প্রৌঢ় অধ্যাপকের মতে
বাছুরের মতো সব নাবালক কবিরা এখন
ঢুঁমরে বেড়ায় যত্রতত্র আর কচি তীক্ষ্ণ খুরে
লন্ডভন্ড করে দেখি কাব্যের প্রশান্ত তপোবন।
গুঁড়িয়ে পদ্যের স্তূপ ক’বিঘা নিষ্ফল জমি জুড়ে
বানায় বিচিত্র ঢিপি। উপরন্তু বেয়াড়া পাঠক
তাদেরই লেজুড় হয়ে দিব্যি ঘোরে, যাক রসাতলে
কাব্যলোক; পুরোদমে যাচ্ছে তাই চলুক নাটক
ভীষণ পতন থেকে কবিতাকে উদ্ধারের ছলে।
এই সব বাছুরের দল জানি গোটাবে পাততাড়ি
দু’দিন ইয়ার্কি মেরে। আপাতত করে মণ্ডুপাত
রীতির নীতির আর সমস্বরে চেঁচিয়ে হঠাৎ
কাঁপায় কাচের ঘর, ভেঙে পড়ে থাম সারি সারি।
হা কপাল, কালক্রমে বাছুরেরা হবে ধেড়ে ষাঁড়,
কল্কে দেবে বহুজন, হয়তো খেতাব পাবে “স্যার”।
ফিরে যাচ্ছি
ফিরে যাচ্ছি, ফিরে যাচ্ছি, আমি যেন সুপ্রাচীন গ্রিক,
নীল ত্রিপলের মতো আকাশের নিচে অ্যাম্ফিথিয়েটার
থেকে ফিরে যাচ্ছি আলো থেকে অন্ধকারে।
কে যেন ডাকছে শুনি; এ আমার মতিভ্রম, কেউ ডাকছে না,
কেউ ডাকবে না।
এখনও তো চোখে
ভাসে অর্ধপশু অর্ধমানবের ক্ষিপ্র পেশি আর কানে আসে
প্রবীণ পুরোহিতের নিবিড় প্রার্থনা।
নগরের পুরুষের কোলাহল আর পুরনারীর বিলাপে
ছায়াচ্ছন্ন পথ-ঘাট, প্রতি চত্বর। নতজানু
যে যেন প্রগাঢ় স্বরে বলে, “হে রাজন,
আমাদের নগরের পরিত্রাণ চাই।“
ওরা তো সদলবলে আসে, জড়ো হয় হাটে মাঠে,
বস্তি-বন্দরের
আলো-আঁধারিতে,
কখনো জলার ধারে কিংবা গাছতলায় কখনো।
ওরা আসে বেয়াড়া দামাল,
দ্যাখো শ্রেণীস্বার্থের সাধের গণ্ডি ছুঁয়ে
চকিতে কোথায় যেন সোনার হরিণ ছুটে যায়,
চতুর্দিকে মৃত্যুর সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে
দেখেও কেবলি ওরা-যে যাই বলুক-
সোনার হরিণ চায়। আপাতত নৈরাজ্যের সাথে
মিতালী পাতাতে গররাজি।
ওরা তো সদলবলে আসে, ওরা আসে,
পায় ইতিহাসের কর্দম; কী বিশ্বাসে
পথ চলে অবিরাম, দিগন্তে নিবদ্ধ দৃষ্টি, অথচ জানে না
পদে পদে প্রমাদেরই ফাঁদ।
কখনো-বা লাঠি ঘোরে, কখনো নিশান ওড়ে হাওয়ায় হাওয়ায়,
বাজারে ফুলুরি নিয়ে দরাদির, জিলিপির রসে
বড় সিক্ত, আহ্লাদিত ছেলে বুড়ো যুবকের কষ।
পিতৃহত্যা মাতৃহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা ইত্যাদি চলছে
পুরোদমে ইতস্তত প্রতিহারী হেঁকে যায় সুউচ্চ প্রাচীরে
পরিখায় পরিখায় জনশূন্যতায়।
দুটো চোখ উপড়ে নিলেও, হে রাজন,
প্রাক্তন পাপের বোঝা কমবে না একতিলও। কাঁদো
দারুণ রক্তাক্ত চোখে কাঁদো
প্রাকারে দাঁড়িয়ে একা। হবে না প্রতিধ্বনিত তোমার দরবার
সুললিত স্তবে।
পঞ্চমাঙ্ক শেষ, ফিরে যাচ্ছি…
চৌদিকে শবের ছড়াছড়ি, ফিরে যাচ্ছি…
ভাঁড়ের কেবলি ভয়, কখন মাড়িয়ে দেয় নায়কের শব,
ফিরে যাচ্ছি-
বিকৃত শবের গন্ধ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বিবরে আবার
অ্যাম্ফিথিয়েটার থেকে পালা দেখে ফিরে যাচ্ছি আর
জানেন তো বস্তুত পালাটা বিয়োগান্ত ফিরে যাচ্ছি।
মা সন্ধ্যায় বাতি জ্বালেননি বলে,
পিতা দরজার কাছে এসে
উদার অভিজ্ঞ হাত বাড়াননি বলে,
ভাই তার নিপুণ সেতার বাজায়নি বলে
বোন ঘর সাজায়নি বলে
ফিরে যাচ্ছি, ফিরে যাচ্ছি, কেউ ডাকছে না।
কেউ ডাকবে না?
ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?
এখানে তো বোনাস ভাউচারের খেলা নেই কিংবা নেই মায়া
কোনো গোল টেবিলের, শাসনতন্ত্রের ভেল্কিবাজি,
সিনেমার রঙিন টিকিট
নেই, নেই সার্কাসের নিরীহ অসুস্থ বাঘ, কসরৎ দেখানো
তরুণীর শরীরের ঝলকানি নেই কিংবা ফানুস ওড়ানো
তা-ও নেই, তবু কেন এখানে জমাই ভিড় আমরা সবাই?
আমি দূর পলাশতলির
হাড্ডিসার ক্লান্ত এক ফতুর কৃষক,
মধ্যযুগী বিবর্ণ পটের মতো ধু-ধু,
আমি মেঘনার মাঝি, ঝড়ুবাদলের
নিত্য-সহচর,
আমি চটকলের শ্রমিক,
আমি মৃত রমাকান্ত কামারের নয়ন পুত্তলি,
আমি মাটিলেপা উঠোনের
উদাস কুমোর, প্রায় ক্ষ্যাপা, গ্রাম উজাড়ের সাক্ষী,
আমি তাঁতি সঙ্গীহীন, কখনো পড়িনি ফার্সি, বুনেছি কাপড় মোটা-মিহি
মিশিয়ে মৈত্রীর ধ্যান তাঁতে,
আমি
রাজস্ব দফতরের করুণ কেরানি, মাছি-মারা তাড়া-খাওয়া,
আমি ছাত্র, উজ্জ্বল তরুণ,
আমি নব্য কালের লেখক,
আমার হৃদয়ে চর্যাপদের হরিণী
নিত্য করে আসা-যাওয়া, আমার মননে
রাবীন্দ্রিক ধ্যান জাগে নতুন বিন্যাসে
এবং মেলাই তাকে বাস্তবের তুমুল রোদ্দুরে
আর চৈতন্যের নীলে কতো স্বপ্ন-হাঁস ভাসে নাক্ষিত্রিক স্পন্দনে সর্বদা।
আমরা সবাই
এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?
কোন সে জোয়ার
করেছে নিক্ষেপ আমাদের এখন এখানে এই
ফাল্গুনের রোদে? বুঝি জীবনেরই ডাকে
বাহিরকে আমরা করেছি ঘর, ঘরকে বাহির।
জীবন মানেই
মাথলা মাথায় মাঠে ঝাঁ ঝাঁ রোদে লাঙল চালানো,
জীবন মানেই
ফসলের গুচ্ছ বুকে নিবিড় জড়ানো,
জীবন মানেই
মেঘনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে দাঁড় বাওয়া পাল খাটানো হাওয়ায়,
জীবন মানেই
পৌষের শীতার্ত রাতে আগুনে পোহানো নিরিবিলি।
জীবন মানেই
মুখ থেকে কারখানার কালি মুছে বাড়ি ফেরা একা শিস দিয়ে,
জীবন মানেই,
টেপির মায়ের জন্যে হাট থেকে ডুরে শাড়ি কেনা,
জীবন মানেই
বইয়ের পাতায় মগ্ন হওয়া, সহপাঠিনীর চুলে
অন্তরঙ্গ আলো তরঙ্গের খেলা দেখা,
জীবন মানেই
তালে তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিলে চলা, নিশান ওড়ানো,
অন্যায়ের প্রতিবাদে শূন্যে মুঠি তোলা,
জীবন মানেই
মায়ের প্রসন্ন কোলে মাথা রেখে শৈশবের নানা কথা ভাবা,
জীবন মানেই
খুকির নতুন ফ্রকে নকশা তোলা, চারু লেস বোনা,
জীবন মানেই
ভায়ের মুখের হাসি, বোনের নিপুণ চুল আঁচড়ানো,
জীবন মানেই
হাসপাতালের বেডে শুয়ে একা আরোগ্য ভাবনা,
জীবন মানেই
গলির মোড়ের কলে মুখ দিয়ে চুমুকে চুমুকে জলপান,
জীবন মানেই
রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়ানো,
স্ফুলিঙ্গের মতো সব ইস্তাহার বিলি করা আনাচে-কানাচে
জীবন মানেই… … … … … … …
আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরেথরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।
এ রঙের বিপরীত আছে অন্য রঙ,
যে রঙ লাগে না ভালো চোখে, যে-রঙ সন্ত্রাস আনে
প্রাত্যহিকতায় আমাদের মনে সকাল-সন্ধ্যায়-
এখন সে-রঙে ছেয়ে গেছে পথঘাট, সারা দেশ
ঘাতকের অশুভ আস্তানা।
আমি আর আমার মতোই বহু লোক
রাত্রিদিন ভুলুণ্ঠিত ঘাতকের আস্তানায়, কেউ মরা, আধমরা কেউ
কেউবা ভীষণ জেদী, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া। চতুর্দিকে
মানবিক বাগান, কমলবন হচ্ছে তছনছ।
বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই
জনসাধারণ
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনও বীরের রক্তে দুখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
হৃদয়ের হরিং উপত্যকায়। সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ,
শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায়।