পার্টির পরে
এখন কোথায় যাবো পথ খুঁজে এই মধ্যরাতে
একা একা? পান্থনিবাসের সব দরোজা জানালা
বন্ধ, পথও লুপ্ত, অস্তিত্বের স্বরে স্তরে বিশ্রী জ্বালা-
হঠাৎ হবে কি দেখা কীর্কেগার্ড, নীটশের সাথে?
এ কেমন শূন্যতায় পা দু’টো দেখাচ্ছে খেল এই
দর্শকবিহীন পথে? নাকি অলৌকিক কিছু চোখ
রয়েছে তাকিয়ে সর্বক্ষণ! স্মৃতি-বিস্মৃতির ঢোক
গিলে বলি নিজেকেই-নেই, কোথাও কিছুই নেই।
ভীষণ বদলে যাচ্ছে দৃশ্যাবলী, হাতের নিকট
হাত এসে কী যে বলে বাউল গানের মতো শুধু।
ব্লিপ, ব্লিপ, হিরোশিমা মন আমার, ব্লিপ, ব্লিপ, রীতি,
নাতি, রাজনীতি, রশোমন, রোসো মন, কে চম্পট
দিলো কানা গলির ভেতর? ব্লিপ, ব্লিপ, রুক্ষ, ধুধু
বয়স আমার, নীল ম্যাপ, ট্যাঙ্ক, ককটেল-স্মৃতি।
পিছুটান
সর্বদাই ছিল পণ, যাই বলুক, সর্বক্ষণ
হাঁটবো সামনের দিকে, চলে যাবো সুউচ্চ চূড়ায়
আখেরে একদিন সূর্যাস্তের রঙ মেখে রুক্ষ গায়।
কস্মিনকালেও তাকাবো না ফিরে, মনের মতোন
পথ না-ই থাক, তবু হেঁটে যাবো, যখন তখন
একটি কি দু’টি ফল ছিঁড়ে নেবো ঝরণাতলায়
অঞ্জলি উঠবে ভরে জলে, শুনেছি রূপকথায়-
তাকালে পিছনপানে মানুষের দীপ্র দেহমন
শিলীভূত হয়, কোথায় যে জন্মস্থান, কোন বাঁকে
নতুন জাহাজ ভিড়েছিল, কার ওষ্ঠে চুমু, খেয়ে
যাত্রারম্ভ-মুছে যায় সবকিছু। তাকাবো না ফিরে,
করেছি শপথ, তবু সিঁড়ি, অনেক মুখের ভিড়ে
স্বতন্ত্র একটি মুখ, দোচালা, বনানী গান গেয়ে
ওঠে; হায়, প্রত্যেকেরই মর্মঘাতী পিছুটান থাকে।
প্রথম দেখা
তোমাকে প্রথম দেখি মধ্যাহ্নের নিঝুম চৈনিক রেস্তোরাঁয়।
অবশ্য এ কথা তুমি করো না স্বীকার। তুমি বলো,
আমাদের দেখা হয়েছিল
অনেক আগেই
কী এক মেলায়।
মেলা? শুনে মনে
কেমন খটকা লাগে। যদি পৃথিবীকে সুবিশাল
কোনো মেলা ভাবো, তবে হয়তো কখনো
কোনোখানে হয়েছিল দেখা,
আজ মনে নেই, কিন্তু এ ও কি সম্ভব
আমরা দু’জন মুখোমুখি
দাঁড়িয়েছিলাম মুখোমুখি ভোরবেলা, দুপুরে কি অপরাহ্নে
অথবা মদির অস্তরাগে-যতই ক্ষণিক হোক সেই ক্ষণ-
ভুলে যাবো? তাই, ভাবি-
হয়তো রহস্যে ভেসে তুমি কোনো নির্বাচিত দিন
মনে রেখে মৃদু হেসে আমাদের কাল্পনিক প্রথম দেখার
গল্প বলো, গল্পে আছে তোমার গভীর অনুরাগ।
তোমাকে প্রথম দেখি মধ্যাহ্নের নিঝুম চৈনিক রেস্তোরাঁয়।
এক কোণে নিরিবিলি বসেছিলে। তোমার সমুখে
