আমার ছেলেকে
খবদ্দার খোকা তুই কোনোদিন শিল্পের মৃগকে
দিবিনে ঘেঁষতে ত্রিসীমায়। বরং ডিঙিয়ে বেড়া
ভাষ্য, টীকা, দর্শনের মহানন্দে নিশ্চিন্দির ডেরা
বাঁধিস মনের মতো। জীবনকে সঁপে দিয়ে ছকে
বাজাবি ঢোলক নিত্য; চাকরির চরম নাটকে
সাজলে বিখুঁত হুঁকোবরদার, সমাজের সেরা
মুরুব্বির তল্পি বয়ে সামলালে নথিপত্র ঘেরা
অস্তিত্বকে, পৌঁছে যাবি উন্নতির প্রশস্ত সড়কে।
অক্ষান্তরে শিল্পের আঁতুড়ঘরে আছে কালকূট
হতাশার। রাত্রিদিন বিষাক্ত হাওয়ায় শ্বাস টেনে
কী পাবি অবুঝ তুই? অন্তহীন যন্ত্রণা, বিষাদ
অথবা পতন শুধু। সাফল্যের বিখ্যাত মুকুট
ক’জনের ভাগ্যে জোটে? তার চেয়ে স্থুলচর্ম বেনে,
বীমার দালাল হওয়া ভালো, ভালো ফুর্তির আস্বাদ।
একজন পাইলট
আকাশকে ধন্যবাদ। এ শূন্যতা, এই নীল আমাকে বাঁচায়,
রইলাম চিরঋণী। এনামেল-মসৃণ উধাও মেঘদল
ছুঁয়ে যায় এরোপ্লেন; ক্রমাগত উঠছি উপরে,
যাচ্ছি চলে দূরে ফেলে বিন্দু
বিন্দু মাঠ,
গাছ পালা,
সরু নদী,
দপ্দপে
লোকালয়, সব কিছু দূরে ফেলে। আমার সত্তায়
বাজে নীলিমার স্তব; আকাশের অকূল সাহারা
চষে চষে কী বেল কী জুঁই
প্রত্যহ ফোটাতে চাই বুঝি না কিছুই। নীলিমায়
প্রপেলর গুজ্ঞনে মৃত্যুকে ভুলে থাকি প্রহরে প্রহরে।
না, আমি কখনও আর নিচে নামবো না,
নামবো না, নামবো না।
মনে পড়ে কৈশোরের সতেজ সকালে কতদিন
আকাশে দিয়েছি ছেড়ে ঘুড়ি আকাঙ্ক্ষার। মেঘমালা
কখনও হয়েছে ফুল, কখনও বা এজ্ঞেলের পুণ্য ডানা হয়ে
দৃশ্যলোভী বালকের হৃদয় করেছে জয় ক্ষণে ক্ষণে, ফের
মুহূর্তে বদলিয়ে রঙ হয়ে গেছে মিকেলেজ্ঞেলোর
আদমের মুখ, দীপ্ত, প্রসারিত হাত, দৃষ্টি খোলা।
বুঝি তাই আজীবন আকাশ-মাতাল আমি, তাই
পরিণামে হলো হবার-
নীলিমাকে করেছি সুহৃদ
রত্রিদিন
উপরে উঠছি বলে চক্ষুশূল হবো কি সবার?
না, আমি কখনও আর নিচে নামবো না,
নামবো না, নামবো না।
নিচে নর্দমার গন্ধ। অজস্র পিচ্ছিল কেঁচো বিষাক্ত জজ্ঞাল।
ভালবেসে কেবলি বর্ধিত করে অস্তিত্বের ঢিবি, চতুর্দিকে
অস্তিচর্মসার মানুষের ভিড় আর পথে পথে অধঃপাত
দাঁত বের করে হাসে। নগরে জঙ্গলে ভেদচিহ্ন লুপ্তপ্রায়,
সবাই ঘাঁটছে নোংরা আবর্জনা উৎসবের উত্তেজনা নিয়ে ।
প্রেম তো সুদীর্ঘ
পত্রের-মার্জেন-ঘেঁষা পুনশ্চের মতো সংকুচিত, ক্ষণজন্মা
শিল্পীরা জলের দরে বিকোয় বাজারে, প্রগতির চাকা দেখি
অবিরত পাঁকে আট্কে যায়; স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা, উদরতা,
করুণা নামক কিছু বিখ্যাত বিষয় আগাগোড়া শোকাবহ
বিশাল কাফনে মুড়ে লোকগুলো মহানন্দে বগল বাজায়,
ঘৃণাকে আনন্দ ভেবে শান্তিকে তর্জমা করে হিংসার কাঁটায়!
