তবু হয়, এরকমই হয়
তবু হয়, এ রকমই হয়
কখনো চাওনি তুমি এ রকম হোক, তবু সব লতাগুল্ম,
জলজ্যান্ত গাছ
শুকিয়ে বিবর্ণ হলো, বড় শীর্ণ। ফুলদানি শূন্য বহুকাল,
নানারাঙা পাখিরা উধাও-
ওরা কি মেতেছে আত্মহননে কোথাও? ঝাড়লণ্ঠনের শোভা
সহসা গিয়েছে মুছে, ঝাঁক ঝাঁক বাদুড় কেবলি ঝুলে থাকে
ছাদে, ঘরময়
পশুবিষ্ঠা, বারংবার হাত খুঁজে পাই না কোথাও আজ হাত।
কখনো চাওনি তুমি এ রকম হোক, তবু হয়,
এ রকমই হয়।
এ শহরে আছে এক পথ, কখনো সে স্নিগ্ধ কখনো বা
গরিমায় ঝলমলে, মাঝে-মধ্যে যেন আর্টেমিস-
ছায়ার মতোন তার গায়ের বাকল ছেড়ে ছুড়ে করে স্নান
জোরালো জ্যোৎস্নায়।
তুমি জানবে না কোনোদিন সে পথের জন্যে একজন কবির হৃদয়
কী রকম আর্তনাদ করে রাত্রিদিন। সর্বক্ষণ আমি তার করি ধ্যান
যেমন উদ্ভ্রান্ত পাখি অলভ্য স্বর্গের। এ দারুণ শুশুনিয়া
বুভুক্ষ, তামাটে
জমিনে কর্কশ মুখ রেখে ব্যাধের উদ্যম থেকে পলাতক
প্রাণীর মতোন আজো তোমার জন্যেই বেঁচে আছি
বললে কি তুমি আজ করবে বিশ্বাস? জানবে না কোনোদিন
আমার প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে তোমারই নাম গুঞ্জরিত, আমি
শুধু দূর থেকে দেখি পথরেখা, তৃষ্ণা বাড়ে সত্তাময়। যাবো
কি সেখানে?
হাত পেতে নেবো জল রুক্ষ সন্নাসীর মতো? এ রকম হোক,
কখনো চাইনি আমি; তবু হয়, এ রকমই হয়।
একটি আশ্রয় আমি যুগ যুগ পরে পেয়ে গেছি ভেবে খুব
সম্মোহিত হয়ে
ছিলাম অনেকদিন, অলৌকিক খড়কুটো দিয়ে সাজিয়েছি
তাকে, হৃদয়ের ফুল্ল তাপে
রেখেছি সর্বদা উষ্ণ, কখনো চোখের জলে ধুলাবালি
ধুয়ে মুছে নক্ষত্রের মতো।
অকস্মাৎ বজ্রপাত, আমি দগ্ধ আশ্রয়ের কাহিনী শোনাই ঘুরে ফিরে
গাছপালা, নদীনালা, সূর্যাস্তকে নিশীথের প্রেতের মতোন কণ্ঠস্বরে।
তিন যুগ পর
অকস্মাৎ অন্ধকারে একটি পুরনো কোঠাবাড়ি
তাকালো আমার প্রতি চোখ মেলে। বাড়িটার ঘ্রাণ
বাড়ে ক্রমাগত, দেখি বর্ষিয়সী নারী,
পরনে নিঝুম শাড়ি, অত্যন্ত সফেদ, যেন অই আসমান
দিয়েছে মহিমা তার সমগ্র সত্তায়। তাকে চিনি
মনে হয়, তিনি মাতামহী আমার এবং যাকে
আপা বলে ডাকতাম শৈশবে, কৈশোরে। মনে হতো চিরদিনই
থাকবেন তিনি তার কোঠাবাড়ি ভালোবেসে আর আমার ব্যাকুল ডাকে
দেবেন সানন্দ সাড়া যখন তখন। অন্ধকারে
এই তো দেখছি তিনি জ্বেলেছেন হ্যারিকেন ঘরে, আলো যার
কল্যাণের প্রতিবাদ অশুভের বিরুদ্ধে সর্বদা। বারে বারে
আমার মাতুল সেই কবে মদে চুর হয়ে ফিরে এলে হ্যারিকেন তাঁর
নিশ্চুপ বেরিয়ে আসতো আঙিনায় সন্তানের হাত ধরে তিনি
উঠোন পেরিয়ে ঘরে রাত্রিময় যেতেন ঔদাস্যে ভরপুর।
দিতেন শুইয়ে তাকে, নিতেন জুতোর পাটি খুলে, আমি ঋণী
চিরকাল এ দৃশ্যের কাছে। সুন্দরের স্পর্শে বাজে অস্তিত্বের সুর।
রাত্রি বড় ভয়ংকর মনে হয় আজকাল, ভীষণ টলছে মাথা, সারা
গায়ে ভুর ভুর করে গন্ধ প্রায় প্রতিরাত, মধ্যরাতে বুঝি
মেঘে মেঘে হেঁটে যাই, খিস্তি করি নক্ষত্রের সাথে। দিশেহারা,
বেজায় বিহ্বল আমি আর্ত অন্ধকারে। কী-যে খুঁজি
এ বিজনে এলোমেলো ভীষণ একলা আর কেমন অচেনা
লাগে প্রতিবেশ; আপা, তুমি হ্যারিকেন দোলাবে না?
