- বইয়ের নামঃ প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ দরজা থেকে
আমিতো যুবক নই, মধ্য বয়সের রুক্ষ পথে
নিঃসঙ্গ চলেছি হেঁটে রৌদ্রদগ্ধ আর ঝঞ্ঝাহত
অভিজ্ঞ শরীরে নিয়ে পথনিষ্ঠ শ্রমণের মতো।
বিমুখ সকল দিক, তবু আছি টিকে কোনো মতে।
কেটেছে আমার দিন পথের কিনারে বৃক্ষমূলে
বসে গান শুনে গোত্রহীন কোনো একলা পাখির,
আলোজ্বলা কুটিরের খোঁজে, ভুলি কামড় ক্লান্তির,
যখন আমার দিকে তুমি তাকাও দু’চোখ তুলে।
পিঙ্গল বয়স নিয়ে তোমার নিটোল যৌবনের
নিকটে সর্বদা নতজানু আমি; প্রতিদ্বন্দ্বী যারা
তাদের বৈভব আছে জ্বলজ্বলে, যদিও মনের
ঐশ্বর্যে কাঙাল নই আমিও এখনো। তুমি ছাড়া
কে জানে আমার হৃস্পন্দন কত তেজী, প্রেমময়?
অথচ দরজা থেকে আমাকেই ফিরে যেতে হয়।
ভিমানী বাংলাভাষা
মানুষের অবয়ব থেকে, নিসর্গের চোখ থেকে
এমন কি শাক সব্জি, আসবাব ইত্যাদি থেকেও
স্মৃতি ঝরে অবিরল। রাজপথ এবং পলাশ
যখন চমকে উঠেছিল পদধ্বনি, বন্দুকের
শব্দে ঘন ঘন, স্মৃতি নিজস্ব বুননে অন্তরালে
করেছে রচনা কিছু গল্প-গাথা, সত্যের চেয়েও
বেশি দীপ্র। কান্তিমান মোরগের মতো মাথা তুলে
কখনো একটি দিন দেয় ডাক, পরিপার্শ্ব দোলে,
মানুষ তাকায় চতুর্দিকে, কেউ কৌতূহলে, কেউ
গভীর তাগিদে কোনো, যেন কিছু করবার আছে,
সত্তায় চাঞ্চল্য আসে। করতলে স্বপ্নের নিভৃতে
মনে পড়ে, দিকচিহ্ন, গেরস্থালি, নক্ষত্র দুলিয়ে
অভিমানী বাংলাভাষা সে কবে বিদ্রোহ করেছিল।
আমার প্রেমের মধ্যদিনে
তোমার চুলের রাত্রি, শিখা-জিত আমাকে জড়ায়
গনগনে দ্বিপ্রহরে। তোমার ব্যাকুল বাহুদ্বয়
আমার বন্দর হয়, কী নিঃশব্দ, দীপ্র গীতময়
হয়ে ওঠে নিমেষেই কম্পমান তোমার অধর
আমার তৃষিত ওষ্ঠে আর ছোট ছায়াচ্ছন্ন ঘর
রূপান্তরে ছলোচ্ছল জলপুরী, থর থর তুমি
তরঙ্গিত নদী, কখনো বা গাঢ় বেদনার ভুমি,
তোমার চোখের জল আমার আত্মায় ঝরে যায়।
চুম্বনের পূর্ণতায় সত্তাময় বিষাদের সুর
বুনে দাও নিরুপায়, তুমি হয়ে যাও কী সুদূর।
আমার প্রেমের মধ্যদিনে তোমার চোখের জল
নিবিড় আষাঢ় আনে সত্তায় খরায়, অবিরল
হাওয়া বয় হৃদয়ের ঝোপেঝাড়ে। থামে সব কথা,
তোমার অধর থেকে আমাকেই ছোঁয় অমরতা।
আমি আর করবো কত শোক
আমি আর করবো কত শোক?
অপরাহ্নে পাথরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে
খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে
মাঝে মধ্যে থমকে দাঁড়াই। ভূগর্ভস্থ কোনো স্তব্ধ
সভ্যতার মতো নিস্তব্ধতা চর্তুদিকে।
এদিক ওদিক, সবদিকে
খানিক তাকিয়ে, পাথরের মধ্যে দিয়ে
খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে
দু’পায়ে বাজিয়ে নুড়ি এগোই একাকী।
ছায়াচ্ছন্ন পথ, সাঁকো, উঠোন, ইঁদারা
পুরোনো কালো পাম-সু, বিবর্ণ,
বিবাহমণ্ডপ, নৈশ ভোজ, ঝলমলে গোরস্থান,
নানান বয়সী কত মুখ ভেসে ওঠে বারংবার।
খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে
দু’পায়ে বাজিয়ে নুড়ি এগোই একাকী।
খেলাচ্ছলে চড়ুইয়ের নকশা-প্রায় কংকাল একদা
গিয়েছি ভাসিয়ে জলাশয়ে, মনে পড়ে। নিজস্ব কৌতুক ভুলে
হঠাৎ বালক তার ভেজা হাত দেখে সন্ধ্যেবেলা
অবুঝ কান্নায় ঢেউ হয়েছে সবুজ।
পাখির কংকাল আর নিজের আঙুল
ভীষণ অভিন্ন ভেবে কেটেছিল তার সারা রাত।
হিরন্ময়ী তরুণীর ঈষৎ ঘর্মাক্ত
উরুর মতোন দ্বিপ্রহরে
লাশের শিয়রে নতজানু, একজন
কর্পুর মৃতের কাছে কীরকম ব্যবহারযোগ্য
ভেবে খুব বিহবল হয়েছে কোনোদিন,
মনে পড়ে।
নুড়ি আর খুব উঁচু বুনো ঘাস বুকে চেপে, দূরে
পাখির কংকাল হাতে নিয়ে
প্রাচীন শ্যাওলাময় জলাশয়ে ডুবিয়ে দু’হাত
কতিপয় মুখের পিছনে
পাথরের মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে
আমি আর করবো কত শোক নিশিদিন?
ইচ্ছেগুলি থেঁতলে দিয়ে
ইচ্ছেগুলি থেঁতলে দিয়ে করলে এ কি?
চেয়ে চিন্তে কয়েক বিঘে দুঃখ নিলে?
দুঃখ-দুঃখ বেড়াল শুধু তীক্ষ্ম দাঁতে
মাংস ছিঁড়ে হৃদয় ফুঁড়ে ওষ্ঠে চাটে।
তার সে অঙ্গে সঙ্গ চেয়ে মনের ভেতর
মৎস্য হয়ে কেমন তুমি একলা হ’লে।
তীষণ দগ্ধ দূর শতকী পাখির বাসা
স্বপ্নে কেন ভস্ম ছড়ায় বারে বারে?
বহুকালের উজান বেয়ে জ্বলজ্বলে তার
যুগল বাহু জড়ায় কেন স্মৃতির গ্রীবা?
শিরায় শিরায় এখনো কি জ্বলবে প্রদীপ,
উড়বে পায়রা হৃদয় জুড়ে অবিরত?
