
সে কোন মড়কে গেল মুছে জরিগাঁথা ঝলমলে
পোশাক-আশাকে মোড়া টেরিকাটা মিউজিসিয়ান?
ভাবতে ভালোই লাগে
মিউজিসিয়ানগণ এ শহরে সুর তোলে যখন তখন,
ভাবতে ভালোই লাগে,
সেই সুরে এক ঝাঁক কবুতর স্বপ্নের ভগ্নাংশ হয়ে যায়,
ভাবতে ভালোই লাগে
সেই সুরে সূর্যমুখী আর দীপ্র সিংহের সম্প্রীতি
নেচে ওঠে গহন দুপুরে,
সেই সুরে সব বাড়ি হেঁটে যায় কবিতার পঙ্ক্তির মতন।
ভাবতে ভালোই লাগে
সেই সুরে রোগশয্যা উৎসবের দ্বীপ হয় ক্ষিপ্র রূপান্তরে,
ভাবতে ভালোই লাগে
সেই সুরে আফ্রিকার চেয়ে বেশি অন্ধকার আরেক আফ্রিকা
নিমেষেই মৃত্যুহীন আলো-স্নানে মুক্তির মতোই জেগে ওঠে।
ভাবতে ভালোই লাগে
সেই সুরে বড় ক্লান্ত ক্ষুধার্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবিরল ঝরে,
শস্যকণা ঝরে।
অভিযুক্ত আমি
আমার নিজের কাছে কী নগ্ন জবাবদিহি করি
প্রায়শই, যেন আমি কনফেশনপ্রবণ খুব
এবং নিজেই ধর্মযাজক, যেজন অন্তরালে
পাপী-তাপী সকলের গোপন বক্তব্য শুনে ফের
প্রার্থনায় নতজানু। কখনো কখনো মনে হয়,
হত্যাপরায়ণ আমি। কাকে হত্যা করে আশেপাশে
চোখ রেখে ঘুরি একা একা? আমার তো অস্ত্র নেই,
তবু কেন মধ্যরাতে ক্রূর অন্ধকারে শূন্যতায়
বঙ্কিম চাঁদের মতো ছোরা দুলে ওঠে দৃষ্টিপথে
বারংবার? কেন নিদ্রাহীন প’ড়ে থাকি বিছানায়?
কখনোবা আতঙ্কিত পালিয়ে বেড়াই, এমনকি
কুকুর দেখেও ভয়ে লুকাই আড়ালে। আমি কার
হত্যাকারী? দেখেছি কি তাকে কোনো দিন? বলা দায়,
তবু নিজেকেই অভিযুক্ত করে যাই বারবার।
আকাঙ্ক্ষার আয়ু
দেখি তাকে, ব’সে থাকে এক প্রান্তে নীরব, স্বপ্নিল-
সকলের কাছাকাছি থেকেও অনেক দূরে তার
এ কেমন অবস্থান? কখনো ধরায় সিগারেট,
ধোঁয়া ছাড়ে, ইতস্তত করে পায়চারি কখনোবা।
দ্যাখে সে একটি পাখি ব’সে আছে ভীষণ একাকী;
পাখিটির চোখে বুঝি স্বপ্নের মতন জ্বলে কারো
মুখচ্ছবি, ভাবে; দ্যাখে পাখির গহন চোখে তার
আপন আকুল চোখ। বিহঙ্গ, মানুষ দীর্ঘশ্বাস।
চতুষ্পার্শ্বে বাজে কী ব্যাপক অনুপস্থিতির সুর।
হঠাৎ নাছোড় তৃষ্ণা বুকে কালো মড়কের মতো
ত্বরিত ছড়িয়ে পড়ে। চোখে তার দুলে ওঠে কত
করোটি, কঙ্কাল আর বালির কর্কশ সিংহগুলি
কেশর দুলিয়ে করে তুমুল গর্জন। পুনরায়
জ্যোৎস্নাময় বালিয়াড়ি গোলাপ বাগান হয়ে ডাকে।
একেই প্রতীক্ষা বলে? মাঝে-মধ্যে লজ্জাবোধ হয়।
বহুদিন কেটে গেছে তার এরকম প্রতীক্ষায়।
গাছপালা পাখি কিংবা ভ্রাম্যমাণ মেঘে চোখ রেখে,
চোখ রেখে আসবাবপত্রে, পথে অনেক সময়
কাটিয়েছে, মনে হয়, কত যে শতাব্দী চলে যায়
দীর্ঘ ছায়া ফেলে তার কাতর হৃদয়ে, শূন্যতায়
ব্যাকুল মুহূর্তগুলি ব্যর্থ যায়, আঁধারে গড়ায়।
‘দয়া করো’ সে সর্বদা তার দৃষ্টি মেলে দ্যায়
পথে, দ্যাখে খুব ঝঞ্ঝাচিহ্ন নিয়ে একটি প্রাচীন
জাহাজ বন্দরে আসে পণ্যহীন, যাত্রীরা উধাও;
কাপ্তান, নাবিক কেউ নেই। বনশোভা দূরে স’রে
যেতে থাকে; ‘দয়া করো’ হাওয়ায় মিলায় বার-বার।
কী এক দুঃখের গান রাত্রির হৃদয় থেকে যেন
পল্লবিত হয়, সুর কোথায় যে তাকে নিয়ে যায়
আর সে নিজে ঘুমে-হেঁটে-বেড়ানো লোকের মতো একা
ক্রমাগত পথ চলে। দুঃস্বপ্নসংকুল কোনো বাঁকে
সহসা ফেরালে চোখ কিছু পতনের শব্দ শোনে-
কে যেন ছায়ার মতো দ্রুত সরে যায় বহু দূরে;
কে তুমি কে তুমি বলে ডোবে সে অতল হাহাকারে।
প্রতীক্ষা ফুরোয় তবু ফুরোয় না আকাঙ্ক্ষার আয়ু।
আমার কবিতা দ্যাখো
আমার কবিতা দ্যাখো তোমার দিকেই চেয়ে আছে
অপলক সদ্য-প্রেমে-পড়া তরুণের মতো। গাছে,
দেয়ালে টেবিলে, বারান্দায় বাল্বে, টবে,
ড্রইংরুমের স্মিত শোভন বৈভবে,
স্নানাগারে শাওয়ারের ছিদ্রময় মুখে, রান্নাঘরে,
যেখানেই রাখো চোখ, নিশ্চিত দেখব তুমি প্রহরে প্রহরে
আমার কবিতা তীব্র চেয়ে আছে তোমার দিকেই, কী উন্মুখ!
লজ্জায় যতই ঢাকো মুখ
অথবা ঔদাস্যে দূরে সরে যাও, কবিতা আমার
তোমাকে করবে আলিঙ্গন বারংবার।
আমার কবিতা যেন এক ঝড়ে-পড়া পথচারী,
কোনো কোনো দিন দেবে ক্ষিপ্র টোকা দরজায়, তুমি তাড়াতাড়ি
খুলবে তো খিল? পারবে তো তাকে ডেকে নিতে কাছে?
অথবা যদি সে প্রজাপতি হয়ে নাচে
তোমার শয্যার পাশে, তাকে
চিনতে পারবে তো অকস্মাৎ? যদি সে সেখানে থাকে
প’ড়ে কোনো আহত প্রাণীর মতো আর্তিময়তায়,
করবে সতেজ তাকে তোমার কোমল শুশ্রূষায়?
যখন তোমাকে ছোঁবে আমার কবিতা নিরিবিলি, অত্যন্ত সোহাগভরে
রাখবে প্রগাঢ় ওষ্ঠ ঠোঁটে, তাকে ফেরাবে কী করে?
যখন তোমার কাছাকাছি কেউ নেই,
আমার কবিতা মৃদু হেসে বলবে তোমাকে, ‘এই
শোনো, কোনো দিন ভেবে দেখেছ কি বেশি সুন্দর, তুমি নাকি
আমি? তার হাসি দূরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলে দেখবে যে পাখি
রেলিং-এ গাইছে গান, সে আমারই কবিতা আপন।
রাত্তিরে যখন খোপে যুগল পায়রা করে প্রহর যাপন,
তুমি কারো দস্যুতায় আর্তনাদ করো, কী সুদীর্ঘ হাহাকার
হয়ে যায় তোমার শরীর আরো নৈঃসঙ্গে, তখনও দুর্নিবার
কবিতা আমার চেয়ে থাকে তোমার দিকেই আর
চোখের বাঙ্ময় জল হয়ে কাঁপে, কখনো আবার
ঘুমহীন কৌচে কি শয্যায়
নগ্ন, অসহায়,
গোপনে তোমার পথে
অত্যন্ত পীড়িত হয়, ধু-ধু আর্তনাদ হয় একটি রোমশ ক্রূর হাতে।
আমার বয়স আমি
আমার বয়স আমি পান করে চলেছি সর্বদা। বয়সের
ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে দেখি দূরে
বয়স দাঁড়িয়ে থাকে বালকের মতো
আলোজ্বলা গলির ভেতরে,
কখনো আর্মেনিয়ান গির্জের সমীপবর্তী মাঠে
বৃষ্টিভেজা কিশোরের ভঙ্গিমায়, কখনো-বা রোদে
আমার বয়স যুবা ভাঙা মন্দিরের পাশে থরথর বুকে
নিসর্গ, নারীর কাছে সমর্পিত। এখন তোমরা যারা খুব
জ্বলজ্বলে তীরে ব’সে গপ্পো করো হাওয়ায় উড়িয়ে
বাদামের খোসা,
বাতাসের মুখে দাও মেখে গোল্ড-ফ্লেক-ঘ্রাণ কিংবা
মধ্যরাতে শহরের পথে দ্যাখো সুনীল নাবিক,
দ্যাখো নিজেদের স্বপ্ন হেনরি মুরের
মূর্তির ভেতরে নিরালায় কী সবুজ ঘুমায় এবং শোনে
শ্মশানে সানাই,
তাদের নিকট এই বয়স আমার গালগল্প কিংবা কোনো
ম্যানিফোস্টো এলেবেলে রচিত।
আমার বয়স আজ চায়ের কাপের ঠোঁটে সাতচল্লিশটি
চুমো খায়, পদযুগ দেয় মেলে ডাগর সূর্যাস্তের,
এক বুক জলে একা দাঁড়িয়ে কখনো দ্যাখে সূর্যোদয় আর
কখনো টেবিলে হাত, হাতে ঠেকিয়ে চিবুক
আমার বয়স পড়ে অপরূপ মানচিত্র আকাঙ্ক্ষার, সুদূর স্বপ্নের।
মাঝে-মাঝে বয়সের চোখে পাতায় ক্যাকটাস
বসায় বিষাক্ত দাঁত, অকস্মাৎ বয়সের মাথা থেকে
খুসকি ঝরে যায়, খুসকি ঝরে যায়, খুসকি ঝরে যায়।
আমার বয়স গোনে এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত
আট নয় দশ
এক দুই তিন চার, গোনে, শুধু গোনে, মাঝে-মধ্যে
কড়িকাঠে রাখে চোখ, রাখে
আস্তিনে উচ্ছিষ্ট কণা স্বাপ্নিকের, অজস্র বিমর্ষ কাকাতুয়া
তার বুকে নেমে আসে। আমার বয়স ঘোরে গোলক ধাঁধায়,
দ্যাখে কিছু নেই, এমনকি ক্রূর মিনোটরের অস্পষ্ট
পদচ্ছাপও নেই।
আমার বয়স কাশে একা ঘরে মধ্যবয়সের
তামাটে প্রহরে
এবং প্রসেপ্স খেলে, বেড়ালের পিঠে হাত রেখে
কখনো ভাবুক হয়, মুখ ধোয়া স্বপ্নের বেসিনে বারংবার।
আমার বয়স কাঁধে ঈগল-কপোত নিয়ে হাঁটে
ফুটপাতে, কখনো-বা থমকে দাঁড়ায়, যেন কোনো
একান্ত নিঃসঙ্গ ঘোড়া মোটরের ভিড়ে;
কখনো সিংহের পিঠে চ’ড়ে বেড়ায় সমুদ্রতীরে
আয়ুভুক বয়স আমার।
আমার বয়স শার্ট, ট্রাউজার, গেঞ্জি, আন্ডারওয়ার খুলে
মেঝেতে গড়ায়, ভাবে কেন এত হিংসা দ্বেষ গ্রন্থের পাতায়?
কেন হু হু জল অবিরল পাবলিক লাইব্রেরির দু’চোখ বেয়ে ঝরে?
ফুটপাতগুলি কেন এমন ঔদাস্যে ভরপুর?
আমার বয়স জন্ম শাসনের বিজ্ঞাপনগুলিকে নিমেষে
বানায় বৈষ্ণব পদাবলি,
বন্দুককে ম্যান্ডোলিন, জংধরা কৌটাকে ললিপপ।
আমার বয়স চোখ হ’লে পরিপার্শ্ব হয়ে যায় সহসা ডিজনিল্যান্ড,
আমার বয়স চোখ হ’লে ক্লোজ শট, লং শটে
বিভক্ত, সম্পূর্ণ ফের চিত্রময় বিশদ জগৎ।
কারা কী ফোঁড়ন কাটে, বাঁকা চোখে তাকায় ক’জন,
কারা করে নফরৎ ইত্যাদিকে কখনো দেয় না পাত্তা আমার বয়স।
বলে সে, কী লাভ এই খিস্তি খেউড়ের প্রতি মনোযোগী হয়ে?
