কোথাও সোনালি ঘণ্টা
মাঝে-মধ্যে দূরে যাওয়া ভালো ভেবে মনস্থির করি
একটি ব্রিজের কাছে সাবলীলভাবে চলে যাবো
তুমি আর আমি ধুলিময় পথ হেঁটে একদিন।
মেঘার্ত দুপুরে সেই ব্রিজটির কাছে গিয়ে দেখি-
সমুখেই তৃণভূমি, একটি স্বপ্নিল ঝিল বেঁকে
গেছে দূরে, বুঝি ছুঁতে চায় কোথাও কাউকে আর
তিনটি বাছুর মাঠে দৌড়ায়, লাফায় কখনো বা।
ট্র্যাক্টর মাঠের স্বপ্নে তুলে তীব্র ঢেউ নিদ্রা যায়।
… কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
‘এই দ্যাখো আমাদের আপন দোচালা ঘর
এইতো দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালবিহীন’, বলে তুমি
সেদিকে এগিয়ে গেলে। যেন নিরিবিলি কাচময়
স্বপ্নের ডেরায় পেয়ে গেছি ঠাঁই আমরা দু’জন
শুকনো খড়ে বসে পড়ি। আমাদের আপ্যায়ন করে
গাছপালা, উড়ে-যাওয়া পাখি, দূরবর্তী শান্ত ঝিল।
… কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
হাওয়ায় উড়ছে চুল মাঝে-মাঝে, একটি কি দু’টি
গুচ্ছ নেমে আসে গালে, তোমার দু’চোখ কালজয়ী
প্রাচীন সোন্দর্য যেন। তোমার হাতের সাথে হয়
আমার হাতের দৃষ্টি বিনিময় নিসর্গের ঘরে।
… কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
একজন বুড়ো লাঠি দিয়ে নাড়ে খড় দূরে, যেন
আপন অতীতরাশি নিয়ে মেতেছে খেলায়। তুমি
হঠাৎ দুলিয়ে কালো ব্যাগ প্যাস্টোরাল অপরাহ্নে
বললে, ‘চলো, ফেরা যাক, গোধূলির ঘ্রাণ
আমার শরীরে মেশে, সমাজতো ধৃতরাষ্ট্র নয়।
আমি গোধূলির মতো গলে আবার সংহত হই।
… কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
গভীর হৃদয়জলে হৃদয় চলেছে ভেসে আজ
নিরুদেশে, বিদায়ের বাক্য থাকে প্রতিটি যাত্রায়।
দু’জন দু’দিকে যাই, সামনে পথ, শুধু দীর্ঘ পথ
ফুলপাতা, গাছ করে উচ্চারণ বাল্মীকির শ্লোক।
…কোথাও সোনালি ঘণ্টা বাজে বহুদূরে…
কোথায় তুমি?
একটি বনে সন্ধ্যেবেলা ঢুকে পড়েই মুষড়ে পড়ি,
হঠাৎ ভীষণ ক্লান্ত লাগে।
বন্য ঘ্রাণে ধরলো নেশা তড়িঘড়ি।
আগুন-রঙা স্বপ্ন জ্বলে তরুণ বাঘের পায়ের দাগে,
বনের মধ্যে মিশমিশে এক রাত্রি এল ক্রমান্বয়ে।
রাস্তাগুলি কোথায় এখন? চতুর্দিকে বনভূমি।
তোমার খোঁজে বনবাদাড়ে মত্ত হয়ে
ঘুরবো আমি চিরদিনই?
আমার দুঃখ-আলোয় ধৌত কৌমুদিনী
কোথায় তুমি? কোথায় তুমি? কোথায় তুমি?
বনের মধ্যে হাঁটছি একা, বড় একা, নগ্ন পায়ে
ফুটছে কাঁটা বারে বারে।
হঠাৎ যেন শুঁড়ের মতো কিসের ঘায়ে
ধরলো জ্বালা সত্তা জুড়ে বেবুন, বেবুন অন্ধকারে।
দীর্ঘ ঘাসে জখমি মৃগের রোঁয়া কাঁপে,
দিক-ঠিকানা লুপ্ত সবই; চতুদিকে বনভূমি।
তোমার জন্যে কোন্ পুরনো অভিশাপে
কাঁদবো আমি চিরদিনই?
আমার থেকে সরে যাওয়া কৌমুদিনী
কোথায় তুমি? কোথায় তুমি? কোথায় তুমি?
