কোথাও পারি না যেতে
(টি , এস এলিয়টকে নিবেদিত)
আমরা ভেবেছিলাম খড়ে-ঠাসা মাথা নিয়ে শুধু
হবে না ঘুরতে আর সাত পুরুষের
বিধ্বস্ত ভিটায় কিংবা জনশূন্য অলিতে গলিতে
প্রলাপের ঝোঁকে
হবে না কুড়াতে বুঝি সময়ের সুতীব্র ধিক্কার।
যাত্রারস্ত হয়েছিলো মনে,
তোমাকে সুদূর কোনো পিতামহ ভেবে
মহানন্দে বাড়াবো পা নতুন যুগের চৌমাথায়।
হা কপাল! তোমারই গণ্ডিতে
এখনও রয়েছি বাঁধা, জানি
চুকানো যায় না ঋণ বুড়ো মোড়লকে
কানাকড়ি দিয়ে।
অস্তিত্বের চতুর্দিকে কখন দেয়াল
হয়ে গেছে গাঁথা,
এখন সেখানে মাথা ঠুকে
কী ভীষণ অর্থহীন অলীক ভাষায়
পরস্পর কথা বলি, ঘেন্নায় দেখি না মুখ কারো।
যখন-তখন ভয় পাই, চমকাই
নিজের বিকৃত ছায়া দেখে
আর মনে হয়
সবকিছু মেরামত সাপেক্ষ এখনো,
তাই ‘মিস্তিরিকে ডাকো’বলে
ভীষণ চেঁচিয়ে উঠি
সামনের সিঁড়ির পাশে
ধ্বংসের রাজধানীতে!
আমাদের চতুর্দিকে রাস্তা খোলা, তবু
কোথাও পারি না যেতে। কে এক চতুর
বাজিকর শস্তা কিছু আলোর খেলায়
সর্বদা মাতিয়ে রাখে, স্ফুর্তি জাগত!
বন্ধুর কামিজ কোর্তা অকাতরে নিজের বলেই
হামেশা চালিয়ে দিচ্ছি, আমি খাঁটি নবীন যুবক।
শস্তা নভেলের খালে চালাই নিরুদ্ধ কামনার
বেসামাল নৌকোটিকে। আমার ভোটাধিকার নেই
জীবনের নির্বাচন কেন্দ্রে আমি ব্যালট পেপার
হারিয়ে ফেলেছি যেন, পাতিপাতি করে খুঁজি তবু
পাই না হদিস তার। পক্ষান্তরে জীবনকে বলিঃ
কী খেল দেখালে ভায়া, বেধড়ক বসিয়েছো পথে
এবং নিয়েছো কেড়ে ছলে বলে সব পুঁজিপাটা।
প্রত্যহ বন্ধুরা বলেঃ “কেন শুধু আগুনের ঝড়ে
বল তো কিসের মোহে রাত্রিদিন পাখা পোড়াচ্ছো হে?
চেয়ে দ্যাখো কয়েকটি যুবা,-বাক্সর্বস্বের দল-
হাঁটু মুড়ে বেপরোয়া দুরাশার মহান চত্বরে
রাত্রিকে করছে পান ক্রমাগত চাঁদের গেলাশে!
তুমি শুধু ভয় পাও, যেন আর্ত হরিণের চোখে
জটিল লতার ছায়া, অথবা বাঘের থাবা কাঁপে।
উপদ্রুত কেরানীর বিশুষ্ক মুখের মতো যাচ্ছেতাই এক
অন্ধকারে আমরা স্বপ্নের
গলা টিপে নানাবিধ হত্যাকাণ্ডে মাতি,
কখনো আবার
জীর্ণ হোটেলের
টেবিলে চিবুক রেখে বলি, আমাদের মনীষাকে
বয়স্ক করেছো ভরে আমাদের সংকীর্ণ আকাশ।
জনাকীর্ণ পথে হাঁটি, আওড়াই ধ্যানমগ্নতায়ঃ
হতশ্রী জীবনে
কিছুটা পালিশ দাও প্রভু, জানতাম
একদা ফ্লেবস ছিল সুকান্ত পুরুষ, দীর্ঘকায়।
কোনো অশ্বারোহীকে
মধ্যযুগের পুরু মৃত্তিকা ফুঁড়ে
হঠাৎ এসেছো, শরীর বীরের ঢং।
পাথুরে জমিতে আলোর ফুলকি ওড়ে,
বর্ম তোমার অনেক জবরজং।
ঘোড়ার খুরের শব্দে চমক লাগে,
নগরবাসীর জিজ্ঞাসু চোখ জ্বলেঃ
“অবেলায় এলো এ কোন্ অশ্বারোহী”
প্রাক্তন ঘোড়া ভড়কালো কোলাহলে।
কারুকাজময় গবাক্ষে হাত রেখে
দয়িতা তোমার দাঁড়াবে না ব্রীড়াভরে,
দেখাবে না পথ ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে;
এখন সে লোটে নিয়ন-দীপ্ত ঘরে।
জয়ের নেশায় রক্তগোলাপ দেখে
তুমি বিবিক্ষু একেলে বিসংবাদে?
স্বেদাক্ত ঘোড়া দ্বিধায় দুলকি চলে,
অজানা পথের চিহ্ন বুঝতে বাধে।
তুমি কি বোঝো না ডুয়েলের দিন গত?
