ঈদকার্ড, ১৯৭৭
হঠাৎ হারিয়ে ফেলি যদি দৃষ্টিশক্তি কোনোদিন,
তবুও তোমাকে আমি দেখবো সর্বদা সবখানে।
যদি পক্ষাঘাতে হই হীনবল, চলৎশক্তিহীন,
তথাপি নিশ্চিত আমি ছুটে যাবো তোমারই বাগানে,
যেখানে থাকবে বসে তুমি সবুজ মেঘের মতো
ঘাসে কিংবা ডাল থেকে অন্যমনে তুলে নেবে ফুল।
যদি কোনো দ্রুত ধাবমান যান কিংবা দৃষ্ট ক্ষত
কেড়ে নেয় আমার দু’হাত, তবু তোমাকে ব্যাকুল
বাঁধবো নিবিড় আলিঙ্গনে। যদি ওষ্ঠ মুছে যায়
নিষ্ঠুর ফুৎকারে কারো, তবু গাঢ় করবো চুম্বন
তোমার মদির তাপময় অস্তিত্বের কিনারায়
বারংবার, যদি স্তদ্ধ হয়ে যায় এই হৃৎস্পন্দন
আমার, তবুও শিরাপুঞ্জে প্রতি রক্তকণিকায়
তোমাকে ধারণ করে একা পড়ে থাকবো শয্যায়।
উল্টো দিকে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন
অন্ধের মতোন আমি অন্ধদের মধ্যে সারাক্ষণ
হাতড়ে বেড়াই কী-যে বুঝি না নিজেই।
পুরোনো চিঠির খাম? চকচকে শূন্য থালা, নাকি
টগর, মল্লিকা ফুটফুটে?
দলছুট কাকাতুয়া? রঙিন টিকিট?
কোথাও না-পাওয়া
কখনো না-দেখা
মানুষের হৃৎপিণ্ডের মতো থর থর কোনো প্রাণী?
মেঘের জঙ্গল থেকে নেমে আসা এবং হাওয়ায়
ভাসা নানারঙা ঘোড়াদের ফুল্ল দানাপানি? শোনো,
যা হোক একটা কিছু হাতে
এলে, ছুঁতে গেলে স্মৃতিময়, স্মৃতিহীন
যে-কোনো জিনিশ,
স্বস্তি পাবো ভেবে ঘুরি সবখানে। কখনো বাড়াই হাত ডানে,
কখনো-বা যাই বাঁয়ে, একটানা খুঁজি।
মাঝে-মধ্যে প্রশ্ন করি-দোটানায়
এভাবে ফুরোবে তবে জীবনের পুঁজি রুক্ষ পথে, বধিরের
আস্তানার?
বিবর্ণ যুগল চেয়ারের অভ্যন্তর থেকে
ভেসে আসে স্বর
এখানে খুঁজো না কিছু, হবে প্রতিহত।
দেয়ালে সন্তের চোখ, ধারালো, সুদুর-
চোখ ডেকে বলে
এখানে খুঁজো না কিছু, হবে প্রতিহত।
তুমি শত লোক হয়ে খুঁজলেও আহতের ব্যান্ডেজের মতো
সান্তনা পাবে না।
ফিরে যাও, তুমি ফিরে যাও।
ভয়-পাওয়া শিশুর মতোন
ভয় চোখ ঢেকে থাকে পাঁজরের ভেতরে, আমার,
বলে শিউরোনো কণ্ঠস্বরেঃ
এখানে খুঁজো না কিছু অন্ধ নিকেতনে,
ফিরে যাও, তুমি ফিরে যাও।
মানুষের হৃদয়ের ভেতরে চালিয়ে দিয়ে খুব
কম্প্রমান পাঁচটি আঙুল
ভীষণ পাথুরে কিছু করি অনুভব, বাড়ে উপদ্রব।
গোলাপের গল্প শুনে সাত তাড়াতাড়ি
গোলাপ বাগানে যাই, দরজা পেরিয়ে বুঝি, রকের বাশিন্দা
অতিশয় ধাপ্পাবাজ সে কথক। কীটের পাহাড়ে
গৌতম বুদ্ধের পোজে
বাহারী পোশাক পরে বসে আছে সঙ, কোলে তার
কংকালের ভায়োলিন, তার চক্ষুদ্বয়
পাখির পুরীষে ঢাকা, আমি
দ্রুত ফিরে এসে দেখি ক্রমাগত উল্টো দিকে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন।
একদা
সতেজ ঘাসের মতো চকচকে এক ঘোড়া দৌড়ে এসে
একটা জলাশয়ের সামনে দাঁড়ালো।
তখনো তার কেশর থেকে, ক্ষুর থেকে মুছে যায়নি সূর্যাস্তের রঙ।
টলটলে জলের দিকে গ্রীবা বাড়িয়ে
দেখলো সে, আধখানা চাঁদ বন্দিনি রাজকন্যার মতো