বরং রঙিন নুড়ি কুড়িয়ে বেড়াব একা-একা
অথবা ঝরনার পাশে শুয়ে শুনব পাখির রাঙা
প্রেমালাপ; কারো মুখচ্ছবি-ফেউ ইন-
স্বপ্নের জোয়ারে
আসবে সোনালি ভেসে। আমার বয়স কিছু ফেড আউটের
স্মৃতি বয়ে দূরবর্তী সুবর্ণরেখার দিকে ছুটে যায়।
আমার বয়স কৃষকের রৌদ্রদগ্ধ মুখের মতন স্পষ্ট
চেয়ে থাকে ফসলের দিকে,
দ্যাখে পঙ্গপাল আসে ঝাঁক ঝাঁক, কী হিংস্র ঝাঁপিয়ে
পড়ে মাঠে সর্বনাশা ক্ষুধায়, মেঘ না পোকামাকড়ের দল, বোঝা দায়।
আমার বয়স আজ কবির চোখের মতো নাচে
চরাচরে, যায় দূরে নক্ষত্রটোলায়, পাতালের
অন্ধকারে, মাছ আর বনহংসীর হৃদয়ে আর
কবরের নিস্তব্ধ গভীরে।
আমার বয়স তার করতলে অদৃশ্য মোহর পেয়ে খুশি,
আমার বয়স তস্করের মতো চতুষ্পার্শ্ব থেকে
এলেবেলে কত কিছু নিয়ে যায় ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় স্মৃতির গুহায়।
প্রাচীন পাথর আর লতাগুল্মের ভেতর হেঁটে যেতে যেতে
আমার বয়স ক্রমাগত মেপে চলে
একান্ত আপন মহাদেশ।
আমার ভেতরে এক বাঁশিঅলা
আমার ভেতরে এক বাঁশিঅলা বানিয়েছে তার
আপন নিবাস; সেখানে সে প্রতিদিন কী একাকী
তন্ময় বাজায় বাঁশি যখন তখন। রৌদ্রময়
দারুণ খরায় কিংবা গহন বর্ষায় তোলে সুর-
খুলে যায় অন্তহীন পথ, একাকী কে হাঁটে আর
ইচ্ছে হ’লে পথপ্রান্তে ছায়াকে খোঁচায় বাঁশি দিয়ে।
একজন সঙ্গী আছে তার, স্থূলোদর; মর্চেপড়া
পেরেকের মতো থাকে প’ড়ে এক কোণে কী নিঃসাড়।
যখন সে জেগে ওঠে, হৈ-হুল্লোড় করে বড় বেশি,
খাদ্য পেলে চক্ষুদ্বয় অতিশয় জ্বলজ্বলে হয়
তার, মাঝে-মধ্যে বলে, ‘অসীম তৃষ্ণায় বুক ফেটে
যাচ্ছে, দেখছ না। তার নখ বেড়ে যায় ক্রমাগত;
ঘুমোলে ভীষণ ডাকে নাক। বাঁশিঅলা সঙ্গীটিকে
নিয়ে সর্বক্ষণ খুব বিব্রত বলেই একা একা
পথ হাঁটে। কাক ডাকে, ঝরা পাতা দু’পায়ে মাড়িয়ে
যায় দূরে, যেন তার কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই, যেন
হারাতে হয়নি কিছু কস্মিনকালেও। কানাকড়ি
পাবে না জেনেও স্তব্ধতার গালে গাল রেখে সুর
তোলে, মাঝে-মাঝে মনে পড়ে তার-সঙ্গীটির তীক্ষ্ণ
ক্ষুধা আছে, আছে তৃষ্ণা, আছে নিঃসঙ্গতা অন্তহীন।
আমার মুখস্থ হয়ে গেছে
আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ধুলো, নুড়ি, ঝরা পাতা।
আজকাল বড় নত হয়ে চলি, মাথা
তোলা দায়। পোড়া মানব মাংসের গন্ধ শুঁকে শুঁকে
ক্লান্ত, শুতে যাই, অভ্যাসের দাস, ধুঁকে
ধুঁকে কোণঠাসা আর্ত পশুর মতন শুধু কাটাই সময়
আর বুলেটের গর্তময়
দেয়ালের মতো আকাশের দিকে চেয়ে থাকি, ঘুম
আসে না কিছুতে, পাড়া বেজায় নিঝুম।
আমার লোহিত ম্যান্ডোলিন
স্বপ্নের গহন লোকালয়ে একা হেঁটে যেতে যেতে
সেই কবে আমি পেয়েছিলাম একটি ম্যান্ডোলিন।
গভীর সোনালি ঝোপ থেকে রাজহাঁসের মতন
বাড়িয়ে নিস্তব্ধ গ্রীবা এসেছিল আমার নিকটে-
আমার আঙুলে চুমো খেয়ে একরাশ রইল ঝুলে
নিভৃত গলায় স্বপ্ন এবং অশ্রুত সুর নিয়ে।
কখনো বাজাই ওকে ভয়ে-ভয়ে, যেমন নিঃসঙ্গ
কেউ বন্দিনিবাসে বাজায় সুর খুব সাবধানে।
যখন পাখির রক্তে অজস্র বুদ্বুদ গান গায়,
সহসা ফুলের গন্ধে যখন ধুলায় প’ড়ে-থাকা
অত্যন্ত নীরব হাড় বেহালার আদল নিজেই
পেতে চায় অথবা যখন কোনো একাকী কুকুর
ডাগর চাঁদের দিকে মুখ তুলে প্রায় ভবঘুরে
প্রেমিকের মতো করে প্রহর যাপন, ম্যান্ডোলিন
দেয়ালের স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে অন্য স্বপ্নে ডোবে,
রাত্রিকে পরায় কত সুরময় স্বপ্নিল কাতান।
যমজ ভায়ের মতো আমরা দু’জন সর্বদাই
আছি কাছাকাছি, অবিচ্ছিন্ন, আমি আর
আমার লোহিত ম্যান্ডোলিন। প্রহরে প্রহরে বাজে
সত্তা তার, সুরে কোন ভূগর্ভস্থ নগরের মৃত
কলরব, কোনো খ্রিস্টপূর্ব শতকের সুন্দরীর
সোনালি শরীর, দীর্ঘশ্বাস, খনি আর টানেলের
অন্ধকার, জাহাজের ভগ্নাংশ এবং পথরেখা
জেগে ওঠে; কখনোবা বর্তমান বাজে ম্যান্ডোলিনে।
কোনো কোনো শেষ রাতে প্রেমিকার ছায়ার মতন
একটি নিঃশব্দ সুর আমাকে মাতিয়ে রাখে খুব,
এখন সে দূরবর্তী গাছের আড়ালে যেন ক্লান্ত
ডোরাকাটা চাঁদ, চাঁদ অকস্মাৎ নামে ম্যান্ডোলিনে,
নাচে তারে তারে, কাঁদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, বারে বারে
বিহ্বল আমাকে নিয়ে যায় জনশূন্য এভেন্যুতে।
দেখি স্তব্ধ চৌরাস্তায় এক অলৌকিক অর্কেস্ট্রায়
বাজিয়ে চলেছি আমি আমার লোহিত ম্যান্ডোলিন।
তবে কি এখন আমি অস্তরাগে মাতাল বাদক?
আহত এ-যুগ ঘন ঘন ছুড়ছে পা যন্ত্রণায়,
কষে ফেনা, চোখে তার দুঃস্বপ্নের ক্রূর ঊর্ণাজাল
এবং সেবার্থে তার আসে দলে দলে অন্ধ নার্স
চতুর্দিকে থেকে-কালো, সাদা, পীত, বাদামি; একাকী
আমি ছুটি দিগ্ধিদিক, কখনোবা ভাবি ক্লান্ত মনে-
আগুন লাগুক বনে, নামুক ব্যাপক ধস পথে,
আমৃত্যু আমাকে ম্যান্ডোলিনে তুলতে হবে সুর।
একজন কবি শুধু
মগজে পাখির ঘ্রাণ, টানেলের অন্তর্গত রূপ, বংশীধ্বনি,
হৃদয়ে অনেক প্রতিধ্বনিময় স্তর নিয়ে ঘুমায় বলেই
হয়তো-বা স্বপ্নে তার জ্বলজ্বলে কালো নীল সবুজ বাদামি
এবং ফিরোজা ঘোড়া, ভেলা,
একটি ইস্পাতি বাড়ি, বেহুলার রাঙা চেলী, উজাড় খামার
মিশে যায় আর গোরখোদকের নিঃশ্বাস হঠাৎ
লাগে যেন গালে ভোরবেলাকার স্বপ্নে। দীর্ঘ ঘাসে
কোদাল ঘুমিয়ে থাকে কর্পূর আতর ইত্যাদির স্মৃতি নিয়ে,
কোদাল ঘুমিয়ে থাকে, স্মৃতির মতন সাদা হাড়
আর মাটিমাখা করোটির স্বপ্ন নিয়ে
কোদাল ঘুমিয়ে থাকে, যেমন শ্রমিক তার হাড়ভাঙা খাটুনির পর,
কোদাল ঘুমিয়ে থাকে চুম্বনরহিত শুষ্ক ওষ্ঠের মতন।
‘হয়তো-বা স্বপ্নে’ এই শব্দ ক’টি মনে-মনে আউড়ে সে
নিজের ভেতরে যে-স্তব্ধতা থাকে, তাকে
নিঃসঙ্গ স্বজন ভেবে গাংচিল গাংচিল বলে মনের দ্বীপের
মাটিতে দবিজ লেখে নিভৃত দলিল।
‘হয়তো’ শব্দটি যেন থরথর চোখের নিবিড় পক্ষচ্ছায়া,
রোদে কম্পমান,
জ্যোৎস্নায় নিথর।
কখনো পাতার শিহরণ হয়ে আর কখনো-বা মাছরাঙা
পাখিটির চোখ হয়ে হৃদয়স্পন্দন হয়ে সদ্য প্রেমিকের জেনেছে সে
‘হয়তো’ হারিয়ে-যাওয়া যুবতী বোনের
প্রত্যাবর্তনের
ছায়াচ্ছন্ন আহত প্রত্যাশা,
‘হয়তো’ বেকার যুবকের দ্রুত কর্মখালি বিজ্ঞাপন পাঠ,
‘হয়তো’ পদ্মার বুকে শেষ রাতে জেলেদের জাল,
‘হয়তো’ টেবিলে খুব ঝুঁকে-থাকা কবির খাতার সাদা পাতা,
‘হয়তো’ অনেক দূরে স্মৃতিবিস্মৃতি মধ্যবর্তী ডাকবাংলো,
‘হয়তো’ রোদের আঙুলের স্পর্শে চকিতে শিউরে-ওঠা হ্রদ,
‘হয়তো’ শারদ আকাশের নীলে স্বপ্নবিন্দুর মতন কিছু
চকচকে কবুতর,
‘হয়তো’ হেমন্ত গোধূলিতে গুহাহিত
স্তব্ধ টেলিফোন,
‘হয়তো’ আপন শহরের শেষপ্রান্তে পরিত্যক্ত বাসডিপো,
‘হয়তো’ নির্জন গোরস্থানে পড়ে-থাকা ভাঙা বাঁশি,
‘হয়তো’ প্রাচীন চীনে কবির গভীর
সংকেতে মেদুর কোনো হাইকুর আভা,
‘হয়তো’ সমুদ্রতীরে অভ্রে-গড়া নিরিবিলি স্বপ্নের ফ্যাক্টরি।
‘হয়তো’ এখনও তার জীবনকে খানিক দুলিয়ে দেয় বলে
একটি ঘুমন্ত
সিংহকে জাগায় ভায়োলিনে ছড় টেনে
এবং পাড়ায় ঘুম গণ্ডারকে গিটারের সুরে।
সিংহের কেশরে আস্তেসুস্থে স্বপ্ন রেখে, রেখে কিছু আকাঙ্ক্ষার
রাধাচূড়া
দ্যাখে সে কখনো কোনো কোনো হ্যাংলা কলমের নিচে
বাংলা ভাষা তীরবিদ্ধ পাখির মতোই
আর্তনাদ করে।
কখনো-বা ময়লা পোস্টকার্ড স্নেহাশিস, শুভাশিস হয়, হয়
ব্যাকুল কুশল,
ভিন্ন ভিন্ন পোস্টকার্ড বকুলের মতো ঘ্রাণ নিয়ে
যে যার গন্তব্যে যায়। কোনো কোনো কার্ড মৃত গাংচিলের মতো
বাক্সে পড়ে থাকে সর্বদাই।
স্ট্রিটকার নর্তকীর মতো ক্ষিপ্র মুদ্রায় চঞ্চল চৌরাস্তায়,
পুলিশের হাতে কিছু সজীব গোলাপ গান গায়, গান গায়,
ভিখিরি বালক রুক্ষ ফুটপাতে একটি দুঃখিত কবিতার
পঙ্ক্তির মতন একা দুর্দশার ছায়ায় ঘুমায়।
কবর খননকারী যেন কালপুরুষ, একাকী গোধূলিতে
বিড়ি ফোঁকে ঘন ঘন, ঘাম মোছে কপালের, কোদালের মুখে
হীরের ঝলক দেখে হেসে ওঠে অকস্মাৎ, পা ঠোকে মাটিতে,
হাত দুটি মেলে দেয় আসমানে, কী যে খোঁজে, আর
বানায় কিসের তোড়া করোটির মতো;
কবর খননকারী কান পেতে শোনে কত খুলির গজল
এবং কখনো নিজে খনখনে গলায় পুরোনো গান গায়, গান গায়…
তিনজন দীপ্র ফিল্ড মার্শাল ম্যাপের দিকে তাকাতে তাকাতে
কিংবা কালো কফি খেতে খেতে
বিপুল বেলুন হয়ে মহাশূন্যে জমালেন পাড়ি, মারহাবা!
পাঁচজন অবসরপ্রাপ্ত খোঁড়া সৈনিক চায়ের কাপ থেকে অতীতের ক্বাথ করে পান। সাতজন বাজিকর অপরাহ্নে
সোৎসাহে বাজিয়ে ভেঁপু প্রজাপতি হয় এবং সতের জন
গলা-ফোলা, মঞ্চপ্রিয় জননেতা কী মোহন মাতলামি শেখাতে শেখাতে
নিমেষে গড়েন কত হিতবাদী ক্লাব, নামে বঞ্চনার ধস।
একজন কবি শুধু বারবার পুড়ে গিয়ে কেমন ধূসর
ভস্ম ফুঁড়ে পুনরায় নিঃশঙ্ক ওঠেন বেঁচে সতেজ পালক
নিয়ে বুকে, তারপর ‘শব্দ গান হও’ বলে স্বপ্নের গ্যারাজে
ব’সে একা-একা
লেখেন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ কী তন্ময় রূপান্তরে।
পাশে তার চিতাবাঘ, ভায়োলিন এবং একটি সাদা হরিণ ঘুমায়।
কবির ঘর
বেগম সুফিয়া কামালকে নিবেদিত)
বিনীত শোভিত ঘর, সামান্যই আসবাবপত্র, কতিপয়
ফটোগ্রাফ দেয়ালে, টেবিলে,
দেয়ালে সর্বদা জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষ।
ঘরময় আনাগোনা,
কখনো ঘুমিয়ে থাকে এক কোণে শব্দহীন ট্রানজিস্টারের
মতো একা, আলস্যের স্তূপ।
ঘরের অত্যন্ত অভ্যন্তরে প্রায়শই মধ্যরাতে
কে যেন বাজায় এক করুণ বেহালা,
মধ্যরাত ঝরে তার হৃদয়ের নিঝুম চাতালে।
কোনো কোনো দিন
অতিথি আসেন কেউ কেউ,
দেশী কি বিদেশী; কেউ চুপচাপ চেয়ারে থাকেন ব’সে,দৃষ্টি
বুলোন চাদ্দিকে, যেন কোনো পুরাকীর্তি
দেখার উদ্দেশ্যে এসেছেন খুব দূর দেশ থেকে,
কেউবা করেন প্রশ্ন খুঁটিনাটি, কেউ কেউ তাঁর
সত্তায় সন্ধানী চোখ রেখে জেনে নিতে চান বুঝি
একটি যুগের সূর্যোদয়, অস্তরাগ।
জননীর হৃদয়ের মতো ঘর, প্লুত নিরালায়,
সেখানে থাকেন কবি। মেঝেতে লুটিয়ে-পড়া রোদ,
জানালার জ্যোৎস্না তিনি করেন সেলাই
খাতার পাতায়, অকস্মাৎ কেউ তার মুখ দেখে
চমকে উঠতে পারে-দীর্ঘ তপঃক্লেশে চক্ষুদ্বয়
ওষ্ঠ, নাক এবং চিবুক বুঝি এরকমই হয়। অন্তর্গত
দহন পায় না কেউ টের, দ্যাখে তিনি কী নির্মল
হাসেন, বলেন কথা আনন্দ ছড়িয়ে চতুষ্পার্শ্বে।
অবশ্য কাঁদেন কোনো কোনো রাতে অন্তরালে বিছানায় শুয়ে
ভীষণ একাকী।
তাঁর প্রতি আছে বনবাদাড় পাহাড় চিতাবাঘ আর তৃষিত হরিণ,
দিনের ত্র্যাভেন্যু আর রাত্রির কলোনি আর রজনীগন্ধার সমর্থন।
কখনো নিজের ঘরে নিজেই অতিথি, যেন এই
প্রথম এলেন, গল্পগুজবের শেষে
তাহলে বিদায় বলে বাগান পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে
নিঃশব্দে যাবেন চলে কে জানে কোথায়।
কখনো দ্যাখেন তিনি ঘরের দেয়ালে একজন
সুদূর কিশোরী ঘন ঘন পা দোলায় খাটে ব’সে,
কুয়োতলা নিমজ্জিত কুয়াশায়, সাঁঝবাতি গভীর ইশারা;
কখনোবা কারো স্মিত শরীরের প্রথম বানারসী জ্বলে, যেন
সূর্যোদয়; দ্যাখেন কোত্থেকে
সহসা একটি ঘোড়া ঢুকে পড়ে ঘরে তার মেঝেতে পা ঠুকে
ঠুকে খুব সহজেই জাগায় ঝরনার গান, বনস্থলী। নুড়ি
গড়াতে গড়াতে সুপ্রাচীন মুদ্রা হয়, মুদ্রা শিল্পীর আঙুল;
ক্ষেতের আইল জাগে ঘরে, জাগে চৌরাস্তা, মিছিল-
কবির সামান্য ঘর নিমেষেই সারা বাংলাদেশ হয়ে যায়!
