যন্ত্রণা
আমার ছেলেটা জ্বরে ধুঁকছিলো,জ্বলছিলো তার
চোখ দুটো, টকটকে কৃষ্ণচূড়া। কী ভেবে নিলাম
ছোট হাত মুঠোর ভিতর আর ছুঁয়ে দেখলাম
কপালটা যাচ্ছে পুড়ে, হাঁপাচ্ছে সে এবং মাথার
ব্যথায় কাতর খুব। শুকনো ঠোঁট পাখির ছানার
দুরু দুরু বুক যেন, টের পাই। বাইরে উদ্দাম
হাওয়া, দরজায়, জানালার দিচ্ছে হানা অবিরাম।
কেবলি শিউরে উঠি ডাক্তারকে ডাকবো আবার?
কৃষ্ণচূড়া তাকালো আমার চোখে। “খুব বেশি তোর
কষ্ট হচ্ছে খোকা? মাথাটা বুলিয়ে দিই, ঘুমো তুই”
বললাম। সাড়া শব্দ নেই কোনো, বেড়ালটা হাই
তোলে বসে এক কোণে। নিদ্রোহীন ভাবি, হায় ভোর
কি হবে না আর? পারবো না ওর যন্ত্রণা কিছুই
নিতে আমি! যন্ত্রণায় আমরা নিঃসঙ্গ সর্বদাই।
যে আমার সহচর
যে আমার সহচর
আমি এক কংকালকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটি, প্রাণ খুলে
কথা বলি পরস্পর। বুরুশ চালাই তার চূলে,
বুলোই সযত্নে মুখে পাউডার, দর্জির দোকানে নিয়ে তাকে
ট্রাউজার, শার্ট, কোট ইত্যাদি বানিয়ে ভদ্রতাকে
সঙ্গীর ধাতস্থ করি; দু’ বেলা এগিয়ে দিই নিজে
প্রত্যহ যা খাই তাই। কখনো বৃষ্টিতে বেশি ভিজে
এলে ঘরে মাথাটা মুছিয়ে তপ্ত চায়ের পেয়ালা
রাখি তার টেবিলে সাজিয়ে আর শোনাই বেহালা
মধ্যেরাতে বন্ধ ঘরে। মাঝে –মাঝে তাকে হৈ-হৈ রবে
নিয়ে যাই বন্ধুদের গুলজার আড্ডার উৎসবে।
সেখানে সে বাক্যবীর, দর্শনের অলিগলি ঘুরে
শোনায় প্রচুর কথামৃত, সাহিত্যের অন্তঃপুরে
জলকেলি করে তার বেলা যায়, কখনো যা ফের
“শোনো বন্ধুগণ, আত্মাটা নিশ্চয় দামী পাথরের
বাক্স নয়,—সংশয়ের কালো জলে পারবে কি ভেসে
যেতে এই আত্মার পিছল বয়া চেপে নিরুদ্দেশে?
পাবে তীর কোনোদিন?”-ইত্যাকার চকিত ভাষণ
দিয়ে সেও প্রগল্ভ আড্ডাকে করে প্রভূত শাসন।
গলির খেলুড়ে ছেলে যে আনন্দে কাগজের নৌকো
ছেড়ে দেয় রাস্তা-উপচানো জলে কিংবা কিছু চৌকো
ডাক টিকিটের লোভে পিয়নের ব্যাগের ভিতর
দৃষ্টি দেয়-তারই খুশি কংকালের দুটি যাযাবার
চোখ ধরে রাখে। তারপর অকস্মাৎ, “মনে আছে
হাতের বইটা ফেলে রেখে বারান্দায় খুব কাছে
টেনে নিয়েছিলে কাকে? মনে পড়ে সে কার ফ্রকের
অন্তরালে উন্মীলিত হিরণ্ময় মসৃণ ত্বকের
অন্তরঙ্গতায় তুমি রেখেছিলে মুখ? মনে পড়ে
গোধূলিতে কৌমার্য হরণ সেই কৈশোরের ঘরে?”
