কখনো কখনো স্মৃতি
কখনো কখনো স্মৃতি রাজনীতির মতোন তীব্র
হয়ে ওঠে, ক্রমাগত জিভ তার এগোতেই থাকে।
কোনো কোনো বস্তু কিংবা ব্যক্তি রশ্মির আকারে
স্মৃতির জিহ্বায় নাচে, কখনো বা স্মৃতি অকস্মাৎ
ভীষণ অসামাজিক। কুয়োতলা,সাঁকো, মুখচ্ছবি
ধু-ধু হৃদয়কে করে গোপনে লেহন। বেঁচে থাকা
আপাতত গলি, পার্ক ফুটপাতে সমর্থন পেয়ে
আমার নিজের মধ্যে সুড়ঙ্গ বানায় রাত্রিদিন।
কুয়োজলে স্নান সেরে কেন নদীতীরে চলে যাই?
এখনো মাথার চুল অতিশয় ভেজা, বেলাবেলি
আবার ফিরলে ঘরে দেখবো কি অম্লান বাসন
সাজিয়ে রেখেছে কেউ। হাত-পাখা মাদুরের কাছে
স্বপ্নের হাতের মতো শুয়ে আছে দেখবো কি খর
মধ্যাহ্নে অথবা পাবো শুধু ধবধবে শূন্যতাকে?
কবির ডায়েরী
সকালে ফাউস্ট পড়লাম, কিছুক্ষণ তরতাজা
সংবাদপত্রও বটে, সদ্য-দেখা যুদ্ধার্ত পোলিশ
ফিল্মের নানান শট মনে পড়ে। করি ঘষামাজা
পঙক্তিমালা কবিতায়, জানালায় মেফিস্টোফিলিস
হাসে, পা দোলায় ঘন ঘন, তার উত্তোলিত ভুরু
সর্বক্ষণ জপে মৃত্যু, কখনো বা হঠাৎ দাঁড়িয়ে
আমাকে শোনায় তত্ত্ব রাশি রাশি। ভেনাসের ঊরু
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কিংবা প্ল্যাটো দিলেন বাড়িয়ে
তাঁর হাত মগজের কোষে কোষে। বেহুলা কখন
আসে লখিন্দরময় ভেলা নিয়ে খলখলে জলে,
নিজেই বিস্মিত হই। চিত্রকল্প যখন তখন
নেচে ওঠে চতুষ্পার্শ্বে, দেয়ালের থেকে কত ছলে হঠাৎ বেরিয়ে আসে চিত্রমালা,
শূন্য থেকে আসে,
যেমন মেঘের পরে জমে মেঘ। দুপুরে চৈনিক
রেস্তোরাঁয় তিনজন তীক্ষ্ম সমালোচকের পাশে
বসে আস্তে সুস্থে করলাম মধ্যাহ্ন ভোজন, ঠিক
বুঝতে পারিনি কী যে ওঁরা তিব্বতী মন্ত্রের মতো আউড়ে গেলেন কিছুক্ষণ নিশ্চল
জ্যাকেট হয়ে,
বোঝালেন কী কী বস্তু নিরঞ্জন সাহিত্যসম্মত।
বেরুলে নতুন বই কিছুকাল থাকি ভয়ে ভয়ে।
রিভিউ মুদ্রিত হলে কোথায় নতুন পাণ্ডুলিপি
আপনার বলবে কি প্রকাশক কিংবা সম্পাদক
‘আগামী সংখ্যায় অবশ্যই লেখা চাই’, বলে ছিপি
খোলা সোড়া বোতলের মতো হবেন কি? ধ্বক
করে ওঠে বুক অকস্মাৎ। থাক, আপাতত বেলা
থাক আড্ডা দিয়ে বাদ্য শুনে, স্বপ্নলোকে ছুঁড়ে ঢেলা।
প্রায়শই গাঢ় সন্ধ্যা উপহার দেয় কিছু কথা,
লতাগুল্ময় উৎস থেকে উচ্ছ্বসিত জ্যোৎস্নামাখা।
ঝরণার মতোন হাসি, আধফোটা স্বপ্ন, ব্যাকুলতা।
চোখ বুজলেই দেখি কালো বধ্যভুমির উপরে
একটি রহস্যময় পাখি উড়ে উড়ে গান গায়
সারারাত। কবেকার মিউজিসিয়ান আস্তে করে
প্রবেশ আমার ঘরে, ধুলো ঝাড়ে শরীরের, খায়,
মদ চামড়ার থলে শূন্য করে। তার বেহালার
তারে আদি কান্না, সুপ্রাচীন স্মৃতি বাজে, আমি তাকে
ঘরে রেখে নামি পথে। ফুটপাত, গাছ, অন্ধকার,
বেশ্যার চোখের মতো রেস্তোঁরার আলো শুধু ডাকে
আমাকেই, যে আমি তাদের আপনজন আর
আমার নিবাস এখানেই, এই সত্য হয় গান
অস্তিত্বের মাঠে, পুনরায় মধ্যরাতে ফিরে আসি
ঘরে, কড়া নাড়ি, শুতে যাই, দেখি বিধ্বস্ত বাগান
ঘরময়, পরাভুত নগরীর দেয়াল, মিনার
স্মৃতির অরণ্য চিরে জাগে, শব্দের বুদ্বুদ নাচে
শিরায় শিরায়, হয় পঙক্তিমালা, যেন আদিবাসী
আমি নগ্ন, নতজানু অন্ধকারে রহেস্যর কাছে।
ঘুমঘোরে ভাবি ফের অর্ফিয়ুস বাজাবে কি বাঁশি?
