রেনেসাঁস
চকচকে তেজী এক ঘোড়ার মতোন রেনেসাঁস
প্রবল ঝলসে ওঠে চেতনায়। ক্ষিপ্ত তরবারি,
রৌদ্রস্নাত রণতরী, তরঙ্গে তরঙ্গে নৃত্যপর,
জ্বলন্ত গমের ক্ষেত, আদিগন্ত কালো মহামারী,
অলিন্দে রহস্যময়ী কেউ, দিকে দিকে প্রতিদিন
ভ্রাম্যমাণ অশ্বরোহী, মাঝিমাল্লা স্মৃতিতে ভাস্বর।
জেল্লাদার ট্রফি, অসিচালনা অথবা বল্লমের
খেলা-কোনো কিছু নয়, সেকালে মেধার উল্লাস
এখনো আমাকে টানে। তোমার উদ্দেশে কতিপয়
চতুর্দশপদী লিখে, নিশীথের শেষ প্রহরের
ক্ষয়িষ্ণু বাতির দিকে চোখ রেখে শুভ্র সূর্যোদয়
আকণ্ঠ করবো পান, মড়কের প্রতি উদাসীন
অশ্বারূঢ় নাইটের মতো যাবো। সভ্যতার বিভা
উঠবে চমকে জ্যোৎস্নালোকে, জ্বলবে ঘোড়ার গ্রীবা।
রৌদ্রলোকে, নক্ষত্রের বিপুল জোয়ারে
আমাদের দু’জনের মধ্যে যেন কবরের মতো কিছু আছে,
বুঝি তাই অন্তহীন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে
দু’জন দু’দিকে থাকি। শুকনো ওষ্ঠে পানি ঝরবার
অনেক আগেই বেলা যায়, বেলা যায়।
তবুও তোমার প্রতি যাই বেলাশেষে,
যেমন নিঃসঙ্গ বেদুইন
ব্যাকুল প্রবেশ করে মরুদ্যানে। আমি বালির ভেতর থেকে
ঝরণার বদলে
বেনামি কংকাল তুলে আমি আর প্রিয় কোনো গান
হঠাৎ গাইতে গিয়ে বোবার মতোন কিছু শব্দ করে ফেলি।
কবরখানার পাশে দ্বিপ্রহর, সোনালি নর্তকী,
প্রতিটি মুদ্রায় তার
কেমন ঔদাস্য ছিল, কবরের ফুলের মতোন
দৃষ্টি নিয়ে কী তন্ময় তাকিয়েছিলাম একজন
প্রতিমার প্রতি,
তুমি তাকালে না;
অথচ আমার ভেতরের দৃশ্যাবলী দুলে উঠেছিল খুব।
কবরখানার পাশে দাঁড়ালেই কেবলি আমার
সাবানের ঘ্রাণ, যেশাশের অন্তিম ভোজন, শূন্য পানপাত্র,
জংধরা হেলমেট চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া জল মনে পড়ে,
মনে পড়ে কুয়াশায় ভীষণ একলা কারো যাওয়া।
তোমার নিকট থেকে চলে যেতে ভারি ভয় পাই,
যেমন ধার্মিক ধর্ম থেকে,
সর্বক্ষণ বুক জুড়ে থাকে তোমাকেই
পাওয়ার প্লাবন, কাতরতা।
ধ্বংসস্তূপে বসে আমি তোমার অধরে ওষ্ঠ রেখে
অমরতা চেয়ে নিতে পারি,
তোমাকে বাঁধতে পারি আলিঙ্গনে কবরের পাশে,
কবিতাও লেখা যায় লাশময় প্রান্তরে একাকী
ট্রেঞ্চে জ্যোৎস্না ব্যেপে এলে মুশকিল নয়
দিনপঞ্জী কিংবা চিঠি লেখা।
যখন একলা থাকি ঘরে, পোশাক বদলে ফেলি যথারীতি,
সিগারেট খাই, ভয় পাই, এ ভয়ের কোনো ব্যাখ্যা
চলে না কখনো।
কখন যে কবেকার শীতল মোমের গন্ধে ভরে যায় ঘর,
অনেকেই ফিস ফিস কথা বলে, মনে হয়, আমি
কারো কথা শুনি না স্পষ্টত।
বুঝি বা দেয়াল বলে, ‘আত্মসমর্পণ করো’, কিন্তু তার প্রতি?
