সংবাদপত্রে কোনো একটি ছবি দেখে
তুমি ও ঘুমিয়ে ছিলে ছোট খাটে, পাছে ঘুম-দ্বীপে
ঝড় ওঠে, পাছে বানচাল হয় চাঁদের মতোই
স্বপ্নের মোহন নৌকো, হাঙরের দাঁত ছিঁড়ে ফেলে
শান্তির রুপালি মাছ কিংবা অপদেবতার ক্রূর
দৃষ্টি পড়ে কচি মুখে, ঘুমের মোমের ডানা পুড়ে
হয় ছাই, পাছে ভয় পাও তাই মায়ের প্রার্থনা
একা ঘরে সারাক্ষণ ছিল জেগে তোমার শয্যার
চতুষ্পার্শ্বে; উদ্ভিদের মতো তুমি ঘুমে ভাসমান।
কে এক ভীষণ দৈত্য তোমার ঘুমের দ্বীপটিকে
অকস্মাৎ দিল নেড়ে প্রাণপণে, অভ্রের প্রাসাদ
হলো গুঁড়ে, বিচূর্ণিত প্রবালের সিঁড়ি। সান্তিয়াগো
উঠলো নড়েঃ দরদালানের ভিতে কে বলবে আজ
কী ঘুণ লুকিয়ে ছিল? এবং তোমাকে কী আক্রোশে
স্বপ্ন দেখে দুঃস্বপ্নের গোলকধাঁধায় দিলো ছুঁড়ে!
সান্তিয়াগো, যেন সে তাসের ঘর, এক ফুঁয়ে হলো
আস্তাকুঁড়; শহরের কণ্ঠ হলো তীব্র হাহাকার।
তোমার বিভ্রান্ত চোখ কী যেন খুঁজছে প্রতিক্ষণ,
কাকে খোঁজো ধ্বংসস্তূপে? মাকে? নাকি বিমর্ষ পিতাকে-
যিনি রোজ শূন্য ঘরে বাজাতেন রাত্তিতে বেহালা,
বিকেলে তোমার ছোট হাত ধরে নিজেরই বাগানে
বেড়াতেন অন্য মনে, শুনতেন পাতার মর্মর।
মাঝে মাঝে “দ্যাখো চেয়ে কী সুন্দর পাখি, ওরা ডালে
শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে,” বলে যিনি সূর্যাস্তের দিকে
দু’চোখ দিতেন মেলে-বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে খোঁজো তাঁকে?
সেখানে যেও না আর। কেউ নেই, কিছু নেই, কালো
একটি বেড়াল শুধু বসে আছে হলুদ জজ্ঞালে।
ছেঁড়া কাগজের টুকরো উড়ে এসে তোমার পায়ের
কাছে থামে। না, সেখানে নেই কোনো রঙিন পুতুল-
যা আছে দেখলে বড়ো ভয় পাবে, যেও না সেখানে।
কে এক বর্বর তার সর্বনাশা খেলার নেশায়
ভেঙেছে তোমার শান্ত খেলাঘর। হে দুঃস্বপ্নচারিণী
আমার হৃদয় হলো তোমাদের বিধ্বস্ত শহর!
সম্পাদক সমীপেষু
আমরা বাগান চাই আমরা ক’জন অকপট,
শান্তিবাদী ক্লান্ত নাগরিক এমন বাগান চাই
যেখানে ফুলের কাছে সহজে পারবো যেতে, ঘাসে
চিৎ হয়ে শুয়ে দিব্যি পা দুটো নাড়বো অকারণ
মাঝে মাঝে। কী কী ফুল থাকবে বাগানে তার সুদীর্ঘ তালিকা
বলোতো পাঠাতে পারি পৌর সমিতির কাছে। ভদ্রমহোদয়,
আমরা বাগান চাই, আমরা ক’জন হতচ্ছাড়া,
যারা মাঝরাস্তা দিয়ে ভাগ্যের ছ্যাকড়া গাড়ি হাঁকাতে হাঁকাতে
বড়ো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সম্প্রতি, আমরাই
শহরে বাগান চাই লিরিকের প্রসন্নতা-ছাওয়া;
এবং বিশ্বেস করো আছে আজো চাওয়ার সাহস।
২
চেতনপুরে ফুলের চারায় ধরলো নতুন কলি;
ছেঁড়া জামায়, জুতোর গর্তে করছি স্বপ্ন জড়ো।
স্বপ্ন-আভায় স্বর্গ হলো চেনা ময়লা গলি,
হিংসুটে সব মত্ত পথিক সরো তোমরা সরো।
আমরা কিছু দুর্বিনীত বাগান বাগান বলে
কান করেছি ঝালাপালা মানী-গুণীর বটে।
ফুলবাগানের অলীক মালী শুনছি সে কোন্ ছলে
মস্ত বাগান সাজিয়ে দেবে, দৈবে কতোই ঘটে!
