তার আগে
কখনো আকাশ কখনো-বা দূরবর্তী গাছপালা,
কখনো গলির মোড়, কোনো আত্মীয়ের মৃত মুখ
ল্যাম্পোস্টের ঝাপসা আলো কুয়াশায়, মর্চে-পড়া তালা
কিংবা মেথরনীর নিতস্ব কখনো যৎসামান্য ভুলচুক
অথবা সংঙ্গিনাকীর্ণ রাত মানসে ঝরায় কত
কবিতার ফোঁটা। তার আগে ট্রেন চলে যায় দ্রুত ছিন্নভিন্ন করে
আমার শরীর; চোখে ওঠে লাল পিঁপড়ে অবিরত
ঝাঁক ঝাঁক, হৃৎপিণ্ড বিক্ষত হয় পাখির ঠোকরে।
তিনজন বুড়ো
চায়ের দোকানে ব’সে ঘেঁষাঘেঁষি তিনজন বুড়ো
অতীতের পাহাড়ের ঢালু বেয়ে তুষারের চূড়ো
ছুঁল আর ভাসাল শরীর হ্রদে, প্রজাপতি-ছাওয়া
মাঠে ছুটোছুটো করে ক্লান্ত হল। যেন নাওয়া-খাওয়া
নেই কারো এভাবে রয়েছে ব’সে ওরা তিনজন
ছারপোকা কবলিত বিবর্ণ বেঞ্চিতে। ভন ভন
ওড়ে মাছি নাকের ডগায়, বুঝি ওরা এককাট্রা
গাইছে কাওয়ালি। নাড়ে, ওরা মাথা নাড়ে আর ঠাট্রা
মস্করা কথার ফাঁকে ফাঁকে চলে। কেউ তার উড়ো
কথাকে চিঞ্চিৎ নকশি করে তোলার আশায় গুঁড়ো
গুঁড়ো রঙ বর্ণনায় দিল তোফা ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
বলল সে, শোনা ভাই খুঁটিনাটি ফ্যাসাদ মিটিয়ে
বদলেছি বউ আমি জুতোর পাটির চেয়ে ঘন
ঘন। ধোয়া ছেড়ে অন্যজন বলে, ‘আমি গত গণ-
অভ্যুত্থানে অহরহ দেখেছি তাসের রাজা কত
গেছেন চকিতে ভেসে ম্লান বিশীর্ণ কুটোর মতো
বানের প্রবল তোড়ে, ঘটনার গলগ্রহ। বাকি
যে থাকে সে বলে না কিছুই, যেন সে দ্বিতীয় পাখি
উপনিষদের, দেখে শুধু দেখে গভীরে একাকী।
দাঁত
বয়স আমার চল্লিশ হল
এবং তোমার থরোথরো ষোলো।
কৃতী নই কোনো, আমি অভাজন;
অনেক আশায় নষ্ট গাজন।
কলেজের বাস ক’টি বসন্ত
নিয়ে থামলেই মাঝে মাঝে দেখি।
তোমার জুতোর খুরে ওড়ে কাল,
হৃদয় স্মৃতির জোছনায় সেঁকি।
হঠাৎ কখনো তোমার গালের
রক্তাক্ত দেখে লাগে বড় চেনা-
যেন তা ট্রয়ের সূর্যাস্তের
অতীব বিধুর মেঘেদের ফেনা।
তোমার ও-মুখমণ্ডল দেখে
মনে পড়ে আরও দৃশ্য ভিন্ন,
এক লহমায় মনে প’ড়ে যায়
নভোচারীদের পায়ের চিহ্ন।
একদা তোমার বয়স যখন
পাঁচটি চাঁপার মতো অবিকল,
দেখেছি সেদিন তুমি কচি দাঁতে
কামড়ে কামড়ে খেতে কত ফল।
আজও অবশ্য শুভ্র দাঁতের
ধারে ছিঁড়ে নাও ফলের চামড়া
এবং মাংস। শুধু তাই নয়,
আরও কিছু কথা জেনেছি আমরা।
তোমার তীক্ষ্ণ দাঁতের ফলায়
ক্ষতবিক্ষত রক্তগোলাপ;
বাঘিনীর মতো ঠোঁট চাটো আর
দু’পায়ে মাড়াও পাখির বিলাপ।
তোমার দাঁতের শরশয্যায়
বুক পেতে দিয়ে সুখ যারা চায়,
সেই গোষ্ঠীর আমি নই কেউ;
মজ্জা চাটছে বয়সের ফেউ।
দুঃস্বপ্নে একদিন
চাল পাচ্ছি, ডাল পাচ্ছি, তেল নুন লাকড়ি পাচ্ছি,
ভাগ-করা পিঠে পাচ্ছি, মদির রাত্তিরে কাউকে নিয়ে
শোবার ঘর পাচ্ছি, মুখ দেখবার
ঝকঝকে আয়না পাচ্ছি, হেঁটে বেড়ানোর
তকতকে হাসপাতালি করিডর পাচ্ছি।
কিউতে দাঁড়িয়ে খাদ্য কিনছি,
বাদ্য শুনছি।
সরকারি বাসে চড়ছি,
দরকারি কাগজ পড়ছি,
কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি,
খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, দু’বেলা
পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনি কথা শুনছি,
ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি।
আপনারা নতুন পয়ঃপ্রণালী পরিকল্পনা নিয়ে
জল্পনা-কল্পনা করছেন,
কারাগার পরিচালনার পদ্ধতি শোধরাবার
কথা ভাবছেন (তখনো থাকবে কারাগারে)
নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, মাটি কাটছে ট্রাক্টর,
ফ্যাক্টরি ছড়াচ্ছে ধোঁয়া, কাজ হচ্ছে,
কাজ হচ্ছে,
কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি।
মধ্যে মধ্যে আমার মগজের বাগানের সেই পাখি
গান গেয়ে ওঠে, আমার চোখের সামনে
হঠাৎ কোনো রুপালি শহরের উদ্ভাসন।
দোহাই আপনাদের, সেই পাখির
টুঁটি চেপে ধরবেন না, হত্যা করবেন না বেচারীকে।
কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি,
খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, দু’বেলা
পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনি কথা শুনছি,
ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি।
পক্ষপাত
ঘাসের নিচের সেই বিষাক্ত সাপকে ভালোবাসি,
কেননা সে কপট বন্ধুর চেয় ক্রূর নয় বেশি।
ভালোবাসি রক্তচোষা অন্ধ বাদুড়কে,
কেননা সে সমালোচকের চেয়ে ঢের বেশি অনুকম্পাময়।
রাগী বৃশ্চিকের দংশন আমার প্রিয়,
কেননা সে দংশনের জ্বালা অবিশ্বাসিনী প্রিয়ার
লাল চুম্বনের চেয়ে অধিক মধুর।
আমি কালো অরণ্যের সুকান্ত বাঘকে ভালোবাসি,
কেননা সে একনায়কের
মতো কোনো সুপরিকল্পিত
সর্বগ্রাসী শক্রতা জানে না।
পশু বিষয়ক কবিতা
খুব জনসমাগম হয়েছিল; ছেলেমেয়েগুলো ঘর ছেড়ে
পার্ক ছেড়ে, মাঠ ছেড়ে রাঙা ঘুড়ি এবং বেলুন
ওড়াতে ওড়াতে,
মহিলারা সেজেগুঁজে বাতাসে মেয়েলি ঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে
সেখানে নিবিড় এলো, যুবকেরা ছিমছাম, কেউ কেউ রাগী
দৃষ্টি মেলে চারদিকে এলো ভিড়ে, বুড়োরা স্মৃতির
পদশব্দ শুনে-শুনে।
খাঁচার ভেতরে কিছু জমকালো পশু। স্বাস্থ্যল পেশির খেলা
ভালো লাগে, বুঝি তাই খুব জনসমাগম হয়েছিল। বন ছেড়ে এই
সংকীর্ণ খাঁচায় যতটুকু ভালো থাকা যায় খেয়ে দেয়ে কিংবা
আলস্যে ঝিমিয়ে,
ভালো আছে ওরা সব। হঠাৎ লাফায় কেউ, দোল খায় কেউবা মজায়,
একজন করে ঘোরা-ফেরা, যেন গিন্নী ডেপুটির,
এবং শিম্পাঞ্জিটিকে দেখে মনে হয় দেকার্তের
শাণিত পাতার স্বাদ জানা আছে তার। কেউ এত পায়চারি
করছে ভারিক্কি চালে, যেন হোমরা-চোমরা নেতা কেউ,
এক্ষুণি ধরবে ছেঁকে তুখোড় রিপোর্টারের ঝাঁক।
পরিচর্যা চলে যথারীতি, বস্তুত খাঁচায় নেই
খাদ্যাভাব উপরন্তু দর্শকেরা শৌখিন আদরে
দেয় খেতে ছোলা কলা ইত্যাদি, ইত্যাদি। দূরে থেকে
ক’জন ভিখারি, লুব্ধ দৃষ্টি, চলে যায় মাথা হেঁট করে।