কমলা রঙের ঘোড়া
আমি তো তুখোড় কোনো জকি নই, অথবা সহিসও নই, তবু
কমলা রঙের ঘোড়া কেশরের গৌরব দুলিয়ে
আমার চাদ্দিকে ঘোরে দুলকি চালে, কখনো হঠাৎ
কোথায় যে চলে যায়, বোঝা দায়। পুনরায় আমার নিকটে
ছুটে আসে স্বেদসিক্ত শরীরের এবং গ্রীবা কবিতার পঙ্ক্তির মতন
সমুখে বাড়িয়ে দেয় আদর কুড়াতে।
সে কবে কোত্থেকে এই কলা রঙের দীপ্র ঘোড়া এসেছিল
আমার নিকটে, বলা মুশকিল। এসেছিল, বলা যেতে পারে,
পথ ভুলে গোধূলিতে দুলে দুলে, যেন মেঘ। তারপর আস্তাবলহীন
কাটিয়েছে বহু দিনরাত্রি খোলা আকাশের নিচে, নক্ষত্রের
স্পন্দন করেছে অনুভব চোখে, পেশির ভেতরে, স্তরে স্তরে।
আমাকে যায়নি ছেড়ে কোনো দিন কমলা রঙের এই ঘোড়া।
রৌদ্রে তাকে নিয়ে যাই প্রতিদিন, কখনো নিজেই যায় আর
গড়ায় দবিজ ঘাসে, খুশি ঝরে সত্তা থেকে, বুঝি
সবুজের স্পর্শে তার ঘরে রূপান্তর-তখন সে ঘোড়া নয়,
নিঃসঙ্গ দেবতা কোনো, স্বর্গচ্যুত ক্রীড়াপরায়ণ।
রাত্তিরে বাজিয়ে ব্যাঞ্জো কাছে ডাকি তাকে, নিরিবিলি
সে আসে, ঘুমায়, স্বপ্ন দ্যাখে অভ্রময় গূঢ় শিল্পিত ক্ষেতের।
কমলা রঙের ঘোড়া নর্তকের মতো ভঙ্গিতে কখনো ঘোরে
আশেপাশে, অকস্মাৎ দেয় লাফ, কম্পমান প্রোজ্জ্বল কেশর
অমরত্ব চায়, তার গ্রীবা চায় শারদ ভোরের
নীলিমার মতো শান্তি, চক্ষুদ্বয় বহুদূরে ফেলে-আসা কোনো
উপত্যকা, ঝকঝকে, সঙ্গীত-স্পন্দিত। তার খুর মানবিক
সাঁকো চায়, চায় সাম্য-ঘেরা পূর্ণ গোলাপ বাগান আর স্বপ্নের প্রান্তর।
আমার আপন ঘোড়া-এতদিনে আমারই তো বলা যায়, নাকি
এমন একটি ঘোড়া কারো কখনো হওয়ার নয়?
কমলা রঙের ঘোড়া মাঝে-মধ্যে কবিতার পায়ের কাছেই
মাথা রাখে, যেন মৃত্যুহীন স্বপ্নে মগ্ন। অকস্মাৎ
কখনো ভীতির ফণা দেখে প্রশ্ন করি নিজেকেই-
কমলা রঙের ঘোড়া আমার নিকট থাকবে কি চিরদিন?
কাঙাল
একজন হতচ্ছাড়া লোককে আমি প্রত্যহ দেখি,
সারাক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকে
আমার দরজার সামনে, তার মুখে টুঁ শব্দটি নেই।
এক মাথা ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল, তোবড়ানো তার
ট্রাউজার, শার্ট বোতামহীন,
সমস্ত শরীরে দেশ-বিদেশের নানা স্ট্যাম্প।
যেন সে মুঠি খুললেই করতলে
স্বপ্ননগরীর পায়রাময় সিংহদ্বার ঝলমলিয়ে উঠবে,
প্রস্ফুটিত হবে দিনান্তের ছাপ-লাগা মরূদ্যান!
প্রত্যহ দেখি তাকে, একই রকম উদাস দৃষ্টি মেলে
দাঁড়িয়ে থাকে সর্বক্ষণ দরজার সামনে, চুপচাপ।
কী অন্ধকারে, কী জ্যোৎস্নায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে
প্রহরের পর প্রহর।
সেসব প্রহর কুষ্ঠরোগীর ওষ্ঠের মতো ভারি
মনে হয় আমার।
আমি তাকে ‘আমার দরজা থেকে দূর হ’ বলে তাড়িয়ে
দিতে চাই বারংবার; সে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে যায় না,
ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকে একা।
এ কেমন কাঙাল তুই দাঁড়িয়ে থাকিস নির্বিকার?
তোর কণ্ঠ থেকে যাঞ্চা ঝরে না এক ফোঁটা,
হাত দুটো বুকের ওপরেই থাকে আড়াআড়ি।
যদি এতই অহংকারী, তবে কেন আমার মতো নৈরাশ
মুখে নিয়ে অপেক্ষা করিস এখানে প্রতিদিন?
জানলার পর্দা সরিয়ে দেখি সবিস্ময়ে-
রৌদ্র পোড়ায় তাকে, বৃষ্টি করায় স্নান।
শত শত মাকড়সা ওকে ঘিরে বুনতে থাকে জাল,
কোত্থেকে উন্মাতাল এক জেব্রা ছুটে এসে
প্রবেশ করে ঊর্ণাজালে। উন্মাদের স্মৃতির মতো
ছিন্নবিচ্ছিন্ন জাল ঝুলতে থাকে তার চোখে-মুখে
ওষ্ঠে, হাতে, গ্রীবায় আর একা সে দাঁড়ানো
পুরাকালের শিলীভূত যোদ্ধার মতো।
যত তাড়াতে চাই, তত তীব্র দাঁড়িয়ে থাকে, অনড়।
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই সে নেই।
কিছুক্ষণ
দূরে বা কাছেই
মৃত্যু তো আছেই
ওত পেতে, ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তোমার চোখের
পাতার কম্পন কিছুক্ষণ দেখে নিই এ শোকের
ব্যাপক প্রহরে।
দেখে নিই নিস্তব্ধতা অধিকৃত ঘরে
তোমার হাতের নাড়া চায়ের সময়,
কখনো বলি না প্রিয় কোনো কথা আমাদের, দেয়ালের ভয়।
এখনও বিস্কুটে দাঁত বসাই, চায়ের কাপে খুব চুক চুক
দিচ্ছি তো চুমুক।
কখনোবা কালো এক ফোঁটা চোখের জলের মতো মনে হয়
এই লোকালয়।
কী যেন হাওয়ার মধ্যে আছে
কী যেন হাওয়ার মধ্যে আছে, কী যেন একটা খুব
জীবন্ত, রহস্যময়, প্রাণীর ঘ্রাণের মতো প্রায়।
ভাষা নেই, তবু কিছু বলার আশায় ঘাই মারে
সহসা হাওয়ায় ফের কোথায় হারায় অকস্মাৎ।
যখন নিজেকে মেলে দিই টেলিফোনের ভিতরে,
যখন টেবিলে ঝুঁকে লিখি, বই পড়ি, বিছানায়
শুয়ে-শুয়ে কী তন্ময় অতীত আবৃত্তি করি কিংবা
যখন নিঃসঙ্গ হাঁটি ফুটপাতে, রেস্তোরাঁয় বসি,
হঠাৎ হাওয়ার মধ্যে কী যেন সুতীব্র জেগে ওঠে।
মনে হয়, কারো জিভ চাটছে আমাকে নিরিবিলি,
আমাকে দেখছে কেউ নিকট আড়াল থেকে, যেন
বলবে গোপনে কিছু আমাকেই। আমি উৎকর্ণ,
সে-কথা আকণ্ঠ পান করবে বলে প্রহরে প্রহরে
চকিতে চাতক হয় আমার প্রতিটি রোমকূপ।
কী যেন হাওয়ার মধ্যে আছে, কী যেন একটা গূঢ়
সংকেতের মতো বেজেজ ওঠে শব্দহীন। দৃশ্যাবলি
সচকিত, নাগরিক নিসর্গবাসরে একজন
নগর পুলিশ হুইসিল তীব্র বাজাতে বাজাতে
ক্লান্ত হয়, স্বপ্নাবেশে দ্যাখে শহরের ত্র্যানাটমি
গলে গলে পড়ে তার চোখের পাতায়, দ্যাখে দূরে
মৃতের কুচকাওয়াজ, তারপর চক্ষুদ্বয় দ্রুত
কচলাতে কচলাতে জ্যোৎস্নায় নিজের বুট জোড়া
কিঞ্চিৎ পরখ করে। কী যেন হাওয়ার মধ্যে আছে,-
স্পন্দমান ভাষাহীন এক অলীক টেলিপ্রিন্টার!
কী যেন হাওয়ার মধ্যে আছে। পাখিগুলি চিহ্ন হয়ে
জরুরি একটা কিছু আমাকে বোঝাতে চায় বুঝি-
নইলে কেন অবেলায় ওরা উড়ে যায় বারবার?
কেন বৈদ্যুতিক তারে বুক পেতে শীর্ণতা পোহায়?
কী যেন হাওয়ার মধ্যে আছে বলে যত দ্রুত আমি
লোকালয়ে হেঁকে যাই তত কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।
চতুর্দশপদী
একটি পাখির সঙ্গে তার খুব ভাব আছে আর
সে পাখি সর্বদা তাকে কিছু আলো কিছু অন্ধকার
মিশিয়ে শোনায় গান। গানের ভেতরে বসবাস
করে তার দিনরাত্রি বয়ে যায়। কিসের আভাস
সকালবেলার মতো দৃষ্টিপথে; সাপ কি নেউল
কিংবা গিরগিটি অস্তিত্বের কিছু চমক উসুল
করে নেয় তার কাছ থেকে, সে অনেক নিচে থেকে
ওপরে তাকায় বারবার, কখনো বা যায় হেঁকে
শব্দ কতিপয়, বলে-শহরের বুকের ভেতরে
অহর্নিশ জ্বলে প্রেম নিয়ন বাতির মতো, থরে,
থরে কী সাজানো শ্বেতপাথরের শীতল টেবিলে,
বলা মুশকিল; হয়তোবা আকাশের দীপ্র নীলে
অনেক কবর আছে, কবরের পাশে শোকসভা
এবং করোটি ফুঁড়ে প্রবল গায়ক রক্তজবা।
চাঁদ
ভেবেছিলাম সে, চাঁদ, অভিমানী কৃষকের মতো
আর ফিরে আসবে না আকাশের মাঠে,
যে-দেশে একদা অবিরত
বয়ে গেছে রক্তস্রোত, হয়েছে নারীর চোখ নদী; গোঠে, হাটে
আর পথে ঘাটে
লাশের গম্বুজ আর যে-দেশে মৃত্যুর লোভী ফাঁদ
ছিল পাতা প্রতি ইঞ্চি মাটিতে, শবের রিক্ত হাত
পৌঁছেছিল নীলিমায়, সেখানে আসবে কেন চাঁদ?
তবু এলো শহীদের বুকের গর্তের মতো চাঁদ, এলো রাত
নিয়ে, নির্বিকার; তার ঠোঁট থেকে অবিরাম ঝরছে বিষাদ।
ছায়ায় যেও না মিশে
পিছনে তাকানো মানা। যতক্ষণ এই পাতালের
হিম অন্ধকারে আছি, পারব না তাকাতে কখনো
তোমার মুখের দিকে। যদি তুমি আগুনের তাপে
নিমেষে মোমের পুতুলের মতো গলে যাও কিংবা
উবে যাও অকস্মাৎ, তবু দৃষ্টি অন্য কোনো দিকে
নিবদ্ধ রাখতে হবে। গলায় ঝুলবে ম্যান্ডোলিন।
পেরিয়ে এসেছি বহু দীর্ঘ পথ, পায়ে বহু ক্ষত,
তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই সাবলীল
শুকোবে এ ক্ষত, মুছে যাবে নৈরাশের রেখাবলি।
তোমার শরীর থেকে শীতল কুয়াশা ঝেড়ে ফেলে
তুমি এসো, তুমি এসো দীপ্র রাজহাঁসের মতন।
ভয় নেই, তাকাব না। কিছুতেই ফিরে তাকাব না।
আমাকে চিনতে পারছ না? তাহলে কি পাতালের
ছায়ায় পড়েছে ঢাকা আমার একান্ত পরিচয়?
আমার হাতে কি তুমি দেখতে পাওনি ম্যান্ডোলিন?
এখনও তুলতে পারি কত সুর ব্যাকুল আঙুলে,
সেই সুর শুনে পাখি এখনও সান্নিধ্যে আসে, নুড়ি
গড়াতে গড়াতে চলে আসে কাছে, পশুরা হিংস্রতা
ভুলে যায় নিমেষেই। শোনো, আমি ম্যান্ডোলিনে সুর
তুলে সব নরখাদককে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি,
সব প্রহরীর দৃষ্টিপথে তৈরি করে মায়াপুরী
এখানে এসেছি এই অন্ধকার নীরক্ত মণ্ডলে।
কিন্তু তুমি দূরে সরে যাচ্ছ কেন এরকমভাবে?
তবে কি তোমাকে দেখে ফেলেছি হঠাৎ পুনরায়?
তবে কি আবার লোভী হয়ে গেছি ক্ষয়িষ্ণু বেলায়?
ফিরে এসো, আর ফিরে তাকাব না; আমার নিকটে
ফিরে এসো; দেখে নিও, আমি হেঁটে যাব ধু-ধু পথে,
নগ্ন প্রান্তরের ধার ঘেঁষে ম্যান্ডোলিনে সময়কে
বাজাতে বাজাতে যাব অত্যন্ত একাকী। ফিরে এসো,
ছায়ায় যেও না মিশে, আমার হবে না আর ভুল।
ট্যান্টালাস
এখন তো পুশিদা সে জলশায় অত্যন্ত নিকটে
উচ্ছ্বসিত, রৌদ্রঝলসিত, জ্যোৎস্নাচমকিত; দেখি
আমার নিজের মুখ টলটলে জলে, ঝলমলে
ফলের গাছের ডাল ছায়া রাখে পানির তালুতে।
বিশাল চোখের মতো জলাশয় চেয়ে থাকে স্থির
একান্ত আমার দিকে, স্বপ্ন হয়ে ওঠে মাঝে-মাঝে।
শান্ত মেঘ আঁকে মৃদু চুম্বন সে হ্রদে কিংবা পাখি
করে ম্লান, কখনোবা জলপান; বিনম্র লাজুক
কোনো প্রাণী রাখে মুখ তার বুকে মুছে নিতে খর
পিপাসা অস্তিত্ব থেকে। দাঁড়িয়ে রয়েছি তীরে একা
সেই কবে থেকে, পদযুগ ভেজা খুব, ফুটিফাটা
পথ সারা বুক, ওষ্ঠে কেবলি শুকোয় রক্তধারা।
ভীষণ তৃষিত চোখে জলাশয়; শুধু জলাশয়
নাচে নক্ষত্রের মতো। কী কাতর অস্তিত্ব আমার!
