পার্ক থেকে যাওয়া যায়
পার্ক থেকে যাওয়া যায়। গেলে মার্ক পাওয়া যাবে
তার কাছে। যদি মোমগন্ধী ইকারুস হয়ে যাই ফুল-চন্দন দেবে সে
গোধূলিতে। কিন্তু ইকারুস বড় পতনপ্রবণ। আকাশের
সুনীল বন্ধন তাকে পারে না রাখতে ধরে। পার্কময় আমি
কিংবা আমাকেই পার্ক বলা যেতে পারে। রৌদ্রে জ্বলি, করি পান
আকণ্ঠ আরক শ্রাবণের,
কখনো-বা মগজকে নগ্ন তুলে ধরি কাঁচা দুধের জ্যোৎস্নায়।
পার্কের বাইরে দেখি আইসক্রিমের শূন্য বাক্স নিয়ে কেউ
প্রত্যহ দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ কেউ বেশ ঘটা করে
দোকান সাজায় নিত্য, বেচে না কিছুই কোনো দিন।
কে এক রাজকুমার আসবেন বলে
আসবেন বলে
আসবেন বলে প্রতিদিন ওরা অভ্যাসবশত
যে যার দোকান নিয়ে অটল অপেক্ষমাণ, পণ্যহীন। এই পার্ক থেকে
যখন যেখানে খুশি যাওয়া যায় উজ্জ্বল সবুজ মেখে ট্রাউজারে, কানে
দখিন হাওয়ার গুলতানি পুরে, পাখিদের গান
শার্টের আস্তিনে গুঁজে এবং পকেটবন্দি রজনীগন্ধার শুভ্র ঘ্রাণ অকাতরে
বিলিয়ে সড়কে যাওয়া যায়, প্রভাতবেলার শান্ত প্রফুল্ল বন্দর ছেড়ে
দুপুরের মাঝ-দরিয়ায় ভেসে সূর্যের সোনালি সঙ্গ ছেড়ে
গোধূলির তটে যাওয়া যায়।
অতীতের শুকনো খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বহুদূরে যাওয়া যায়, আপাতত
আমার গন্তব্য গলি। রাবীন্দিক নয় মোটে, রবীন্দ্রনাথের
গলিঘুঁজি কাঁঠালের ভূমি, মরা বেড়ালের ছানা আর মাছের কানকা
সত্ত্বেও কেমন সুশ্রী। পার্কের পাথুরে বেঞ্চ ছেড়ে
আমি যে গলিতে যাব নাম তার অলীক অক্ষর দিয়ে শুধু।
কোনো কোনো দিন হাসে সে-ও, প্রায় প্রতিদিন সে-গলির গাল
বেয়ে পড়ে লোনা জল। থাকে একজন, চোখে যার যুগপৎ
শতকের ধূমায়িত বিভীষিকা যৌবনের নিটোল কুহক। মাঝে মাঝে
ফুলের তেলের মতো তার স্মৃতি আনে বিবমিষা।
তবু মনে হয়,
সত্বর সেখানে গেলে আমার অসুখ যাবে সেরে
নিবিড় স্বপ্নিল পথ্যে, একান্ত গহন কোনো নার্সময়তায়।
দেখব গলির মোড়ে প্রস্তুত ফিটন, মেঘলোক-ফেরা ঘোড়া
খুরে খুরে অস্থিরতা ঝরাচ্ছে কেবল।
দুলিয়ে পাদানি খুব উড়িয়ে স্মৃতির মতো স্বচ্ছ নীলাম্বরী
ফুরফুরে হাওয়া খাতে যাবে ভালোবাসা,
আমার মোহিনী ভালোবাসা।
রৌদ্রের মিছিল এলে রোঁয়া-ওঠা তোয়ালের মতো
আকাশের মোড়ে মোড়ে নক্ষত্র-বিপনি
বন্ধ করে ঝাঁপ।
আমরা এ ওর গায়ে ছায়া ফেলে পথ চলি; আমাদের হাতে
হলুদ ফেস্টুন কত অথচ বেজায় খাঁ খাঁ লালসালু। এ তল্লাটে কোনো
স্লোগানের স্পষ্টতাই নেই। অতঃপর বিস্ফোরণ, ছত্রভঙ্গ কিছু মুখ,
পরিচিত
দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দু’দল দু’দিকে যায় অভিমানে গরগরে ক্রোধে।
তাহলে কোথায় যাব? একা-একা সার্কাস দেখাতে পারব না
চৌরাস্তায়। অতএব পার্কে ফেরা ভালো সেই
পণ্যহীন ফিটফাট কতিপয় দোকানির কাছে গিয়ে সরাসরি বলা-
আমি তো রাজকুমার নই, আমার গালিচা নেই শূন্যচারী, তবু
তোমাদের কাছে ফিরে আসি খেলাচ্ছলে তোমাদের দোকানের শোভা
দেয় উস্কে কল্পনাকে। ভাবি, আজই পার্কের ভেতর
নিজস্ব সুহাস চারা করব রোপণ, জল দেব, নাম দেব স্বাধীনতা।
পুলিশ রিপোর্ট