তবে কেন বৃথা উঁচিয়ে নগ্ন অসি
তেড়ে আসো আজো একালের পোড়ো মাঠে?
প্রাচীন জরিতে ছড়ায় কালের মসী।
ড্রাগন হননে সুবেশ অশ্বরোহী
এসেছো উড়িয়ে অনেক যুগের ধুলি?
তোমার সুনীল ঘোড়ার খুরের ঘায়ে
পালকের মতো উড়ছে মড়ার খুলি!
ড্রাগনের দিন হয়নিকো অবসিত,
কিন্তু তোমার বর্শা অকেজো আজ।
দ্যাখো ভীষণের নৃত্যনাট্য দ্যাখো,
দ্যাখো জনপথে জন্তুরা জাঁহাবাজ।
তোমার বর্ম অথবা অশ্ব দেখে
উঠবো কি মেতে অর্বাচীনের মতো?
ভুলিনি ভীষণ রক্তবমন আজো,
এখনো কাঁদায় মহাসমরের ক্ষত।
লুপ্তি ঘনায় সব দিগন্ত জুড়ে,
পাঁজর-খাঁচায় পিশাচের তাল গুণি।
কার নিঃশ্বাসে ফুলেরা ভস্মীভূত?
নিরুপায় শুধু ধ্বংসের কাল শুনি।
এ যুগের আঁধি রুখবে কি দিয়ে বলো?
লুকা ও বরং অতীতের কোনো গড়ে।
বল্লম আর সাধের শিরস্ত্রাণ
শোভা পাক আজ ঘুমন্ত যাদুঘরে।
খেলনা
আমার মেয়েকে দেখি বাড়িটার আনাচে কানাচে
বেড়ায় আপন মনে, ফ্রক-পরা। খেলাঘরে তার
রকমারি খেলনা নিয়ে সকাল-বিকাল মেতে আছে।
দেখি রোজ ঘটা করে পুতুলের বিয়ে দেয় আর
ছোটায় কাঠের ঘোড়া তেপান্তরে, সমুদ্রে ভাসায়
সপ্তডিঙা। মায়ের গজ্ঞনা কিংবা পিতার নিষেধ
মানে না কিছুই, শুধু পুতুল-ভাঁড়ের তামাশায়
হাসে, নাচে ছড়ার ঘরোয়া ছন্দে, নেই কোনো খেদ।
আমারও খেলার শখ আশৈশব, খলনার রূপক
স্বকালে করেছে ভিড়, তাই দৃশ্যান্তরে খলনাগুলি
কতিপয় শস্তা বুলি আর নষ্ট ধারণার ছক
মনে হয়। সংসার-জলার কাদা ঘেঁটে ছেঁকে তুলি
রঙচটা ভাঙা মূর্তি-মন আর বসে না খেলায়,
খেলনা ফেলে বসে থাকি নিরুপায় আজ অবেলায়।
ঘৃণায় নয়
অতীতের মায়াবী পাহাড় থেকে এ বর্তমানের
নিবিড় উপত্যকায় এসে দেখি জীবন ফিরিয়ে
আছে মুখ অন্ধকারে। একজন বৃদ্ধ গাঢ় স্বরে
বললেন হাত ছুঁড়েঃ “সৌন্দর্য, মহত্ত্ব সত্য আর
সদ্গুণ ইত্যাদি রক্ষা করো, রক্ষা করো এ বাগান-
যেখানে পাখির গান শিল্পের প্রতীক খোঁজে প্রতি
লাল নীল ফুলে স্তব্ধ পাথরে মনের অস্তরাগে,
যেখানে হাতের মুঠো ভরে যায় সোনালি পালকে।“
অন্ধকার জীবনের বাগানে নিগ্রোর মতো শুধু
আর্তনাদ করে ওঠে, মহত্ত্ব পিছল নর্দমায়
ভেসে যায়, সৌন্দর্য কবরে পচে, সত্য অবিরাম
উদ্ভ্রান্ত ভিখিরী হয়ে ঘোরে মনীষার মন্বন্তরে।
আমার শয্যায় দেখি অজস্র মৃত্যুর ছায়া আর
হাজার হাজার ঘোড়া খুরের আঘাতে, কেশরের
আন্দোলনে আবার জাগাতে চায় মৃত শতাব্দীকে
আমার শরীরে, চোখে। আমি ছিন্নভিন্ন অন্ধকারে।
একমুঠো তারা দিয়ে যদি কেউ আমার পকেট
ভরে দেয় কিংবা কতিপয় জনপ্রিয় খেলনা দেয়
হাতে তুলে-তবু আমি হাতের শিকড় দেব মেলে
জীবনের সমৃদ্ধ মাটিতে, স্বর হবো আশ্চর্যের।
ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাকে কাগজের মতো
যদি গুঁজে দেয় কেউ হাতে, টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে
এক ফুঁয়ে পারবো না হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে সব।
কেননা শিখিনি ঘৃণা, বস্তুত ঘৃণায় নয় জানি,
প্রেমেই মানুষ বাঁচে। চিরদিন বিমুগ্ধ নিষ্ঠায়
তাই শাদা চাঁদ কাফ্রি-রাত্রির প্রেমিকা পৃথিবীতে।