পাই না উত্তর।
অনিদ্রার ঘোরে শুধু নিদ্রাকেই ডাকি, পাছে আমি
আত্মহত্যা করে ফেলি জাগরণে ক্রুর নিঃসঙ্গতাবোধে।
প্রতিদিন দেখি আমি মনশ্চক্ষে একটি বিজন পথরেখা-
সে পথে আমরা, তুমি আর আমি, হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে
জেনে নিতে চাই প্রকৃতই কতদূর যাওয়া,
সে পথে তোমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে নিরিবিলি
কখনো ফিরিয়ে আনতে চাই মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া
দগ্ধ চিৎকারের মতো আমার আহত, অভিমানী
কবিতাগুলিকে।
এভাবে অনন্তকাল তোমার সঙ্গেই হেঁটে যাওয়া যেতো যদি
দয়ার্দ্রে রোদ্দুরে
প্রজাপতিদের মধ্যে, তবে আমি বিশ্রামের কথা
ভুলে থাকতাম।
প্রতিদিন ধু ধু পথে স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলি, যেন মরুদ্যান।
বারবার আমাদের দু’জনের মধ্যে কবরের মতো কিছু,
বস্তুত কবরই এসে যায়।
‘এ কবর কার? বলে আমরা দু’জন পরস্পর চেয়ে থাকি
কিছুক্ষণ দেখি প্রজাপতি ঘাস ছুঁয়ে
ঝরণার নিকটের উড়ে যায়।
কবরের দীর্ঘ ঘাস আমাকে জড়াতে চায় যত,
তত বেশি ভালো লাগে জীবনের সঙ্গে উন্মুখর গলাগলি
রৌদ্রালোকে নক্ষত্রের বিপুল জোয়ারে।
লোকটা বুড়োই বটে
লোকটা বুড়োই বটে, অতিশয় স্মৃতিভারাতুর।
স্মৃতিমোহে সে একাকী সন্ধ্যায় কবরে দীপ জ্বালে
কোনো কোনো দিন খামখেয়ালের আঁকাবাঁকা খালে
প্রায়শ ভ্রমণ করে কাটে তার বেলা। মদে চুর
(খাঁটি দেশী) প্রতিরাতে, ক্লান্ত মনে তার দেয় হানা
বোমারু বিমান ঝাঁক ঝাঁক, দ্যাখে গ্রামে কি শহরে
লোক মরে লক্ষ লক্ষ, ইউরোপ আর্তনাদ করে
চকচকে হিটলারী বটের তলায়। লাশটানা
গাড়ি খুব এঁটেল কাঁদায় ডুবে যায়। কানে আসে
বন্ধ গ্যাস ঘরে দগ্ধ মানুষের বিকট চিৎকার।
শোনে সে এখনো মরু শেয়ালের হাঁক, পোড়া ঘাসে
বুট ঘষে জেনারেল। ট্যাঙ্ক চলে, ক্ষেত ছারখার।
লোকটা বুড়োই বটে, তবু আজ স্বপ্ন দ্যাখে, সুখে
সে ঘুমায় একা জলপাই বনে তরুণীর বুকে।
লোকটার কাহিনী
একজন লোক, যার চালচুলো নেই, ঝরে গ্যাছে
ফুটো পকেটের বিবর্ণ মানি ব্যাগের মতো যার সংসার
যে স্বপ্নের ভগ্নাংশ কুড়োতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে
এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় বারংবার, ট্রাফিক-অরণ্যে পরীর আর্তনাদ
শুনতে শুনতে, পালাতে পালাতে
অবসন্ন সন্ধ্যার ঠোঁটে ওষ্ঠে চেপে কোথাও এক কোণে
ঘুমোতে চায় কিছুক্ষণ।
তার শুকনো মুখে ঝরে স্মৃতির মতো একরাশ পাতা,
হাওয়া এলোমেলো করে দেয় রুক্ষ চুল, কয়েকটি পাখি
ভীষণ হল্লা করে বিকেলকে কাঁপিয়ে ওড়ে দিগ্ধিদিক।
সে হয় অবসাদগ্রস্ত, তার মুখ নিদ্রার স্তনে গচ্ছিত,-
যেন কোনো প্রৌঢ় মণিরত্নের ঠিকরোনো আলোর মতো
ব্যাকুলতায় মুখ ঘষে তন্বী-সত্তায়
এবং তার নিজেকে মনে হয় ভাঙা বাবুই পাখির বাসার মতো।
লোকটা সন্ধ্যাকে সমুদ্র ভেবে ভাসায় নিজস্ব জলযান,
গাভিন গাভির মতো পালে লাগে দিগন্তের ঘ্রাণ, অকস্মাৎ
সে দ্যাখে, গলুইয়ে এক তরুণী, জল-ছুঁই-ছুঁই তার চুল,
মসৃণ, ছন্দিত হাত, চোখে পৌরাণিক সৌন্দর্যের বিস্ময়, দৃষ্টি
তারই দিকে নিবদ্ধ, সে সোনালি বর্শিতে বিদ্ধ।
লোকটা রত্নদ্বীপের জাগরণ অনুভব করে নিজের ভেতরে
আর তন্বীর সামনে নতজান, হয়ে সে বলে-
আমাকে দিয়েছো তুমি নতুনের সাহস, যৌবনের অহংকার।
লোকটার কাহিনী, যদি কাহিনী বলা যায় একে,
এখানে শেষ হলেই ছিল ভালো, মোটামুটি তৃপ্তিকর।
কিন্তু তা হওয়ার নয় কস্মিনকালেও। অন্য পরিণাম
ওঁৎ পেতে আছে তার জন্যে, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে
যে কোনো সময়-
যেমন তার নৌকো হঠাৎ ফুটো হয়ে যাবে
কিংবা সে নিজেই পুড়িয়ে ফেলবে নিজস্ব চন্দ্রোপণ জলযান
অথবা দু’দিকে বিস্মৃত যুগল পথের কোনটিকে
ঠিক পথ ভেবে এগোবে, মনস্থির করতে না পেরে
কেবলি পথের ধারে যাবে আর ফিরে আসবে বারে বারে।
হয়তো সে সারাক্ষণ পার্কের বেঞ্চিতে বসে
আরাধনা করবে নীরবতার
আর সন্ধ্যামালতীর সান্নিধ্যের স্বপ্ন দেখবে ঝিমুতে ঝিমুতে
অথবা বিস্কুট চিবুতে চিবুতে, হয়তো বা মন দেবে
মূলো আর গাজর ফলানোয়, গো-পালনে,
হেঁটে যাবে সর্ষে ক্ষেত্রের ভেতরে, জোনাকিতে ছেয়ে যাবে
সমস্ত শরীর
কোনো কোনো রাতে
কিংবা পতঙ্গরূপে সকাল-সন্ধ্যা উড়ে বেড়াবে ছমছমে
পোড়োবাড়ি আর গোরস্তানে।
কাহিনীর সমাপ্তির তাগিদে।
লোকটার সম্ভাব্য পরিণামের যে কোনো একটি, যার যেমন ইচ্ছে,
বেছে নিতে পারে।
আপত্তি জানানোর জন্যে সে একটা আঙুলও নাড়বে না।