এত উজ্জ্বলতা আমি কখনো দেখিনি।
সবখানে জ্বলজ্বলে ঝোপ; এত উজ্জ্বলতা, চোখ-অন্ধ-করা,
চৈতন্য-ধাঁধানো
উজ্জ্বলতা দেখেননি মুসাও কখনো।
হাতে নিয়ে পাকা লাঠি দেখলাম ওরা, সংখ্যাহীন
জ্বলজ্বলে ঝোপঝাড় এগোয় কেবলি। চতুর্দিকে তরঙ্গিত মাথা,
উত্তাল, উদ্দাম।
সড়কের দুকুল-ছাপানো
লোক, শুধু-লোক।
লোক,
আমাদের চোখের পাতায়
লোক।
লোক,
পাঁজরের প্রতিটি সিঁড়িতে
লোক।
লোক,
ধুকপুকে বুকের স্কোয়ারে
লোক।
হঠাৎ সে কোন তরুণের বুকের গভীর থেকে
কী যেন ফিনকি দিয়ে ছোটে, পড়ে আমার দু’হাতে।
রক্ত এত লাল আর এমন গরম
কখনো জানিনি আগে, ব্যারাকে পৌঁছেই ঘন ঘন
ধুই হাত ঘষে ঘষে,
অথচ মোছে না দাগ কিছুতেই সে তাজা রক্তের।
হোস পাইপের অজস্রতা পারে না মুছতে দাগ,
এ-দাগ ফেলবে মুছে এত পানি ধরে না সমুদ্রে কোনো দিন।
ঘড়িতে গভীর রাত, ব্যারাক নিশ্চুপ। বারান্দায়
করি পায়চারি আর হঠাৎ কখনো কানে ভাসে আসে
সমুদ্রের বিপুল গর্জন;
সুন্দরবনের সব বাঘ যেন আমার ওপর
পড়বে ঝাঁপিয়ে ক্ষমাহীন।
ঘুমোতে পারি না আমি কিছুতেই, ঘুমকে করেছি গুম খুন।
কেমন উৎকট গন্ধ লেগে রয় সকল সময়
আমার দু’হাতে আর সমস্ত শহরে।
সারাটা শহর যদি কেউ দিত ঢেকে
অজস্র সুগন্ধি ফুলে, তবে দুটি হাত গোপনে লুকিয়ে
রাখতাম সুরভিত ফুলের কবরে সর্বদাই।
প্রকারভেদ
সুকণ্ঠ কোকিল তুমি বসন্তের মাতাল নকিব,
মধ্যরাতে বিপর্যস্ত করে ফেল এখনও আমাকে,
নিদ্রার গহন থেকে নিয়ে যাও পাতার টেরেসে।
হাঁস তুমি ব্রজেন দাশের মতো কাটছ সাঁতার
পাড়ার পুকুরে যথারীতি। নিঃসঙ্গ কুকুর তুমি
শহরের নানা দৃশ্য রাখছ দু’চোখে; টিকটিকি
যখন-তখন তুমি ডেকে ওঠো, দেয়ালের মাঠে
দিব্যি ফুলবাবু সেজে হাওয়া খাও প্রত্যহ দু’বেলা।
কোকিল, কুকুর, হাঁস, টিকটিকি ইত্যাদি ইত্যাদি
আটক করে না জেলে তোমাদের অলিতে গলিতে
কারফ্যু হয় না জারি অতর্কিতে। তোমাদের কেউ
করে না শোষণ কোনো দিন; কেননা তোমরা নও
ঈর্ষণীয় সেই জাতি বস্তুত মানব যার নাম।
প্রত্যাবর্তন
পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে।
এই রৌদ্র, এই পথ কতকাল আমাকে অত্যন্ত
করেছে ব্যাকুল। বাইরের ক্ষীণতম শব্দ কিংবা
একটি দৃশ্যের জন্যে পিপাসার্ত কাটিয়েছি অনেক বছর।
অনেক বছর আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে কাটিয়েছি
হিরন্ময় ভেন্টিলেটারের
স্বপ্ন দেখে দেখে। কতকাল কৃষ্ণচূড়া, তৃষিত বুকের মধ্যে
দেয়নি ছড়িয়ে অগ্নি-গুঁড়া।
আমার মাথায় সাদা চুল ওড়ে হাওয়ায়, পুরানো
চটের থলের মতো শিথিল শরীর,
দাঁত নড়বড়ে,
দৃষ্টি নিবু নিবু আর জীবনের প্রতিটি মোর্চায়
যেন সান্ধ্য আইন হয়েছে জারি। রাস্তার কিনারে
বিশীর্ণ চাঁদের মতো নুয়ে-পড়া দর্জিটা এখনও
কী ব্যগ্র পরায় সুচে সুতো।
আমার যে-ঘর নেই
সে-ঘর আমাকে ডাকে বুক হাট করে,
আমার যে-শয্যা নেই
সে-শয্যা আমাকে ডাকে বিশ্রামের স্বরে,
আমার যে-প্রিয়া নেই
ডাকে সে বুকের পদ্ম উন্মোচন করে,
আমার যে পুত্র-কন্যা নেই
ডাকে তারা কচি চারাদের মতো বাহু মেলে দিয়ে।
পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে।