শিল্পের অপচয়
মনে হয়, কতকাল বাইরে যাইনি কতকাল,
যেন হিমযুগে রয়ে গেছি, অন্ধকার বাস করে
দীর্ঘকাল বাস করে, হৃদয় কেমন কৃষ্ণকায়
তুষারের মতো হয়ে গেছে। লতাগুল্ম কিছু নেই
চুতুষ্পার্শ্বে, বুজে থাকা চোখ বড় বেশি ঢাকা রুক্ষ
পাথুরের কণায়, ঘোড়া কোথায় যে উধাও, একটি
শীতল গুহায় আমি ভীষণ আটকা পড়ে গেছি।
আমাকে পাবে কি খুঁজে কখনো উদ্ধারকারী দল?
এখন পাতিনা আর কান কোনো শব্দের উদ্দেশে,
পাছে প্রতারিত হই। হাতে হাত ঘষি বারংবার
জ্বালানিবিহীন, ক্রমাগত নীল-হয়ে-আসা ওষ্ঠে
নাচে স্বপ্ন, নাচে স্মৃতি; জন্ম-জন্মান্তর কম্পমান
দৃষ্টিপথে। যদি কেউ আসে এখানে, দেখবে একা
বিশীর্ণ কংকাল আর দেয়ালে শিল্পের অপচয়।
শুভেচ্ছান্তে
তোমার বয়স কত হলো ঠিক? ঝড়ে-জলে আজ
তেষট্রি পেরুলে বুঝি। আমিও তোমাকে সুপ্রাচীন
ধুমল কাগুজে স্তূপে অতিশয় পরিণামহীন
বিবর্ণ দলিল ভেবে বস্তুত ছিলাম ভুলে। বাজ
পাখি বলে রটেনি তোমার নাম কিংবা অধিরাজ
ছিলে না কখনো কোনো কবিসংঘে। বড় বেশি ক্ষীণ
স্বাস্থ্য আজ; হাঁপানি এবং বাতে কাটে নিশিদিন।
ছিল না তোমার পদ্যে বিশ্ববীক্ষা, সূক্ষ্ম কারুকাজ।
বেঠিক মাটিতে তুমি ছড়িয়েছো বীজ ক্রমাগত
বছর বছর? কিন্তু জানি, কখনো সখনো ভুল
মাটিতেও ফলে কত আশ্চর্য ফসল অবিরত!
যদিও তোমার গোলা শূন্য, তবু রক্তপায়ী মাঠে
স্বেদক্ষরণের কথা ভেবে যেন তোমারই চৌকাঠে
করুন প্রত্যহ পুষ্পবৃষ্টি দয়ালু ফেরেশতাকুল।
শোনো হে
শোনো হে তোমাকে নিয়ে ভারি মুশকিল।
এখনো সুস্থির হ’য়ে গুছিয়ে-গাছিয়ে সব সময়মাফিক
কিছুতেই বসতে পারলে না। এখনো হঠাৎ ঢিল
ছুঁড়ে দাও মগডাল, পুকুরের সবুজাভ জল লক্ষ্য করে
কিংবা দাও শিস পথে হেঁটে যেতে ঠিক
চঞ্চল যুবার মতো। এখনো তোমার মৌন রক্তের ভিতরে
এক ঝাঁক পাখি গান গেয়ে ওঠে যখন তখন,
প্রেমিকার খুব কাছে থাকবার জন্যে, কী-যে হয়,
আজো ছোঁক ছোঁক করে মন
এবং তোমার সত্তা জুড়ে নামহীন এক ব্যাকুলতা রয়।
শোনো হে তোমাকে নিয়ে ভারি মুশকিল।
একদিন চিঠি বিলি না করলে ডাকপিয়ন, তোমার মধ্যে
জেগে ওঠে ছটফট একটি মানুষ আর এখনো দুয়ারে এঁটে খিল
ঘরময় করো ক্ষিপ্র পায়চারি, শূন্য পাতা পদ্যে
ভরে না উঠলে সুখ সর্বদা তোমার সাথে দেয় আড়ি, তুমি
নিষ্ফল ক্ষেতের মতো পড়ে থাকে একা শুকনো ডাল,
খড়কুটো, মরা শালিখের স্মৃতি নিয়ে। কেমন রহস্যময় জলাভূমি
তোমাকে কেবলি ডাকে, তুমি ফের হয়ে যাও অস্থির, মাতাল।
সন্দেহপ্রবণ নই
এখন নতুন নয় আর আমাদের পরিচয়।
বেশ কিছুদিন, বলা যায়, কী মধুর এক সাথে
কাটিয়েছি আমরা দু’জন কথা বলে কত, হাতে
হাত রেখে, পথ চলে শস্যক্ষেত, সাঁকো, জলাশয়
বনানীর ধার ঘেঁসে। তোমার সান্নিধ্যে প্রতিবার
গিয়েছি, যেমন ছুটে যায় দ্রুতপায়ে একা একা
পুণ্যার্থী তীর্থের দিকে আর যখনই হয়েছে দেখা
তোমার দৃষ্টিতে শূচি হয়েছে তো সমগ্র আমার।
যতই প্রগাঢ় আর দীর্ঘ হোক পরিচয় আমাদের,
যতই বলো না কেন ভালোবাসি তোমাকেই আমি,
তবু এক অস্থিরতা বারে বারে ক্রুর বৃশ্চিকের
মতোন দংশন করে আমাকে এবং অন্তর্যামী
সাক্ষী আমি স্বভাবত সন্দেহপ্রবণ নই মোটে;
তবুও সন্দেহ-কীট তোমার সত্তায় মাথা কোটে।
সময়ের লালা
অনেক শতাব্দী চুপচাপ বসে আছি, মনে হয়।
অনেক শতাব্দী অস্তিত্বের শৈলাবাসে ফুলপাতা,
উদাস সুরভি, কিছু ওষুধের চাপা ঘ্রাণ নিয়ে,
পায়ে নিয়ে কম্বলের তাপ,
অনেক শতাব্দী মিশরের সুপ্রাচীন
প্রকোষ্ঠের মতো
মগজের ভেতরে কখনো
অমাবস্যা, কখনো ডাগর
পূণিমা, অদ্ভুত ফ্রেস্কো নিয়ে বসে আছি, মনে হয়।
স্পন্দন আছে কি নেই, বোঝা মুশকিল। অকস্মাৎ
কেমন খটকা লাগে, চোখের পাতা কি জমে যাবে
উত্তুরে হাওয়ায়?
