প্রতীতি আসেনি
প্রতীতি আসেনি আজো, শুধু গৃহপালিত স্বপ্নের
তদারকে বেলা যায়। অস্তিত্বকে ভাটপাড়া থেকে
টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে, চিকণ কথার বিদ্যুল্লতা
থেকে দূরে উল্টো পাল্টা চিত্রকল্পে দিয়েছি পা মেলে।
বশংবদ নক্ষত্রেরা আত্মায় জানায় দাবি, দেখি।
সবসুদ্ধ কয়েক শ’, তারও বেশি সুকণ্ঠ কোকিল
হত্যা করে, বহু লক্ষ প্রজাপতি ছিঁড়ে, পাপিয়াকে
সোৎসাহে নির্বংশ করে, লোকটা সদর্পে হেঁটে গেলো
রোমশ ছত্রিশ ইঞ্চি ঠুকে ঠুকে। সময়ের ছাদ
ধসে যেতে চায়, দেখলাম ভূতগ্রস্ত নগ্নতায়।
শতাব্দীর ফসিল জমানো কতো কবির পাঁজরে।
মধ্যে মধ্যে হাতড়াই স্বর্গের চৌকাঠ, বসে বসে
দিনের উদ্বেল স্তন খুঁটি; ভাবি, নিস্তাপ সন্ধ্যার
মেঘমালা, ফুলের নিশ্বাস, বৃক্ষ ছায়া, দাঁড়বন্দী
পাখিটার টলটলে চোখগুলো আমাকে কবিতা
দেবে কিছু? দশটি আঙুলে খুঁটি নিজেরই পাঁজর।
প্রতীতি আসেনি আজো, প্রেম আসে মরালের মতো,
ডানা ঝাপটিয়ে বসে চিত্তহারী প্রচ্ছন্ন মাস্তুলে।
ভাটপাড়া থেকে দূরে ভালবাসা তুমি থাকবে কি?
মেলবে কি পাখা এই ভূতগ্রস্ত কলঙ্কী পাঁজরে?
প্রভুকে
প্রভু, শোনো, এই অধমকে যদি ধরাধামে পাঠালেই,
তবে কেন হায় করলে না তুমি তোতাপাখি আমাকেই?
দাঁড়ে বসে-বসে বিজ্ঞের মতো নাড়তাম লেজখানি,
তীক্ষ্ণ আদুরে ঠোঁট দিয়ে বেশ খুঁটতাম দানাপানি।
মিলতো সুযোগ বন্ধ খাঁচায় বাঁধা বুলি কুড়োবার,
বইতে হতো না নিজস্ব কথা বলবার গুরুভার।
বন্ধুদের প্রতি
সময়ের প্রশংসা করবো বলে আমরা ক’জন
খুজি কিছু বাছা-বাছা চিত্রকলা, উপমা প্রতীক
মগজকে হুকুম খাটিয়ে। কল্পনার জামেয়ারে
সত্তা ঢেকে দেখি ক’টি অপোগণ্ড পোকা ইতিমধ্যে
রূপক করেছে নষ্ট। দর্শনের মেরাপ-বাঁধানো
প্রাঙ্গণ কয়েক বিঘা জুড়ে আছে, একটি জিজ্ঞাসা
ভেঙে চুরে হাজার জিজ্ঞাসা আড়চোখে চেয়ে থাকে
দ্বিধান্বিত নীলিমার দিকে। আমরা চেঁচিয়ে মরি
সমস্বরে- ইতিহাস লেখে কতো কাকের ছা বকের ছা-
পাই না স্তুতির ভাষা। কয়েক পুরুষ অপেক্ষায়
স্থিত হলে হয়তো উজ্জ্বল লোকভাষা জন্ম নেবে,
কবিত্বের শৃঙ্গারে বাড়বে জানি কালের জৌলুস।
আমরা কয়েকজন আমোদ প্রমোদ ক্লান্ত হয়ে
আত্মপরিচয় ঢেকে ব্যক্তিগত বিকারী ধোঁয়ায়
দুশ্চিন্তার উপদ্রবে ছিঁড়ে ফেলি শিল্পের জটিল
অন্তর্বাস, পণ্ড করি, কনাব, তারার শুদ্ধ খেলা।
কী ভ্রান্তিবিলাসে দেখি ধাতুর প্রাসাদে কয়েকটি
অন্ধ ঘোড়া রাত্রিদিন ঘোরে এক অর্থহীনতায়ঃ
তাদের আরোহী নেই, মালিকানা জানা নেই কারো
ত্রিধাতু নির্মিত সেই প্রাসাদের। অন্ধ ও বধির
ঘোড়াগুলি নক্ষত্রে বমন করে, লেজের দাপটে
তাড়িয়ে বেড়ায় খোজা ক্রীতদাস, নগ্ন ক্রীতদাসী
সর্বক্ষণ একই বৃত্তে। অবিবেকী সুরে স্তূপীকৃত
শব হলো ছিন্নভিন্ন, চতুর্দিক নক্ষত্র, বিষ্ঠায়
মতিচ্ছন্ন একাকার। আশেপাশে যা-কিছু চোখের
চাওয়ায় এখনো স্পষ্ট, জোবজগতের সেই সব
আনন্দ সঙ্কট ত্রাস প্রতিক্রিয়া খোঁজে মননের
তীব্র সত্যে, স্বচ্ছতায়। কিন্তু আজো ক’পা বাড়ালেই
পণ্ড হয় চৈতন্যের নব্য নাট্য, মনন গোঙায়!
