তোমার চোখ
যখন তোমার চোখ আমার দু’চোখে রাখো তুমি,
মনোলীন অন্ধকারে জ্বলে ঝাড়লণ্ঠনের শোভা,
কখনো জাহাজ আসে উড়িয়ে নিশান, কখনো বা
হরিণের ক্ষুর ডোবে ঝিলে, স্বপ্ন হয় বনভূমি।
তোমার অতল দু’টি চোখ তুলে তাকাও যখন,
মৃত কোনো সভ্যতার প্রাসাদের দীপাধারে রূপ
জেগে ওঠে, মগজের কোষে পোড়ে কী মোহন ধূপ,
রূক্ষ পথ হয় গীতবিতানের পাতার মতোন।
তোমার চোখের নিরালায় স্বর্গপথ ওঠে দুলে,
কাঁপে হ্রদ, বনস্থলী, একজন কবির হৃদয়
প্রায়শ বিছিয়ে দেয় কাতরতা, মৃত্যু গান গায়
রাজপুরুষের বেশে হননের তীব্র স্পৃহা ভুলে।
অমন চোখের জন্যে অপলক চোখে সুনিশ্চয়
শতাব্দী শতাব্দী ধরে ব্যাকুল প্রতীক্ষা করা যায়।
তোমার নিদ্রার দিকে
আমার ভেতর থেকে একজন একাকী মানুষ হেঁটে যায়
তোমার নিদ্রার দিকে, তুমি তার যাত্রা, ব্যাকুলতা,
কাতর দৃষ্টির প্রতি উদাসীন, ঘুমের ভেতরে
মজ্জমান, লতাপাতা জড়ায় তোমাকে,
খরগোশ বুকের নগ্ন মদির উষ্ণতা
শোঁকে কিছুক্ষণ। তার যাত্রায় রোদ্দুর নাচে, বৃষ্টি পড়ে,
কখনো জ্যোৎস্নাও ঝরে। কেমন অচেনা পাখি ডাকে
তার দু’চোখের নিরালায়।
আমার ভেতর থেকে একজন একাকী মানুষ হেঁটে যায়
তোমার জাগরণের প্রতি, তার চুমু ঝরে অবিরল
যে পুষ্পিত জাগরণে। এখন সে তোমার নিদ্রার দিকে হাত
দিয়েছে বাড়িয়ে, নিশীথের ঘ্রাণময় বিছানায়
নিটোল ঘুমাও তুমি, তোমার নিদ্রার রাঙা জল
অত্যন্ত নিথর থেকে যাবে।
ভয় নেই, তোমাকে সে জাগাবে না; বুকে নিয়ে শীতরাত
তোমার রূপের হ্রদে ওজু করে চলে যাবে উড়িয়ে ফানুস
আকাঙ্ক্ষার। চিরকাল হৃদয়ের অভ্যন্তরে তার গভীর বনানী
আবৃত্তি করবে কিছু স্মৃতিময় বাণী।
যখন সবুজ লনে শিশুর মতোন সুখে গড়াবে সকাল,
কার্ডিগান গায়ে তুমি বারান্দায় নিশ্চুপ দাঁড়াবে,
তখন তোমার মনে হতে পারে একজন একাকী মানুষ
শীতল সিঁড়ির ধাপে নত মুখে নিঃস্ব বসে আছে কতকাল।
তোর কাছ থেকে দূরে
তোর কাছ থেকে দূরে, সে কোন নিশ্চিন্তিপুরে পালাতে চেয়েছি
প্রতিদিন, বুঝলি মতিন!
হয়তো বা টের পেয়ে অবশেষে নিজেই উধাও হয়ে গেলি
একটি নদীর তীরে, মাঠ-ঘেঁষা, গাছ ঘেরা, জুঁইকি চামেলি
ইত্যাদির ঘ্রাণময় বিজন নিবাসে। আমি তোকে
দীর্ঘ চোদ্দ বছরের সাইকেডেলিক স্মরণের তীব্র ঝোঁকে
ডাকি মধ্যরাত্রির মতো বুক ছিঁড়ে বারংবার,
প্রতিধ্বনি শুধু গূঢ় প্রতিধ্বনি ফিরে আসে মগজে আমার।
কেমন আছিস তুই? এখনো কি ভীষণ অস্থির তুই, ওরে?
