জুনের দুপুর
সেদিন জুনের দুপুর ছিল, একলা ছিলে তুমি।
ঘরের দুপুর বাড়ায় গ্রীবা,
হঠাৎ তোমার পায়ের, নিচে উঠলো কেঁপে ভূমি।
তখন আমি কিসের ঘোরে নিজের ভেতর একা বাঁচছি, মরছি, মরছি, বাঁচছি।
এমনি করেই দ্বন্দ্ব থেকে ফোটে দুঃখরেখা!
ক্লান্ত মনে পড়ছি ধুধু দেয়াল-জোড়া লেখা।
বুকের ভেতর মরুর জ্বালা,
তোমার সঙ্গে ক’যুগ যেন হয়নি আমার দেখা।
ঘরে-বাইরে সঙ্গে আমার নোংরা নরক ঘোরে।
কোথাও কিছু নেইকো পাওয়ার,
বাগান-ফাগান, কোঠাবাড়ি ধুলোর মতো ওড়ে।
তোমার বুকে ওষ্ঠ চেপে ভুলি গেরস্থালি-
শহর কালো বিন্দু হয়ে
শূন্যে মিলায়, সত্তা জুড়ে ঝরে সময়-বালি।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, অবসন্ন হাটুরের মতো বসে আছি
হাঁটু মুড়ে নগর ভেলায়।
এ এক প্রকৃত খেলা, এই ভেসে-যাওয়া তীরবর্তী শোভা দেখে,
জ্যোৎস্নার মাধ্যমে গড়ে তোলা মধুর সম্পর্ক কোনো
মহিলার সাথে।
বাতিল প্রেমিক যদি ফের খুঁজে পায় বেলাবেলি সম্প্রীতির ডেরা,
তাহ’লে সে নীলিমাকে জানিয়ে অভিবাদন, প্রায়
ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে উড়ে উড়ে অপরাহ্নে
ঘাসের অম্লান সবুজকে চুমু খেয়ে, হাত রেখে
খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, হাত রেখে
খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, দেয়ালের শ্যাওলায়
মগ্ন হবে গৃহপ্রবেশের সূরে এক লহমায়। কয়েক শতাব্দী তার
আঙুলে উঠবে নেচে, দেশলাই জ্বালালে আঁধারে
প্রাচীন দেয়ালচিত্র অকস্মাৎ হবে উন্মোচিত, বুঝিবা আহত হবে
কাতর হৃদয় তার অতীতের অসামাজিকতা হেতু আর
রাখবে সে চোখ টিকটিকি কিংবা বাতির ওপর।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, ঢাকাও মরাল হতে জানে
পূর্ণিমায়, দেখে নিই। যেন দরদালান সমেত যাচ্ছে উড়ে
দুলিয়ে বিপুল ডানা মগজের জ্যোৎস্নায় আমার।
ওলোট-পালোট কত স্মৃতি গোলাপের মতো ঝরে
এখন আমাকে ঘিরে, ঘ্রাণে নেশাতুর হয়ে পড়ি।
শৈশব কাঠের ঘোড়া চেপে আসে, যৌবনের খর দিনগুলি,
রাত্রিগুলি খুব মেশামেশি করে রক্ত কণিকায়,
চামর দোলায় কোন, অব্যক্ত তরুণী, তবু কিছু স্বেদচিহ্ন
থেকে যায় আমার এ শরীর-পেরুনো অন্য এক অবয়বে।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, আমিও ভাসছি ক্রমাগত।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে, ঢাকা ওরা মৃত, ওরা পূর্বগামী পরিজন,
বুঝি ওরা বারংবার মরীচিকার চিৎকার শুনে
ছুটে গেছে, কোথায় যে মরুদ্যান প্রস্রবণ নিয়ে
আমন্ত্রণে উন্মুখর বেলা শেষে, করেনি খেয়াল। ওরা মৃত,
ভ্রান্তির গহ্বরে ওরা হারিয়ে ফেলেছে কণ্ঠস্বর।
দেখি প্লেগ-কবলিত শহরের মতো
ক্রুর অমাবস্যার এলাকা-
ছিন্নভিন্ন জামা, জীর্ণ জুতো পড়ে আছে ইতস্ততঃ
কাঁটাগুল্ম, পাথরের মধ্যে, ফুলের কেয়ারিগুলি ভরে ওঠে
পচা নাড়িভুড়ি আর হাড়গোড়ে। দেখি কতিপয়
ন্যাংটো লোক পথে
করছে বপন মৃত্যু,-আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি তাহ’লে?
