কবিতার অস্তঃপুরে
যেতে চাই, আকৈশোর মগ্নতায়, অতি সন্তর্পণে
স্বপ্নের নীলাভ সাঁকো বেয়ে
কবিতার অন্তঃপুরে যেতে চাই। হয়তো সেখানে
রহস্যের ফটক পেরিয়ে
দেখবো আছেন সেই আমর বাগানে
নয়জন ভুবন-মোহিনী;
নয়টি নিবিড় নীল চেয়ারে হেলান দিয়ে বুনছেন কিছু
অন্তহীন সোনালি সূতোয়।
ফুলগুলি (হল্দে, লাল, সুনীল, বেগুনি)
বাতাসে নর্তকী যেন। কেবলি হোঁচট খাই, সার্চ লাইটের
ঝাঁ-ঝাঁ আলো দেখাবো না পথ জানি, তবু যেতে চাই
উজিয়ে সকল বাধা প্রেমিকের মতো।
হয়তো সেখানে
দেখবো রাস্তার ধারে চিতাবাঘ সূর্যমুখী ফুলে
মুখ রেখে বাঘিনীর স্মৃতি আনে ডেকে
কিংবা কাকাতুয়া কোনো দাঁড়টাকে তার
বানিয়ে চাঁদের নৌকো আহলাদে দুলছে সর্বদাই।
রঙিন ধুলোর পথে মনে হবে বিকেলের আলো
সুন্দরবনের
তরুণ জ্বলন্ত বাঘ হয়ে ফের নেমেছে নদীতে!
দেখবো চকিতে,
কয়েকটি ঘোড়া দ্রুত কাকে যাচ্ছে নিয়ে,-
বৃষ্টির সুরের মতো আরক্ত কাঁকরে খুর বাজে,
খুর বাজে শুধু।
সুবচনী হাঁস নিয়ে খেলছে বালক, জানালার
অনেক বাইরে ঝুঁকে ডাকছে মা বেলা গেলো বলে।
বারান্দায় একা বসে কে এক প্রবীণ ভদ্রলোক
নিমগ্ন দান্তের কাব্যে, সূর্যাস্তের গাঁদা ফুল-রঙ
বিশুষ্ক ফলের মতো মুখে পড়ে; জানু বেয়ে তার
একটি চঞ্চল শিশু উঠছে নামছে বার বার।
ইহুদীটা শহরের বাড়িগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে উড়ে,
থলি কাঁধে, জীর্ণ টুপি নড়ছে মাথায়। কোনোমতে
কাকের চোখকে দিয়ে ফাঁকি
কেউবা ছিঁড়ছে রুটি, ক দিনের বাসি, নড়বড়ে
পাঁচিলের ধার ঘেঁষে। কাকগুলি পাখা ঝাপটায়
নগরের সুবিশাল নীলপক্ষ ঘড়ির আয়নায়।
ছাদের চূড়োয় বুঝি একা কেউ বাজায় বেহালা
ভুল সুরে। মধ্যরাতে উলঙ্গ গাধার পিঠে কেউ
গান গায় তারস্বরে। কী যেন পুড়ছে ভয়ানক
শব্দ করে, সভ্যতার বিশ্বস্ত দলিল হয়তোবা।
নিমেষেই সমস্ত শহর
দেখবো কী করে হয়ে যায় ফণিমনসার বন
-এইতো মিশ্রিত চিত্র (সব নয়) সেখানে ছড়ানো।
মেঘ রৌদ্র, এভেনিউ টেলিগ্রাফ তার ইত্যাদির নাম ধরে
ডেকে-ডেকে যাবো চলে ঐ কবিতার অন্তঃপুরে।
কমা সেমিকোলনের ভিড়ে
বিচিত্র হিংসুক ভিড় শিল্পকে প্রচণ্ড লাথি মেরে,
তীব্র কোলাহল করে বোধগুলি আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে
ফেলে দিলো, যেন ছেঁড়া হলুদ কাগজ। ক্রমাগত
সময় তাড়িত তারা, ঘোরে ঘূর্ণিপথে, বাঁশিগুলি
তাদের রোমশ হাতে গুঁড়ো হয়, চতুর্দিকে শুধু
বেজে ওঠে ক্যানাস্তারা। জীবন দু’হাতে ঢাকে কান!