কোনো ইন্দ্রনীল অভিমান নেই
রাগের কারণ থালেও আমি আর রাগান্বিত হইনা এখন।
কারণাবিহীন ক্রোধে ফেটে পড়ে, আকাশের দিকে ছোঁড়ে হাত,
লাথি মারে, হায় আল্লা, আলখাল্লা-মোড়া সমাজের বেবুনসদৃশ
ঘোর বয়স্ক পাছায়,
তেমন ভীষণ রাগী লোক নই আমি, উপরন্তু
এখন আমার কোনো ইন্দ্রনীল অভিমান নেই।
কেউ কোনো বাঁকা কথা, কটু কথা বললেও মেজাজ
আজকাল হিস হিস করে না কখনো, কারো উপেক্ষা আমাকে
করে না কাতর আর। সন্ধ্যেবেলা মরুভূমি আজ, উষর সন্ধ্যায়
বুকে কত
উটের কংকাল, ভাঙ্গা বেহালা ছড়ানো ইতস্তত,
বালিয়াড়ি রক্ত শুষে নেয়, রক্ত শুষে নেয়, ঠাণ্ডা
পানির বদলে সর্পবিষ ঝরে ডাইনীর মতো বৃক্ষচূড়া থেকে,
তবুও নিজের হাত কামড়ে ধরি না বারংবার। বসে থাকি
গৃহকোণে চুপচাপ, যেন বা উপোসী বৃদ্ধ, ক্ষয়ে সমর্পিত।
সূর্যমুখী হার-পরা গাধা অজস্র পদ্যের পাতা খাচ্ছে বলে
প্রতিদিন যততত্র নতুন সারস মৃত পড়ে থাকে বলে
রাগ নেই, কোনো খেদ নেই
স্বতই জীবনোজ্জ্বল রুবেন্স-রমণী প্রায় কমনীয় ত্বকময়ী দয়িতা
আমাকে
একদিন ত্যাগ করে যাবে ভেবে। বসে থাকি একা বেড়ালের
পশমে ডুবিয়ে হাত, পশম কোমল বলে লিরিকের স্বরে-
বেঁচে আছো তুমি, বেঁচে আছো অলৌকিক মহল্লায়,
দেয়ালের ড্যাম্প-নকশা, কাচের গেলাশ টেবিলের উপত্যকা,
ঘাসফুল গান গায় তোমার সত্তায়, তুমি ওদের প্রগাঢ় মাতৃভাষা জানো।
এখন আমার কোনো ইন্দ্রনীল অভিমান নেই,
শুধু কবিতার চোখ অনুরাগে আমার দু’চোখ
না ছুঁলে কেমন করে মন আর বুকের ভিতর মৃত কোনো
শহর নিশুত কেঁদে ওঠে।
চন্দ্রোচ্ছ্বাস
এখন আমার আশাবাদ
অন্ধের যষ্টির মতো এদিকে-ওদিকে ঠুকে ঠুকে
করছে পরখ পথঘাট, মাঝে মাঝে কী বিস্বাদ
লাগে সবকিছু, এ জীবন ধুঁকে ধুঁকে
পথ চলে, কখনো বা থমকে দাঁড়ায়
খেলনার জ্বলজ্বলে বাক্সের সমুখে, ফেলে ঠাণ্ডা দীর্ঘশ্বাস।
কখন যে বাক্সটির ভেতরে হারায়
নিজেকেই, অনন্তর ফিরে আসে। বেবাক বাতিল এলেবেলে
ছিট কাপড়ের টুকরো হ’য়ে স্বপ্নগুলি ওড়ে। আমার জীবনে তুমি এলে
অকস্মাৎ, যেন উপদ্রুত এলাকায় চন্দ্রোচ্ছ্বাস।
চায়ের দোকানে বসে
চায়ের দোকানে বসে মেঘলা সন্ধ্যায় অকস্মাৎ সাধ হয়
রবীন্দ্রনাথের মতো চুলদাড়ি রেখে প্রেমিক সন্ন্যাসী হয়ে
রূপোর মতোন কিছু ভস্ম আলতো বুলিয়ে দিই রুক্ষ জীবনের গালে।
আমারও মুখমণ্ডলে উপনিষদের আভা বেশ
মিশ্চিন্ত করুক খেলা সারাবেলা, সাধ হয়। কয়েকটি
টক বিস্কুটের গুঁড়ো পড়ে থাকে বিবর্ণ পিরিচে।
উড়ছে গেরুয়া আলখাল্লা কালপুরুষের তলোয়ারে গাঁথা,
ধর্মকর্ম কতকাল করি না হে, বাতাসের কিছু কি