চেয়ে আছে তার চোখের প্রতি।
বনের ঘন কালো আকাশের নিষ্পলক চেয়ে থাকা-
সব কিছু অমান্য করে সে
তার মুখ বাড়িয়ে দিলো জলাশয়ে, জলপানের জন্যে নয়,
বন্দিনি রাজকন্যার ওষ্ঠে চুম্বন আঁকার জন্যে।
শীতল পানির স্পর্শ নিয়ে ফিরে এল ওর মুখ
অচুম্বিত, বিচূর্ণিত চাঁদ
প্রত্যাবর্তন করে তার নিজস্ব অবয়বে।
তেজী আর চকচকে ঘোড়াটার কেশর থেকে
ঝরতে থাকে বিন্দু বিন্দু
জলের মতো স্বপ্ন আর
স্বপ্নের মতো জল।
রহস্যময় বনের দিকে তাকিয়ে
হঠাৎ ঘোড়াটার মনে পড়ে গেল
সেই ভুলুণ্ঠিত তেজস্বী সওয়ারের কথা, একদা যে তার পিঠে বসে
ঘুরে বেড়াতো দূর-দূরান্তে,
যার হাতে ছিল ভালোবাসার পতাকা
আর মাথায় সূর্যের মতো উষ্ণীষ।
এখন তোমাকে ছাড়া
আসে না দু’চোখে ঘুম কিছুতেই কোনো কোনো রাতে
তোমাকে প্রবল ভেবে। কত হিজিবিজি, ছায়াবাজী
প্রহরে প্রহরে দেখি, দেখি অস্থিচর্মসার মাঝি
নৌকোর কংকাল নিয়ে বুকে ঝোড়ো জলের আঘাতে
ছিন্নভিন্ন কালো চরে। নয় সবুজ পাতার ভিড়ে,
ভাঙা কবরের পাশে একটি কোকিল করে বাস,
স্মৃতিপোষ্য, আর গানে তার শিহরিত বুনো ঘাস
ঘন ঘন, মহাকায় কৃকলাস ঘোরে নদীতীরে।
নির্ঘুম রাত্তিরে জ্বলি শূন্য ঘরে অত্যন্ত একাকী,
কী বলতে কী বলে ফেলি নিজেকেই। একটি প্রতিমা,
সে তোমারই অবয়ব, জেগে ওঠে বাস্তবের সীমা
ছিঁড়ে খুঁড়ে, পুনরায় স্বপ্নস্মৃতিময় সে বৈভব
সরে যায় দূরে, ভগ্ন কণ্ঠে ডাকি, তোমাকে ডাকি,
এখন তোমাকে ছাড়া সুনিশ্চিত বাঁচা অসম্ভব।
এখনো উদ্বেগে কাঁপি
এখনো কি অন্ধকার কোণে একা ভীষণ নিশ্চুপ
আড়ালে থাকবো বসে? এখনো কি কারো খুব কালো
চুলের ছায়ার কথা ভেবে-ভেবে, গহন দৃষ্টির
অত্যন্ত রাঙ্ময় কোনো ভিতর ভূবন আবিষ্কার
করে দিব্যি সম্মেহিত কাটাবো প্রহর? এখনো কি?
নিজের প্রশ্নের কাছে নিজেকেই বড় অসহায়
মনে হয়। সে আমার দিকে তার সুরভিত
করতল পুনরায় বাড়িয়ে দেবে কি ভেবে আমি
এখনো উদ্বেগে কাঁপি। বৈরী বায়ুস্তরে বিপর্যস্ত
ঈগল আবার যদি না পায় আশ্রয় কোনোখানে,
তবে কার কী বা এসে যায়? তার ছিন্ন ডানা থেকে
একটি অস্পষ্ট ইতিহাস আর্তস্বরে উন্মোচিত
হতে চায়। ঝড়ক্লান্ত ঈগলের রক্তাক্ত ডানায়
আমার অতীত মগ্ন, নিজেরই শোণিত করি পান।
এবং প্রকৃত বিল্পবীর মতো
আমি তো একাই থাকি রাত্রিদিন, হৃদয়ের ক্ষত
শুঁকি, চাটি বারংবার। বোমাধ্বস্ত শহরে যেমন
নিঃসঙ্গ মানুষ ঘোরে, খোঁজে চেনা মুখ কিংবা
স্বজনের মৃতদেহ, প্রত্যহ আমি তেমনি করি
চলাফেরা একা একা। ধ্বংসস্তূপে চোখ পড়লেই
আমার অস্তিত্ব করে আর্তনাদ। কবেকার গাঢ়
বেহালার সুর বাজে পুনরায়, সভ্যতার পোকা-ছাওয়া মাংস
স্পন্দিত সে সুরে।
একটি ভালুক, লাল, বড় স্তব্ধ, বহুদিন থেকে
নিরিবিলি ঘরে
রয়েছে দাঁড়িয়ে ঠায়। যদি প্রাণ পায় চলে যাবে তাড়াতাড়ি
মৌচাকের খোঁজে দূরে বাড়িটিকে ফেলে। বিটোফেনি সুর ঝরে
