কী ভাবছো তুমি?
কী ভাবছো? কী ভাবছো তুমি অন্তরালে? কাল রাত
নির্ঘুম কেটেছে বুঝি? নানা স্তর থেকে অকস্মাৎ
অসংখ্য বিলুপ্ত প্রাণী, সংহারপ্রবণ, সংহারপ্রবণ, অতি কোলাহলময়
এবং অকুতোভয়,
উঠে এসেছিল দিতে হানা
তোমার এ জরাগ্রস্ত ঘরে? মেলেছিল রুক্ষ ডানা
ভয়ঙ্কর কোনো পাখি ঢেকে দিতে অস্তিত্ব তোমার?
নাকি ভুলে-যাওয়া সব পাখি, অস্পষ্ট ফুলের ঝাড়
মনের ভিতরে
পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দেখছো কর্কশ বালুচরে
পড়ে আছো, যেখানে রঙের খেলা নেই, ফুলঘ্রাণ
নেই একরত্তি, কতকাল কোনো গান
বাজেনি তোমার প্রাণে। কেবলি ক্ষয়ের টানে একা
উদাস চলেছো ভেসে, চতুর্দিকে কম্পমান বনরেখা।
যে-জন বাজায় বেলা দু’হাতে একেলা, তুমি তার
কাছ থেকে বহু দূরে চলে গ্যাছো, যার অন্ধকার
ফুলের স্তবক হয়, জ্যোৎস্নায় সাঁতার কেটে, ডুব
দিয়ে মল্লিকার বনে যে-জন আড়ালে দ্যাখে খুব
মগ্ন হয়ে একটি অস্পষ্ট পরী, দ্যাখে সেই পরী
মগের ভিতরে তার আঙুল ডুবিয়ে রত্ন, ঘড়ি,
এবং পিঙ্গল চোখ তুলে আনে, তার পরগণা
থেকে নির্বাসিত তুমি। তোমার মগজে ধূলিকণা
ওড়ে অবিরত ইদানীং। এ ভীষণ বনবাস
কখন কাটবে বলো? করে পাবে করোটি সুবাস?
স্বপ্নের জটিল লতা-গুল্মময় হৃদয়ের তন্তুগুলি দ্রুত খাচ্ছে উঁই
অগোচরে, বেলা যায়। পরিপার্শ্ব বিদেশ-বিভূঁই
মনে হয়; কোথায় কী আছে
বাসগৃহে, ফুটপাতে, দূরবর্তী গাছে,
যেওনা-পল্লীর কাছে, ভুলে থাকো? কী ভাবছো?
কী ভাবছো তুমি?
ভাবছো কি মানুষের আলুথালু সত্তা দুঃস্বপ্নের জন্মভূমি?
ভাবছো কি কৃষ্ণচূড়া প্রায় ডাকঘর
অতিশয় শূন্য, মুছে যায় স্বপ্নাক্ষর
কালো ফুঁয়ে বারংবার, ঝরণা তলে কেন কুড়োয় না ফুল সুধা,
বুলেটের ঝড়ে আর্তস্বরে ডেকে যান দীর্ণ পাবলো নেরুদা?
কে আসে এমন ধু ধু অবেলায়
কে আসে এমন ধু ধু অবেলায় আমার নিবাসে?
