শব্দের সংস্রবে কতকাল
শব্দের সংস্রবে কতকাল কেটে গেছে, মেলামেশা
ভালোবাসাবাসি
হয়েছে শব্দের সঙ্গে বারে বারে। দূর থেকে ওরা কেউ কেউ
বহুক্ষণ আড়চোখে তাকিয়ে থেকেছে, কতদিন কানামাছি
খেলার প্রস্তাব রেখে দিয়েছে সম্পট অকস্মাৎ
আমাকে কিছু না বলে। ধুলো কিংবা মেঘের আড়ালে
দূর দিগন্তের দিকে পলায়নপর
কাউকে কাউকে আমি উপড়ে এনেছি, বলা যায়,
মায়াবী উদ্যান থেকে। কেউ কেউ এমনই নাছোড়,
মধ্যপথে তর্ক জোড়ে, কে কোন পরিধি ভালোবাসে
বিশদ বুঝিয়ে দ্যায় যুক্তি বিশ্লেষণে। আজকাল, হা কপাল,
কোকিলও উকিল হয়ে যায়।
বাঁচাই ভাষার ঝরণাধারা। শত নুড়ি, লতাগুল্ম-রঙধনু,
কখনো বা খরবেগ চোরা টান থাকে, মাধুর্যের উন্মীলন,
বাঘের হুংকার,
নবজাতকের স্পন্দমান বুক অথবা লাশের পাশে প্রহর যাপন,
পুরোনো বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পাওয়া,
মর্চেপড়া চাঁদ,
স্বাস্থ্যেজ্জ্বল শবাগার থাকে ভাষার চঞ্চল ওষ্ঠে।
শব্দের ওপারে গোরখোদক পরখ করে মাটি সন্ধ্যেবেলা,
কুকুর প্রভুর দিকে চেয়ে থাকে জ্বলজ্বেল চোখে,
একাকী কর্কশ খুনী হাত ধোয় ঝরণাতলে, জননী কন্যায় চুল বাঁধে,
বালক ওড়ায় দ্বিপ্রহরে কত সাবানের রঙিন বুদ্ধুদ,
পড়ার টেবিলে কেউ এলোকেশী মাথা রেখে স্বপ্ন দ্যাখে, দ্যাখে
শাদা ঘোড়া ছুটে যায় অভ্রের প্রান্তরে,
পায়ে তার সোনার মুকুট,
জলোচ্ছ্বাস,প্রেমিকের মুঠো থেকে প্রেমিকার হাত ছিঁড়ে যায়।
ভোরে অপরাহ্নে, চন্দ্রালোকে
স্মিত ডানা-অলা ডাকপিয়ন দোলনচাঁপা চিঠি তাড়া তাড়া
রেখে আসে লাল বাক্সে, উড়ে উড়ে ফেরে মেঘলোকে,
ভীষণ শুকিয়ে-যাওয়া ইঁদারার মতো কিছু মাঝে মধ্যে হাহাকার করে
আমার ভেতরে।
যদি উচ্চারিত হলে সর্বদা আমার দৃষ্টিপথে
একটি খয়েরী বাড়ি উদ্ভাসিত হয়, গেটে যার যুগল রূপালি ছুরি
ঝোলে সারাক্ষণ।
যখন অথবা বলে কেউ, একটি সুদীর্ঘ পথ, আজোজ্বলা,
মনে পড়ে যায়।
কাগজে আনলে তুলে অন্যমনে ভ্রমণ নামক শব্দটিকে,
আরক্ত কোমল গালে ঝুলে-থাকা কালো চুল, ভেজা চোখ, পুরনো পুকুর,
অশ্চিমে সূর্যের হারাকিরি,
ফসলবিহীন মাঠ ঘেঁষে রেল লাইনের ধারে বহুদূরে
পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, রাজসিক গাছের গুঁড়িয়ে বসে থাকা,
খঞ্জের মোহন যানে চেপে কয়েক মাইল সাবলীল চলে যাওয়া,
হঠাৎ পাখির সম্ভাষণ, মাধুর্যের স্পর্শ-লাগা,
স্মৃতিতে চাঞ্চল্য আনে।
অধিকন্তু মানে রৌদ্রঝলসিত বাবুই পাখির বাসা,
সূর্যের ভেতর পিকাসোর হাত, মেঘদল নেরুদার সঙ্গীতমুখর
পাণ্ডুলিপি, আদিগন্ত চাইকোভস্কির হংসমালা,
পাথুরে বেঞ্চিতে
সেজানের জাগরণ, জ্যোৎস্নালোকে ধাবমান বুনো অশ্বপাল।
হায় মধ্যরাতে ঘুমহীন মুহূর্তের ঝরে-পড়া, বুক-চেরা দীর্ঘশ্বাস,
এমন একটি ঘর যেখানে জ্বলে না আলো অনেক বছর,
তাকে ছেড়ে এসে পুনরায় বড় একা ঘরহীন ঘরে ফেরা।
শহুরে জ্যোৎস্নায়
সেদিন এক ফালি জ্যোৎস্না দেখে চমকে উঠেছিলাম,
যেমন সাপের চকচকে চোখ দেখে পথচারী।
জ্যোৎস্না যে-কোনো স্থানে তন্বীর সুরের মতো গুঞ্জরিত হতে
পারে-
নৈসর্গিক যে কোনো বস্তুতে, যে-কোনো প্রতিষ্ঠানে।
ডিমভরা পাখির বাসায় টলটলে জ্যোৎস্নাঃ শৈশব।
হরিণের পিঠে কিংবা চিতাবাঘের জ্বলজ্বলে চোখে জ্যোৎস্নাঃ