(বাইরে ট্রাফিক যেন সুন্দরবনের আর্ত আদিম চিৎকার,
শীত-হাওয়া দুপুরকে চুমু খায়, তামাটে কুকুর
ছুটে যায় ল্যাম্পোস্টের দিকে, গোয়েন্দার মতো কেউ,
না কি দেবদূত জানালার কাচে ঘষে ঠোঁট চোখ)
কোকের বোতল আর বইয়ের পাতায় চোখ আর
তোমার চাদ্দিকে বয়ে যাচ্ছিল প্রফুল্ল বর্তমান,-
ঝোড়ো মনে ঢুকে দেখি এবং নিমেষে হৃদয়ের
(অন্য কোণে কিছু কমনীয়, রুক্ষ অচেনা মুখের
নড়া-চড়া পর্যটন, সিনেমা, স্ক্যান্ডাল বিষয়ক বাক্যালাপ,
মুহূর্তে নিঝুম ঝরে কাঁটা চামচের তক্কে গপ্পে, ন্যাপকিনে,
আমাদের পাশে বসে কীর্কেগার্ড মৃদু খাচ্ছেন রঙিন স্যুপ)
নিভৃত গোলাপবন উঠলো দুলে, যখন তাকালে
চোখ তুলে। এক রাশ হাওয়া গেল খেলে
বুকের ভেতরে-যেন শহর ঢাকার পূনর্জন্ম
ময়ূরের কলাপের মতো!
সেদিন বিকেলে নিসর্গের অন্তঃপুরে তোমার কবোষ্ণ হাত
ধরে হেঁটে যেতে যেতে অকস্মাৎ মনে হলো-
পঁচিশ বছর আগে যে আমার পাশে ছিল
এমনই বিকেলে, তুমি ছিলে তার গভীর আড়ালে
হওয়া না হওয়ার রশ্মিজালে,
আমার শতাব্দীব্যাপী প্রতীক্ষার পারে।
তখনই কি সে সুদূর কালে
তোমাকে প্রথম দেখি না-দেখার মায়াবী উদ্যানে?
বিশদ তদন্তসূত্রে
বিশদ তদন্তসূত্রে জানা গেল ফাল্গুন সন্ধ্যায়-
তোমার হিশেব নাকি, কবি, খুবই পাকা চিরদিন।
বাউল গানের মতো তোমার জীবন উদাসীন,
এই তো জানতো লোকে, তোমাকে অনেকে অসহায়,
বড় জবুথবু বলে করেছে শনাক্ত, তবু, হায়,
সেয়ানা হিশেবীরূপে খ্যাতি রটে তোমার হে কবি।
তোমার হৃদয়ে জ্বলে সর্বদাই যে রক্তকরবী
তাও নাকি হিশেবেরই ফুল? যে কিন্নর গান গায়
তোমার ভিতরে ভেলা অবেলায়, যে-ও বুঝি গণিতের
ক্রীতদাস? যে প্রেমিক তোমার কংকাল জুড়ে আছে,
তার হাতে যোগ-বিয়োগের ফলাফলময় খাতা?
অথচ যদ্দুর জানি করেছে উজাড় জীবনের
সমস্ত তবিল তুমি গোপন জুয়ায়, যারা বাঁচে
নিক্তিতে ওজন করে তুমি নও তাদের উদ্গাতা।
বুগেনভেলিয়া
ঘরের বাইরে নুয়ে আছে নিরিবিলি বারান্দায়
বুগেনভেলিয়া, যেন শূন্য রাঙা মন্দিরে প্রণতা
দেবদাসী একাকিনী। ঘরের ভেতরে আচ্ছন্নতা
গদ্যের পদ্যের, আমাদের দু’জনের চেতনায়
কত যে শতাব্দী বয়ে যায়। আমাদের বাক্যালাপে
খৃষ্টপূর্ব সূর্যোদয়, বিশ শতকের অস্তরাগ,
কত তক্কো গপ্পো মেশে। তোমার কপালে মৃদু দাগ
কবেকার হেসে ওঠে, দূরে বুগেনভেলিয়া কাঁপে!
