নিজের কবিতার প্রতি
কবিতা আমার ধমনীকে তোর
জোগাই নিত্য রক্তকণা।
হায় রে তবুও তোর জন্যেই
পদে পদে জোটে প্রবঞ্চনা।
হেঁটেছিস পথ গুরুজনদের
শত গজ্ঞনা মাথায় করে।
কাটা ঘুড়ি তুই, বাতাসের লেজ
শাসাচ্ছে তোকে অবুঝ ওরে।
হায় রে দুস্থ কবিতা আমার
তুলে নিলি কোন্ জোয়াল কাঁধে!
কিসের তাড়ায় এখানে যে তোর
চক্ষুলজ্জা খোয়াতে বাধে!
ছেঁড়া কাঁথাটাকে সম্বল করে
কতকাল আর ঘুরবি বল?
নির্বোধ নারী, বাতুল পুরুষ
তোর কাছে চায় সুখের ছল।
অনাবশ্যক মুক্তো ছড়ালি
ফোটালি অলীক কথার খই।
যোগ্য মূল্য দেবে যে তেমন
উলুবনে বল ক্রেতারা কই?
পয়ারে কিংবা মাত্রাবৃত্তে
আঁধারকে দিলি আলোর ধার।
বিশ্বজোড়া সে সন্তাপ ছেঁকে
এনেছিস বটে সত্যসার।
প্রতি পক্ষের বাছা বাছা চাঁই
নিন্দা রটায় কাব্যলোকেঃ
রোগজর্জর এক দশকেই
দারুণ শনিতে পেয়েছে তোকে
খ্যাতির দ্রাক্ষা নাগালে পাসনি
বলেই দিবি কি গলায় দড়ি?
তোর দর্পণে চিরন্তনের
প্রতিবিম্বকে ঈষৎ ধরি।
নিরুদ্দেশ দেয়াল
মুহূর্তে মুহূর্তে ভীতি, বদ্ধ কালা চার দেয়ালের
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মগজের কোষে। এমন কি
মস্তিষ্কে দেয়াল গেঁথে হো-হো হেসে ওঠে বহু লোক,
কোপন স্বভাবী লোক। “কী দরকার দেয়াল-পেরুনো
দৃষ্টির দিব্যতা দিয়ে” বলে তারা অভ্যাসের বশে
সত্তার চৌদিকে তোলে পাথুরে দেয়াল ঝোড়ো হাতে।
যতই নিরেট হোক, দেয়ালটা থাকুক আমাকে
ঘিরে পাহারায়,
দৃষ্টি তবু যায় দূরে, দরজা-জানালা
থাকে পড়ে। পা’দুটো কী করে ব্যস্ততায় খোঁজে পথ
গর্তের ভিতর, যাকে বলি ঘর। ডুসেলডর্ফের
পোড়-খাওয়া পথপ্রান্তে যেতে চাই, অস্ট্রিয়ান বাড়ির বাগানে
যে তরুণী ফুল তোলে, নোয়ায় কম্পিত ডাল, যার
স্তনভারে সূর্যগন্ধী ফলের সোনালি-অন্য মনে
গভীর গোলাপটিকে হাওয়ায় দুলিয়ে জীবনের
মানে বলে বাক্যের অতীত- তারই কাছে সারাবেলা
কেবলি পৌঁছুতে চাই।
কায়রোর কফির দোকানে
এক কোণে বসে বসে দৃশ্য গাঁথি, মিনারের মতো প্রবীণ যে ভদ্রলোক
খাচ্ছেন সুগন্ধ কফি, ইচ্ছে হয় বলি তাঁকে, “কেমন আছেন?”