শিল্পকর্মে আস্থা ছিল বলেই ক্ষুধার দাঁতে
দীর্ণ হয়ে ক্লিন্ন প্রাণে পোড়াই আতশবাজি।
ঘুমাক তারা ঘুমাক সুখে নিদ্রা এলে রাতে,
ঝুলিয়ে কাঁধে মরা পাখি আমরা ঘুরতে রাজি।
৩
এমন বাগান চাই যেখানে গেলেই নির্বিবাদে
লতাপাতা জড়ানো ঘোড়ার মূর্তি দেখে অচিরাৎ
ভুলবো দুঃসহ শোক, বস্তুত বাগানে এসে কোনো কোনো দিন-
বুধবার, শুক্রবার, কিংবা রবিবার, হোক না যে কোন দিন,
খুঁজবো অদৃশ্য আরোহীকে লোহার ঘোড়ার পিঠে!
দেখবো বেঞ্চিতে বসে অচেনা কে লোক চুরুটটা
ফুঁকে ফুঁকে ইতস্তত স্মৃতির খোলামকুচি ছড়াচ্ছে প্রচুর।
বুঝি নিঃসঙ্গতা কালো সহোদর তার!
আমাদের রমণীর মুখে ফুলের স্তবকগুলি
মেলুক আরক্ত ডানা, আমাদের শিশুদের মুখে
দয়ালু বাতাস দিক চুমু ঘন ঘন, ফুলবাগানের ডাল
মাতাল কবিকে দিক কবিতার পংক্তি উপহার।
এবং সেসব ডালে বিষ পিঁপাড়েরা কখনো সদলবলে
বাঁধতে না পারে যেন বাসা; যদি বাঁধে
তাহলে কি করে যাবো বাগানের পথে? কী করে ছেলেরা ডাল
বেয়ে বেয়ে কেবলি হারিয়ে যাবে পাতার জঙ্গলে?
ভদ্রমহোদয়! বারো মাস তের পার্বণ-কাতর
লাজুক আত্মাকে বসতিতে যথাযথ
রাখার প্রয়াসে নিত্য উচাটন আমরা কখনো
গুহাকে করিনি ঘর, রাখিনি পানীয় করোটিতে,
আঁকিনি স্বর্গের নক্সা বাঘছালে, তুকতাক মন্ত্রের প্রাচীন
কোনো পুঁথি ছিল না সম্মুখে সর্বক্ষণ। হল্দে
পুঁথির তুলোট পাতা আকাঙ্ক্ষার শবটাকে কখনো পারে কি
দিতে চাপা? একদিন লক্ষ্যে পৌছে যাবো নিরাপদে
আমরা তেমন কেউ নই; দূরে ও নিকটে
প্রকৃতই লক্ষ্য কিছু আছে কিনা সেও তো জানি না।
নানান ফুলের গাছে সুশীতল জল দেবো বলে
দু’বেলা অসীম ধৈর্যে ঝারি হাতে সবাই প্রস্তুত,
অথচ বাগানই নেই, কোথাও বাগান নেই আজ।
সময়
সময় ক্ষধার্ত বাঘ। পশু, পাখি, উদ্ভিদ, মানুষ
গ্রাম আর জনপদ যা প্রায় গোগ্রাসে গিলে ফেলে
এবং প্রত্যহ খোঁজে নতুন শিকার। চোখে মেলে
চেয়ে থাকে রাত্রিদিন, হিংস্রতায় প্রখর, বহুঁশ।
অশেষ ধ্বংসের কালি মুখে তার মেখেছে কলুষ
যুগে যুগে। জঠরে কি দাঁতে অবাস্তব ক্ষুধা জ্বেলে
ছুটে যায় লোকালয়ে, সভ্যতায়, গেলে অবহেলে
সব কিছু; মহানন্দে ওড়ায় সে জয়ের কানুস।
আমাকে ও প্রতিক্ষণ খাচ্ছে আঘাটায়, আমি তার
জ্বলন্ত চোয়ালে বিদ্ধ, যেমন উদ্ধার অসম্ভব
জেনে ও পথিক কোনো পাহাড়ের খোঁচে প্রাণপণে
পাথর আঁকড়ে ঝুলে থাকে। আর যে মানবতার
দায়ভাগ বয়ে চলি তারই টানে করে যাই স্তব
অমৃতের, যদিও বিরাম নেই কালের হননে।