আমার অসুখ বলে ঢাকা মন খারাপ করেছে।
ওর চোখে-মুখে বিষণ্নতা জেগে থাকে সারাক্ষণ,
যত বলি ফুল্ল স্বরে, ভেবোনা লক্ষ্মীটি, আমি খুব
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবো, দেখে নিও,
তত সে খারাপ করে মন, চোখে জমে অশ্রুকণা,
আমার শিয়রে বসে থাকে ঠিক নার্সের ধরনে।
জ্যোৎস্নায় ভাসছো তুমি ঢাকা বেসামাল পূর্ণিমায়।
যাবো না স্বাস্থ্যের লোভে কোনো শৈলাবাসে,
তুমি আছি থেকো তুমি আমার অসুখ সেরে যাবে।
জ্বরদগ্ধ চোখে দেখি জ্যোৎস্না-ধোয়া স্নেহজাত পথ্য
তার হাতে নাচ আর রোজ নিয়ে আসে কিছু ফুল
রোগীর টেবিলে সুখ ফোটানোর অমল উদ্দেশ্যে।
আমার অস্তিত্ব থেকে অসুখের ছায়া সরে যাচ্ছে, দেখে যাও।
টেবিলে জমাট মেঘ
টেবিলে জমাট মেঘ এক খণ্ড যেন স্বপ্নে বুঁদ,
কিংবা অভিশপ্ত গ্রীক দেবীদের কেউ সারাক্ষণ
মুক্তির প্রহর গুণে গুণে ক্লান্ত, ঘুমে অচেতন,
এক্ষুণি উঠবে জেগে এবং সত্তায় তার হবে
মুঞ্জরিত ক্ষণে ক্ষণে বহুবর্ণ গভীর সংগীত।
টেবিল তরঙ্গ হয় বারে বারে মেঘের প্রভাবে।
যখন বুলাই হাত মেঘখণ্ডে, তোমাকে প্রবল
মনে পড়ে। টেবিলের স্বপ্নিল মেঘের অন্তরালে
আলোড়নকারী কোনো কণ্ঠস্বর আছে জেনে প্রতি
মুহূর্ত অপেক্ষা করি, কখন তোমার অস্তিত্বের
সুর হবে গুঞ্জরিত, কখন এ ঘর পুনরায়
ইডেনের লতাগুল্মে যাবে ছেয়ে, দূর সমুদ্রের
সফেন উল্লাসে হবে উচ্ছ্বসিত আর ভেনাসের
পদচ্ছাপ উঠবে জেগে রেণুময় নিঝুম মেঝেতে।
টেবিলে জমাট মেঘ বেজে ওঠে স্বপ্নে, জাগরণে।
সর্বদা কম্পিত হাতে তুলে নিই মেঘ, প্রতিবার
প্রতিহত আমি শব্দহীনতায়, জব্দ হই খুব।
তবে কি ওঠেনি বেজে মেঘপুঞ্জ? তবে কি মিথ্যেই
গভীর নিদ্রার হৃদে পড়ে টোল? শিরায় শিরায়
কেন তবে সূর্যোদয় আগণন, কেন ঝাঁক ঝাঁক
গাংচিল সহসা ওড়ে বুকের ভেতরে বারংবার?
আমার নিজস্ব হাড় কেন বেহালার মতো বাজে?
টেবিলের এক খণ্ড মেঘে আছে তন্দ্রিল সিম্ফনি
অলৌকিক, বুঝি তাই সুরস্নাত এ ঘর আমার।
দেখেছি কখনো টেবিলের মেঘপুঞ্জে দ্রাক্ষালতা
ক্রমবর্ধমান আর রূপোলি ঝালর চমকায়
ঘন ঘন, কখনো বা মেঘখণ্ডে মৃতকে আরেক
মৃতজন ভীষণ জড়িয়ে পড়ে থাকে স্তব্ধতায়
যমজ ভায়ের মতো। কখনো আবার সামুদ্রিক
মাছের কংকালে গড়া উদ্যান সেখানে জেগে ওঠে।
ইদানীং ভয়ে ভয়ে থাকি-যদি এই মেঘখণ্ড
মরাল সংগীত গেয়ে শেষে ডুবে যায় স্তব্ধতায়,
যদি অস্তরাগময় হয়, যদি মৃত শশকের
মতো একা পড়ে থাকে এক কোণে, তাহলে কী হবে?