যৌবন।
বারান্দায় হেলান-দিয়ে-থাকা লাঠি আর
পার্কের বিবর্ণ বেঞ্চিতে জ্যোৎস্নাঃ বার্ধক্য।
সিগারেটের ধোঁয়ায় বৃত্ত এঁকে প্রায়শই জ্যোৎস্নার কথা ভাবি-
কিছু জ্যোৎস্না আমার সঙ্গে পারফিউমের মতো থাকে সর্বক্ষণ
আর এমনও তো হয়, এক টুকরো বখাটে কাগজ
কোত্থেকে উড়ে আসে, কবিতা হয়, জ্যোৎস্না হয়।
আততায়ীর কানপট্রিতে-জ্যোৎস্না ফিক করে হেসে ওঠে।
কখনো রাষ্ট্রদূতের ট্রিম-করা গোঁফে, কখনোবা
বন্দুকের নলে, উদাস প্রান্তরে মৃত সৈনিকের নীল ওষ্ঠে,
শাদা প্রজাপতির মতো বসে থাকে জ্যোৎস্না।
বুনো জ্যোৎস্নায় আমি তাকে কখনো দেখিনি
হয়তো দেখবো না কোনোদিন তার চোখ চন্দ্রালোকে
কীরকম হয়, কীভাবে সে হাঁটে জ্যোৎস্নার ভেতরে
স্বপ্ন-গাঁথা শাড়ি পরে, জানবো না কখনো।
আঁজলাভরা জ্যোৎস্না দিয়ে ওজু করে আমি তাকে আবৃত্তি করি
মধ্যরাতে, সহসা এক পাল ঘোড়া, শহুরে জ্যোৎস্নায়
নাচতে নাচতে
আমার সস্মুখে শুয়ে পড়ে, যেন কিছু গল্প আছে ওদের,
এভাবে তাকায়।
মুহূর্তে লুপ্ত ঘোড়া আর ফুলের তোড়ার ব্যবধান।
চন্দ্রালোকে কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো কখনো পড়িনি,
পড়লো আরো বেশি ভালো লাগতো কী?
গোইয়ার মগজে খুব রাঙা বিপ্লবী পূর্ণিমা ছিল বুঝি!
জ্যোৎস্নায় বিয়াত্রিচে আর সে একই স্বপ্নের একাকার।
শিরোনামহীন
কিছুই পারো না ধরে রাখতে কখনো, ঝরে যায়-
হাত থেকে গোলাপ টগর, চিঠি, ঝুঁটি কাকাতুয়া,
কবিতা লেখার নীল পোয়াতী প্রহর
নিরিবিলি ঝরে যায় শুধু।
এক ডিসেম্বরে পাওয়া নামঙ্কিত আলৌকিক একটি রুমাল
হারিয়ে ফেলেছো তুমি অন্য ডিসেম্বরে।
এমন শিথিল মুঠি যদি, তবে ঘোর অবেলায়
কী করে ধরবে বলো সারবন্দি ঝড়ক্ষুব্ধ খুঁটি?
প্রতিবাদ করবো কি? স্বীকার করাই ভালো, আমি
ব্যর্থতার আতিথ্য গ্রহণ করে অম্ল
ঢেকুর তুলছি ক্রমাগত,
তবু কলমের নিবটিকে সোনারুর মতো খুব ঘঁষে ঘঁষে
একটি নিজস্ব অলংকার বানিয়েছি চমৎকার। বারংবার
হৃদয় কুপিয়ে তুলে আনি গোপন উদ্ভিদ কিছু,
অথচ খরখরে কাগজের কাছে কতবার পরাস্ত এ হাত।
কী এক সময় এল বিশ্বাময়, নির্ভরযোগ্যতা নেই কোথাও কিছুর।
ব্যানারে ফেস্টুনে মিথ্যা চেঁচাচ্ছে মাতাল
আদিবাসীদের মতো। মুদ্রাক্ষর, নাম ধাম লোকালয়, কবির হৃদয়
সবকিছু মিথ্যা, ভয়ানক মিথ্যা মনে হয় আর
অতিশয় ঘৃণ্য ঠেকে বসবাস পৃথিবীতে আজ।
অন্যদের কাছ থেকে, এমনকি নিজের নিকট
থেকেও পালাতে চায় দিগ্ধিদিক দেশে দেশে বিপন্ন মানুষ।
বসে থাকি অস্তরাগে ভীষণ একাকী, চক্ষুদ্বয় নিবু নিবু,
কেমন নিঃস্পন্দ শিরোপুঞ্জ মাঝে-সাঝে অলৌকিক গুঞ্জরণে
নড়ে চড়ে উঠি আর ক্ষণিকের জন্যে তড়াক লাফিয়ে ওঠে
হরিণ শিশুর মতো খুশি।
কখনো আবার বড় লোনা,
খর ঢেউ ভেঙে পড়ে আমার শরীরে
এবং পায়ের নিচে পড়ে থাকে অনেক গাংচিল, ভেজা, মৃত;
ভারি জব্দ করে ক্রুর হিসহিস জলে চাবুক।
ভালোমন্দ কিছু অভিজ্ঞতা আছে আমারও অকূল সমুদ্রের,
আমিও দুলেছি ঢেউশীর্ষে বহুকাল,
দেখেছি দু’চোখ ভরে উথাল পাথাল কত মাছ,
এবং ডাগর চন্দ্রোদয়।
আহারের মতো ছুটে চলেছি সফেদ
প্রাণীটির প্রতি আজো বিরতিহীন।
পরে কোনোদিন তীরে পৌঁছে সঙ্গীহীন ইশমায়েল বলবে
অবসন্ন, সিক্ত স্বরে ট্র্যাজিক কাহিনী আমাদের।