আমার অনেক দীর্ঘশ্বাস, অনিদ্রার রক্তজবা
করেছি অর্পণ এই জল দর্পণে। বহুক্ষণ
ঝুঁকে থাকি নিষ্পলক কখনো দাঁড়াই, ফিরে আসি
পুনরায়, তীরবর্তী ফল ছুঁতে গিয়ে দেখি ওরা
লাফিয়ে শতেক দূর স’রে যায়। আমার যন্ত্রণা
দেখে দেখে পানি আসে গাছের পাতার চোখে আর
কুঞ্চিত ফলের চোখ, পাথরের নিচে শত কীট
ভীষণ শিউরে ওঠে। ওষ্ঠ রাখি জলাশয়ে, তবু
পারি না করতে পান এক বিন্দু জলও। বারবার
এরকম প্রতিহত হবো আমি-এই তো নিয়তি।
উদ্ভিদ আমার চোখে, কাঁধে, গ্রীবায় একাকী বাড়ে,
পানি কাঠগুঁড়ো হয়ে ঝরে ঠোঁটে, মুখের ভেতরে।
ভয় পাই, অবশেষে গাছের শিকড় হয়ে যাব?
আমি তো ফিরি না ঘরে আর, পুড়ে যাই। জলাশয়,
হে পুশিদা জলাশয়, তুমি পারো নাকি ধুয়ে নিতে
আমার এ অভিশাপ নিমেষেই একটি চুম্বনে?
তুই চোখে বন্ধ কর
তবে কি আমার চক্ষুদ্বয় বাস্তবিক অপরাধী?
কী লাভ দৃষ্টি খুঁত খুঁজে? আমি তো সৌন্দর্যবাদী,
অনাবাদী জমিনের স্তরে স্তরে ফুলের বিকাশ
সৃষ্টি করে নিই আর দীপ্র রক্ত-মাংসের উচ্ছ্বাস
দেখি কঙ্কালের কড়ি-সাদা হাড়ে। শবব্যবচ্ছেদ
করে যে নিকটে আসে তার সঙ্গে ত্র্যাপোলোর ভেদ
সহজে পাই না খুঁজে মাঝে মাঝে। আমার দু’চোখে
নাকি বড় বেশি ব্যাকুলতা খেলা করে, বলে লোকে।
বলো তো তোমরা কেন আমার চোখের অপরাধ
সর্বদা মুখস্থ করো? কেন শুধু বাধাও বিবাদ
আমার বোধের সঙ্গে? আমি গাছের ভিতরে গাছ
স্তনের আড়ালে ভিন্ন স্তন মাছের ভেতরে মাছ
দেখি বলে আমার এ চক্ষুদ্বয় অপরাধী আখ্যা
পায়, তবু রাত্রিময় সুনসান শ্মশানও কামাখ্যা
আমার দৃষ্টিতে আর কারো ঊরুভেজা ভেনাসের
সামুদ্রিক ঘ্রাণমাখা ঊরু। দৃশ্য দেখি বিনাশের।
যে মুখে সকাল মগ্ন, অপরাহ্ন সঙ্গীতমুখর,
রাত্রির নিঃশ্বাস বহমান, তার দিকে থরথর
হৃদয়ে প্রখর চেয়ে থাকি, বুঝি পড়লে পলক
দেখব না তাকে আর। অতীতের রুপোলি ঝলক,
বর্তমান, ভবিষ্যৎ চোখের সবুজে কম্পমান,
কবেকার একাকিনী স্রোত বয়ে যায় খরশান
আমার শরীর ছুঁয়ে, আমি হই নদী, ধু-ধু মাঠ;
কখনোবা পিপাসায় নিজের নিয়তি করি পাঠ
আমার চোখের নিচে জ্বলজ্বলে চোখের ভিতরে,
এবং কদম ফোটে সত্তার নিভৃত স্তরে স্তরে।
বাড়িকে ব্যথিত দেখি, পথকে প্রফুল্ল অতিশয়,
সুসময় ব্যেপে এলে, উৎসবের দীপাবলি নয়,
দেখি দুঃসময় দরজার কাছে রয়েছে দাঁড়িয়ে
ব্যগ্র অতিথির মতো। গেরস্থালি দেবে সে নাড়িয়ে।
যে আমার সঙ্গে থাকে অথবা থাকে না, দূরে থাকে,
যদি সে লুকায় মেঘে, গাছের ভিতরে, তবু তাকে
অক্লেশে দেখতে পাব-এই তো চোখের অপরাধ।
বুঝি তাই ওরা বলাবলি করে, লোকটা উন্মাদ।
সহজেই বাড়ে নিত্য আমার এ দেখার ভুবন-
দেখি কারো ধু-ধু জন্ম জন্মান্তরব্যাপী অনশন
অহর্নিশ জ্বলে সত্তাময়, কেউ দেয়ালে পেরেকে
ভীষণ রক্তাক্ত সাঁটা, কেউ কেউ স্বপ্ন ব্যতিরেকে
ঘোরে পথে বিপথে এবং সামনে তার ভগ্ন সেতু
দেখে কেঁপে ওঠে বারংবার। আমার দৃষ্টির হেতু
হয় না কারুর ক্ষতি। তাহলে একটি কণ্ঠস্বর
কেবলি আবৃত্তি করে কেন ‘তুই চোখ বন্ধ কর?’
দীর্ঘশ্বাস
শরীরের কত ধুলো লাগলে, কত কাঁটা বিঁধলে পায়ে
একটি দীর্ঘশ্বাস জন্ম হয়?
একটি দীর্ঘশ্বাস খুব বেশি
দীর্ঘ নয়, নিমেষেই শেষ হয়; অথচ তার জন্মলগ্ন
অতিশয় ইতিহাসময়। বিন্দু বিন্দু। বিষ ঝরে কণ্ঠনালিতে,
মোহন আগ্রহে তুমি হাত বাড়ালে
যার জন্যে, সে হারিয়ে গেল কুয়াশায়,
ভাবলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনোমতে
আরেকটু এগোলেই নেচে উঠবে প্রস্রবণ, কিন্তু
পদযুগ রক্তাক্ত করে সেখানে পৌঁছে দেখলে
ধুলোর পাহাড় ছাড়া কিছুই নেই;
এ রকম মুহূর্তেই একটি দীর্ঘশ্বাসের জন্ম হয়।
কতবার তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছ?
কতবার তোমার হৃদয়ে ঝাঁক ঝাঁক টিয়ের মৃত্যু হয়েছে?
তোমার মগজের ফুলের কেয়ারি শুকিয়ে গিয়েছে কতবার?
কতবার তোমার আকাঙ্ক্ষা করেছে আত্মহত্যা?
কতবার তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছ, কতবার?
যখন কোনো ঠোঁটের দিকে তোমার ওষ্ঠ ফুরোতেই
গোধূলির মতো বিদায়বেলা এসে যায়,
‘আবার হবে কি দেখা?’-এই নগ্ন ব্যাকুলতা
আবৃত্তি করেও যখন কোনো
স্পষ্ট উত্তর মেলে না,
যখন এক গা ধুলো নিয়ে, উষ্কখুষ্ক চুল আর
ভীষণ তৃষ্ণার্ত চোখ নিয়ে এসে দ্যাখো সে আসেনি,
তখন তোমার সত্তাময় কী শীতল দীর্ঘশ্বাস বয়।
নাছোড় অতিথি
বেশ কিছুদিন থেকে প্রত্যহ দেখছি পষ্ট তাকে।
আমার শোবার ঘরে শায়িত সে, স্পন্দনরহিত,
পতিত জমির মতো, যেখানে কখনো ফসলের
স্বর্ণশীষ গীতিকবিতার মতো করবে না গুঞ্জন।
কী করে এলো সে এই বেডরুমে, বলা মুশকিল।
আমার অস্বস্তি হয়ে সর্বক্ষণ আছে সে এখানে-
বড় বেশি নীল তার ঠোঁট, নাক, নখাগ্র বেবাক;
শরীরে কুঠার হানলেও নড়বে না এতটুকু।
সমস্ত শরীরে তার রাশি রাশি মাছির মতন
হিজিবিজি অক্ষরের ব্যান্ডেজ এবং হলদে কিছু
পাণ্ডুলিপি চুমু খাচ্ছে তাকে বারংবার, বুঝি তার
এমন চরম ঘুম ভাঙাতে ব্যাকুল। ঘরময়
মৃত্যুগন্ধ কর্পূরের মতো তীব্র। টেবিলে ডালিয়া,
ভাস-এ গোলাপের তোড়া; আমি ব্যাঞ্জো বাজিয়ে বাজিয়ে
নিদ্রিত মানুষটিকে বিস্মৃতির কন্দরে পাঠাতে
চাই প্রতিদিন, হায়, ব্যাঞ্জোধ্বনি, গোলাপ, ডালিয়া
থেকে মৃত্যুগন্ধ উঠে আসে। চেয়ে থাকি তার দিকে,
এই চেয়ে-থাকা যেন নিয়তি আমার। এতকাল
বলিনি কাউকে তার কথা। অতিশয় কৌতূহলী
প্রতিবেশীরাও আজও কিছুই পায়নি টের, শুধু
প্রত্যহ আমাকে দ্যাখে দূর থেকে আর কেউ কেউ
কখনো তাকায় আড়চোখে, পরস্পর কত কিছু
বলাবলি করে, চলে হাসাহাসি। আমার বিশ্বাস
সন্দেহ করে না ওরা কিছু। হয়তো ভাবে, ইদানীং
লোকটা বেজায় খাপছাড়া বটে, তা’ছাড়া মাথায়
কিছু ছিট ছিলই তো বরাবর। এটাই বাঁচোয়া।
এদিকে আমার বেডরুমে নিদ্রিত মানুষটির
পায়ে লতাগুল্ম জন্মে, শামুক বুকের শুষ্ক তটে।
কতদিন গেল কেটে, পুলিশকে দিইনি খবর-
যেন সে গোপন ব্যাধি, ভয়াবহ, কস্মিনকালেও
কাউকে যায় না বলা তার কথা। অথচ পাচ্ছি না
ভেবে কিছুতেই আজও কী করে লুকোব তাকে, কোন
পাতালে আসব রেখে। কখনো মাথার ঘাম পায়ে
ফেলে কংক্রিটের পুরু দেয়ালের অভ্যন্তরে তাকে
দুরু দুরু পুরে রাখি; যেমন ত্র্যালেন পো-র গল্পে
আছে, কখনোবা ব্লিচ করে হাওয়ায় মিলিয়ে দিই।
তবু সে আমার ঘরে শুয়ে থাকে সমস্ত শরীরে
ঘোর কালো নক্ষত্রের মতো অক্ষরের ভিড় নিয়ে।
তার পাশে ঠায় ব’সে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে
কোনো কোনো স্তব্ধ মধ্যরাতে শাবল গাঁইতি হাতে
মেঝেতে সুড়ঙ্গ কেটে তাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাই
সবার অলক্ষে বহুদূর একা-একা, পুঁতে আসি
মাটির অনেক নিচে। শিস্ দিতে দিতে ঘরে ফিরে
দেখি ঠাণ্ডা বিছানায় শায়িত সে নাছোড় অতিথি।
নিঃসঙ্গ শেরপা
পর্বতে উঠেই আমি পতাকা উড়িয়ে দেব ঠিক।
আরোহণে কী রকম কৃতী কিংবা আনাড়ি সে-কথা
অবান্তর, আরোহণই মুখ্য শুধু। চূড়ার সন্ধানে
উঠছি পর্বত বেয়ে ক্রামগত। দৃষ্টিতে এখন
বনশোভা নয়, নয় সমতলভূমির নিরালা
সৌন্দর্য অথবা ঘর গেরস্থালি। চক্ষুদ্বয়ে ভাসে
একটি শিখর শুধু দুর্গম শিখর সর্বক্ষণ।
কোনো প্রলোভন আর পারবে না ফেরাতে আমাকে।
মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে, বড় অসহায়; পদযুগ
ক্ষতময়, তবু পাথরের বুকে লোহা ঠুকে ঠুকে
দড়ি বেয়ে উঠতেই হবে আরও বহুদূরে একা
অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে। অকস্মাৎ কখন যে
নামবে বিরূপ ধস, ভাবি প্রাণক্ষয়ী অবসাদে,
কখনো অকালমৃত শেরপাদের মনে পড়ে যায়।
নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি
হে নিশীথ, আজ আমি কিছুই করতে পারব না।
বই পড়া, চিঠি লেখা অথবা বন্ধুর পাশে ব’সে
নিবিড় আলাপ-আজ কিছুই হবে না। সারা রাত
নির্ঘুম কাটবে অতিশয়; আমি কি অসুস্থ তবে?
থার্মোমিটারের নেই প্রয়োজন; যদিও শরীর
পুড়ে যাচ্ছে তাপে, তবু নেবু পানি, বার্লি, তপ্ত জল
কমলালেবুর রস চাই না কিছুই আজ রাতে।
কোমল অনল আমি পান করে এসেছি এক্ষুণি।
আমার সম্মুখে ছিল একরাশ মদির স্নিগ্ধতা,
তবে আমি মিছেমিছি অনলের কথা কেন বলি?
রজনীগন্ধা কি আগুনের রেণু শিরায় শিরায়
তুমুল ছড়াতে পারে এই মতো, হে নিশীথ, বলো?
ঘর কি সমুদ্র হতে পারে? নইলে কী করে সেখানে
সহজেই আফ্রোদিতি আসে তার সমস্ত শরীরে
স্বপ্নের মতন ফেনা নিয়ে? যখন সে এলো ভেসে,
ঘরের দেয়াল মুছে গেল; গেল উবে আসবাব।
এ কাকে দেখেছি আমি? এত চেনা, তবুও কেমন
সুদূর অচেনা; তার কণ্ঠস্বরে কথা নয়, ঝরে
স্মৃতি, স্মৃতি গান হয় স্তব্ধতায়। সহসা বিদায়,
যেন স্বপ্ন জাতক্রোধে ছুড়ে দেয় ধুলায় আমাকে।
ব্যর্থ মানুষের মতো চেয়ে থাকি, ঘরের দেয়াল
ফিরে আসে, দেখি ঠিক মাথার ওপরে আছে ছাদ।
ত্র্যাশট্রেতে পোড়া সিগারেট, তার সত্তার সৌরভ
ঘরে, সে মুহূর্তে বন্ধ হতে পারত হৃদয়স্পন্দন।
আমি একজন রাগী মানুষের মতো আকাশকে
সে মুহূর্তে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে চেয়েছি। সূর্যাস্তকে
চেটেপুটে সাফ করে দিতে লাগে কতক্ষণ বলে
সেদিকেই দৌড়ে গেছি, দৌড়ুতে দৌড়ুতে ক্লান্ত বড়।
হে নিশীথ, আজ আমি কিছুই করতে পারব না।
আমার মগজে ফণিমনসার বন বেড়ে ওঠে,-
দেখি আমি পড়ে আছি যুদ্ধ-ধ্বস্ত পথে কী একাকী;
ভীষণ আহত আমি, নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি!
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি, নিথর বিশাল,
মাটি ফুঁড়ে জেগে ওঠে গভীর রাত্তিরে!