আমাদের পিতৃপুরুষের চেনা রূপলোক আজ
ব্যঙ্গচিত্র বর্ণাভাসে চৈতন্যের বিনিদ্র নিষ্ঠায়,
জীবন যাত্রার নাটে। যখন বাতিকগ্রস্ত আলো
গাধার চিৎকার হয়ে ফেটে পড়ে ধাতুর চত্বরে,
আমরা কয়েকজন একচ্ছত্র ভীষণ পিতলে
নীলিমা মিশিয়ে কিছু, মানবিক গলিঘুঁজি ঘেঁটে
ভুলে যেতে চাই এই শতকের জলাতঙ্ক, দূর
সমাজের সুখসঙ্গ, ভুল রূপকের খেসারৎ!
সমস্ত আকাশে চাঁদ পিটিয়ে রুপালি কানাস্তারা
আস্তাকুঁড়ে ভাবুককে বেকুব বানায়। অবসাদে
হাই তোলে ইতিহাস। হরিণ এবং খচ্চরের
সংগমে নিতেছে জন্ম অদ্ভুত বেখাপ্পা জন্তু সব।
পৃথিবীকে বদলাতে পারি না আমরা, পারবো না
ওষুধবিষুধ দিয়ে কিংবা ঝাড়ফুঁকে পৃথিবীর
শুশ্রূষা করতে। শুধু কিছু উপমা প্রতীক আর
চিত্রকল্পে শিল্পের শুদ্ধতা দেব ভাষার গতিকে।
বন্ধুর জন্যে
কৌচের কোমলে ডুবে গৃহিণীর গানের বাগানে
হরেক ফুলের শোভা দ্যাখো চোখ বুজে সবখানে,
প্রহর বদলায় রঙ গানে; বন্ধু তুমি প্রেমে
জল হয়ে যাও গলে। হঠাৎ বহতা সুর থেমে
গেলে তুমি “হৃদয় বুড়িয়ে যায় গ্রন্থিল পেশীর
সবলতা ক্রমশ শিথিল হলে? শুধু বিদ্বেষীর
মতো ক্রোধে সহসা ফেলবো খুলে নিজেরই পাঁজর
হাড়ে নিয়ে?”-এইসব প্রশ্ন নেড়েচেড়ে যথারীতি
ক্লান্ত হও, মাঝে-মাঝে শব্দের গন্ধের কিছু স্মৃতি
জিভের ডগায় তুলে হুইস্কির মতো করো পান।
তারপর সবান্ধব রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান
কবিতায় আধুনিক মানুষের আত্মার সন্ধানে
জটিল অরণ্যে করো মৃগয়া প্রচুর! ভিন্ন ধ্যানে
তোমার ছেলেটা দেখি চকখড়ি চকখড়ি চক
ছড়া কেটে ঘরের মেঝেতে বসে নড়বড়ে বক
আঁকে আঁকাবাঁকা টানে (মানে না আঁকার ব্যাকরণ)
হঠাৎ বকের মুখে গেঁথে দেয় তারা অকারণ।
খাঁচার পাখিটা রাগী, নিজেরই নরম ডানা দুটি
করেছে রক্তাক্ত শিকে, কী সুন্দর দুর্বিনীত ঝুঁটি
ক্রমাগত যাচ্ছে ক্ষয়ে ক্ষত হয়ে-তবুও অবুঝ
কেবলি ক’দিন থেকে যেতে চায় বনের সবুজ
পাতায়, রোদ্দুরে, মেঘে।
তুমিও ফিরিয়ে নাও চোখ,
সে কোন অদৃশ্য মোহনায় দ্রবীভূত দুই শোক
অভিন্ন ধারায় বয়। যেহেতু তুমিও জানো বিষ
দিয়ে বিষ ক্ষয় হয়, জীবনতো অন্ধকারে শিস
দিয়ে চলা, ইত্যাদি পাঁচালি,-বুঝি তাই অকাতরে
দুঃখের ফসিলগুলি প্রত্যহ সাজাও থরে থরে।
পেরিয়ে অনেক রাস্তা নাম ধরে ডাক দিই, সাড়া
দাও তুমি, কতোবার আমার অস্থির কড়া নাড়া
শুনে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামো, প্রীত, নিয়ে যাও ঘরে,
আমিও প্রসন্ন হেসে পোষমানা ঘরের আদরে।
প্লাস্টিকের ফুল, মূর্তি কফি সেট- হয় না বিশ্বাস-
থাকবে না চিরদিন। ভয় হয়, সমস্ত নিশ্বাস
শুষে নেয় যেন কেউ। বড়ো ভয় হয়, যদি আর
প্রাণপণে ডেকেও কোথাও না পাই তোমার!