দেবার মতোন কিছু নেই
রাজরাজড়াকে হাসানোর ক্ষমতা আমার নেই,
হীরে-জহরত ঝলসিত মহিলার কোলজোড়া জুলজুলে
দৃষ্টি নিয়ে মোলায়েম থাবা নাচানোর, বারংবার
গলার রঙিন ঘুন্টি দোলানোর শিল্প আমি আয়ত্তে আনিনি।
বিশাল প্রাসাদে একা দিনরাত্রি অনেক বছর
কাটায় যে লোক তার মতো হয়ে গেছি, বলা যায়-
খাপছাড়া, অবসাদপ্রস্ত, ছায়াবিলাসে আশিরপদনখ
নিমজ্জিত, বড় বেশি প্রতিধ্বনিময় এ আমার
সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের চুমু-খাওয়া মাথায় কুঠুরি।
অতীতের সাথে খুনসুটি করে কাটে বেলা আর
কেবলি নিজেকে দুঃখ দিতে পারি, নিতে পারি প্রতিশোধ নিজের ওপর।
অপ্রেমের মরুভূমি থেকে হেঁটে আমি তোমার নিকটে
পৌঁছেছি সন্ধ্যায়-
যে সন্ধ্যায়, মনে পড়ে, আমার একান্ত ব্যক্তিগত নিস্তব্ধতা
উঠেছিল বেজে গূঢ় সরোদের মতো, কে অচেতনা পাখি তার
তীক্ষ্ম ঠোঁটে করেছিল পান সুখে হৃদয়ের শোনিত আমার!
কমলালেবুর খোসাভরা ঘরে তুমি
নিউজপ্রিন্টের গন্ধময় ঘরে তুমি
কী স্বপ্নের বীজ দূর থেকে দিয়েছিলে দীপ্র ছড়িয়ে সায়াহ্নে।
অনেক সন্ধ্যার ধ্যানে যুগ যুগ পরে
অমন নিবিড় সন্ধ্যা উঠেছিল ফুটে,
যেন পারিজাত।
পারিজাত সন্ধ্যা আমি পেয়েছি বলেই
শহর শক্রতা সাধে, মধ্যরাত এমন কাঁদায়?
বলেছি অজস্র কথা আমরা দু’জন ভোরবেলা, সন্ধ্যেবেলা,
মধ্যাহ্নে রাত্তিরে,
প্রহরে উপচে রোজ পড়েছে অনেক কথা আর
রঙিন ঘুড়ির মতো উড়েছে সে সব কথা আকাশে আকাশে,
কখনো জ্বলেছে ওরা উৎসবের বাল্বের মতোন ঝোপে-ঝাড়ে।
যখন একলা থাকি, সময় পোহাই শূন্য ঘরে, মনে হয়-
এই কি বলতে চেয়েছিলে তুমি? আমিও কি এই
আবোল তাবোল
আউড়ে তোমাকে হৃদয়ের স্বর শোনাতে চেয়েছি বারংবার?
এখন আমরা মুখোমুখি বসে নেই,
আমার নিকট তুমি নেই,
তবুও প্রখর আমি তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছি সকল সময়।
আমার মুঠোয়
তোমার স্বপ্নিল হাত কোমল প্রাণীর মতো চুমুকে চুমুকে
করছে সময় পান আমার দু’চোখে
তোমার চোখের পূর্ণ দখল এখন।
আঁধারে দুলিয়ে গ্রীবা বলেছিলে, এইতো এসেছি,-
দ্যাখো চেয়ে কী সহজে এসে গেছি তোমার কাছেই।
আমিও বলেছি, মনে পড়ে, স্বপ্নাচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে,
গভীর প্রত্যয়,
অনেক শতাব্দী ধরে আমি আছি একাকী তোমারই প্রতীক্ষায়।
তোমার দু’চোখে ছিল বিপর্যস্ত সভ্যতার শোক,
তোমার শরীরে ছিল বেদনার প্রগাঢ় চুম্বন,
তোমার যৌবনে ছিল বসন্তের পুষ্পিত বিলাপ,
দুঃখের কবল থেকে ছুটে এসে তুমি
দেখলে আমারও দুঃখ ছাড়া আর দেবার মতোন কিছু নেই
কিছু নেই।
নিজের নিকট থেকে
নিজের নিকট থেকে বহুদূরে চলে যেতে চাই-
দিনের আড়ালে,
রাত্রির ওপরে ভেসে ভেসে যতদূর যাওয়া যায়
ততদূর চলে যেতে চাই। এ শহরে ঘরে কিংবা
বাইরে কোথাও
বলো না থাকতে কেউ আমাকে, এক্ষুণি
আসবাব, বইপত্র, লেখার টেবিল আর কবিতার খাতা
তছনছ করে চলে যেতে চাই অতিদূরে পথরেখা
ধরে একা একা!
আমি কি অজ্ঞাতবাসে যাবো সবকিছু ফেলে টেলে?