প্রবল নড়বে ভাবো কোনোদিন? বলা কওয়া নেই,
যেতে হয়, সবাইকে যেতে হয় শৌচাগারে আর শবাগারে।
চায়ের দোকানে বসে চেনা অচেনা মুখের ভিড়ে
এ রকম ভাবনার পাড়া ঘুরে বেড়াতে লাগে না মন্দ কখনো সখনো।
চায়ের দোকানে বসে মেঘলা সন্ধ্যায় খিস্তি খেউড়ের মাঝে
রবীন্দ্রনাথকে কেন টেনে আনা মিছেমিছি? বিশেষত তার চুলদাড়ি
বিষয়ে নীরব থাকা ভালো। অন্য কিছু ভাবা যাক, আমাদের দীর্ঘশ্বাসে
যাক বয়ে কিছু সিক্ত যুথী গন্ধ, মগজের অন্তর্গত আকাশে উড়ুক
আমাদের পোড়খাওয়া জীবনের বেদনার সাথী। যে বিদায় অকস্মাৎ
এসেছিল নেমে ভরসন্ধ্যার মতোন, তার কথা ভেবে নিজেকে
পোড়াই পুনরায়।
কেন তার কথা মনে পড়ে সারাক্ষণ, কেন? খোলা আকাশের
নিচে তার ওষ্ঠে, মনে পড়ে, খেলা করছিল সোমত্থ বিকেল,
তৃষ্ণার্থ যাত্রীর মতো আমি সেই ওষ্ঠস্থিত অপরাহ্ন চুমুকে চুমুকে
পান করতে গিয়ে প্রতিহত, হঠাৎ সে সরে গিয়ে বলেছিল
‘চুম্বনে আশ্লেষে শোনো, আমাকে খুঁজো না তুমি খুঁজোনা কখনো,
আমার আপন মনোলোকে আছো তুমি, থাকবে সর্বদা’।
ভিজিয়ে চোখের জলে সত্তা সে আমার হাত নম্র ছুঁয়েছিল,
তখন আকাশে ছিল বিদায়কালীন রুমালের মতো পাখি থর থর।
আমি সে ভুবনে আজ, মানে তার মনোলোকে, পড়ে আছি একা
(হৃদয়কে চোখ ঠারি) ছিন্নবেশ রুক্ষকেশ সন্তের মতোন উপবাসে।
আমাকে করছে রান্না সর্বক্ষণ ভীষণ আনাড়ি পাচকের মতো কেউ।
কে সে? কে সে? বলে আমি বিচ্ছেদের বালি মুখে পুরি চায়ের
দোকানে বসে
রবীন্দ্রনাথের মতো চুলদাড়ি রেখে প্রেমিক সন্ন্যাসী হয়ে যেতে চাই
দেশ দেশান্তরে বাদ্য বাজাতে বাজাতে পথপ্রান্তে নদীতীরে, ফুটপাতে, টার্মিনালে
এবং ছড়াতে চাই ভস্ম জীবনের মুখের উপর, মরণের চোখে,
(মরণরে, হে মোর মরণ)
দুনিয়াদারির কোনো তোয়াক্কা না রেখে অলৌকিক জমিদারি
ঔদাস্যে বেড়াই খুঁজে, এক জোড়া রণপা কোত্থেকে এসে যায়।
স্বপ্নের মতোন ভেসে ওঠে পথরেখা, ছিন্ন স্মৃতির মতোন দৃশ্যাবলী,
আমি ফুটপাত, ত্র্যাভিনিউ, মজা খালবিল লঞ্চ টার্মিনাল,
বাস ডিপো আর বনবাদাড়, আঁধার জমিজমা, চকচকে
ফ্ল্যাটে আর কোঠাবাড়ি, গোচারণ ভূমি
পায়ের অনেক নিচে রেখে হেঁটে যাই, হেঁটে যাই, হেঁটে যাই
কেমন চিত্রিত মুখে, মাথার উষ্ণীষ মেঘলগ্ন;
কেবল জ্বলতে থাকে মাথার উপরে ধ্রুবতারার মতোন তার চোখ,
বিপরীত জীবনের লোভ। বেলাশেষে লঘু প্রজাপতিদের
মোহন বিক্ষোভ দেখে লাস্যময় সময়ের কথা ভাবি, ভাবি
কোন পথ কোন দিকে যায়, কতদূর যায়? বিপুল জ্যোৎস্নায়
কাক কেন মাথা কোটে বৃক্ষমূলে পত্রালি অস্থির কেন হয়?
আমার বিরুদ্ধে কেন কথা বলে বারংবার আমারই হৃদয়?