চতুর্দশপদী
মনে পড়ে কোনোদিন আমাদের আবদ্ধ জলায়
চিলে তুমি রাজহংসী। শ্যাওয়ার পিছল সবুজে
কখনো হয়নি ম্লান শাদা পাখা, আলো খুঁজে খুঁজে
গ্নণ্ডি ছেড়ে চলে গেছো বহু দূরে। তোমার চলায়
এ-কাল মেলেছে দল। প্রতারণা কি ছলাকলায়
আনোনি বিভ্রম কোনো মগ্ধ চোখে; স্বপ্নের গম্বুজে
বাধোনি সুখের বাসা মসৃণ আরামে চোখ বুজে
এবং হওনি বিদ্ধ শিকারীর তীরের ফলায়।
জলার কাদায় আজো আমাদের চঞ্চু, পাখা ডোবে,-
মজে থাকি অধঃপাতে। মধ্যে-মধ্যে হাই তুলি, ভাবি
এখন কোথায় তুমি? বুঝি না দারুণ সর্বনাশ
পেতেছে জটিল ফাঁদ আমাদের অস্তিত্বের লোভে।
উড়ো কথা কানে আসেঃ মেটাতে এ জীবনের দাবি
ইতিমধ্যে এমন কি তুমিও হয়েছো পাতিহাঁস।
জনৈক সহিসের ছেলে বলছে
ঘোড়ার নালের মতো চাঁদ
ঝুলে আছে আকাশের বিশাল কপাটে, আমি একা
খড়ের গাদার শুয়ে ভাবি
মুমূর্ষু পিতার কথা, যার শুকনো প্রায়-শব প্রায় অবাস্তব
বুড়োটে শরীর
কিছুকাল ধরে যেন আঠা দিয়ে সাঁটা
বিছানায়। গতায়ু হবেন যিনি আজ কিংবা কাল,
অথবা বছর ঘরে, আপাতত ভাবছি তাঁকেই,
তাঁকেই ভাবছি যিনি ঘোড়াকে জরুর মতো ভালোবেসেছেন
আজীবন। মুমূর্ষু পিতার চোখে তরুণ ঘোড়ার
কেশরের মতো মেঘ জমে প্রতিক্ষণ। মাঝে-মাঝে
তাঁকে কেন যেন
দুর্বোধ্য গ্রন্থের মতো মনে হয়, ভাষা যার আকাশ-পাতাল
এক করলেও, মাথা খুঁড়ে মরলেও
এক বর্ণ বুঝি না কখনও।
“জকির শার্টের মতো ছিল দিন একদা আমারও,
রেসের মাঠের সব কারচুপি নখের আয়নায়
সর্বদা বেড়াতো ভেসে। প্রতিদিন গলির দোকানে
ইয়ার বন্ধুর সাথে চায়ের অভ্যস্ত পেয়ালায়
দিয়েছি চুমুক সুখে। বিড়ির ধোঁয়ায় নানারঙ
পরীরা নেচেছে ঘুরে আর অবেলায়
কোথাও অশেষ স্বপ্ন ভাড়া পাওয়া যাবে ভেবে কতো
অলিগলি বেড়িয়েছি চষে আর রাতের বাতাসে
উড়িয়ে রুমাল হেসে শক্রতা, ব্যর্থতা ইত্যাদিকে
কাফন পরিয়ে
আপাদমস্তক
‘বলোতো তোমরা কেউ স্বপ্ন ভাড়া দেবে’-
বলে তীব্র কণ্ঠস্বরে মাথায় তুলেছি পাড়া, ভাগ্যদোষে পাইনি উত্তম।
“রাজা-রাজড়ার দিন নেই আর ছাপার হরফে
কত কিছু লেখা হয়, কানে আসে। ছোটো-বড়ো সব
এক হয়ে যাবে নাকি আগামীর সখের নাটকে!