এই শহরে নগ্ন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে
দেখলে হঠাৎ প্রচুর বেলা অস্ত গেল।
রৌদ্র-সেঁকা শিশিরভেজা জামা তুমি
ছেড়ে ছুড়ে বললে এবার ফিরতে হবে।
ফিরতে গেলেই যায় কি ফেরা? পায়ের নিচে
শুকনো পাতা, ব্যর্থ শিল্প কান্না জোড়ে।
ইচ্ছেগুলি থেঁতলে তুমি সামনে গিয়ে
ক্লান্তভাবে খুললে মুঠি বেলাশেষে-
নেই তো কিছুই, কী-যেন সব ছাইয়ের মতো
পড়ছে ঝরে,বিষণ্নতা আসে ব্যেপে।
বিঘে কয়েক দুঃখে তুমি কেমন ফসল
তুলবে বলো? পঙ্গপালের শব্দ জাগে।
ইদানীং সন্ধ্যেবেলা
বকুলের ঘ্রাণময় পথে কিংবা শেফালির নিজস্ব ট্রাফিক আইল্যান্ডে
কার সাথে রফা করে প্রেমের এগারো দফা কর্মসূচি আমি
বাস্তবায়নের পন্থা বেছে নেবো? আমার এ প্রশ্নে সন্ধ্যেবেলা
বকুল বিমর্ষ ঝরে যায়,
শেফালির চোখে
বাষ্প জমে। পথে পাতা, রাশি রাশি, ডালপালা, মৃত পাখি দেখে
এখানে একটা কিছু ঘটে গেছে ভয়ংকর, যে কোনো পথিক
বলে দিতে পারে সহজেই। একটি মানুষ তার একাকীত্ব
নিজের ভেতরে রেখে হেঁটে গেছে কতবার এ রকম
দৃশ্যের ভিতরে।
তার হাতে ছিল স্মিত অমল পতাকা, চোখে দূরত্বের আভা,
তার দীর্ঘ ভ্রমণের স্বীকৃতি রয়েছে কত নিরালা নিশ্বাসে,
ভরপুর সারাবেলা, কেমন অচেনা গানে গুঞ্জরিত
সরাইখানায়।
ভ্রমণ ছাড়া কি পথিকের অন্য কাজ নেই? পথে কত গহন দুপুর
কত অমানিশা তাকে ঢেকে দ্যায় কোমল আদরে?
সবুজ রৌদ্রের কাছে বেগুনি জ্যোৎস্নার কাছে হাত
পেতে সে কি
চেয়ে নেয় কিছু ঝুলি ভরে তোলার আগ্রহে?
এবার প্রশ্নের পর প্রশ্ন বারংবার
চঞ্চু ঠোকে; যেতে যেতে দেখে যাই আমার নিজের আকাঙ্ক্ষাকে
আমি গলা টিপে হত্যা করি; সন্ধ্যেবেলা
গোলাপ-স্পন্দিত পথে নিঝুম গ্রহণ করে কত মৃতদেহ।
হত্যাকারী বড় একা, পরিত্যক্ত; চরাচর আর্তনাদ করে।
বহুদিন থেকে যোগফল নিয়ে ভাবছি, অথচ বারংবার
বিয়োগ করতে হয়, বিয়োগান্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই।
দেখেছি সতেজ সুখ কতদিন বাইসাইকেল
চালাতে চালাতে গায়ে খড়কুটো, শুকনো পাতা
ফুলের পরাগ,
কখনো বা টুকরো টুকরো রঙিন কাগজ
নিয়ে টগবগে গান গেয়ে হাসিমুখে গেছে দিগন্তের দিকে।
হঠাৎ কোত্থেকে দুঃখ চায়ের দোকানে এসে বসে
আমার টেবিলে হাত রেখে;
মুখোমুখি বসে থাকে বহুক্ষণ, বলেনা কিছুই।
কেবল চামচ নাড়ে, বিস্কুটের ভগ্নাংশ খিমচে তুলে নেয়
নখ দিয়ে নিরিবিলি ভীষণ ঔদাস্যে,
যেন কবি-মূর্তি, সামাজিক দাবি ভুলে, সর্বস্ব খুইয়ে
স্বপ্ন পেতে চায়।
সন্ধ্যেবেলা খুব শূন্য হয়ে গেছে ইদানীং। পাখি ডাকে
পাতা ঝরে,
একজন গৌণ ব্যক্তি বসে থাকে খুনীর মতোন একা, তার
মুখ কবরের ঘাসে থুবড়ে পড়ে আছে কাদামাখা,
পোকা মাকড়ের মধ্যে। সুন্দরের পায়ে চুমু খেয়ে
ক্ষয়ে যায় ক্ষয়ে যায়, আপনার নিশ্বাসের প্রতি
বিরূপ সে ইদানীং, দীর্ঘশ্বাস হয়ে তাকে। নিজেকে কর্কশ
লাগে তার।
ভালোবাসা যদি পুনরায় ফুল্ল মুখ তুলে চায়
ভালোবেসে, তবে আমি বাইসাইকেল চালিয়ে দিগন্তে যাবো
বকুল শেফালি আর জুঁই নীল দীর্ঘ পথে ছড়াতে ছড়াতে।