বরং আমার এরোপ্লেন শূন্যতায় হযে যাক
খান্ খান্, তবু আমি নিচে নামবো না।
ক্ষধার চিৎকার থেকে, নর্দমার তীব্র গন্ধ থেকে
দারিদ্রের দাঁত নখ থেকে, আতঙ্কের থেকে দূরে,
সমস্ত কাঙালপনা, ক্ষুদ্রতার থেকে
আর কিনু গোয়ালার গলি থেকে দূরে,
নীলিমার নহবত শুনে-শুনে যাবো ঊর্ধ্বে যাবো,
আরো ঊর্ধ্বে আরো
না, আমি কখনো আর নিচে নামবো না,
নামবো না,
নামবো না……
একজন বেকারের উক্তি
যদি হতে পারতাম কোনো হিন্দী ফিল্মের নায়ক
পুণ্যবলে, তবে আমি ডুগডুগি বাজিয়ে ঠিক কৃতী
পুরুষ হতাম জানি। প্রেমের দেবতা যথারীতি
মেঘের আড়াল থেকে দিত ছুঁড়ে পুষ্পিত শায়কঃ
হস্তিমুর্খ ধনী দুলালী সে-ও নির্ঘাত শৌখিন
প্রেমে খেতো হাবুডুবু। মধ্যপথে বাড়াভাতে ছাই
পড়লেও, শেষ দৃশ্যে বিসমিল্লা খানের সানাই
বাজবে মধুর সুরে, হেসে খেলে কেটে যাবে দিন।
অতএব চাকরি বিনে কস্মিনকালে ও ফুটপাত
হতো না চষতে আর পরিশ্রমী কুকুরের মতো
একটি হাড়ের খোঁজে ক্রমাগত গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
হতাম না ক্লান্ত শুধু। আপাতত এই শীর্ণ হাত
করি সমর্পণ দুস্থ জ্যোতিষীর কাছে, ভাগ্যহত-
রুপালি পর্দার লীলা অবিরত থাকে চোখ জুড়ে!
একটি টিনের বাঁশি
যখন ছিলাম সাত বছরের খেয়ালি বালক,
মধ্যদিনে বিছানাকে রত্নদ্বীপ ভেবে সযতনে
খুঁজতাম গুপ্তধন। শিকারের খোঁজে ঘুরে বনে
দিতাম মাথায় গুঁজে সাতরঙা পাখির পালক
রেড ইণ্ডিয়ানদের মতো আর উটের চালক
সেজেছি তো সাহারায়। সে-সব দুপুরে ক্ষণে ক্ষণে
চিরচেনা বাঁশি-অলা বাজাতো টিনের বাঁশি, মনে
জ্বালাতো আতশবাজি, গলিময় সুরের আলোক।
আজ এই জীবনের মধ্যদিনে ভাবি যদি সেই
বাঁশি-অলা ফিরে আসে, এ-গলির মোড়ে ঘুরে ঘুরে
বাজায় টিনের বাঁশি, তা হলে আনাড়ি তার সুরে
পাবো কি আনন্দ আর? ডেকে এনে নিজের পাশেই
আবার বসাবো তাকে? অসম্ভব, সে পৃথিবী পড়ে
হয়ে গেছে ছাই আর সে-বালক অনেক আগেই!
কখনো আমার মাকে
কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কিনা আজ মনেই পড়ে না।
যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর
সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টাপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধাবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কিনা
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।
যেন তিনি গান দুঃখ জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, এখন তাদের
প্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!