মুখে শতাব্দীর গাঢ় বিশদ শ্যাওলা আর ভীষণ ফাটল,
যেন বেদনার রেখা। ব্রোঞ্জের অদ্ভুত চক্ষুদ্বয় খুব স্থির
চেয়ে থাকে অন্ধকারে; মনে হয়, ওরা কোনো দিন
দ্যাখেনি কিছুই,
যদিও দ্যাখার কথা ছিল শতাব্দীর মতোই ব্যাপক বহু কিছু।
কী যেন বলতে চায় সেই মূর্তি, কণ্ঠস্বর তার স্তব্ধতায়
টোকা দিতে চেয়ে
হাওয়ায় হারায়, দুটি হাত বুঝি ধরে রেখেছে অতীত কিছু।
ব্রোঞ্জমূর্তি প্রশ্ন চিহ্ন, উত্তরবিহীন; ঘাস ক্ষিপ্র চাটে তার পদযুগ।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে বনপোড়া একটি হরিণী
ছোটে দিগ্ধিদিক, তীব্র তৃষ্ণায় কাতর; জলাশয়ে মুখ রেখে
মরুর দুরন্ত দাহ মেখে নেয় বুকে এবং আপনকার
মাংস আর হাড়ের ভেতরে
সে ঘুমায় নিরিবিলি। বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে-জুয়ার টেবিলে
সহসা নক্ষত্র ঝরে, সন্ত সন্ত বলে জুয়াড়ীরা
শূন্যের উদ্দেশে
তোলে হাত, কখন যে হাত বেয়ে সাপ নেমে আসে,
উত্তেলনা হেতু
কিছুতে পায় না টের, ভাবে দ্রাক্ষালতা জীবনের
ওষ্ঠে দেবে ফেলে কিছু সোনালি মদিরা বেলাবেলি।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে ৫-মধ্যরাত্রির শহরে এক
সুনীল জাহাজ
সহজে প্রবেশ করে, নাবিকেরা গাঙচিল হয়ে
কলোনির, বাণিজ্যিক এলাকার ছাদে ছাদে ওড়ে,
একজন অন্ধ, ক্রূর, বণিকের হাতে বাজপাখি;
নগর পুলিশ অর্ফিয়ুস না কি বলে কেউ কেউ
করোটিতে তবলা বাজায়।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে মৃত শিশু মেঘে ভাসমান ক্ষমাহীন,
কার্পেটের তলা থেকে, জানালার পুরু পর্দা থেকে,
টেলিগ্রাম আর কিছু পুরোনো চিঠির তাড়া থেকে
এবং মাছের পেট থেকে নারী আর শিশু আসে ভেসে ভেসে,
মেহেদি পাতার ভিড় থেকে, বেলুনের ঝাঁক থেকে
নারী আর শিশু ভেসে আসে। বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে
পতাকার নিচে কত আহত প্রেমিক নতজানু
গোধূলিতে, চতুর্দিকে উন্মাদের পাদধ্বনি, কার সে বাঁশিতে
নস্টালজিয়ার মতো সুর, কী সুন্দর প্রাণী পথের ধুলায়
বিকলাঙ্গ, ক্লাউনের টুপি সবুজ ঘোড়ার পায়ে পায়ে ঘোরে,
ক্লাউন কফিনে ব’সে পিট পিট চেয়ে থাকে ভীষণ একাকী।
বৃষ্টি পড়ে রঙ-করা গালে তার, বৃষ্টি পড়ে মৃত্যুর পাহাড়ে।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে-কতিপয় লোক দেবদূতের নগ্নতা
বড় বেশি কাম্য ভেবে উন্মাদের মতো নগ্ন হয়ে যায়,
তরুণীর ওষ্ঠে বারবার চুমো খায় কর্কশ কঙ্কাল আর
লোহিত বনের ধারে পাথরের ঘোড়ায় সওয়ার
অত্যন্ত পাথুরে যোদ্ধা, স্তব্ধ অস্ত্রে চির-জ্যোৎস্না বয়।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে একজন অসুস্থ নৃপতি শয্যাশায়ী
একটি সোনালি খাটে, অলৌকিক ফলের আশায়
প্রহর ফুরায়, তাহলে কি দীপ নিভে যাবে গহন বেলায়?
কোন তেপান্তরে আজ হাঁপাচ্ছে বিশীর্ণ পক্ষীরাজ,
ভাবেন নৃপতি, চোখ বুজে আসে, তৃতীয় কুমার তার এখনও ফেরেনি!
বিচ্ছেদ
কোনো কোনো দিন
গভীর রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেলে, প্রায়শই ভাঙে আজকাল,
নিজেকে ভীষণ একা লাগে। যেন আমি
প্রাচীন ধ্বংসস্তূপে অত্যন্ত ভেতর থেকে জেগে
প্রথম দেখছি পৃথিবীকে।
‘কে তুমি এখানে এই আঁধার নিবাসে ব’সে আছে’,-
নিজেকেই প্রশ্ন করে খুব
বিচলিত হই। কাকে যেন ডেকে ডেকে
হৃদয়ের গলা ফেটে যায়, রক্তস্রোতে
আকাঙ্ক্ষার নৌকাডুবি বারংবার। অকস্মাৎ স্মৃতি,
প্রধান ফোয়ারা বুঝি এভেন্যুর, উচ্ছ্বসিত হয়! পলাতক
স্বপ্নেরা কখনো দূরে শূন্য উঠোনের
বৃষ্টিজালে ধরা-পড়া মাছ,
কখনোবা ধাবমান ঘোড়ার কেশরে মুক্তোমালা।
কেবলি বাড়াই হাত জাল আর কেশরের দিকে,
হাত ঝুলে থাকে
ফাঁসির মঞ্চের কোনো মৃতের জিভের মতো। কেউ,
মনে হয়, ছোরা থেকে নিচ্ছে মুছে রক্তের চিৎকার,
নিচ্ছে ধুয়ে অস্থিরতা বৃষ্টির গহন
জলে; ধু-ধু অন্ধকারে আমার কেবল ব’সে থাকা, চেয়ে থাকা,
কেউবা বিচ্ছেদ শব্দটিকে ঠেলে দেয়
আমার জানালা দিয়ে।
সারা রাত একা
জানালার চোখ থেকে টপকে টপকে পড়ে জল।
ভোট দেব
তোমার ভোটাধিকার আছে বলে ক’জন নিঝুম প্রজাপতি
ক্যানভাসারের মতো উড়ে যায় গহন দুপুরে
আমার চুলের গুচ্ছ ছুঁয়ে, কান ছুঁয়ে।
ব্যালটবাক্সের গায়ে বহুবর্ণ স্বপ্নের কামিজ ঢিলেঢালা,
নানান প্রতীক ওড়ে চতুর্দিকে। স্বর্ণকণ্ঠ পাখিরা এখন
কেবলি স্লোগান গায়, পরীদের নাচ জমে ওঠে
বেবাক ব্যালটবাক্স ঘিরে। ভোট দিন ভোট দিন
বলে দেবদূত কতিপয় পা দোলান দূরে অলীক কার্নিশে!
সহসা বিলোন তারা রঙিন পুস্তকা, ম্যানিফেস্টো;
করি না কখনো পাঠ। সেসব কাগজ, মনে হয়,
নীলিমায় উড়ে যাওয়া ভালো;
ওরা মেঘে গেলে পাবে ভিন্ন অবয়ব,
কিছুটা সত্যতা পেতে পারে।
কতবার ভোটকেন্দ্র ছেড়ে আমি
এসেছি নিজের খুব কাছে ফিরে, পা মেলে আপন
হৃদয়ে একলা চত্বরে,
নতুন প্যাকেট থেকে তাজা সিগারেট বের করে
খানিক ভেবেছি কারো কথা, ধোঁয়া ছেড়ে
ভেসেছি সমুদ্রে হোমারের আর যেহেতু ইউলিসিস নই,
এসেছি আবার ফিরে জীর্ণ ঘরে মশার গুঞ্জনে,
স্বপ্নের চিবুক ধরে শুয়ে থাকি, কখনো চেয়ারে ঢুলি আর
অকস্মাৎ তড়িঘড়ি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা চাই বলে করি পায়চারি ঘরময়।
কখনো আমাকে ক্ষিপ্র শোঁকে স্বপ্ন, যেমন শশক লতাগুল্ম।
তবু আমি ভোটকেন্দ্রে যাব, বসব সহাস্য মুখে
নতুন কাপড়-ঘেরা এলাকায় প্রীত ম্যাজিশিয়ানের মতো,
হঠাৎ উড়িয়ে দেব রুমাল, পায়রা।
ব্যালট পেপারে খুব ঝুঁকে
আমি ভালোবাসাকেই ভোট দিয়ে ঘরে
কিংবা পার্কে যাব শিস বাজাতে বাজাতে।
মধ্যরাতে
পুরোনো দেয়াল ঘড়ি আওড়ায় গাঢ় মধ্যরাত,
মধ্যরাত শিরাপুঞ্জে বোনে সুর, যেনবা সরোদ
ঝংকৃত গুণীর হাতে। তন্দ্রার চুম্বন চোখে, হাত
থেকে আস্তে খসে যায় আক্ষরিক দান্তের নরক।
আমি কি হারাচ্ছি পথ মধ্যপথে? হায়রে নির্বোধ,
কেন তুই নিশীথকে করিস বিশ্বাস? কেন তোর
ঘরে এত মৃত গাংচিলের ভিড়? এ কেমন ঘোর
সত্তাময়? নিষ্প্রদীপ হৃদয়ের জটিল সড়ক।
অকস্মাৎ দেখি, গাংচিলের স্তূপ ফুঁড়ে তুমি এই
মধ্যরাতে অন্ধকার ঘরে এলে, আমি অনশনে
কম্পমান; রাত্রি-রাত্রি গন্ধ সারা শরীরে তোমার-
চোখে জ্যোৎস্নাপায়ী ট্রেঞ্চ, সেতু, বাগানের ফলভার
এবং নির্জন পথ। ছুটে যাই, বাঁধি আলিঙ্গনে,
ওষ্ঠের শিশির নিই। তারপর নেই, তুমি নেই।
মর্সিয়া
নিমেষেই প্রকৃতি ও মানুষের চোখ মুখ সুনসান, সিয়া,
চোখের, গাছের পাতা লতাগুল্ম কী ব্যাপক গাইছে মর্সিয়া!
মানুষ এসেই যায়
বহুদিন ধরে যাচ্ছি,কখনো আনন্দে, কখনোবা কায়ক্লেশে
অত্যন্ত কাতর পথ হাঁটি। মাঝে-মধ্যে
পান্থনিবাসের প্রেতায়িত নিরালায়
থাকি মধ্যরাতে; মধ্যরাতে মগজের
ভেতরে বেড়াল হয়ে ঘুমোয় পেলব, নিরিবিলি।
বহুদিন ধরে যাচ্ছি, কখনো হঠাৎ কোনোখানে
যাত্রা থেকে গেলে দ্বিপ্রহরে
কিংবা গোধূলিতে
আশেপাশে কুয়োতলা, কল খুঁজে নিই, জলপান করে দীর্ঘ
স্মৃতির মতন পথরেখা
স্মৃতিতে মিশিয়ে, অন্য তৃষ্ণা নিয়ে, আবার নিঃসঙ্গ পথচারী
আমার ফেরার কথা ছিল নিশীথের মৃত্তিকায়
কামিনী ঝরার আগে। সেই কবে রজনীগন্ধাকে
কথা দিয়ে চলে গেছি কতদিন ভাবলেশহীন,
কাঁটার খতরা ছিল পদে পদে, অথচ আমার
সৌজন্যসম্মত ভঙ্গি খায়নি কখনো টোল; শুধু
প্রত্যাবর্তনের গান ভুলে
অচেনা পথের দিকে চোখ রাখি বারংবার, সামনে বাড়াই
পদযুগ; পদযুগ ধূলিময়, বীণাধ্বনি, স্বপ্নের মহলে
মখমলে ঢাকা। মমতায় প্লুত কোনো মৃত্তিকায়
শেকড় লাগে না; এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে
চলে যেতে হয় বলে চলে যাওয়া? অস্থায়ী ডেরায়
রাত্রিশেষে কাঠখড় ভস্মীভূত হ’লে, পাখিদের পাড়া খুব
নিঝুম বিবশ হ’লে শবব্যবচ্ছেদ মনে করে
আমি কি মুছি না চোখ? থাক,
শোকগাথা রচনায় কাজ নেই। রিক্ততার রুক্ষ তপোবনে
কেটে গেছে বহু বেলা, তপোক্লেস বেড়ে যায় ক্রমাগত; এবার সত্তার
সম্ভ্রম বাঁচিয়ে অন্ধকার
পথের আড়ালে পথ খুঁজে নেব, খুঁজব দিগন্তের অশ্বপাল।
আমার ফেলার কথা ছিল বনস্থলী থেকে খুব
কান্তিমান সাদা ঘোড়া বেরিয়ে আসার আগে; আমি
প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি রাখিনি বলে ওরা
সেই কবে থেকে ব’সে আছে পথপ্রান্তে, নদীতীরে।
মাঠে তাঁবু, কেউ কেউ অপেক্ষায় কাবু সন্ধ্যালোকে।
ওদের সবার জন্যে বীজ নিয়ে আসব বলেই
দিগন্তের দিকে মুখ রেখে ব’সে আছে বহুজন।
কেউ কেউ হাই তোলে, চুল টানে; ধনুকের ছিলার মতন
কেউ কেউ। মরমীয়াবাদী যেন কেউ কেউ, ওদের দু’চোখে
প্রতীক্ষার মতো কত প্রহর গড়িয়ে যায়, যায় নিত্য যায়।
‘সে আসবে’ বলে অনেকেই গল্পে মাতে, গেরস্থালি
ছিন্নমূল মানুষের গন্ধে ভরপুর। জ্যোৎস্না আর গীতধারা
একই স্রোতে মিশে যায়, কখনো দোলনা দুলে ওঠে
ঘুমপাড়ানিয়া গানে। আকাশ কবির
খাতার মতন সম্ভাবনাময়, কেউ দূর আকাশের দিকে
আঙুল দেখিয়ে বলে,-‘এই তো আমার কাঁথা, রুপোলি নকশায়
অর্থময়, আমি এর অনন্ত ঔদাস্য
সমর্থন করি। একজন বৃদ্ধ বলে,
প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘যে গেছে সে প্রতারক,
আসবে না কস্মিনকালেও;
‘যদি সে কখনো আসে, আমার মাথায় মাবুদের
‘লানত আসবে নেমে, লিখে রাখো তোমরা সবাই।
একজন নারী তার চুলরাশি মেঘময় সন্ধ্যায় ছড়িয়ে
বলে মৃদুস্বরে, ‘যে গেছে সে বিশ্বাসঘাতক
‘হৃদয়ে পাথর তার, চক্ষুদ্বয় দাগাপ্রিয় খুব,
‘আসবে না, আমি চুল ছিঁড়ে নদীতীরে উন্মাদিনী হয়ে ছুটে