বর্তমানে এ দেশের স্ত্রী-পুরুষ সাপের পাঁচ পা
হঠাৎ দেখেছে যেন। দিনগুলি হিস্টিরিয়া রোগী”-
কখন ও মুমূর্ষু পিতা ঘোড়ার উজ্জ্বল পিঠ ভেবে
সস্নেহে বুলোন হাত অতীতের বিস্তৃত শরীরে।
মাঝে-মাঝে গভীর রাত্তিতে
দেখেন অদ্ভুত স্বপ্নঃ কে এক কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়া উড়িয়ে কেশর
পেরিয়ে সুদূর
আগুন রঙের মাঠ তাঁকে নিতে আসে।
অথচ আমার স্বপ্নে রহস্যজনক ঘোড়া নয়,
কতিপয় চিম্নি, টালি, ছাদ, যন্ত্রপাতি, ফ্যাক্টরির
ধোঁয়ার আড়ালে ওড়া পায়রার ঝাঁক
এবং একটি মুখ ভেসে ওঠে, আলোময় মেঘের মতোই
একটি শরীর
আমার শরীর মেশে, আমি স্বপ্নে মিশি,
রুপালি স্রোতের মতো স্বপ্ন কতিপয়
আমার শরীরে মেশে, আমি মিশি, স্বপ্ন মেশে, আমাকে নিয়ত
একটু একটু করে স্বপ্ন গিলে ফেলে।
তিনটি ঘোড়া
তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ,
বন্য কেশরের জ্বলছে বিদ্যুৎ।
চোখের কোণে কাঁপে তীব্র নরলোক,
তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ।
আকাশে মেঘদল সঙ্গ চায় বুঝি,
মাটির নির্ভর উঠছে দুলে শুধু।
বাতাসে ঝলমল মুক্ত তলোয়ার,
তিনটি তলোয়ার আঁধারে ঝলসায়।
স্বপ্নহীনতায় স্বকাল হলো ধু-ধু,
স্বস্তি নেই খাটো মাঠের মুক্তিতে।
খুরের ঘায়ে ওড়ে অভ্র চৌদিকে,
তিনটি শাদা ঘোড়া স্বপ্ন তিনজন।
শূন্যে মেঘদল যাচ্ছে ডেকে দূরে,
মেঘের নীলিমায় দেয় না ধরা তারা;
লক্ষ গোলাপের পাপড়ি ওঠে ভেসে,
অন্ধকারে যেন মুখের রেখাগুলো।
তিনটি ঘোড়া বুঝি সাহস হৃদয়ের,
ত্রিকাল কেশরের শিখায় জাগ্রত।
শূন্য পিঠে ভাসে মুকুট উজ্জ্বল,
তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ।
তিনটি হাঁস এবং পিতামহ
রাস্তার লোকটা সেই তিনটি নিস্তব্ধ হাঁস রেখে
চলে গেলো, প্রায় কিছু না বলেই লম্বাটে পা ফেলে
অন্তর্হিত; যেন বোবা, ক্ষমাপ্রার্থী হয়তোবা। দেখি
স্কুটার-দলিত শাদা-লাল হাঁসগুলো বারান্দার
কংক্রীটে নিঃসাড় চঞ্চু রেখে নির্বিকার পড়ে আছে
মূক বেহালার মতো।
তাদের শরীর ছুঁয়ে বুঝি
বহু যুগ বয়ে গেছে প্রবল হাওয়ার। কে বলবে
ওরা তিনজন মৃদু ঘুরতো বাগানে, খেতো খুঁটে
খুদকুঁড়ো, তুলতো গুগলি কিছু পুকুরে ফুলের মতো ভেসে
কোনে দিন? এখন তো তারা শুধু তিনটি স্তব্ধতা
বারান্দায়, আমাদের স্নেহের ওপারে। ছায়াচ্ছন্ন
বারান্দায় দৃষ্টি মেলে জেদী পিতামহ
তাঁর অন্ধকার ঘরে একা
সমুদ্রের ঢেউয়ের ফেনার মতো চূল নেড়ে নেড়ে
-যেন সেই ঝড়ের রাতের রাজা, উন্মত্ত লীয়ার-
চতুর্দিক আর্তনাদে দীর্ণ করে বললেনঃ “ওরে
ফিরিয়ে আনলি কেন শীতল কংক্রীটে?
এখ্খুনি নিয়ে যা তোরা, আমার স্বপ্নের শবগুলি
ফিরিয়ে আনলি কেন? নিয়ে যা, নিয়ে যা!”
দাগ
“না, আমি কস্মিনকালে তোমার এ নৈঃসঙ্গ্য ঘোচাতে
পারবো না”, বলে তুমি সেই ছোট ঘরটি গোছাতে
মন দিলে। এটা-সেটা নেড়ে চেড়ে তুলে নিলে দুল
বালিশের নিচে থেকে, পরলে আবার। এলোচুল
সহযে বিন্যস্ত হলো; পরিচিত গন্ধমাখা ঘরে
বিধ্বস্ত স্নায়ূর রাজ্য, বন্দী আমি ভয়ের নিগড়ে!
বুঝি তাই অকস্মাৎ বুকে টেনে নিলাম তোমাকে
সংক্রামক হতাশায়। বললামঃ “হত্যা করো তাকে,-
আমার এ নৈঃসঙ্গ্যকে; তোমার স্বপ্নের পাটাতনে
তুলে নাও হাত ধরে। বাকল-বঞ্চিত গাছ বনে
যেমন দাঁড়িয়ে থাকে তেম্নি তুমি থাকে আজ পাশে,
আলিঙ্গনই জানি রক্ষাকবচ এমন সর্ব নাশে।“
নৈঃসঙ্গ্য হত্যায় মেতে খুলে নিলে দুল, নিরুত্তাপ
বালিশে নামলো কালো উচ্ছল প্রপাত। কার ছাপ
খুঁজি তবু সবখানে? উন্মীলিত তোমার দু’চোখ
আমার চোখের নিচে, যেন দুটি সভ্যতার শোক
ভ্রষ্টলগ্নে শুধু কাঁপে পাশাপাশি। দু’চোখের তটে
সে মুহূর্তে দেখি মহাপ্লাবনের দাগ জেগে ওঠে।