কমা সেমিকোলনের ভিড়ে এ জীবন কখনো বা ঢ্যাঙা এক শূন্যতায়
ভীষণ হাঁপিয়ে ওঠে, পালাই পালাই বলে রোজ
প্রহর হত্যার দায়মুক্ত হতে চায়, মুখ থুবড়ে পড়ে দেখি
কেমন খুঁড়িয়ে হেঁটে স্মরণীয়ভাবে গলি আর এভেনিউ
নিঃসঙ্গ পেরিয়ে যায়, বেলাশেষে হয়তোবা ঝুলে থাকে বাসে।
ডানে কিংবা বামে লতাগুল্ম, তৃণদল
কিছুই পড়ে না চোখে, নিরুপায় রক্তচক্ষু মেলে
দূর নীলনবঘনে।
“এ-ও ভালো শুকনো ডালে ঝুলে ঝুলে তুমি
প্রতিদিন রাজহাঁস হওয়ার রুটিন-বাঁধা স্বপ্নে মশগুল,
এ-ও ভালো রঙরেজিনীর কিছু রঙ ধার নিয়ে কদাচিৎ
নিজের আত্মার চিত্র মনোহারী করার নিখুঁত
প্রয়াসে নিমগ্ন থাকা, ছুঁড়ে ফেলে দেয়া দূরে নিরঙ বুরুশ-
এ-ও ভালো; ভালো এই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা মরজগতের
শিল্প সব, চেয়ে দেখা যা-কিছু লুকানো
রহস্যের রুপালি আধারে, ভালো কমা সেমিকোলনের ভিড়ে
“নিমজ্জন। অতঃপর নানান ফুলের ডাঁটা নিয়ে শূন্য বুকে
বেপরোয়া নিদ্রা যাওয়া ভালো, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পালা
এলেই নিশ্চিত জেনো চুকে যাবে সব পাট। দ্যাখো
সারাক্ষণ কারা যেন সুন্দর পাখির ঝাঁক প্রত্যহ দু’বেলা
পোড়াচ্ছে ফার্ণেসে” বলে এ জীবন ভাঙ্গা হাঁটু গেড়ে
বসে গৃহকোণে আর মাথা রাখে স্বপ্নহীন ক্ষুধিত দেয়ালে।
কাননবালার জন্যে
একদা তোমার নাম হাটে মাঠে ঘাটে, সবখানে
গুজ্ঞরিত হতো জানি। বড়ো মিঠে তোমার সংলাপ
মুখস্থ করতো যারা রাত্রিদিন, তাদের উত্তাপ
জোগাতে মোহিনী রূপে-এ দশকে আজ তা কে জানে!
বিজয়িনী তুমি, তাই সেলুনে কি পানের দোকানে
রবীন্দনাথের পাশে ঝুলতো তোমার ফটোগ্রাফ,
দেখতাম; সে আশ্চর্য বাবুবিলাসের যুগে-সাফ
মনে পড়ে-ছিলে বহু যুবকের বিনিদ্র শিথানে।
কাল তার ত্র্যালবামে কিছুতে রাখে না সব ফটো,
দেয় ঠেলে আস্তকুঁড়ে; সময় বেজায় জাঁহাবাজ।
বুঝি তুমি তাই লোকলোচনের আড়ালে, মলম
পারে না রুখতে আর জরার আঁচড়। বড়ো-ছোটো
পানের দোকানে ঝোলে অন্যান্য বালার ছবি আজ,
নেপথ্যে জীবনী লেখে পুরোদমে ভৌতিক কলম।
কেমন ক’রে শেখাই তাকে
কেমন করে শেখাই তাকে
ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে
জ্বাল্তে তারার বাতি,
যখন কিনা আমরা নিজ
অন্ধকারে শুধুই ভিজে
কাদা ছোঁড়ায় মাতি!
কেমন করে শেখাই তাকে
ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে
বলতে সত্য কথা,
যখন কিনা মিথ্যা থেকে
আমরা নিজে শিখছি ঠেকে
চতুর কথকতা!
কেমন করে শেখাই তাকে
ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে
বাসতে শুধুই ভালো,
যখন কিনা রাত্রিদিন
আমরা নানা অর্বাচীন
হচ্ছি ঘৃণায় কালো।
কেমন করে বলি তাকে
ছোট্ট অবুঝ শিশুটাকে
‘আস্থা রাখো ওহে’!
যখন কিনা বিশ্ব জুড়ে
আমরা শুধু মরছি ঘুরে
নাস্তিকতার মোহে।
কোথাও কেউ নেই
আকাশে চঞ্চল মেঘের কারুকাজ,
বর্ষা সেতারের বাজালো ঝালা আজ।
একটি সুর শুধু শুনছি ঘুরে ফিরে-
সে সুর বাজে যেন আঁধার চিরে চিরে।
বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা,
কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।
বজ্রে কেঁপে উঠি, বিরহ মেলে দল;
হৃদয়ে ঝরে জল কেবলি অবিরল।
কৌতূহলে হাত বাড়াই ডানে বামে,
আঁধারে শূব্যতা, হতাশা বুকে নামে।
বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা,
কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।
আমার পৌরুষ অবুঝ পাখি হয়ে
আঁধারে মুখ রেখে কাঁদে না লোকালয়ে।
তবুও মেঘেদের অকূল হুতাশনে
স্মৃতির লোকালয়ে পড়ছে কাকে মনে?
বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা,
কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।
আকাশ ঢেকে গেছে নীলাম্বরে আজ,
ভাবছো কোন ছলে করবে তুমি সাজ?
আপন অঙ্গ তো চেনাই হলো দায়।
কী মেঘে বিদ্যুৎ লুকিয়ে ভীরু পায়?
কেমন করে বলো নামবে তুমি পথে!
পারতে যদি সেই নীলাম্বরী হতে!
আমার অঙ্গনে সিক্ত এলোচুলে
আঁচলে মুছে মুখ দাঁড়ালে নাকি ভুলে?
আমার অঙ্গন আঁধারে হলো বন,
নিয়েছি বুক পেতে জলের দংশন!
বাইরে কিছু যায় না জানি দেখা,
কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।