জীর্ণ শীর্ণ আমার নিবাসে
কে আসে তীক্ষ্ণ ক্ষুধার্ত চোখে? করে না তেমন পীড়াপীড়ি কিছু,
চায় না কিছুই, নগ্ন সিঁড়িতে বসে থাকে একা,
বসে থাকে একা,
বসে থাকে একা।
বসে থাকে একা।
উস্কো খুস্কো চুলের ভেতরে স্বপ্ন বুঝিবা হরিণের মতো
করে ছোটছুটি। সরু আঙুলের ডগায় জমেছে স্মৃতির অভ্র।
এখানে আসার কথাই ছিল না। এই লোকালয়,
ফুটপাত, গলি কমলালেবুর স্নেহপরায়ণ
রঙ, শহরের দুঃস্থ বুড়োটে বাজিকর আর খাঁচার ময়না।
ছেড়ে ছুড়ে কবে চলে গিয়েছিল; তবু সে এসেছে
ফিরে উদাসীন। চোখের কিনারে রঙ-বেরঙের
পাখি মরে যায়,
পাখি মরে যায়,
পাখি মরে যায়।
নিজেকে বন্দি রেখেছে বাক্যের জালে।
মুক্তির গান শুনে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়তে চাইলে দ্যাখে সে
জালের সীমানা বাড়তেই থাকে মোহের বুননে
বাড়তেই থাকে,
বাড়তেই থাকে,
বাড়তেই থাকে।
একদা ছিলাম সতেজ যুবক, একদা আমার দিনের অশ্ব
ছুটেছিল কত খোলা প্রান্তরে বালিয়াড়ি আর
গিরি-সংকটে, ক্ষুরের ঝিলিকে মুগ্ধ সবাই।
এখন এইতো ছেঁড়া খোঁড়া আমি, অবসাদ-ছাওয়া।
মনে বসে আছি, দুঃখের সাথে ভাগাভাগি করে
নিজেকে; দু’বেলা করছি আহার, নিজেরই রক্তে ওজু সেরে ফেলি
তীব্র খরায়, বকুল এখন ফুটলো কোথায় ইত্যাদি কথা
বলে সে হঠাৎ নিশ্চুপ হয়। অলক্ষ্যে তার বুকের ভেতরে
বুক ভেঙে যায়,
বুক ভেঙে যায়,
বুক ভেঙে যায়।
কেউ কি এখন
কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
আমার স্মৃতির ঝোপেঝাড়ে
হরিণ কাঁদে অন্ধকারে,
এখন আমার বুকের ভেতর
শুকনো পাতা, বিষের মতো রাত।
দ্বিধান্বিত দাঁড়িয়ে আছি
একটি সাঁকোর কাছাকাছি,
চোখ ফেরাতেই দেখি সাঁকো
এক নিমেষে ভাঙলো অকস্মাৎ।
গৃহে প্রবেশ করবো সুখে?
চৌকাঠে যায় কপাল ঠুকে।
বাইরে থাকি নত মুখে
নেকড়েগুলো দেখায় তীক্ষ দাঁত।
অপরাহ্নে ভালোবাসা
চক্ষে নিয়ে গহন ভাষা
গান শোনালো সর্বনাশা,
এই কি তবে মোহন অপঘাত?
কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
কেন তুমি অভিমানে
কেন তুমি অভিমানে এমন বিষণ্ন আলা ছড়াও আমাকে
ম্লান করে যখন তখন?
কেন যে সরিয়ে নাও হাত নানা ছলে,
বুঝি না কিছুই।
এরকম দৃষ্টি দাও যদি, তাহলে আমার সত্তা জমে
নিথর পাথর হ’য়ে যাবে, মগজ বেবাক খড়ে
যাবে ভরে, আমি শুধু দম দেয়া পুতুলের মতো
একাকী ঘুরবো দিগ্ধিদিক।
তোমার চুম্বন থেকে, আলিঙ্গন থেকে বহুদূরে
পড়ে আছি একা শ্বাসকষ্ট হয় রাত্রিদিন, তুমি
অন্যত্র তোমার
সৌন্দর্যের শিখা জ্বেলে আছো
আমার কষ্টের প্রতি উদাসীন।
আমার বিরূদ্ধে আজ একে একে সকলেই গেছে-
আমার বিরূদ্ধে
পাখিরা নিয়েছে নিন্দা প্রস্তাব, নক্ষত্র
প্রতিবাদ মুখর এবং
শহর ব্যানারে তার লিখেছে বিশাল লাল সুস্পষ্ট অক্ষরে,
‘নির্বাসনে যাও’।
আমার নিজেরই ঘর হয়ে যায় জ্বলন্ত কবর,
এমন কি হাওয়া আজ প্রহরে প্রহরে
শক্রতা সাধছে শুধু জাগিয়ে তোমার স্মৃতিমালা,
নিভিয়ে স্বপ্নের দীপাবলী।
আমার নিকট থেকে তুমি সরে গেলে অভিমানে
একটি সভ্যতা অতি দ্রুত ভেঙে যাবে
আমার ভেতরে।
এই যে আমার যাত্রা, কখনো তা’ তোমাকে পেছনে
ফেলে নয়, তুমি চিরসঙ্গিনী আমার
পথে কি বিপথে, যেখানেই পড়ুক আমার পদচ্ছাপ।
তোমার সমুখে নতজানু হয়ে বলি-
আমাকে পেছনে ফেলে তুচ্ছতার ভিড়ে
আমার নিকট থেকে দূরে
যেও না কখনো।
আমিতো তোমার ভেতরেই সারাক্ষণ সুখে-দুঃখে
দাঁড়িয়ে থাকতে চাই, হতে চাই গান স্তব্ধতায়,-
এই ইচ্ছা প্রতিটি ঋতুতে
প্রবল সজীব থাকে। যখন খুলবো চক্ষুদ্বয়,
তখন তোমারই দিকে পড়ে যেন চোখ।