ঐযে লতাপাতা, ফুল, ওরা মানুষের খুব কাছে
প্রত্যহ আসতে চায়, কখনো হঠাৎ পায় ভয়-
এমন দোটানা মনোভাব ওদের স্বভাবে আছে।
আপাতত দীর্ঘ লাল বারান্দার থেকে, মনে হয়,
আমাদের ভালোবাসা দেখে, নিয়ে অলৌকিক রেশ
বুগেনভেলিয়া ঘরে কী প্রবল করেছে প্রবেশ।
বেহালাবাদকের জন্যে পঙ্ক্তিমালা
আমার ভিতর রাশি রাশি নিউজপ্রিন্টের রোল ঢুকে গেছে
সরাসরি, দ্যাখো আজ কেমন কাগুজে গন্ধ রয়েছে ছড়িয়ে
সত্তাময়; হিজিবিজি লক্ষ লক্ষ অক্ষর বেজায়
চেঁচামেচি করে, প্রায় অশ্লীলতা বলা যায়, আর কি অস্থির
ওরা সর্বক্ষণ, ওরা ভীষণ কলহপরায়ণ। উন্মাতাল,
বেহালাবাদক তুমি সুরে সুরে আমার ভিতর থেকে অই
তাল তাল খসখসে
নিউজপ্রিন্টের মণ্ড তুলে এনে ক্লিন্ন ডাষ্টবিনে ছুঁড়ে দাও।
ওসব ফক্কড় হিবিজিবি
অক্ষর সুনীল শূন্যতায়, নক্ষত্রের পরপারে।
দূষিত রক্তের মতো কালিতে নিমগ্ন আমি সকল সময়
যেন অপদেবতা একাকী।
আমাকে যায় না চেনা আগেকার মতো, অতি দ্রুত
কেমন নির্মুখ আমি হয়ে যাচ্ছি এ খর বেলায়।
বেহালাবাদক তুমি কালির সমুদ্র থেকে আমাকে
নিমেষে তুলে আনো
ধ্বনির মোহন ঝড় তুলে দীপ্রছড় টেনে টেনে।
নিজের রক্তাক্ত বেশভূষা দেখে, ক্ষত দেখে দেখে ঘুরঘুট্রি
অন্ধকারে শ্বাপদের গুহায় আমার কাটে সারাবেলা, তার
নখরে রয়েছে বাঁধা পরমায়ু আমার এবং
নক্ষত্র দেখিনা কতকাল জলাশয়ে
দেখিনি আপন মুখ, যে রূপালি শহরে যাবার কথা ছিল,
পড়েনি সেখানে পদচ্ছাপ।
বেহালাবাদক তুমি বানিয়ে সূরের স্বপ্নময় পথরেখা
আমাকে সেখানে পৌঁছে দাও, পৌঁছে দাও।
আমি এক ঊর্ণাজালে আটকা পড়ে গেছি,
কষ্ট পাচ্ছি, কষ্ট পাচ্ছি অনেক শতক ধরে, বুঝিরা পাঁজর
খসে যাবে বদরাগী হাওয়ার আঁচড়ে।
বেহালাবাদক তুমি আমাকে কর্কশ ঊর্ণাজাল থেকে দ্রুত
মুক্তি দাও, মুক্তি দাও সঙ্গীতের উধাও গৌরবে
কিংবা ঊর্ণাজাল হয়ে যাক ফুলশয্যা অথবা তোমার বাদ্য।
বেহালাবাদক তুমি এতদিন পরেও কি পাওনি আমার
কোনো চিঠি? হায়,
আমিতো চিঠিতে ডাকটিকিটে লাগাতে
ভুলে যাই, বারংবার ভুল হয়ে যায়।