‘বেড়ালেও আসবে না খল, প্রবঞ্চক।
আমার ফেরার কথা ছিল পাখির চোখের মতো
লোকশ্রুত নৌকো ঘাটে লাগার আগেই।
ওদের ক্ষেতের জন্যে বীজ অত্যন্ত স্বপ্নিল হয়ে
প্রগাঢ় রয়েছে জমা আমার মুঠোয়, যতদিন যায় বীজ তত স্বপ্ন হয়।
সর্বদা জমিন ডাকে, বীজ কী প্রবল ছুটে যেতে চায় শূন্য
মৃত্তিকার প্রতি
আমার মুঠোর খোসা ছিঁড়ে। বীজ নিয়ে এসে দেখি
আমার আপন প্রত্যাবর্তনের পথে, রাত্তিরেই ফেরা, কোনো
মশালের চিহ্ন নেই, বাদ্যরব নেই, নেই নারীর বিস্ময়।
জমিনে ছিটিয়ে বীজ আমি স্বপ্ন হই, বীজ স্বপ্ন, স্বপ্ন সোঁদা
ধান গন্ধময়, বীজ মরালের ওড়াউড়ি, নিদ্রায় কাতর
ওদের ঘুমন্ত ওষ্ঠে, গালে বীজ চুমো খায়। প্রত্যাবর্তনের
পথে আমি দেখি এক কবির কঙ্কাল বর্ষাভেজা
হাওয়ায় দোদুল্যমান যূথিবনে, তার অক্ষিগর্ত যেন গায় গান-
মানুষ এসেই যায় শেষে নিরুদ্দেশ থেকে মানুষের আপন নিবাসে।
মূকাভিনয়
আমরা মূকাভিনয় করি অনেকেই সারাক্ষণ,
আমাদের এ রকম করে যেতে হয় বহুকাল।
এত যে মূকাভিনেতা চুতষ্পার্শে আনাগোনা
করে নিত্য সারি সারি, তা দেখে অবাক মানি। তারা
হাঁটে, বসে, মাথা নাড়ে, কখনো দুদ্দাড় দেয় লাফ,
আবার ঝিমোয় কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে নেচে ওঠে
পুতুলের মতো ঠিক এবং ফুরোলে দম থামে
অকস্মাৎ কখনোবা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে গাঢ়
অন্ধকারে বহুক্ষণ, দেয়ালের আলেখ্য যেনবা।
আমি কি আলাদা কেউ? বস্তুত আমার প্রাতিস্বিক
ধরন রয়েছে কিছু-যেমন হাঁটার ভঙ্গি আর
সহসা আড়াল থেকে সকলের মুখোমুখি একা
দাঁড়ানোর ঢঙ কিংবা রৌদ্রের সহিত ব্যক্তিগত
যোগাযোগ, অন্ধকার টানেলে সুদীর্ঘ বসবাস।
আমিও মূকাভিনয় করি রাত্রিদিন। হাত-পা নাড়ি,
মাথায় চালাই হাত ঘন ঘন, ঠোঁট ফাঁক করে
হাসতে সচেষ্ট হই, চেয়ারে গা এলিয়ে মৃদুমন্দ
পা দোলাই বারংবার। অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ আলো পড়ে
সারা মুখে, গাল বেয়ে পানি নামে। কেন এই উষ্ণ
জলধারা, কাউকেই জানাতে পারি না। প্রাণপণ
চেঁচিয়ে উঠতে চাই, শুধু ঠোঁট নড়ে এলোমেলো,
কখন হারিয়ে গেছে কণ্ঠস্বর, নিজেই জানি না।
কেবলি মূকাভিনয় করি এলেবেলে সারাক্ষণ,
এ রকম করে যেতে হবে দীর্ঘকাল, মনে হয়।
যখন আমার মৃত্যু হবে
যখন আমার মৃত্যু হবে, হবেই তো কোনো দিন,
তখন হয়তো তুমি রাত্রির শয্যায় ঘুমে লীন,
বালিশে স্খলিত খোঁপা, স্বপ্নময় ঘুমে অকস্মাৎ
উঠবে শরীর কেঁপে সুখঘোরে, পুরুষের হাত
তোমার কোমরে লগ্ন, সে-হাত দস্যুতা জানে খুব।
যখন আমাকে মৃত্যু অতর্কিতে বানাবে বেকুব,
তখনি হয়তো তুমি গল্পের আসরে বাছা বাছা
চালাক মন্তব্য দেবে ছুড়ে আর কাকে বলে বাঁচা
বলবে শিল্পিত সুরে। যখন আমার মৃত্যু হবে,
তখন হয়তো তুমি সমর্পিত দীপ্র কলরবে।
যখন আমার মৃত্যু হবে, হয়তোবা জানালার
বাইরে তাকাবে তুমি, একাকিনী যাবে বারান্দার
অন্ধকারে, আস্তেসুস্থে গাছপালা, নক্ষত্রের তোড়া
দেখবে, বসবে এক কোণে; সহসা নিঃসঙ্গ ঘোড়া
তোমার হৃদয় জুড়ে খুরে ওড়াবে রঙিন ধূলি
এবং তোমার দিকে ফ্লাওয়ার ভাসের ফুলগুলি
নিঃশব্দে থাকবে চেয়ে অপলক; হয়তোবা যাবে
খাবার টেবিলে তুমি, নিরিবিলি প্লেয়ারে বাজাবে
পুরোনো দিনের গান। সেকালের কোনো কোনো গান
একদা আমার মধ্যে দিত গ’ড়ে স্মৃতির উদ্যান।
যখন আমার মৃত্যু হবে, হয়তোবা দ্বিপ্রহরে
শুয়ে শুয়ে নব্য নভেলের স্বাদ নেবে, হা-হা স্বরে
বাতাস প্রবল যাবে বয়ে, একজন স্বপ্নময়
উদভ্রান্ত কবির কথা হয়তো পড়বে মনে। ভয়
পেয়ে টেনে দেবে পর্দা জানালার? হয়তোবা
ছেলেটা পাশের ঘরে একা বসে মেঘ, বনশোভা
আঁকবে খাতায় কিংবা ছুটে এসে ধরবে জড়িয়ে
তোমাকেই, তুমি পিঠে দীর্ঘ চুল কোমল ছড়িয়ে
চিত্রবৎ; যখন আমার সত্তা অসাড়, তুহিন,
তখন হয়তো তুমি বুনে যাবে উল ক্লান্তিহীন।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
একটি নির্জন দীর্ঘশ্বাস, যেন ক্লান্ত পথচারী কোনো
আমার ঘাড়ের ধু-ধু একাকী প্রান্তরে
আস্তেসুস্থে ছড়ায় তুষার।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
একটি সোনালি সিংহ, তার চকচকে কেশর-দোলানো স্ফীত
গলায় ফুলের মালা, আসে দেয়ালের পলেস্তারা ফুঁড়ে, মুখ
থেকে ব্যাঞ্জো, রত্নরাজি, প্রেমিকের দীপ্র চোখ, সুন্দরীর মুখ বের করে।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
আমার আপন ঘরে সহসা প্ল্যাটোর গুহা জাগে;
গুহায় অনেক ছায়া, কম্পমান, গুহাগাত্রে একজন তার
আধপোড়া সিগারেট চেপে ধরে, কেউবা ঝোলায় পাণ্ডুলিপি।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
স্বপ্নের সবুজ লনে চারজন নিপুণ খেলোয়াড়
টেনিস বলের সাথে ঘন ঘন লাফিয়ে বেড়ায়,
র্যা কেট বাদামি ভায়োলিন হয়ে শূন্যে নেচে ওঠে বারংবার।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
ত্র্যালবাম থেকে কিছু ফটোগ্রাফ প্রবল বেরিয়ে দৃষ্টিপথে
কয়েকটি মুখ হয়। একজন বলে, ‘আমি দুঃখ হয়ে পুড়েছি সর্বদা’,
‘আমি যন্ত্রণাকে ছুটি দিয়েছি দিঘিতে সন্ধেবেলা’, বলে অন্যজন।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
টেলিফোন দেয়ালের সঙ্গে কথা বলে, বই নৈঃসঙ্গের সাথে,
নিশীথের সাথে চক্ষুদ্বয়। কোত্থেকে কেমন পাখি এসে বলে-
আমি তো তোমার নই, কারো নই, পুনরায় স্বপ্নের চিতায় চলে যাব।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
সংবাদপত্রের রাশি রাশি কালো অক্ষর ছাপিয়ে
আট কলামের পরপারে কতিপয় শীর্ণ মুখ শূন্য থালা,
প’ড়ে থাকে; ছাদ গুলিবিদ্ধ মানুষের মতো করে আর্তনাদ।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
পৃথিবীর মানচিত্র পর্দার মতন ঝোলে জানালায়,
সাবমেরিনের চূড়ো মেঝেতে চকিতে দেখা দেয়,
আমার সম্মুখে ব’সে চুরুট ফোঁকেন তেরোজন রাষ্ট্রদূত।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
সকালবেলার মতো কারো হাত, যমজ সোনালি
আপেল এবং টেলিফোন, প্রজাপতি, ফটোগ্রাফ, আসবাব
গান গায়, গান গায় কবিতার জাগ্রত পঙ্ক্তির কানে কানে।
যতবার আমি
যতবার আমি আকাশ শব্দটা উচ্চারণ করতে চাই,
কিংবা বৃক্ষ বলে ডাক দিই,
ততবার তোমারই নাম বলে ফেলি।
জানালার বাইরে তাকিয়ে যখন বলতে যাই, হে শহর-
তখনও তোমার নাম বেজে ওঠে আমার কণ্ঠস্বরে।
কবিতার কিছু পঙ্ক্তি আউড়ে শান্তি পেতে চাইলে
আমি কেবলি তোমার নাম আবৃত্তি করতে থাকি।
স্বপ্ন, তুমি অকস্মাৎ ফুরিয়ে যাও কেন-এই প্রশ্ন করতে গিয়ে
এই নির্ঘুম রাত্তিরে স্বপ্নে কথা বলার মতো
বারবার জিগ্যেস করি, তুমি কেমন আছ?
যদি তুমি আসো
খুব ভোরবেলা উন্মুখ দুটি চোখ মেলে রাখি,
যদি তুমি আসো।
চৈত্র দুপুরে চোখ পুড়ে যায়, তবু চেয়ে থাকি,
যদি তুমি আসো।
কখনো গাছের পাশে গাছ হয়ে দাঁড়াই একাকী,
যদি তুমি আসো।
সন্ধ্যার বুকে হৃদয় আমার ছটফটে পাখি,
যদি তুমি আসো।
অন্ধকারের কেমন আবীর দুটি চোখে মাখি,
যদি তুমি আসো।
মধ্যরাত্রে স্বপ্নের স্বরে বারবার ডাকি,
যদি তুমি আসো।
বস্তুত আমি প্রহরে প্রহরে অনিদ্রা চাখি,
যদি তুমি আসো।
সে কোন গোপন জ্যোৎস্না-ঝালরে নৈরাশ ঢাকি,
যদি তুমি আসো।
রেস্তোরাঁর একটি টেবিলে
ওরা ক’জন যে ছিল রেস্তোরাঁর একটি টেবিলে
সেদিন, পড়ে না মনে। কেউ লম্বা, খর্বকায় কেউ,
মসৃণ কামানো কারো গাল, কারো মুখ যেন ঝোপ,
এক্ষুণি বেরিয়ে এলো বলে খরগোশ কিংবা পাখি।
একজন অনর্গল কথা বলে, অন্যজন বড়
বেশি চুপচাপ, কেউ মাথা নাড়ে ঘন ঘন, যার
পরনে পাঞ্জাবি তার বুঝি নস্যি নেয়ার অভ্যাস।
কেউ দ্রুত কী যে লেখে খুব ঝুঁকে, কেউবা টেবিলে
নিপুণ বাজায় তাল, কেউ শূন্য চায়ের বাটিতে
প্রাচীন রাজার বাড়ি দ্যাখে, রেস্তোরাঁয় অন্ধকার
ফুঁড়ে আফ্রোদিতি এলো ভেবে কেউ বারবার ওঠে
কাঠের চেয়ার ছেড়ে, কেউবা ভীষণ খিস্তি করে।
কারো দুঃখী মুখে ওড়ে এলোমেলো স্বপ্নভস্ম কত।
সময়ের হাতে সমর্পিত, বিচ্ছিন্নতা বোধে ক্ষিপ্ত
ওরা কী-যে বলাবলি করেছিল সেদিন সন্ধ্যায়
রেস্তোরাঁয়, মনে নেই শুধু মনে পড়ে প্রত্যেকেই
বলেছিল-সবাইকে যেতে হবে, কেন যেতে হবে?
শতাব্দীর বিদীর্ণ হৃদয় থেকে
প্রত্যেকের কাছ থেকে আপনার সুখের অভাব
লুকিয়ে রাখাই চিরদিন
আমার স্বভাব।
কখনো চলতি পথে যখন জিজ্ঞেস করে কেউ
ভাবলেশহীন
বাড়িয়ে গেরস্ত হাত, ‘কেমন কাটছে দিন ইদানীং’, বলে-
ভালো, বেশ ভালো, পুনরায় পথ চলি
নিপুণ গোপন রেখে আমার প্রকৃত মনোভাব।
একদা স্বপ্নিল করিডরে যার শরীরের চন্দ্রোদয় দেখে
ছিলাম আচ্ছন্ন সারাক্ষণ তাকে ঝিল, ঝাউগাছ,
অথবা সোনালি মাছ
প্রাচীন হ্রদের কিংবা পাখি রূপে হৃদয়ের অভ্যন্তরে রেখে
বস্তুত সংসারকানা আজও আমি। আগে
অথবা অনেক পরে-কখনো সময় খুব করে প্রতারণা-
স্মৃতিকে গোধূলি শেষে বনভোজনের পোড়া কাঠ, বাসি খাদ্যকণা
ভেবে আপাতত এই অদ্ভুত শহরে করি বসবাস
কখনো বিরাগে, কখনো-বা অনুরাগে।
জানালার কাছে এসে শুনি ফুটপাত, গাছপালা,
পাবলিক লাইব্রেরি, নিউ মার্কেটের বাণিজ্যিক
পথ ল্যাম্পপোস্ট যেন স্বপ্নভঙ্গজনিত বিষাদে
ফেলে দীর্ঘশ্বাস।
যন্ত্রণা আমার অস্তিত্বের রুক্ষ বিদীর্ণ ভূ-ভাগে
নিয়ত প্রগাঢ় লেখে তার হিজিবিজি বর্ণমালা।
সহসা কখন কী-যে হারিয়ে ব্যাকুল দিগ্ধিদিক
কেবলি খুঁজতে থাকি। ফের বাঁশি বাজাবে কি উধাও বিশ্বাস
নিষ্ফলা প্রান্তরে, দগ্ধ বনে, জনশূন্য নদীতীরে,
অসুস্থ শহরে?