এখনো কি অতি দ্রুত হেঁটে যাস দুঃস্বপ্নের ঘোরে
অলীক অলিন্দে কোনো? অবাস্তব বনবাদাড়ে ঘুরিস একা
ছিন্ন বেশ, নগ্নপদ সন্তের মতোন? তোর দেখা,
মানে তোর ঝলমলে প্রকৃত সত্তার দেখা পাবো কি আবার
কোনোদিন? তোকে হারাবার
পর তুই অতিশয় বেগানা আমার বড় বেশি উদাসীন
হয়ে গেলি, রূপান্তরে আমার দুঃখের মতো, বুঝলি মতিন।
যখন এখানে ছিলি, বুকের নিকটে ছিলি, তোর হস্তদ্বয়
আমার স্বপ্নের ঝাড়লণ্ঠন বেবাক অতিশয়
হিংস্রতায় বারংবার দিয়েছে দুলিয়ে। চুরমার
হয়েছে এ-ঘরে নিত্য যা কিছু ভঙ্গুর আর প্রগাঢ় সুমরি
মতো অন্ধকার চোখে নেমে এসেছে আমার ভর দুপুরেই।
এখন এখানে নেই, তুই নেই; আমার বুকের মধ্যে
সবুজ পুকুর!
এই তো সেদিন আমি খাতার পাতায় মগ্ন ছিলাম একাকী
অপরাহ্নে অক্ষরের গানে তরঙ্গিত। ‘সবই ফাঁকি’,
কে যেন চেঁচিয়ে বলে। দেখি খুব থমথমে সমুখে দাঁড়িয়ে
কাল-কিশোরের মতো তুই, যেন দীর্ঘ পথ নিমেষে মাড়িয়ে
এসেছিস বলে দিতে আমার উদ্যাম সব এলোমেলো,
দারুণ বেঠিক।
দিচ্ছিস চক্কর তুই ঘরময়, আমিও ঘুরছি দিগ্ধিদিক
জনাকীর্ণ এ শহরে কে জানে কিসের টানে পরিণামহীন,
বুঝলি মতিন।
যখন এখানে ছিলি, ছিল এক ঝাঁক চিলের ক্রন্দন ঘরে,
ছিল তীক্ষ্ম কলরব সকল সময়, মনে পড়ে।
এখন আমার ঘর অত্যন্ত নীরব, যেন শ্লেট, মূক, ভারী।
কখনো চাইনি আমি এমন নিশ্চুপ ঘরবাড়ি।
দুপুর প্রবেশ করে
দুপুর প্রবেশ করে আমার ভেতরে, কী উদ্দাম
হাওয়া একরাশ বুকে পায় ঠাঁই। সে আছে এখানে
আমার নিকটে বসে, যার কণ্ঠ মৃদু কথা-গানে
পল্লবিত মাঝে মধ্যে এই স্তব্ধতায় ছিমছাম
পরিবেশে, শুধু চেয়ে থাকা কখনো বা, তার নাম
ধূপের মতোন জ্বলে আমার শিরায়। কী যে মানে
অমন দৃষ্টির আজো বুঝতে পারিনি, কিন্তু দানে
দানে ভরিয়েছে সে আমাকে। আগে কী শূন্য ছিলাম।
তবু কি শূন্যতা মুছে যায়? তবে কেন রিক্ত সুর
বেজে ওঠে বারংবার? কেন মনে হয়,আমি শুধু
তার রাজধানী থেকে দূরে চলে যাচ্ছি নির্বাসনে
মুকুট বিহীন একা? দেখি পড়ে আছি খুব ধূ ধূ
পাথুরে জমিনে, কণ্টকিত গুল্মে দীর্ণ চোখ, মনে
প্রেত-নৃত্য। সে-ও যেন বিবাগিনী উদাস দুপুর।
দূরের একটা বাড়ি আমাকে
দূরের একটা বাড়ি আমাকে ভূতগ্রস্ত করে ফেলেছে ইদানীং।
বাড়িটার দেয়াল দরজা জানালা অলিন্দ,
