বয়স যতই হোক
বয়স যতই হোক, আজো অমিলের ভিড়ে মিল
খুঁজে ফিরি বন্ধ ঘরে, প্রত্যেকের থেকে অন্তরালে
একটু আলাদাভাবে থাকি কিছুকাল। কী হারালে
বিনিময়ে কী লভ্য সে কথা ভেবে কিছু ঢিল
ছোঁড়া যায় নক্ষত্রের আস্তানায়। অলোকিক ঝিল
আমার ভেতরে উচ্ছ্বসিত, অস্তিত্বের তন্তুজালে
গভীর সরোদ বেজে ওঠে। সে কোন্ সুদূর কালে
ছিলেন আমারই মতো তপোক্লিষ্ট হোমার, ভার্জিল-
এ কথা স্বরণে রেখে নিজেকেই উস্কে দেয়া যায়
মাঝে-মধ্যে; তবে এ ও জানি শূন্য ফাটা কলসের
মতো বেজে ওঠা শুধু আত্মপ্রবঞ্চককে মানায়।
তাই একা, বড় একা কাটাই প্রহর কলমের
স্পর্শে মূলহীন লাল নীল কমলের জাগরণ
দেখে, দেখে মরুবক্ষে হরিণ-কোমল ঘন বন।
ভালো থেকো, সুখে থেকো
ফেলতে চায় না কেউ, তবু ফেলে দিতে হয় অনেক কিছুই,
দিতে হয় অসহায় সূর্যোদয়ে অথবা সূর্যাস্তে। এ বিজনে
এমন কারুর সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায়, যার সাথে
সারাদিন সারারাত সময় যাপন করে সুখ পেতে
সাধ হয়, তাকে ছেড়ে মন চায় না কস্মিনকালে, তবু
মৃত্যুর শীতল স্বাদ জিভে নিয়ে সন্ধ্যেবেলা চলে যেত হয়।
আমার চোখের মধ্যে যে রূপালি নিঝুম শহর আছে এক
তার অলৌকিক অলিগলি আর হৃদয়ের ধুলো ওড়া পথে
জেগে থাকে তার পদচিহ্ন প্রত্যাশার মতো, হয় না নিশ্চিহ্ন
ঝড় জলে। হাঁসময় সন্ধ্যার আকাশে কবিতার পঙক্তি দোলে,
না কি শাড়ি তার ওড়ে নক্ষত্রমালায়। প্রতীক্ষায় কখন যে
সন্ধ্যার আকাশ ফের ভোরের আকাশ হয়ে যায়, রিক্ত লাগে।
কী কী আমি কতদূরে কখন এসেছি ফেলে অবহেলে,
আজ কি পড়বে মনে ঝড়মত্ত এই মধ্য সমুদ্রে হঠাৎ?
অমন ফেলতে হয় কত কিছু, অবিজ্ঞ কাপ্তান জানে, আর্ত
জাহাজ বাঁচাতে হলে। কিন্তু আমি ছেড়ে যাবো
কেন তাকে, যাকে
কী সকালে কী দুপুরে, অপরাহ্নে, অথবা রাত্তিরে এক বেলা
না দেখলে কিছুতেই চলে না আমার? ভালোবাসা,
জানো নাকি
আমিও নিরুপদ্রব বেঁচে যেতে চাই কিছুকাল? কিছুকাল,
যতটুকু পারা যায় মারকুটে পরিবেশে কিল ঘুষি লাথি
মেরে কিংবা খেয়ে রৌদ্রে, খলখলে জ্যোৎস্নার প্রচার আপ্যায়ন
পেয়ে রাজেন্দ্রাণী বলে দরবেশী ধরনে উদ্যানে
করবো প্রবেশ, বসে পড়বো, দোলাবো মাথা বেশ দূরবর্তী
পাখিদের গান শুনে, নামবে গভীর ছায়া ভালোবাসা জুড়ে।
এই আপ্যায়ন পারবে কি করতে রোধ হৃদয়ের অবিরল
শোণিতক্ষরণ? পারবে কি অস্তিত্বের জিভ থেকে মুছে নিতে
কটু স্বাদ? আমাকেই আত্মার অমল অশ্রুধারায় নিয়ত
ধুয়ে দিতে হবে তার হাত, ফেলে যেতে হবে, ছেড়ে যেতে হবে,
যেমন গিয়েছি আগে অসহায়, ব্যর্থ নিরুপায়। ভালো থেকো,
সুখে থেকো বলে আমি এক ফোঁটা অশ্রু হয়ে থাকবো একলা।
ভায়োলেন্স
শুধু কি ক্ষয়িষ্ণু গ্রামে-গঞ্জে লাঠিসোটা
গজরানো বাবরি (ঝড়মত্ত বৃক্ষচূড়া) ভাটা-চোখ, শক্ত কব্জি,
রামদা সড়কি আফ্রিকার জুলুদের মতো নেচে ওঠে
সংহার নেশায়?
