সেই কণ্ঠস্বর
“নারে খোকা আজ তুই যাসনে বাইরে, দ্যাখ চেয়ে
বাইরে ভীষণ ঝড়। অন্ধকার রাত্তিরে যেসব
ভয়াল দৈত্যের কথা বলি তোকে লালকমলের
সেই গল্পে তারা আজ দলে দলে শক্ত মাটি ফুঁড়ে
এখানে এসেছে তেড়ে-ঘরবাড়ি, টেলিগ্রাফ তার
যা পাবে সম্মুখে তারা তছনছ করবে নিশ্চয়।
“বাইরে এখন বড়ো অন্ধকার, ডাইনীর চুল
ওড়ে চতুর্দিকে আর হাজার হাজার হিংস্র মোষ
ফেনায়িত মুখে ছোটে দিগ্বিদিক, খুরের আঘাতে
আকাশ ভাঙলো বুঝি-দাঁড়া, দরজাটা ভেজিয়ে দি’,
আয় ওরে বুকে আয়, বাইরে ভীষণ অন্ধকার;
না তুই যাসনে আজ যাসনে বাইরে, কথা রাখ”-
এ বলে মায়ের বুক নিত টেনে তার সে খোকাকে
কবেকার ঝোড়ো দিনে, আমি ভয়ে লুকাতাম মুখ।
অথচ এখন আমি ভয়ানক দুর্যোগে একাকী
বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ঝোড়ো হাওয়া তাঁবুর বনাত
কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে আজ হিংসার ফুৎকারে।
ছিঁড়ে-খুড়ে খাবে বলে দৈত্য-দানো চক্রান্তের টানে
আসে তেড়ে পৌরপথে। সম্মিলিত নেকড়ে হায়েনা
রক্তমাখা কাপড়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে চক্রাকারে
ঘোরে, আমি নিরুপায়। ইতিমধ্যে আমার শরীর
ছিন্নভিন্ন গণ্ডারের বৈরিতায়। সময় উজিয়ে
আসেনাকো কানে আর উৎকণ্ঠিত সেই কণ্ঠস্বরঃ
“নারে খোকা আজ তুই যাসনে বাইরে, কথা রাখ”
-মায়ের চকিত কণ্ঠ লিপ্ত এ-কালের কলরোলে।
সেই হাত
যে-হাত যুগল স্তনে খোঁজে চাঁদ-শাদা
স্বপ্নের মদির পথ, খোঁজে ক্ষেত্র প্রীতি কর্ষণের,-
ভাবতে অবাক লাগে, সেই একই হাত
সহজেই কাগযে নির্দেশ লেখে বোমা বর্ষণের!
স্টেজে
আর কী রয়েছে বাকি? সবি তৈরী, গোটা মঞ্চটাই
সুসজ্জিত নানা ছাঁদে। ইতিমধ্যে মাইক লাগানো
হয়ে গেছে আর সামনে শ্রোতাদের চেয়ার সাজানো
সারি সারি, বস্তুত কোথাও নেই তিলমাত্র ঠাঁই।
মঞ্চে বক্তা দু’চার কদম হেঁটে দিচ্ছেন মহড়া
নির্ধারিত বক্তৃতার, বাছা-বাছা বাক্যের শায়ক
অস্থির স্মৃতির তূণে, কিন্তু তবু সভার নায়ক,
পাদপ্রদীপের আলো, মনে হয় সবই মনগড়া!
প্রস্তুত প্রধান বক্তা, সাড়স্বরে সভা উদ্বোধন
করা গেলো যথারীতি, কিন্তু একি শ্রোতারা কোথায়?
তারা তো আসেনি কেউ, স্বস্তি কই এমন সভাতে
যেখানে বক্তার হাঁকডাক সবই অরণ্যে রোদন!
আমরা সবাই সেই বক্তার মতোই শূন্যতায়
কেবলি চলেছি হেঁকে প্রাণপণে মালাহীন হাতে।
স্বর্গে গেলাম দর্শক হিসেবে
(দান্তের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা পূর্বক)
মোল্লা-পুরুত এখনো রটায়
স্বর্গলোকের বিজ্ঞাপন।
নানা মুনি তার নকশা আঁকেন,
ব্যাখ্যা করেন বিজ্ঞজন।
দৈব দয়ায় একদিন ঠিক
পৌঁছে গেলাম স্বর্গলোকে।
স্বর্গতো নয়, আমার শহর
দেখতে পেলাম চর্মচোখে।
সেখানে ও লোক রাস্তা খুঁড়ছে,
মন্ত্রী হচ্ছে, কিনছে নাম।
চৈত্রদুপুর পুড়ছে সেখানে,
গলছে রাতের মধ্য যাম।
ইলেকট্রিকের হঠাৎ-আলোয়
ঘরের জানলা খুলছে কেউ।
ব্যস্ত মানুষ, মন্থর গাড়ি,
বড়ো রাস্তায় ভিড়ের ঢেউ।
এয়ারপোর্টে প্লেন নেমে আসে,
ট্রেন চলে যায় শেষ রাত্রে।
সেখানেও দেখি তর্কের থীম
ফকনার কামু কিবা সাত্রে।
বক্তা ছড়ান ধরতাই বুলি,
রাজায়-রাজায় বাঁধে লড়াই।
টগবগ করে ফুটছে নিত্য
জটিল মতামতের কড়াই।
দোকানে সাজানো বিদেশী কবির
আনকোরা বই দিচ্ছে উঁকি।
ঘটি-বাটি বাঁধা রেখে কেউ
ফটকা বাজারে নিচ্ছে ঝুঁকি।
ডাক্তার এলে ভিজিট চুকিয়ে
গৃহী মোছে তার চোখের খড়খড়ি,
রোগীর শিয়রে শুকনো ফল।
তরুণী টেবিলে খাবার সাজায়,
খবর পড়েন বুড়ো হাকিম।
মুড়মুড়ে দুটি টোস্টের ফাঁকে
নিবিড় হলুদ সোনালি ডিম।
কফির গন্ধে উন্মন মন,
কাজ্ঞিভেরাম কৌচে লোটে।
প্রেমিকের চোখ বালবের মতো
দীপ্ত ভাষায় ঝলসে ওঠে।
রাতের আঁধারে ফুটপাতে আসে
ভিখিরিণী তার নি-ছাদ ঘরে;
ঘাগড়া দুলিয়ে কুষ্ঠরোগীর
ঠোঁট চেপে ধরে কামের জ্বরে!
অক্ষর গুণে পংক্তি মেলায়
রাগী যুবকের দলের চাঁই,
ক্ষিপ্রকলায় চিত্র আঁকছে
রঙ ছুঁড়ে দিয়ে আচ্ছেতাই!
রবিঠাকুরের গান ভেসে আসে,
হেঁটে যায় লোক সুরের টানে।
পিকাসোর ছবি ড্রইংরুমের
দেয়ালকে দেয় অন্য মানে।