বন্ধুবান্ধবের মুখ, চিরচেনা আপন গলির মোড়, ভাঙ্গা
বাড়ি, স্বরণের অভ্যন্তরে সারি সারি গাছ,
কিছুই আমাকে ধরে রাখতে পারে না,
পারলেও আমি
নিজের নিকট থেকে দূরে চলে যাবো, তাকাবো না
ফিরে, আমি, বলে দিচ্ছি, চলে যাবোই এখন।
বিভ্রম আমাকে কিছুকাল ঘুরিয়েছে পথে পথে,
বুঝতে পারিনি কবে স্বপ্নের মতোন এক মোহন উদ্যান
কাঁটাবন হয়ে গেছে এবং অতিথিবৃন্দ ভোজসভায় হঠাৎ
অজস্র কংকাল হলো, বিকৃত আয়নার
ছবির মতোই
দৃশ্যাবলী চতুর্দিকে। চলে যেতে দাও, এরকম দৃশ্য দেখে
ঝিমোতে ঝিমোতে প্রায় উন্মাদের মতো পারবো না
চেচিয়ে উঠতে কোনোদিন মানুষের মধ্যে, আমি
বরং মাটির নিচে নিজেকে আড়াল করে প্রহর কাটাবো।
প্রত্যহ মেঝেতে দেখি শক্ত, মৃত পাখি পড়ে আছে,-
আমি চলে যাবো।
চেতনায় কৃষ্ণপক্ষ নেমে আসে বারংবার বাদুড়ের মতো,
আমি চলে যাবো।
আমার আনন্দ একজন অকস্মাৎ এক ফুঁয়ে
নিভিয়ে দিয়েছে,-
আমি চলে যাবো।
আমার সুখের নৌকো নিমজ্জিত ঘোর কালো গহন নদীতে,
আমি চলে যাবো।
যে পাখি গাইতো গান নিরিবিলি হৃদয়ে আমার
তার বুক একজন তীক্ষ্ণ নখে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলেছে বেবাক,
আমি চলে যাবো।
নিজের নিকট থেকে বহুদূরে চলে যাবো দুঃখিত, একাকী।
নিষ্পিষ্ট বেহালা
আমার হৃদয় জুড়ে সারাক্ষণ এ কী জলহাওয়া।
আবহকুক্কুট ঘোরে উল্টোপাল্টা, দিকচিহ্নগুলি
সহসা গিয়েছে উড়ে, দরজা, জানালা ঘুলঘুলি
কম্পমান ক্ষণে ক্ষণে। খুব একা কোনো গানে-পাওয়া
লোকের স্বভাবে ঘুরি দিগ্ধিদিক মানুষের হাটে,
কখনো দারুণ জনশূন্যতায়। রুদ্র ভূকম্পন
মাঝে মাঝে আনে শোক; নৌকো, সেতু ছাড়াই গহন
খর নদী পার হতে হবে, হবে যেতে ফুল্ল ঘাটে।
স্মৃতি ভেতরে স্মৃতি ক্রিয়াশীল পারম্পর্যহীন-
তছনছ ঘরবাড়ি, ক্ষুধার্ত শহর, ডালপালা,
ছিন্নভিন্ন, তরুণীর স্বেদসিক্ত স্তন, একজন
খোঁড়া লোক, চা খানার নির্জন টেবিল, অন্তরীণ
তেজী যুবা ভেসে ওঠে ডুবে যায় এবং যখন
বিপর্যয় অস্ত যায়, বাজে ফের নিষ্পিষ্ট বেহালা।
পাখির ভূমিকা
এখন ডাকার কথা নয় তার এই মধ্যরাতে অকস্মাৎ,
তবুও এমন আর্ত কণ্ঠস্বরে উঠলো ডেকে, যেন
দিয়েছে বসিয়ে দাঁত কেউ তার বুকে হিংস্রতায়।
যেমন নিপুণ দর্জি কাঁচি দিয়ে কাটে মখমল,
তেম্নি তার ডাক নিশীথকে চিরে ঝরে ফুটপাতে,
কলোনীর ফ্ল্যাটে আর বস্তির বিনীত দোচালায়।
প্রহর প্রগাঢ় হয়, মধ্যরাতে পাখির ভূমিকা
মেনে নিয়ে বালিশের গালে খুব জোরে, গাল চেপে
চুপচাপ শূন্য এক কুটিরের কথা, দূর কোনো
বনানীর কথা ভাবি; খড়কুটো উড়ে আসে ঘরে।
এবং পাখির ডাকে ঝিল, কারো স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখ,
পদচ্ছাপময় দীর্ঘ পথ, প্রাচীন যে ধাতুশিল্পী
বানায় সোনার পাখি কী তন্ময় অন্ধকার ঘরে,
তাকে, আপনার আবডালে নিজেকেই পেয়ে যাই।
মধ্যরাতে পাখি ডেকে যায়, ডেকে যায় কী একাকী,
এই ডাক শুনে শুনে এ জীবন কেটে যাবে বুঝি!