তার গায়, চক্ষুদ্বয় অত্যন্ত সজীব হতে চায়। নিরুপায়
অন্ধতায় তার বেলা যায়।
একটি চিঠির খাম পড়ে আছে টেবিলের বুকে গোধূলিতে
নিষ্প্রাণ পাখির মতো। পুরোনো চেয়ার অকস্মাৎ
দূর শতাব্দীর
সিংহাসন হ’য়ে মিশে যায় ফ্যাক্টরির কালো পেঁচানো ধোঁয়ায়।
চতুষ্পার্শ্বে সভ্যতার মতো কিছু গড়ে ওঠে, ভেঙ্গে যায় ফের,
কম্পমান অন্ধকারে একরাশ বেহালা চোখের মতো জ্বলে।
কবির মেধার কাছে সভ্যতা কী চেয়ে বিমুখ হয়ে থাকে
বারংবার? মরণের সঙ্গে দাবা খেলে অবসন্ন কবি,
পাণ্ডুলিপি, ফুল মেঘে ছড়াতে ছড়াতে চলে যায় অবেলায়।
আমিতো একাই থাকি রাত্রিদিন। কবি জনস্রোতে,
মোটরের ভিড়ে বুনো ঘোড়ার মতোন থতমত;
আর্তনাদ করে তার পেশী, চক্ষুঃশিরা যেন স্মৃতি
ক্রন্দনের মতো আসে ব্যেপে অস্তিত্বের কন্টকিত তটে!
চতুর্দিকে বাজে ট্রাফিকের কলরব, চোখ বেয়ে
ঝরঝর মুহূর্ত ঝরে, জনতার পাশাপাশি মৃত্যু হাঁটে,
কোথায় সে গোধূমের ক্ষেত পুড়ে যায়, শূন্য ঘরে
টেলিফোন একটানা বেড়ে চলে, শুনেছো তো, হায়,
রেডিয়োর সন্ধ্যার খবরে।
এলভিস প্রেসলির মৃত্যু রটে গেছে চরাচরে। চারখানায়
আড্ডা জমে, পপ সুরে মারফতী গান শুনে মাথা নাড়ে বিগত-যৌবন
ফেরিঅলা। অন্ধকারে তরুণ কবির চোখে পড়ে
অপ্সীরর স্তন,
হিজড়ের সুবজাভ গাল, নর্দমায় ভাসমান সুন্দরীর মৃতদেহ।
দ্যাখো দ্যাখো এ শহরে কী ঘর বানায় ওরা শূন্যের মাঝার।
আমিতো একাই থাকি রাত্রিদিন। এখন কোথায় তুমি কোন
সভ্যতার আলো
চোখে নিয়ে আছো শূন্য বারান্দায়? সৌন্দর্য তোমার
সাথে আছে, তোমাতেই মিশে আছে। পাথরের সিঁড়ি
ভেঙ্গে ভেঙ্গে হেঁটে
বহুদূর চলে গেছে বুঝি? একজন কবি তার ব্যাকুলতা,
শব্দপ্রেম রেখেছিলে। তোমার কোমল অঞ্জলিতে-
মনে পড়ে নাকি?
থেমে-যাওয়া ক্যাসেটের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে জানালার
বাইরে কি যেন দেখানোর ছলে আমার আপন
হৃদয়ের অন্তলীন গুহার আঁধার কত সজীব জাগ্রত
দেখে নিতে চেয়েছিলে? অদৃশ্য হরিণ কাঁদে তোমার বাগানে
গভীর রাত্তিরে ঘুরে ঘুরে।
বারান্দায়, ছাদে আর সিঁড়িতে অস্পষ্ট পদধ্বনি, বাড়িটার
দু’চোখে পা ঠোকে ঘোড়া, কার জেল্লাদার পোশাকের
স্পর্শ লাগে তার গালে, বুকে বিদ্ধ কামার্ত নিশান।
বিপ্লবের আগুনের মতো কিছু চক্রাকারে ঘোরে চতুর্দিকে,
কেউ হাত সেঁকে, কেউ পুড়ে ছারখার হয়। হৃদয় কী ঘোরে
সময় আবৃত্তি করে, প্রতীক্ষায় থাকে, জ্বলে আবেগকম্পিত,
স্মৃতিভারাতুর কোনো গজলের মতো।
আমি তো একাই থাকি রাত্রিদিন। কখনো সখনো লোকজন
থাকে বটে আশেপাশে কিংবা
চেনা মহলের চৌহদ্দিতে বসবাস করতেই হয়, কণ্ঠ
মেলাতেই হয় সংসারের ঐকতানে, তবু আমি দৈনন্দিন
কলরবে অকস্মাৎ কেমন রহস্যময় হয়ে উঠি নিজেরই অজ্ঞাতে,
কেমন নিশ্চুপ
এবং প্রকৃত বিপ্লবীর মতো জেগে থাকি নিজস্ব ভূগর্ভে
উদাসীন, একা।