চতুষ্পার্শ্বে কত কিছু খর জলধারার মতোন বয়ে গেছে,
ফেলে গেছে কোনো কোনো চিহ্ন-প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন, আড়ে
সেদিকে তাকিয়ে দেখি সময়ের লালা ঝরে হাসপাতালের
বারান্দায়, করিডোর, ব্যাঙ্ক কাউন্টারে, ভিখিরির
খুব সংকুচিত নগ্ন মধ্যাহ্ন ভোজনে,
মিশকালো আইবুড়ো মেয়েটির শুভ্র প্রার্থনায়,
সময়ের লালা ঝরে বেদেনীর নিতম্বে নিয়ত।
তিনখণ্ড গীতবিতানের ভালোবাসা খরাগ্রস্ত
সত্তাকে লালন করে নিশিদিন। ডাকঘর ডাকে
বেহালার সুরে আমি ছুটে যাই একা, পত্রগুচ্ছ
এখন আমার নামে এসেছে কি আসে নি, ভাবিনা এতটুকু।
তাহলে এ-ও সত্য কবিতা লাফিয়ে উঠে ব্যাপক আঁধারে
চুমু খায় পুলিশের শাদা দস্তানায়
অথবা লেহন করে গণিকার পাইকারী ঊরু?
কবিতা কি তপোজ্জ্বল ওষ্ঠ রাখে মৃতের অধরে?
নাকি বৈদেশিক দূতাবাসে এর ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে
গোলাপের মতো ঝরে যায়
পুরু গালিচায়?
কবিতা কখনো চুপিসাকে ক’ফোঁটা চোখের জল, কিছু ফুল
রেখে আসে মর্গে, পথে পথে ঘোরে, মিশে যায়
শহীদ বেদীর অর্ঘ্যে, মিশে যায় ফেরারীর পায়ের আওয়াজে।
কবিতা কখনো জিরাফের গলা বেয়ে ওঠে, কখনো সুদূর
নীলিমানিমগ্ন তীক্ষ্ম চিলের চোখের
ভেতরে প্রবেশ করে, কখনো বা জাহাজডুবির পরে দ্বীপে
শুয়ে-শুয়ে দ্যাখে শুধু চকচকে মাছের মতোন
জলধোয়া নিজের শরীর,
কখনো বা পিছুটান তার কাছ থেকে টেনে নেয়
কিছু দীর্ঘশ্বাস।
অনেক শতাব্দী ভারি মনোকষ্টে আছি, মনে হয়।
যখন সূর্যাস্ত রাঙা চেলীর মতোন
কোমল ছড়িয়ে পড়ে আকাশে, আড়াল ছিঁড়ে খুঁড়ে।
জ্বলজ্বলে
একটি মোরগ চায় তার প্রতি আমার কাছে, যেন
জেনে নিতে চায় তার প্রতি আমার প্রকৃত মনোভাব আর
অনেক শতাব্দী কাঁপে ঈষদুষ্ণ মোহন কিরীটে, মনোভূমে
ফিরে আসে হাঁস স্বপ্নছায়া নিয়ে মেঘার্দ্র ডানায়।
পারস্পর্যহীন সব বলে আমি দিনরাত্রি মনোকষ্টে থাকি।
অনেক শতাব্দী চুপচাপ বসে আছি, মনে হয়।
আমার ওপর অবিরল সময়ের লালা।
হঠাৎ কবিতা এসে বসে খুব কাছে, হাত ধরে বলে-চলো,
খানিক বেড়িয়ে আসি, যেখানে তোমার খুশি, ওঠো,
খামোকা কোরো না দেরী, খুঁজো না টিফিন ক্যারিয়ার
কিংবা ক্লাস্ক, স্যুটকেশ হোল্ডল ইত্যাদি থাক, বাস ছেড়ে দেবে।