-বলে সে কৌতুকী উচ্চারণে, যে আমার সহচর,
রয়েছে যে রৌদ্রজলে পাশাপাশি ছত্রিশ বছর।
আমি এক কংকালকে সঙ্গে নিয়ে চলি দিনরাত
অসংকোচে, আতংকের মুখোমুখি কখনো হঠাৎ
তাকে করি আলিঙ্গন, প্রাণপণে ডাক নামে ডাকি
দাঁড়িয়ে সত্তার দ্বীপে নি-শিকড়, একা, আর ঢাকি
ভীত মুখ তারই হতে। যে কংকাল বান্ধব আমার
তাকে নিয়ে গেছি নিজের প্রিয়তমার কাছে আর
অকাতরে দয়িতার তপ্ত ঠোঁটে কামোদ চুম্বন
আঁকতে দিয়েছি সঙ্গীটিকে! কী যে নিবিড় বন্ধন
দু’জনের অস্তিত্বের গ্রন্থিল জগতে, বুঝি তাই
ঘৃণায় পোড়াই তাকে, কখনো হৃদয়ে দিই ঠাঁই!
শুধু একটি ভাবনা
দেখি প্রত্যহ দুঃখের তটে
ভাসে স্বপ্নের রুপালি নৌবহর।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
কী করে বাঁচাই স্বপ্নের মায়াতরী?
পথের প্রান্তে দেখি দিনরাত
একটি বৃক্ষ-পিতৃপুরুষ যেন।
মাথা নেড়ে নেড়ে বলেন সদাই-
“বাচো, সুখী হও, তোমাদের ভালো হোক।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
দিগন্ত-জোড়া প্রলয়ের ঝড়ে
কী করে বাঁচাই প্রবীণ বৃক্ষটিকে?
আজকাল লোকে যায় না বাগানে,
তবু তো ধুলায় গোলাপ বাগান বাঁচে।
সেখানে পাখির কণ্ঠে ধ্বনিত
হৃদয়-মথিত কতো মানবিক গান।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
ফাগুনের স্মৃতি ঝলকিত ফুল
কী করে বাঁচাই বারুদের ঘ্রাণ থেকে?
আমার মায়ের প্রশান্ত চোখ
জেগে রয় রোজ সংসারে নানা কাজে।
প্রসারিত তাঁর হাতের মায়ায়
অন্ধকারেও জ্বলে ওঠে দীপাবলি।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
দিগন্ত-জোড়া প্রলয়ের ঝড়ে
কী করে বাঁচাই পুণ্য সে দীপাবলি?
পুতুলের মতো আমার মেয়েটা
সারাদিনমান পুতুল খেলায় মাতে।
ডাকলে কেবলি দৌড়ে পালায়,
লাল জুতুয়াটা কোথায় যে পড়ে থাকে।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
হিংসুক সেই দৈত্যের থেকে
কী করে বাঁচাই খুকির পুতুলগুলি?
শৈশবের বাতি-অলা আমাকে
সর্বাঙ্গে আঁধার মেখে কো করছো এখানে খোকন?
চিবুক ঠেকিয়ে হাতে, দৃষ্টি মেলে দূরে প্রতিক্ষণ
কী ভাবছো বসে?
হিজিবিজ়ি কী আঁকছো? মানসাঙ্ক কষে
হিসেব নিচ্ছো? দেখছো কি কতটুকু খাদ
কতটুকু খাঁটি এই প্রাত্যহিকে, ভাবছো নিছাদ
ঘরে থাকা দায়, নাকি বইপত্রে ক্লান্ত মুখ ঢেকে
জীবনের পাঠশালা থেকে
পালানোর চিন্তাগুলো ভ্রমরের মতো
মনের অলিন্দে শুধু ঘোরে অবিরত?
থাক, থাক-
মিথ্যে আর বাজিও না দুশ্চিন্তার ঢাক।
নীলের ফরাশে দ্যাখো বসেছে তারার মাইফেল আজো, শোনো
কী একটি পাখি ডেকে ওঠে না-না হয়নি এখনো
অত বস্তাপচা এই সব। লজ্জার কিছুই নেই,
দ্যাখো না খুঁটিয়ে সব আর দ্যাখো এই
লণ্ঠনের আলো, সম্মোহনে যার কল্পনার ওড়াতে ফানুস,
পোড়াতে আতশবাজি আনন্দের খুব,
আশ্চর্যের হ্রদে দিতে ডুব!
করেছো কামনা যাকে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা, আমি সেই আজব মানুষ
তোমার পাড়ায় আজ বড়ো অন্ধকার। সম্ভবত
বাতিটা জ্বালাতে ভুলে গেছ, আমি অভ্যাসবশত
কেবলি আলোর কথা বলে ফেলি। মস্ত উজবুক
এ লোকটা-বলে দাও দ্বিধাহীন। ভয় নেই, দেখাবো না মুখ
ভুলেও কস্মিকালে। তোমরা কি অন্ধকার-প্রিয়?
চলি আমি, এই লণ্ঠনের আলো যে, চায় তাকেই পৌছে দিও।