শহুরে গলিতে, চোরাস্তায় আলোকিত ফোয়ারার কাছাকাছি,
তাড়ি-বুঁদ, শূন্য-হাঁড়ি মহল্লায় হৈ-হল্লা, দাঁত-নখ
খিঁচানো প্রহর কটমট
তাকায় চৌদিকে, যেন ডালকুত্তা। ইস্তিকরা কাপড়ের মতো
কলোনীও অকস্মাৎ বন্দুকের নল, তপ্ত ধোঁয়াময় হয়,
রক্তবমি করে সারি সারি ফ্ল্যাটে শহরে শহরে
নানা দেশে ঋতুতে ঋতুতে।
মেঘে মেঘে অন্ধকার পাতালে এবং দূর পবর্ত শিখরে
ধূ ধূ মরুবক্ষে কালান্তক স্বরে অস্ত্র হেঁকে যায়।
জলপাইরঙ কিংবা খাকি ইউনিফর্মের ভিড় গোলাপ বাগানে,
আপেল বাগানে, শস্যক্ষেতে। রাশি রাশি ভারি বুট
পাথরে কাদায় বাজে বনবাদাড়ে এবং সংখ্যাহীন হেলমেটে
মাইল মাইল-ব্যাপী সূর্যমুখী ঘন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে যায়।
মনের ভেতরে খণ্ড প্রলয়ের উন্মত্ত ঝাপটায়
মধ্যবিত্ত প্রেমিকের চোখে ওথেলোর ভীষণ সবুজ চোখ
নিমেষে প্রবেশ করে, অতিশয় কর্কশ রাত্রির কিনারায় বিচুর্ণ স্বপ্নের মতো,
একরাশ বিমর্দিত জুঁইয়ের মতোন
প্রেমিকা নিঃসাড় পড়ে থাকে।
নানা রাষ্ট্র, বিশেষত উন্নতি-ঊর্মিল,
আদিবাসীদের মতো মদির উল্লাসে ধূপ-ধুনো
অথবা আগরবাতি জ্বেলে
নিয়ত বন্দনা করে নানাধর্মী বোমাকেই।
সুদুর দিগন্ত, লোকালয়, দ্বীপপুঞ্জ মুছে-ফেলা।
ঝড়ের পরেও কোনোদিন কূল পাবো কি পাবো না।
না জেনেই সঙ্গীহীন, পানির দংশনে জর্জরিত একা,
প্রায় ক্ষয়ে-যাওয়া
মান্দাস আকঁড়ে ধরে ভেসে চলি ক্ষুধার্ত সমুদ্রের
ভেসে চলি।
ভ্রান্তিবিলাসে
একদা আমারও ছিল একটি আকাশ সীমাহীন
এবং সেখানে কত উড়ন্ত উৎসব প্রতিদিন,
অজস্র রুমাল যেন হাওয়ায় ঊর্মিল। আজ বড়
খণ্ডিত সংকীর্ণ সে আকাশ, মেঘদল কী মলিন।
আমি নিজে বহু নিচে মহিমাবঞ্চিত, জড়োসড়ো
ডানা নিয়ে ভুলুণ্ঠিত সারাক্ষণ। যদিও কখনো
সখনো কিঞ্চিৎ ডানা জোড়া পেতে চায় নীলিমার
স্পর্শ, তবু উঁচু আরো উঁচুতে সহজে আমি আর
পারিনা মেলতে পাখা। বুঝি আজ মেঘাশ্রয়ী মনও
হারিয়ে ফেলেছি আর বায়ুস্তরে কাক শালিকের
নিয়ত সংস্রবে ভুলে গেছি রাজসিক পাখিদের
পরিচয়। অতীতের সৌন্দর্যের মতো কী সূদূর
ওরা ইদানীং ক্ষুব্ধ ডানায় এখনো জাগে সুর,
মাঝে-মাঝে ভ্রান্তিবিলাসে ভাবি আমিও স্বাধীন।
মাঝে মাঝে তাকে
দূর থেকে দেখে ঈর্ষার তাপ লাগে সত্তায়।
তার এলোমেলো রুক্ষ চুলের ঘন অরণ্যে
হরিণের খেলা,
সোনালি সাপের এঁকে বেঁকে চলা, অথবা কখনো
কাঠুরের চোখ, শাণিত কুঠার দেখেছি সহসা।
জ্বলজ্বলে গালে
কর্কশ দাড়ি, ছিপছিপে গায়ে ছেঁড়া পাঞ্জাবী, পায়ে চম্পল
বিবর্ণ আর মুমূর্ষু খুব। রাস্তার ভিড় গহন দুপুরে
চিরে যায় সেই
সতেজ একলা যুবক, যেমন সাগর-জলের বুক কেটে দ্রুত
এগোয় জাহাজ, কেমন অচিন। নিজের ভেতর
জ্বলি অনিবার।
ঔদাস্যের
পাল তুলে চলে হাওয়া থেকে কী যে যখন তখন
মোহন মাগনা কুড়িয়ে সে নয়, আবার ফিরিয়ে
দ্যায় সহজেই
শূন্যের হাতে রূপান্তরের ভিন্ন খেলায়, যেন যাদুকর।
আমাকে দ্যাখেনা। আমি তাকে দেখি, যেমন দুপুর।
রোদ্দুর দ্যাখে।
তার জ্বলন্ত
মহানিশাময় ক্ষুধার্ত চোখ কোথায় কখন
হয় নিবদ্ধ, কেউ তো জানে না। বুঝি তার চোখে
কিলবিলে কীট, পদ্ম-কোরক! পদযুগল তার অবশ্য এই
শক্ত মাটিতে সচল, অথচ প্রায়শই মাথা মেঘমালা ছোঁয়।
কখনো সখনো
থাকতে দ্যায় না আমাকে আমার মধ্যে সে তেজী,
আমাকে আমার গহন ভেতর থেকে টেনে আনে!
বাইরে দাঁড়িয়ে
বড় অসহায়, ভীষণ নগ্ন, আড়ষ্ট লাগে।কিন্তু সে রোজ
ত্রিলোক-বিহারী। দূর থেকে দেখে আমি কি শুধুই
জ্বলতে থাকবো?