অনাহীরী শিশু আর পঙ্গু নারীদের সাদা পাখি নেবে তুলে
চঞ্চুর আশ্রয়? অনাথের ক্ষতি নিরিবিলি ঝরে
নক্ষত্রের আলো, তুমি কপটতা ছেড়ে দূস্থ ভিড়ে
মিশে গিয়ে জেনে নাও জগৎ-সংসার কবিতার
খাতা কিনা। সুখ চাই সুখ চাই বলে সত্তার নিভৃত মূলে
কখনো এনো না ডেকে বিষপিঁপড়ের ঝাঁক; তুমি
দূরত্ব আবৃত্তি করে যখন নিকটে চলে আসো কারো, তার
লতাগুল্মময় মনোভূমি
দুলে ওঠে, সোহাগের সিংহাসনে ব’সে পা দোলানো ভালো লাগে,
ভালো লাগে কবেকার ক্ষতচিহ্নে জ্যোৎস্নাধারা বয়ে
যেতে দেখে অবসরে। হঠাৎ আবার মগজের কোষে জাগে
পদহীন ভিখিরি দল, বন্ধ ঘরে কে এক উন্মাদ ভয়ে
জড়ো-সড়ো কিংবা নোংরা নখে দেয়ালে থেকে রোদ
মুছে ফেলবার জেদে দাঁতে দাঁতে ঘষে। ঘুরে দেখি, ডানপাশে
আর্কাইভ জেগে ওঠে-প্রাচীন দ্রব্যের স্তূপ থেকে
আস্তে একাকিনী নারী, কবে যেন হয়েছিল দেখা, উঠে আসে
ছড়িয়ে স্মৃতির মসলিন; একজন দার্শনিক মূল্যবোধ
বিষয়ে ভাবিত, হাতে তাঁর নষ্ট সভ্যতার ভগ্নাংশ, বিবেকে
প্রভূত পীড়ন, অলিন্দের খোলা হাওয়া চাই বলে
জংধরা চেয়ারের কাছ থেকে বাঁ দিকে দাঁড়ান সরে; কবি
করোটিতে সুরা পান করে খসখসে পাণ্ডুলিপি জ্বলজ্বলে
পাখির মতন দেন ছেড়ে। আর্কাইভে আরো কত মুখচ্ছবি
প্রাচীনতা ভেদ করে ঘাসে ঘাসে, আকাশে আকাশে
কেবলি রটাতে চায় বার্তা, একজন প্রেমিকের
মৃতদেহ গোলাপের গুচ্ছ হয়, ঝরে যায় ক্লান্ত প্রহরের
সঙ্গীত ফুরোলে, হে আমার আপন করুণ বিউগল
বাজো, বেজে ওঠো এ বিশদ সূর্যাস্তের ক্ষণে গভীর আশ্বাসে,
চেয়ে দ্যাখো শতাব্দীর বিদীর্ণ হৃদয় থেকে রক্তবিন্দু ঝরে অবিরল।
সে এক খননকারী
একমনে সে খুঁড়তে থাকে, খুঁড়তে থাকে মাটি।
অমন করে কেন যে সে অষ্টপ্রহর
খুঁড়ছে মাটি একা একা,
কেউ জানে না।
একমনে সে খুঁড়তে থাকে, খুঁড়তে থাকে মাটি।
মাঝে-মধ্যে কান পাতে সে মাটির অনেক নিচে
শোনার মতো গল্প কিছু আছে নাকি?
পোকামাকড়; হাড়ের গুঁড়ো
বলবে কিছু?
যখন তখন ওকে ঘিরে দাঁড়ায় এসে ওরা।
নখ দিয়ে তার মাটি খোঁড়া দ্যাখে সবিস্ময়ে।
অমন করে ক’হাত মাটি খুঁড়লে মেলে
খুব-লুকোনো স্মৃতিকণা?
কেইবা জানে?
কাউকে তুলে আনবে সেকি মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে?
রোদকে বাজায় দশ আঙুলে পুশিদা এক সুরে।
শেকড়-বাকড় উপড়ে ফেলে, পা মেলে দ্যায়
অনেক দূরে-যেন সে ঐ
আকাশ ছোঁবে।
জ্যোৎস্না চেটে নেয় তুলে সে রাতের শরীর থেকে।
ছায়ার ভেতর ছায়া হয়ে লুকিয়ে থাকে একা।
হঠাৎ কখন ছায়া ঝেড়ে নোংরা নখে
কিসের ঘোরে খুঁড়তে থাকে
শক্ত মাটি।
ছায়ার ভেতর ছায়া খোঁড়ে, কেমন খননকারী?
কখন আবার খুঁড়তে থাকে অক্ষিগোলক দুটি,
খুঁড়তে থাকে নিজের রুক্ষ বুকের পাঁজর,
খুঁড়তে থাকে শরীরটাকে।
কেউ জানে না।
গভীরভাবে নিজেকে সে খঁড়তে থাকে শুধু।
স্বপ্নের খোয়ারি
এভাবে ফিরিয়ে দেবে যদি তবে কেন ডেকেছিলে
সবুজ পাতার কাছে, লাল পথে, ধু-ধু মাঠে, ঝিলে?
মোহন ইঙ্গিতে নৈসর্গিক রেস্তোরাঁয়, নদীতীরে
কেন নিয়ে গেলে বাসস্টপে, পশু-পাখিদের ভিড়ে?
হাতে তুলে দিয়ে পাত্র পানীয় ধুলায় দিলে ফেলে,
বলো এ কেমন আতিথেয়তা তোমার চিরকেলে?
দিয়েছ আসন পেতে মেঘে মেঘে বারংবার,
ঘুরেছি দু’জন একসঙ্গে নিরিবিলি বনে আর
মধ্যাহ্নে গাছের নিচে তোমার দু’চোখে নিমজ্জিত
খেলেছি স্বপ্নের ঘরে এক্কাদোক্কা। ঝিল গেছে বেঁকে
বহু দূরে, বুঝি বনস্থলীর সহিত আছে তার
কিছু কথা; স্বপ্নস্থিত কারুকাজে এ বন-বাদাড়
জলের নিচের পুরী, শ্বেত প্রজাপতি, পাখিগুলি
ধাতুর সামগ্রী হয়। অবচেতনার ঘুলঘুলি
চোখ মেলে, পুষ্প গর্ভে অকস্মাৎ অত্যন্ত শানদার
দৃশ্যাবলি, পরক্ষণে সব কিছু কেমন আন্ধার
এবং নিজেকে একা ভীষণ বুরবক লাগে, ভাবি-
এই অবেলায় আমি কোথায় জানাব কোন দাবি?
তাহলে ফিরেই যাব? নাকি এই অদ্ভুত শহরে
কেবলি তোমার খোঁজে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হবো, ঘরে
ফিরব না যথারীতি। যত্রতত্র চালচুলোহীন
থাকব একাকী খুব আর রৌদ্রবিহারের দিন
কোথায় লুকাল মুখ বলে মধ্যরাতে মাঝে-মাঝে
জীর্ণ জব্দ গাড়ি করব মেরামত স্বপ্নের গ্যারাজে।
এই তো ঘুরছে চাকা, কত পাখপাখালি সমেত,
ঘুরছে আমার হাত, ফসল নিবিড় শস্যক্ষেত,
পথের গায়ক আর ফুটপাত। মেট্রোপলিটন
শহরের চৌরাস্তায় একটি অসুস্থ ঘোড়া কোন
স্বপ্নের খোয়ারি নিয়ে থমকে দাঁড়ায় অকস্মাৎ?
স্টেডিয়াম, পার্ক, পথ, সবই তোমার সোনালি হাত।
হাঁটতে হাঁটতে শেষ অবধি
(মতিউর রহমান বন্ধুবরেষু)
হাঁটতে হাঁটতে শেষ অবধি বেলাশেষ কোথায় যাব?
ঠিক জানি না।
এখন পথে রৌদ্র নেই, জ্যোৎস্না গেছে হঠাৎ উবে-
একটা কিছু মনে রেখে হাঁটতে থাকি, হাঁটতে থাকি
এই অবেলায়।
হাঁটতে হাঁটতে শেষ অবধি বেলাশেষে কোথায় যাব?
তোমরা যারা কাদার খেলা ভালোবাসো, হরহামেশা
তোমরা যারা
পথের বুকে হিংস্র কাঁটা দাও বিছিয়ে,
আড়াল থেকে তীর ছুড়ে দাও জহরমাখা, তাদের বলি-
বন্ধু শোনো,
তোমাদের ঐ পাকা ধানে মই দেব না, ছাই দেব না
বাড়া ভাতে।
তোমাদের সব কাকাতুয়া দুলবে দাঁড়ে, বিষ দেব না।
ভেব না ঠিক চায়ের সময় কথার ফাঁকে হাসতে হাসতে
হঠাৎ আমি
হাসতে হাসতে সজীব বুকে বসিয়ে দেব আমুল ছোরা।
আমার আপন দুঃখ-কষ্ট আমারই থাক, কাউকে কিছুই
ভাগ দেব না!
আমার বুকে বাঘের পায়ের দাগ বসে যায়,
আমার গায়ে ক্রুদ্ধ সাপের হিসহিসানি
লেগে থাকে,
আমার পিঠে ক্রূশের গাঢ় চিহ্ন আছে,
বুকের দু’দিক ক্রমাগত যাচ্ছে ক্ষ’য়ে।
সমাজজোড়া প্রতারণার প্রবল তোড়ে যাচ্ছি ভেসে,
কোন আমলে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলাম, মাঝে-মধ্যে
স্মরণ করি।
তোমরা যারা এলেবেলে আমার নামের ওপর শুধু
ছড়াও কালি,
ভয় পেয়ো না; অস্ত্রত্যাগের পরে কেমন
বিষাদে মন খুব ছেয়ে যায়, এখন শুধু দিতে পারি
ভালোবাসা।
ভালোবাসার স্বত্ব যদি ক্রোক করে নাও,
নিঃস্ব হয়ে মিছেমিছি কাঁদুনি আর গাইব না হে।
তোমরা যারা অন্ধতার এক চুক্তিপত্রে সই করেছ
অন্ধ রাত,
ভ্রান্তিভরা এই বলয়ে তারাই বুঝি আমাকে
বাৎলে দেবে?
অগ্রগমী দেবতাদের হাঁড়ির খবর জানা আছে
যখন খুশি পরের ভিটায় ঘুঘু চড়াও, এমনি আরও
কাণ্ডে তোমরা বেজায় দড় জানা আছে।
শববাহকের স্মৃতির মতো স্মৃতি ওড়ে ইতস্তত।
কী যে আমার প্রাপ্য ছিল ভুলেছি তাও হট্রগোলে।
কারো চোখের এক ফোঁটা জল স্বপ্ন হ’ল
রূপান্তরে,
শববাহকের কানের ফাঁকে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফুটেছে;
হাঁটতে হাঁটতে শেষ অবধি বেলাশেষে কোথায় যাব?
ঠিক জানি না।
ঠিক জানি না কেন যে এই নিশান পুঁতি পথে পথে।
হাত-বিষয়ক কবিতা
হাতের বিষয়ে আমি প্রায়শই ভাবি। প্রতিদিন
না হলেও কোনো কোনো দিন নিজের হাতের দিকে
তন্ময় তাকাই, যেন কিছু পাঠোদ্ধারে বড় বেশি
মনোযোগী হয়ে পড়ি। উত্তেজিত মাছের মতন
হাত উল্টেপাল্টে দেখে নিই, রেখাবিদ নই, তবু
হাতের তালুর স্থির লতাপাতা করি উপভোগ।
টেবিলে আমার হাত। কে তুমি? হঠাৎ চক্ষুদ্বয়
প্রশ্ন করে, কেন তুমি এমন ঘুমিয়ে আছ একা
এই টেবিলের বুকে? তুমি কি বধির কোনো শাখা?
নাকি জলচর কোনো প্রাণী ডাঙায় পোহাচ্ছে রোদ?
কখনো শয্যায় হাত পড়ে থাকে এক পাশে, আমি
সবিস্ময়ে দেখি তাকে, সেকি আমারই প্রকৃত কেউ?
স্মৃতির শিশির চোখে নিয়ে হাত অপলক গাঢ়
তাকায় আমার দিকে; সে দৃষ্টিতে নদী, বালিয়াড়ি,
শূন্য তাঁবু; জ্যোৎস্নাময় উটের স্বপ্নিল গ্রীবা, ক্ষেত,
সূর্যাস্ত এবং ক্রূদ্ধ পাখির বিবাদ, সে দৃষ্টিতে
কবির করোটি, সদ্য ক্ষত, নর্তকীর শরীরের
কত ঢেউ, কালো ভেনাসের মতো বর্ষার নিশীথ।
যখন আমার হাত আমাকে বলতে চায় কিছু,
পিঁপড়ের মতো ঘোরে হাতে। মাঝারি আমার হাত
কিছুবা অবুঝ, ত্রস্ত, কিঞ্চিৎ বেঢপও, বলা যায়-
দেখি সে বাতাস হয় উড়ুক্কু প্রান্তরে, ঘাসে ঘাসে;
মাঝারি আমার হাত বেড়ে যায় স্বপ্নের হাওয়ায়।
কখনো চমকে উঠি আমার আপন হাত দেখে,
ক্ষয়িষ্ণু ছায়ার মতো কত লোক লুটোচ্ছে এ হাতে,
লোমকূপগুলি যেন দারুণ মড়ক-কবলিত
পল্লীপুঞ্জ, আর্ত হিরোশিমা, একাত্তরের বিদীর্ণ
বাংলাদেশ। ভয় পাই, কখনোবা ভয় না পাওয়ার
ভান করি; হাতের ভেতরে দ্রুত হাত নিয়ে যাই।
হাহাকারে বন্দি
একটা কেমন সুনীল পাত্র উড়ছে শুধু উড়ছে।
দূরের মেঘে বাস চলে যায়,
অস্তরাগে যাত্রী মেশে।
মেঘে মেঘে কিংবদন্তি, ঢেউয়ের মাথায়
বোতলবন্দি গল্প কিছু বেড়ায় নেচে,
রাজার মতো পা ঝুলিয়ে বসব আমি শূন্যে।
হাত রেখো না আমার বুকে, ক্ষত আবার জ্বলবে।
ঘোর অবেলায় দেখা হলো,
হৃদয় জুড়ে ঝরা পাতা।
চোখে চোখে নিমেষ ফুরোয়, হঠাৎ শুনি
কণ্ঠে ছেড়ে ঝরনাধারা বললে তুমি-
এই যে শোনো, ভালো লাগে তোমার কিছু পদ্য।
মুখচোরা তুই পদ্য আমার যারে উড়ে শীঘ্র,
তার বাগানে যারে উড়ে,
আস্তেসুস্থে করগে ভ্রমণ
তার সে ভীরু চোখের পাতায়, স্তনের ছায়ায়,
অনিদ্র হে পদ্য আমার আয় না তাকে
ঘুম পাড়িয়ে চুমো খাগে তার ঘুমন্ত ওষ্ঠে।
আবার কেন তৃষ্ণা আমার গ্রাস করেছে সদ্য।
জলের কাছে গেলে ত্বরিত
জল স’রে যার অনেক দূরে
তীরের দিকে হাত বাড়ালে তীর থাকে না,
তাকে দেয়া চুমু আমার শূন্যে মিলায়,
আমি ঊষর হাহাকারে একলা থাকি বন্দি।
হিসেবনবিশ
হিসেবী সে নয় তবু নিয়ত হিসেব করে কাটে তার বেলা।
নিজের বিবর্ণ ঘরে কী কী আসবাব আছে, ক’টি ফটোগ্রাফ,
মানচিত্র কিংবা কত বই, দেয়ালে কখন ক’টি পোকা থাকে,
যায় বালিরঙ টিকটিকির জঠরে-সে হিসেব করে।
কখনোবা সিগারেট ধরিয়ে সন্ধ্যাকে আস্তেসুস্থে
পোড়ায় চিতার মতো, তৃষ্ণায় কাতর হ’লে গলা
নিমেষে ভিজিয়ে দেয় স্বপ্নের শিশিরে। অন্তরালে
সংখ্যা লেখে, সংখ্যা কাটে, স্বপ্ন লেখে স্বপ্ন কাটে হিসেবনবিশ।
হিসেবে কোথাও কোনো গরমিল থাকা ভালো নয়
ভেবে সে খাতার প্রতি আনুগত্যে ফেরেশতার পাখার মতন
জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। আঙুলের ডগায় নাচিয়ে কী নির্মল
গণিতের গুঁড়ো, পায়ে পায়ে বাজিয়ে করোটি হরিণের কত
মহামারী ভুলে থাকে, চলে যায় পার্কে; কতিপয় এলোমেলো
নষ্ট মানুষের হর্ষধ্বনি, হৈ হৈ অশ্লীলতা শুনে কাটে ঘোর।
ফিরে আসে, ঘরে ব’সে আশা লেখে, আশা কাটে হিসেবনবিশ।
সতেজ আকাঙ্ক্ষাগুলি নিঃশব্দে জীবনপাত করে আর্ত ঘরে!