বল্লমের মতো ছাদের চূড়ো-সবকিছু
লগ্ন আমার ভাবনায় সকল সময়। বাড়ি আমাকে দীর্ণ করে
উল্টা-পাল্টা করে ফেলে আমার মগজের কোষ।
বাড়িটাকে আমি অনেক দূরে থেকে দেখি প্রতিদিন,
কখনো তাকে প্রাচীন কোনো দুর্গ বলে ভ্রম হয়,
কখনো গ্রিক পুরাণের একচক্ষূ দানবের মতো লাগে ওকে,
দূর্গ হলেই যেন মানাতো বেশি, এমনি গোমড়ামুখো সে বাড়ি।
সেই দুর্গ, থুড়ি, সেই বাড়ির ভেতরে যাওয়ার ছাড়পত্র
আমার নেই, যদিও এক ধরনের নিরাসক্ত আমন্ত্রণ
থাকে সর্বদাই।
ছাড়পত্র ছাড়াই আমি যাত্রা করি বাড়িটার দিকে;
হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হই,
তবু পৌঁছুতে পারি না তার ত্রিসীমানায়।
কখনো পথ আমাকে ঘন অরণ্যের দিকে নিয়ে যায়,
ভয়ংকর কর্দমাক্ত খাদের কিনারে কখনো বা
তখন একদল কংকাল ভারী কাঠের শব্দের মতো
হাসতে থাকে, হাসতে থাকে বিরতিহীন।
বাড়ি, তুমি কেন আমাকে বাইরে রাখো সর্বক্ষণ?
প্রবেশাধিকার চেয়ে আমি বারংবার
টেলিফোন করি হন্তদন্ত হয়ে, ওপার থেকে
পাই না কোনো সাড়াশব্দ;
শুধু এক দঙ্গল বানরের কিচির মিচির ভেসে আসে,
আমি দিনরাত্রি ডায়াল করতেই থাকি ক্রমাগত।
কখনো অবসন্ন চেতনায় নক্ষত্রের আলো
বিকিয়ে উঠবে ভেবে প্রতীক্ষা করি, প্রতীক্ষা করি,
প্রতীক্ষা করি।
বাড়ি, আমার প্রতিটি মুহূর্তকে গোলাপকুঁড়ি বানাই
তোমার জন্যে,
বাড়ি, তোমার কথা ভবে আমার একেকটি দিন
কী দীর্ঘ রক্তাক্ত কাটে।
বাড়ি, আমি তোমার প্রতি আমার সকল স্বপ্নের মাধুর্য
অর্পণ করেছি, তুমি কেন বারংবার দুঃস্বপ্ন দাও?
বাড়ি, তুমি আমার পরমায়ু নিয়ে খেলছো সর্বক্ষণ,
আমার আয়ু ডালকুত্তার মতো খেয়ো না তুমি,
বাড়ি, হে বাড়ি?
বাড়ি, তুমি হাজার হাজার নেকড়ের নখর দিয়ে তৈরী,
তোমার গা-ভরা ড্রাগনের দাঁত দেখিয়ে
আমাকে প্রতিহত করতে চাও,
আমার দরবেশ পদ্য
তোমার তল্লাট থেকে শূন্য-হাতে ফিরে আসবে বারংবার?
প্রাচীন দূর্গের মতো যে বাড়ি তার উদ্দেশ্যে পত্র লিখি প্রত্যহ,
হা নসিব, লেখা হওয়া মাত্রই
প্রত্যেকটি পত্রের সকল ব্যাকুল অক্ষর উবে যায়, রঙিন
ডাকটিকিটগুলি শীতের পাতা হয়ে ঝরে যায়
ধূলায় পাথুরে রাস্তায়।
প্রাচীন দূর্গের মতো একটা বাড়ি অনেক দূর থেকে
দেখে দেখে এখন আমি ভূতগ্রস্ত, ভয়ানক ভুতগ্রস্ত।