কিছুদিন থেকে
কিছুদিন থেকে আমি অতিশয় মনোকষ্টে আছি
একটি সংসার খুব খাপছাড়া অথচ সুন্দর,
স্বতন্ত্র সাজাবো ভেবে কিছুকাল ছিলাম বিভোর।
এ ব্যাপার কিছুতেই হওয়ার নয় বলে চলে গ্যাছে
পাথরের মতো কেউ, পড়ে আছে এখানে সেখানে
শেকড়-বাকড় আর সম্পর্কের ছিন্ন তন্তুজাল।
মদ্যপ যেমন তার শূন্য বাসি গেলাশের দিকে
তাকায়, আমিও তেমনি চেয়ে থাকি নিজস্ব আয়নায়
মাঝে মাঝে। কোনোদিন মুঠোয় আমার জুঁই কিংবা
চামেলী ছিল কি সত্যি? আজ হস্তময় ঘূণপোকা।
ক্ষ্যাপা, বড় ক্ষ্যাপা এই মন দীর্ঘ সূতো ছেড়ে ছেড়ে
লাটাই করেছে শূন্য। হায়, সুদূর মেঘের ঘুড়ি,
উড্ডীন রঙিন ঘুড়ি ফিরে আসবে না কোনোদিন।
হৃদয়ে অনেক মৃত প্রজপতি, মরাল-কংকাল।
স্বপ্নের ভিতরে ক্ষিপ্র ডালকুত্তা শোঁকে আমার
সর্বক্ষণ ধেয়ে আসে পেছনে পেছনে। রুদ্ধশ্বাস
আমি শুধু খুঁজি বনবাদাড়ে আশ্রয়, কিন্তু, হায়,
জঙ্গলও ভীষণ লোকালয়। স্বপ্নে ভিতরে ঘোরে,
আমার চৌদিকে ঘোরে কী কর্কশ কান ঢাকা ছায়া,
সাপ ওড়ে,আমি নগ্ন, একা ধ্বস্ত কবরখানায়।
কী করে যে বেঁচে ছিল
এখানে নানানভাবে নানাজন কাটায় জীবন।
কেউ রাস্তা খোঁড়ে, কেউ টানে গুণ ধান ক্ষেত ঘেঁষে,
কেউবা আপিশে লেখে নথিপত্র, কেউ কেউ ঘোরে
উদাস প্রান্তরে বনবনান্তরে, কেউ গেরস্থালি
ভালোবেসে নীড়মুখী পাখির মতোন মনোযোগে
সাজায় সংসার, কারো দিন যায় গাছের ছায়ায়
পথপ্রান্তে কী একাকী। কেউ কেউ নিজস্ব বিবরে
স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকে, কেউবা বাঁচার মানে খোঁজে
মিছিলে সভায় আর নেতার ভাষণে। কারো সরু
দড়ির ওপর হেঁটে-যাওয়া, কারো শুধু বসে-থাকা।
হরিদ্রাভ গ্রন্থাগারে কারো বই পড়ে কাটে বেলা,
আর নিরক্ষর কেউ জীবন বিশদ করে পাঠ
মেধাবী ছাত্রের মতো। কারো কারো চোখ এত শাদা,
তাদের দৃষ্টিতে গাছ শুধু গাছ, আকাশ আকাশ,
কেউ কেউ শূন্যতায় অকস্মাৎ দেখে ফেলে কত
সুনীল, সবুজ ঘোড়া, দ্যাখে ওরা নৌকো ফুল হ’য়ে
গহন নদীতে ভাসে। কেউ টিন আর সীসা নিয়ে
সর্বদা ঘামায় মাথা; কেউ গাছ থেকে, গর্ত থেকে
অথবা পাতাল থেকে শব্দ তুলে আনে নিরিবিলি।
এরকম নানা খাতে বয় নানাজনের জীবন।
জীবনে ঔদাস্য কিছু, কিছু গূঢ় অস্পষ্টতা থাকে।
অস্পষ্টতা হেতু বাড়ে আকর্ষণ, আংটির মতোন
পরি কত রহস্যের সোনালির হলুদ সুতো, পড়ি
বেড়ালের চোখে স্মৃতি, মৃত প্রেমিকের সঙ্গে হাঁটি
অস্পষ্ট প্রহরে পারস্পর্যহীন কালের বাগানে।
স্বাপ্নিকের আস্তানায় নৃত্যপর প্রাচীন করোটি,
ওষ্ঠে কর্কশতা আর ধূলোবালি নিয়ে বেঁচে থাকি,
অথচ পাইনি খুঁজে অদ্যাবধি বাঁচার নিয়ম।
পরবর্তীগণ সবিস্ময়ে বলবেন কোনোদিন-
সর্বনাশ গোলযোগে কী করে যে বেঁচেছিল ওরা।