ন্যুইয়র্কে যে বালক বল নিয়ে লাফাতে লাফাতে
ঘোরানো সিঁড়িতে ওঠে, ছায়া দেখে ভয় পায়, তাকে বুকে নিয়ে
হরবোলা সেজে জেনে নিতে চাই কী যে তার নাম। ক্যাথিড্রাল
বড়ো রাস্তাটার ডান দিকে রেখে ইচ্ছে হয় গ্র্যাণ্ড ক্যানালের
গণ্ডোলায় দুলি কিছুক্ষণ, দু’দণ্ড বিশ্রাম নিই
প্যারিসের বুলেভারে কিংবা বুদোয়ারে। হাঙ্গেরির
শাদা বাড়িটার
সুদৃশ্য কার্ণিশ ঘেঁষে ভোরের আলোয় মাখা যে পায়রাগুলো
উড়ে যায়, শূন্যতাকে চেয়ে বার বার,
মাদ্রিদের লিরিক জ্যোৎস্নায় আধ-পাগলা যে লোকটা
গত শতকের ঢের কুহক সঞ্চারী শোকগাথা করছে রচনা আর
গীটার ধ্বনিতে এলদেরাদোর ছবি চৈতন্যে জাগায়,
ছন্নছাড়া তাকে, সেই পায়রাগুলোকে
চোখ ভরে দেখবার, সবখানে পৌঁছুবার, রেড স্কোয়ারের
মিশ্র ভিড়ে, পিকিং-এর প্রাণের মেলায়, সবখানে
পৌঁছবার খোলা রাস্তা চাই।
টপকে প্রাক্তনী চোরাবালি হঠকারী যে মদ্যপ
অমিত্রাক্ষরের মায়ামন্ত্রে সেই ঊনিশ শতকে
সমুদ্রে ভাসালো পোত, আমি তার উত্তরাধিকারী-
শিরায় শব্দের ঝোড়ো গান, চৈতন্যের নীলিমায়
সারসের পক্ষধ্বনি শুনি, কী আবেগে অকস্মাৎ
দেয়াল চাহিদ হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ।
পিতলের বক
(আবুল হোসেনকে)
এতদিন আছি তার কাছাকাছি তাই দুটি চোখে
দেখেছি কৌতুক শ্লেষ, টকরো হাসি। স্তব্ধতায় ঠায়
টেবিলে দাঁড়িয়ে আছি আঠারো বছর এক পায়
ধ্যানী আলো-অন্ধকারে। প্রতিদিন তার প্রাণলোকে
কতো কী-যে ঘটে দেখি, ঘোরালো তর্কের তীক্ষ্ণ নখে
ছেঁড়ে ঢের জটিল তত্ত্বের সূত্র, কাটায় হেলায়
সময় শব্দের প্রেমে, বুদ্ধির দেউড়ি আগলায়
সারাক্ষণ। বাষ্পাকুল হয় না সে আনন্দ কি শোকে।
কিছুতে পাই না ভেবে কৌচে বসে কী-যে বলে অত
বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের সঙ্গে রোজ। না খাদ্য, না ঘুম
কিছুই পারে না তাকে বাধা দিতে; হয়তো নিছক
বাজে কথা, গা ভাসায় তবু সেই স্রোতে অবিরত।
যদিন মেয়েটা গেলো, কাঁদলো সে নিশ্চুপ নিঝুম
পুরাণ
হে পিতৃপুরুষবর্গ তোমরা মহৎ ছিলে জানি,
রূপদক্ষ কীর্তির প্রভাবে আজো পাতঃস্মরণীয়,
সে কথা বিশ্বাস করি। যে-প্রাসাদ করেছো নির্মাণ
প্রজ্ঞায় অক্লান্ত শ্রমে, জোগায় তা কতো ভ্রাম্যমাণ
চোখের আনন্দ নিত্যঃ অতীতের ডালপালা এসে
চোখে-মুখে লাগে আর ফুটে ওঠে সৃষ্টির বিস্ময়।
আরো গাঢ় অন্ধকারে ভিজিয়ে শরীর পেঁচা, কাক
অথবা বাদুড় আসে শূন্য কক্ষে বিশাল প্রাসাদে
উত্তরাধিকারী খোঁজে, কিন্তু কিছুতেই কোনোখানে
মানবের কণ্ঠস্বর হয় না ধ্বনিত। অলিন্দের
অন্ধকারে ওড়ে শুধু কয়েকটি দারুণ অস্থির
চামচিকে। লেপ্টে থাকে দুর্বোধ আতঙ্ক স্তব্ধতায়।
দূরত্ব বজায় রেখে দেখে সব খিলান, গম্বুজ
ইত্যাদিতে জমেছে শ্যাওলা আর সিংহ দরজায়
হিংসুক সময় তার বসিয়েছে থাবা। প্রশংসিত
কীর্তিস্তম্ভে ঝরে যাচ্ছে বহু প্রতিবিম্ব পুরাণেরঃ
বিধ্বস্ত ভাঁড়ার ঘরে অতীতের সারসত্য, সব
ভাবনাকে আনায়াসে খুঁটে খায় ইঁদুর, আরশোলা।
হে পিতৃপুরুষবর্গ আমাকে ভেবো না দোষী যদি
এ প্রাসাদ বসবাসযোগ্য মনে না-হয় আমার,-
কেন না এ-সৌধ আর মরচে-পড়া তালার বাহার
করে না বহন কোনো অর্থ অন্তত আমার কাছে।
তোমাদের কারুকাজে শ্রদ্ধা অবিচল, কিন্তু বলো-
কী করে পিতার শব কাঁধে বয়ে বেড়াই সর্বদা?
আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন,
তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পরাণে।