মানবের ব্যাখ্যা
মানবের ব্যাখ্যা নিয়ে ঘামাই না মাথা আজকাল।
মানুষ বিষয়ে কী বলেছে রেনেসাঁস, কাকে বলে
মানবতা, শুভাশুভ, দুর্জনের অনাচার, সাধু
সন্তের উদার ঐশী পর্যটন, ইত্যাদি কিছুই
এখন ভাবিনা আর। সংসারে ক’জন নিরিবিলি
অন্ন ভাগ করে খাই, কখনো পান্থনিবাসে ঠাঁই
খুঁজি, ঘুর একা একা ভেঙ্গে যাওয়া মেলায় কখনো,
নিজের শরীর থেকে পশুগন্ধ মুছে ফেলি কিছু।
মানুষ বলেই গোলাপের প্রতি যাই অনুরাগে,
সযত্নে পালিশ করি জুতো, মোজা দিই রোদে আর
হঠাৎ ভীষণ রেগে যাই, মাঝে মাঝে অভিমান
মেঘের মতোন গাঢ় ছেয়ে যায় সমগ্র সত্তায়।
মানুষ বলেই মানবীর দিকে তাকাই গহন,
স্তব্ধ রাতে হেসে উঠি কখনো খারাপ হয় মন।
মুর্গী ও গাজর
এখন আমার সত্তাময় কত ভীষণ আঁচড়।
কত পৌরাণিক পশু আমার সমগ্রে দাঁত-নখ
বসিয়েছে বারংবার ধুমায়িত ক্রোধে। কী প্রখর
চঞ্চু দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক কালো পাখি আমার
ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছে বেবাক, কোনোদিন দেখবে না
তুমি, খেদহীন আমি তোমার ধারণা, বিবেচনা
ইত্যাদির পরপারে আস্তে সুস্থে হেঁটে যাবো, চেনা-
শোনা ছিল কোনোদিন আমাদের, এই তো সান্ত্বনা।
বিদায়ের ঘণ্টা বাজে হৃদয়ের দিগন্তে এখন।
চড়ায় ঠেকেছে শূন্য রূপসী ময়ূরপঙ্খী নাও,
বৈরী হাওয়া সহসা কাঁপিয়ে দেয় আমার পাঁজর।
দুঃখ নাম্নী যে নিঝুম পল্লী আছে, সেখানে আপন
ডেরা আজো, সংসার পাতো গে তুমি, যাও মেয়ে যাও,
বস্তুত তোমার পথ চেয়ে আছে মুর্গী ও গাজর!
মৃতের মুখের কাছে
মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলে ভাবনার
স্বরূপ বদলে যায়? চোখে সম্মুখে বনভূমি,
কাঁটাবন, শীর্ণ নদী, সন্তের ঔদাস্যময় ছিন্ন
আলখাল্লা, এক পাটি জীর্ণ জুতো, দূরবর্তী লাল
টিলা বেয়ে নেমে আসা কেউটে, গহ্বর ভয়ংকর,
অবেলায় ঘরে ফেরা জেগে ওঠে। চৌদিকে বিপুল
বৃষ্টিধারা, ভেসে যায় শিকড় নিরুদ্দেশে,
কে যেন একাকী দাঁড় টেনে চলে গহন নদীতে।
মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছু গূঢ় কথা
জিগ্যেস করতে সাধ হয়, কিন্তু ভুলে যাই সব।
কেমনে অমন পড়ে থাকে একা এমন অচিন,
শূন্য খাঁচা স্তব্ধতায় কম্পমান, হায়, গানহীন।
মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে দুঃখের ভিতরে
বসে থাকি কিছুক্ষণ খুব একা, মেঘ হয়ে যাই।
মেধার কিরণে স্নান করে
মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী ফিরে আসে
আপন নিরালা ঘাটে, কখনো বিস্তর মেঠো পথ
এবং সুদূর সাঁকো পেরিয়ে, ঔদাস্যে
ফুটপাতে গায় গান, কখনো বা দরদালানের
দেয়াল, রেস্তোরাঁ, পুলিশের পিঠ বেয়ে উঠে পড়ে
কাঠবিড়ালীর মতো নিঝুম ভঙ্গিতে।
মধ্যরাতে জ্যোৎস্না-ধোয়া চা-খানায় ফোকটে চা খেয়ে
গলিতে আড়াল খোঁজে ওরা, প্রত্যুষে সংবাদপত্রে
শিস দেয় অকস্মাৎ মেধার সম্ভ্রম ভুলে দিয়ে।
মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী
উঠোনে বেড়ায় নেচে, ঘরে
প্রহরে প্রহরে শুয়ে-বসে, হামাগুড়ি দিয়ে আর
মেঝেতে গড়িয়ে
কাটায় সময়। কখনো বা
স্বপ্নের ঝরণায় মুখ রেখে দূর ঝুলন্ত উদ্যানে
বাড়ায় স্বপ্নার্দ্র হাত, অন্তরালে অজস্র বেহালা
বেজে ওঠে।
শব্দের ভেতরে শব্দ অবলুপ্ত সভ্যতায় স্মৃতির মতোন
জেগে থাকে, উড়ে যায় মেঘে, যেন হাওয়ায় হরিণ ওড়ে
এক পাল। সভ্যতার দ্বিপ্রহর কখনো প্রোজ্জ্বল মরীচিকা,
কখনো বা ঐন্দ্রজালিকের ভুল খেলা
বিশ্বব্যাপী জনসমাবেশে। যখন সিংহের পায়ে
মরুসীমা শিহরিত হয়, স্ফীত কেশরে কেশরে
সমাহিত সাম্রাজ্যের দিকগুলি সুনীল শোভায়
প্রস্ফুটিত বারংবার, জগৎ-সংসার
নানা গুঞ্জরণে
দৃশ্যে দৃশ্যে অর্থ আর অর্থহীনতায় ক্রমাগত
অত্যন্ত দোদুল্যমান। শব্দাবলী সভ্যতার স্তর,
শোকগাথা আর্তরব কত
বিপুল ধ্বংসের।
রেস্কিউ পার্টির উদ্ধারের অতীত সে ধ্বংসলীলা, মনে রেখো।
তরুণ কবির থর থর হৃদয়ের মতো কিছু
অদৃশ্য পলাশ জ্বলে দ্বিপ্রহরে। ফাল্গুনের পথে
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, মুখচ্ছবি বহু গান। দুপুরেই
অকস্মাৎ চুতর্দিকে কেমন আঁধার হয়ে আসে।
মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী অন্ধকারে
কাকে ডাকে? উন্মুথিত নগর, বনানী উপত্যকা
এবং পাহাড়ি পথ স্বপ্নে কথা বলার মতোন
সাড়া দেয়, শব্দাবলী অভ্যাসের সীমা ছিঁড়ে যায়।
যখন শুধাও তুমি
যখন শুধাও তুমি, ‘হে বন্ধু কেমন আছো’, আমি
কী দেবো উত্তর ভেবে পাই না কিছুই। প্রশ্ন খুব
শাদাসিধে, তবু থাকি নিরুত্তর; যিনি অত্নর্যামী
তিনিই জানেন শুধু কী রকম আছে এ বেকুর
দুঃখজাগানিয়া জনশূন্য ধুধু চরে। এ কেমন
দীর্ঘ স্থায়ী পরবাস নিজেরই ভেতর? দীর্ঘ বেলা
কাটে জন্মান্ধের মতো। সমাধি ফলক, ঝাউবন,
উন্মাদ আশ্রয়, শূন্য ঘর চেতনায় করে খেলা
এসব কিছুই আমি বলি না তোমাকে। প্রায়শই
তোমার মুখের দিকে চেয়ে থাকি চুপচাপ, কথা
সামান্যই বলি, বলি, ‘ভালো আছি’। গূঢ় চঞ্চলতা
গোপন শিরায় জাগে, মনোকষ্ট ব্যাকুল লুকোই।
মৃতের রহস্যময় চোখ আমার নিকটে আসে
লাফাতে লাফাতে, অশ্রুকণা পড়ে থাকে বুনো ঘাসে।
যখন সে লেখে
যখন সে লেখে তার ধমনীতে নেচে নেচে মেশে
গোলাপের পাপড়ি একরাশ, টেবিলের গ্রীবা ঘেঁষে
জেগে ওঠে বহুবর্ণ অশ্বপাল কেশর দুলিয়ে,
দেবদুত মাঝে সাজে দ্যায় তার মাথাটা বুলিয়ে।
যখন সে লেখে, দ্যাখে তার শৈশবের খড়স্তূপে
খরগোশ নাকের ডগা থেকে ঝাড়ে খড়কুটো চুপে
এবং আলেখ্যবৎ আস্তাবলে সহিস ঘুমায়।
যখন সে লেখে, দ্যাখে তার পদাবলী উড়ে যায়,
একজন তরুণীর কোলে কোমল লুটিয়ে পড়ে,
চুমু খায় ওষ্ঠে তার; যখন সে লেখে, সারা ঘরে
জীবনের ঠোঁট নড়ে মৃত্যুর নিতম্ব দোলে শাদা।
যখন সে লেখে, লাশময় বিধ্বস্ত ট্রেঞ্চের কাদা
উঠে আসে চতুপার্শ্বে আর তারই দিকে অবিরত
নিঃশব্দে বাড়ায় গ্রীবা বাংলাদেশ হরিণের মতো।