এ শহরে শতকরা কত লোক সমকামী আর প্লেটনিক
প্রেমিক ক’জন,
পৌরসভা কত ট্রাক পেলে এ শহর হবে স্বপ্নের শহর,
জীবনানন্দীয় ঘাস কতটুকু জমি কার করেছে দখল
এ শহরে, ছায়াচ্ছন্ন শহরতলিতে,
একটি সপ্রাণ বসন্তের জন্যে ক’ডজন কোকিল দরকার,
গোর খোদকের কাছে কত লাশ জমা দিলে
সড়কের মুখ রক্ষা হবে,
টি এস এলিয়টের ধূসর ওয়েস্টকোট, ভালেরির নিরঞ্জন প্রশান্ত দস্তানা,
নেরুদার চিলিময় ইতিহাসরঞ্জিত জ্যাকেট ক’হাজার
সুপার পার্কেটে লভ্য, এ হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হিসেবনবিশ।
রাত্রিদিন একা-একা সে হিসেব করে তেরো বর্গমাইল জায়গায়
ক’জন সৈনিক কুচকাওয়াজ করতে পারে সকালের রোদে,
পঁচিশ মিনিটে ঠিক ক’টি ট্রেঞ্চ খোঁড়া যায়, বঙ্গোপসাগর
ঢেকে দিতে ক’হাজার রণতরী লাগবে এবং অকস্মাৎ
আণবিক আক্রমণ শুরু হলে তেজস্ক্রিয় ভস্ম থেকে মানব শিশুকে
বাঁচাতে প্রত্যেক দেশে কত ভূগর্ভস্থ আশ্রয় শিবির চাই,
ক’কোটি রেডিও আর্তস্বরে কেবলি রটাবে সেই
আত্মা-শুষে-নেয়া দুঃসংবাদ বিস্ময়?
পূর্ব পুরুষের হলদে জাবেদা খাতার ভাঁজে ভাঁজে
হিসেবের ঘনারণ্যে বিস্তর প্রমাদ
প্রাগৈতিহাসিক কিছু প্রাণীর মতন প্রকাশিত।
হিসেবের ফাঁকে ফাঁকে কেমন বেরিয়ে পড়ে তাদের ভণ্ডামি,
লোলুপতা, প্রতারণা, শঠতা ইত্যাদি,
যেমন খুনির ফেলে-আসা হত্যাচিহ্ন অকুস্থলে। পূর্ব পুরুষের সব
দলিল, জাবেদা খাতা বড় গোলমেলে। ক্লান্ত হিসেবনবিশ
এতদিনে জেনে গেছে, উল্টা-পাল্টা দলিলের শুদ্ধ পাঠোদ্ধারে
প্রকৃত আগ্রহী হ’লে পুনরায় পুরোপুরি হিসেব-নিকেশ করা চাই।
নইলে পদে পদে
প্রাক্তন ভ্রান্তির জের টেনে যেতে হবে
ক্ষেতের আইলে, ত্র্যাভেন্যুতে মগজের কোষে পুরষানুক্রমে।
নড়বড়ে ঘরে ব’সে একাকী সে সংখ্যা লেখে, সংখ্যা কাটে আর
হাতির মতন স্মৃতি নিয়ে, নিপুণ দর্জির মতো
সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দ্যাখে কোন ঘরে কত হয় জমা;
তবুও হিসেব তার খুব হিজিবিজি হয়ে যায় বারংবার।
একক দশক আর শতক সহস্র, সব কিছু মাতলামি করে করে
মুছে যায়, জাবেদা খাতায়
চোখের জলের মতো কিছু দাগ লেগে থাকে শুধু।
না, তোমাকে দিয়ে এ হিসেব মেলানো সম্ভব নয়।
কখনো, বলে সে মনে-মনে। অথচ আবার একা-একা হাতে
স্বপ্ন গুঁজে বেশ ঝুঁকে সংখ্যা লেখে, সংখ্যা কাটে। তার চতুষ্পার্শ্বে
পূর্ণিমার উজ্জ্বলতা ছাড়া কিছু নেই, চলে স্বচ্ছতা ছাড়া
কিছু নেই; দেয়ালের গর্ত এবং চৌকাঠ থেকে
ব্যর্থতা কুড়িয়ে জেনে নেয় সত্য মানে যেশাসের গাধা আর
গণিতের গুঁড়ো তার পায়ে চুমু খেয়ে খেয়ে গভীর সংগীতময় হয়।
হে আমার দীর্ঘ উপবাস
কোথায় রাখবে চোখ হে আমার দীর্ঘ উপবাস?
তুমি তো গুহায় আছ দীর্ঘদিন যোগাযোগহীন;
ঘাড় বেয়ে নেমে গেছে রুক্ষ কটা চুল, ওষ্ঠ যেন
খরা-কবলিত মাটি চক্ষুদ্বয় ভীষণ উজ্জ্বল-
ক্রমাগত উপবাসে হে আমার দীর্ঘ উপবাস
এ রকমই হয়, এরকম কম্পমান নিশিদিন।
কোথায় রাখবে চোখ হে আমার দীর্ঘ উপবাস?
এতদিন ফলমূল অথবা তণ্ডুল আশেপাশে
দ্যাখোনি এবং কেউ দেয়নি তোমার হাতে তুলে
ভরা পাত্র টলটলে, আহার্য ও পানীয়ের ঘ্রাণ
তুমি ভুলে গিয়েছিলে। এখন তোমার গুহাগাত্রে
কেমন কোমল ছায়া, মৃদু ঝরনাধ্বনি যাচ্ছে শোনা।
অবিরল; তুমি চোখ মেলে দ্যাখো দ্রাক্ষালতা খুব
কাছে এসে এই বর্তমানের মতন আলিঙ্গন
করছে তোমাকে নিরিবিলি। অতীত সজীব প্রাণী হয়ে
শুঁকছে তোমার পদযুগ, বুঝি চেখে নিতে চায়
ত্বকের উত্তাপ কিছু কিংবা হাড়ে উত্তুরে বাতাস
ছড়িয়েছে কত হিম পরখ করার লোভ তার।
হে আমার দীর্ঘ উপবাস, কতকাল পরে যাবে
পরবাসে পুনরায়? তোমার অসামাজিক রীতি
নদীতীরে কিংবা বনে পায় সমর্থন। খরস্রোতে
চোখ রেখে নদী হও, পর্বতারোহীর নিঃসঙ্গতা
বুকে পুষে গিরিচূড়া হয়ে যাও; হও প্রতীক্ষায়
তীক্ষ্ণ আরও, যেন বঞ্চনাকে ভালোবেসে অকাতরে
খুলে দিতে পারো মুঠি। এখন তোমার খুব কাছে
কত কিছু লোভনীয় রূপে এসে যাচ্ছে সাবলীল;
কোথায় রাখবে চোখ হে আমার দীর্ঘ উপবাস?
থাকবে কি চোখ বুজে? যে তোমার ধু-ধু উপবাসে
বইয়ে দেবে জলধারা, সে যদি গুহায় ছুটে আসে?
যদি সে পরিবেশ করে বিষলতা বারংবার?
হ্যাঁ
হ্যাঁ আমি হ্যাঁ তুমি হ্যাঁ তোমরা হ্যাঁ আমরা
হ্যাঁ আমাদের কিছু একটা করার থাকে কখনো না কখনো
হ্যাঁ এমন কিছু যা হয়তো সোনালি রেখার মতো রহস্যময় নয়
হ্যাঁ জ্যোৎস্না রাতে সারসের হঠাৎ পক্ষধ্বনির মতো নয় হয়তোবা
অথচ আমাদের বেঁচে থাকার সংকেত
হ্যাঁ সংবাদপত্রে যৌথ দুর্দশা পড়া ডাকঘরে চিঠি পোস্ট করা
হ্যাঁ বাসে চড়া হ্যাঁ চায়ের কাপে ঝড় তোলা
হ্যাঁ দুঃসময়ের ছায়ায় চুমো খাওয়া
হ্যাঁ নিসর্গের অন্তঃপুরে কারো হাত ধরে হেঁটে যাওয়া
হ্যাঁ টাইপরাইটারে স্বপ্ন লেখা খাটে ব’সে পা দোলানো
হ্যাঁ চুল আঁচড়ানো খুসকি তুলে আনা
হ্যাঁ মধ্যাহ্নে পাখিডাকা পার্কের প্রিয় সম্ভাষণ শোনা
হ্যাঁ অপরাহ্নে সিঁড়ি বেয়ে কলিংবেল বাজানো
হ্যাঁ অন্ধকারে লিরিকের মতো রাজহংসী দেখা
হ্যাঁ সকালবেলার রোদে প্লেটে ফলের ঘুম দেখা
হ্যাঁ এ ধরনের কত কিছু করার থাকে হ্যাঁ থাকে কখনো না কখনো
হ্যাঁ এই তো সেদিন ম্যান্ডোলিন শুনে
হ্যাঁএকরাশ সূর্যমুখীর ভেতর থেকে একটা বাঘ বেরিয়ে এলো
হ্যাঁ সেই বাঘ ডোরাকাটা কিনা মনে নেই
হ্যাঁ জ্বলজ্বলে সেই বাঘ সূর্যমুখী ফুলগুলি খেতে খেতে
হ্যাঁ নিজেই বিপুল এক সূর্যমুখী
হ্যাঁ সেই উন্মদ ভ্যানগগ তাঁর শীতার্থ ঘরে কিংবা হলদে ক্ষেতের ধারে
হ্যাঁ ত্রিকাল চিবোতে চিবোতে কালো রুটির মতো চিবোতে চিবোতে
হ্যাঁ সূর্যমুখী এঁকেছিলেন নিজেকে প্রতিটি পাপড়িতে মেলে দিয়ে
হ্যাঁ আমি মাঝে মাঝে সূর্যমুখী নয় শব্দ লিখি
হ্যাঁ লিখি
হ্যাঁ সেই শব্দাবলির শরীর থেকে ভেসে আসে
হ্যাঁ ভেসে আসে সূর্যমুখী চিতাবাঘ আর হরিণের ঘ্রাণ
হ্যাঁ ভেসে আসে গোরখোদকের ঘামের ঘ্রাণ
হ্যাঁ ভেসে আসে শ্রমিকের ঘুমের ঘ্রাণ
হ্যাঁ ভেসে আসে লতাগুল্ম ফলমূলের ঘ্রাণ
হ্যাঁ ভেসে আসে আসবাবপত্রের ঘ্রাণ
হ্যাঁ ভেসে আসে মা আর সন্তানের চুমোর ঘ্রাণ
হ্যাঁ ভেসে আসে নারীর ভেজা চুল আর স্তনের ঘ্রাণ
হ্যাঁ ভেসে আসে প্রেমিকের স্বপ্নের ঘ্রাণ
হ্যাঁ ভেসে আসে দুঃখিত মানুষের অশ্রুর ঘ্রাণ
হ্যাঁ আমি হ্যাঁ তুমি হ্যাঁ তোমরা হ্যাঁ আমরা
হ্যাঁ আমাদের একটা কিছু দেখার থাকে কখনো না কখনো
হ্যাঁ দেখি টিলায় দাঁড়িয়ে দেখি আকাঙ্ক্ষার সূর্যোদয়
হ্যাঁ বালিয়াড়িতে শুয়ে শুয়ে দেখি প্রেমের সূর্যাস্ত
হ্যাঁ দেখি আধপোড়া সিগারেট আর বিয়ারের শূন্য বোতল নাচে
হ্যাঁ অন্তহীন প্রান্তরে স্বপ্নের মতো ঘোড়া
হ্যাঁ দেখি একটা সিংহ চাঁদকে চুমো খেতে খেতে ব্যাঞ্জো নিয়ে
হ্যাঁ জ্যোৎস্নায় মিলিয়ে যায়
হ্যাঁ দেখি ঝরনার ঝলমলে পাতা হয়ে দোলে মরূদ্যানে
হ্যাঁ লিওনার্দো দা ভিঞ্চির হাত একালের চুলে বিলি কাটে
হ্যাঁ দেখি খৈয়ামের খুলি গোলাপে তোড়া হয়ে
হ্যা পড়ে থাকে পুরোনো প্রাসাদের নাচঘরে
হ্যাঁ দেখি ইয়ুং স্বপ্নারণ্যে হেঁটে যান ছড়ি হাতে
হ্যাঁ দেখি ইয়ুংয়ের
কোট অবচেতনের মুখোমুখি মাতাডোরের পোশাক
হ্যাঁ দেখি র্যাঁ বো ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন কবিতা
হ্যাঁ দেখি আইনস্টাইন ওভারকোট আর বেহালার বাক্স নিয়ে
হ্যাঁ পার হচ্ছেন গনগনে জার্মানির সীমান্ত
হ্যাঁ দেখি মরুশেয়াল রুমেলের মুঠো থেকে বেরিয়ে আসছে ট্যাঙ্ক
হ্যাঁ দেখি বুখেনওয়াল্ড আর আউসউইজ-এ পুরোনো জুতোর
স্তূপ কাটা চুল
হ্যাঁ দেখি বুলেটবিদ্ধ বাংলাদেশের ভাঙ্গা চুড়ি ছেঁড়া পুঁতির মালা
হ্যাঁ দেখি বাংলাদেশের আগুনে ঝলসে যাওয়া মুখ
হ্যাঁ দেখি জনাব মরণ বায়তুল মোকাররমে লাল নীল সবুজ শার্ট
হ্যাঁ হলদে বেগনি ফিরোজা ট্রাউজার
হ্যাঁ দেখি জনাব মরণ বায়তুল মোকাররমে লাল নীল সবুজ শাড়ি
হ্যাঁ হলদে বেগনি ফিরোজা ব্লাউজ
হ্যাঁ দেখি জনাব মরণ রাশি রাশি সাদা বাদামি ব্রা
হ্যাঁ দেখি বেলুনের মতো ছুড়ে দিচ্ছেন আকাশের দিকে
হ্যাঁ দেখি জনাব মরণ আতর-অলার কাঁধের ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে
হ্যাঁ জনাব মরণ সংবাদপত্রে পড়ছেন শোক সংবাদ
হ্যাঁ জনাব মরণ দস্তানা খুলে ঈগলের চোখের মতো আংটি দেখাচ্ছেন
হ্যাঁ দেখাচ্ছন যখন তখন যেন কালো স্যুট পরা জাদুকর
হ্যাঁ দেখি সভ্যতার চোখে সূর্য অস্ত যায় অস্ত যায়
হ্যাঁ আমি হ্যাঁ তুমি হ্যাঁ তোমরা হ্যাঁ আমরা
হ্যাঁ আমাদের সামনে কালো পাখির মতো ঝাঁক ঝাঁক না উড়ছে
হ্যাঁ ওরা ঝাঁক ঝাঁক না বসছে কার্নিশে মিনারে চঞ্চু ঘষছে বারংবার
হ্যাঁ আমি হ্যাঁ তুমি হ্যাঁ তোমরা হ্যাঁ আমরা হ্যাঁ রৌদ্রে
হ্যাঁ হ্যাঁ রৌদ্রে মুছে ফেলব ওদের ডানার কালো রঙ
হ্যাঁ ওদের রুপালি নক্ষত্র বানিয়ে দেব
হ্যাঁ ওদের বানিয়ে দেব আগামীর একগুচ্ছ গোলাপ
হ্যাঁ প্রত্যেক ধূলিকণাকে দেব গিটারের সুর
হ্যাঁ শহরের প্রতিটি ঘরের ছাদকে বানাব মুকুট
হ্যাঁ হ্যাঁ-স্পর্শে হ্যাঁ-চুম্বনে শূন্যতাকে বানাব সঙ্গীতময় জলসা