তোমার ঔদাস্য
ইদানীং তুমি বড় বেশি ঔদাস্যের কথা বলো,
বড় বেশি তুমি খেলে যাচ্ছো ধুধু নির্লিপ্তির হাতে-
যেন সূর্যরাজা তার অন্ধকার রাণীকে সপ্রাণ
করে না চুম্বন আর, যেন দূর স্বপ্নের গাংচিল
এখন তোমার চারপাশে ওড়াউড়ি ভুলে গেছে,
কোনো ফুলে ঘ্রাণ নেই, সবচে সুস্বাদু ফলও খুব
স্বাদহীন, এ রকম তোমার ধরন ইদানীং।
যখন তোমার কণ্ঠস্বরে ঔদাস্যের ছায়া পড়ে,
হু হু রুক্ষ প্রান্তরের দৃশ্যহীন দৃশ্যাবলী জাগে,
অকস্মাৎ করোটির ভেতরে আমার চকচকে
রেজরের মতো কিছু ভীষণ ঝিকিয়ে ওঠে আর
স্বপ্নময় তারপুঞ্জ ছিন্নভিন্ন হয়। করোটিতে
শত শত নামহীন কবরের ফলক এবং
রাশি রাশি উন্মুখর ফুল, প্যাগোডার স্বর্ণচূড়ো,
তিনটি বিবর্ণ তাস, পলায়নপর অশ্বপাল,
ব্রোঞ্জস্থিত পরস্পর নানা স্বপ্ন বিনিময়কারী
যমজ বিযার ক্যান প্রতিবেশী। ঔদাস্য তোমার
তোমাকে বসিয়ে রাখে ভুল প্রত্যাশার পথপ্রান্তে,
স্বপ্ন-বিবর্জিত হাহাকারময় বিজন সৈকতে।
তোমার ঔদাস্য-মরু উজিয়ে সকাল দশটায়
অথবা বিকেল পাঁচটায় কিংবা কোনো সন্ধ্যেবেলা
যখনই তোমার কাছে যাবো বলে দর্পণে তাকাই
শার্টের কলার ঠিক করে নিই, আড়চোখে দেখি
শাদাকালো চুল, শিরাপুঞ্জে বেজে ওঠে কনসার্ট,
কোন্ ইন্দ্রজালে এ আমার আটচল্লিশের মুখ
আটাশের মুখ হয়ে যায়? সুদূর সুন্দরবন,
চাটগাঁর কুঁজোপিঠ কাজল পাহাড়, সমুদ্রের
ঢেউমালা সিলেটের টিলাস্থিত কোনো স্মৃতিময়
প্রাচীন দুর্গের মতো বাড়ি, মন্টি-মন্টি প্রতিধ্বনি
পরিপূর্ণ ঝিল, গাছপালা আর ঢাকার আকাশ
ছাপিয়ে তোমারই মুখ উদ্ভাসিত আমার দৃষ্টিতে।
যখন পাইনা দেখা, আমার নিকট থেকে তুমি
যখন অনেক দূরে, তোমাকেই দেখি তন্বী গাছে,
ফুলের আভায়, শস্যক্ষেতে, হরিণের মতো এই
থমকে দাঁড়ানো গলিপথে আর আমার আপন
করতলে, পাঁজরের মরুভূমি, চোখের সৈকতে।
আমার এখনকার প্রতিটি কবিতা তার বুক
উন্মোচন করে বলে,-এই তো এখানে তুমি আছো।
তুমিহীনতায় প্রতিদিন আমার কবিতাবলী
তুমিময় হয়, সেখানেই রোজ খুঁজবো তোমাকে,
দেখবো দু’চোখ ভরে বহুবর্ণ বাক্যের ওপারে।
কি উপমা কি উৎপ্রেক্ষা অথবা প্রতীক ইত্যাদির
পরপারে তুমি আছো হৃদয়ের পরগণা জুড়ে।
যতদিন বেঁচে আছি, থাকবে আমার কাছে তুমি
চিরকাল হৃৎস্পন্দনের মতো, অবিচ্ছিন্ন কোনো
যন্ত্রণার মতো সর্বক্ষণ। আপাতত ঔদাস্যের
বিজন গেরুয়া প্রান্তে দাঁড়িয়ে একাকী ছায়াময়
তোমার ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে এ হৃদয়
কেবলি ডাকতে থাকে আর্ত এক পাখির মতোন।