গ্রন্থে আছেন শহীদুল্লাহ
গ্রন্থাবলি প’ড়ে আছে, লেখার টেবিলে চশমা, কালো টুপিটায়
জমছে মসৃণ ধুলো এবং জায়নামাজ, পুণ্য স্মৃতিময়,
নিবিড় গোটানো একপাশে। প্রাতরাশ ঠাণ্ডা হচ্ছে বলে কেউ
ডাকবে না ঘন ঘন। প্রত্যহ বাড়বে বেলা, মধ্যরাতে একে একে বাতি
নিভবে প্রতিটি ঘরে। কদিমী চেয়ার ছেড়ে গ্রন্থাগার থেকে
বেরিয়ে আপনি আর সিঁড়ি বেয়ে যাবেন না একা
দোতলায়, মগজের নন্দিত নিকুঞ্জ
আধ্যাত্মিক পাখির অমর্ত্য গানে গুঞ্জরিত হবে না কখনো।
দুশ্চরিত্র সময়ের কাছে আপনাকে নতজানু হতে কেউ
দ্যাখেনি কখনো, আপনার আচকানে, পেয়েছে সক্ষম পাখা
নিঙ্কলুষ নীলিমায়। হে বিদ্যা, হে প্রজ্ঞা, মনীষার মন্বন্তরে
ছিলেন বিপুল অন্নসত্র, যে যেমন খুশি নিয়েছে অঞ্জলি
পেতে বারবার।
এখন আছেন গ্রন্থে, বাংলার স্মৃতিতে, জ্বলজ্বলে দরোজায়।
সেই কবেকার অপরূপ শৈশবকে কোন জাদুবলে চির-
প্রতিবেশী করে রেখেছিলেন মায়াবী কুঠুরিতে,
ভেবেছি বিস্ময়ে কতদিন। অন্বেষণে
আলোকিত শতঝুরি একটি বৃক্ষের কাছে চেয়েছেন পৌঁছুতে সর্বদা।
সোনালি মাছের মতো উঠত লাফিয়ে
আপনার প্রবীণ চোখের নিচে নিত্য অভিধানের শব্দেরা
বারবার, সস্নেহে দিতেন ঠাঁই একান্ত মানস-
সরোবরে। পাণিনীয় সূত্রের মায়ায় হেঁটেছেন গহন জটিল পথে
দীর্ঘকাল প্রশ্নাতুর। বাংলা ব্যাকরণ রাজনর্তকীর মতো
মদির কটাক্ষ মেলে আপনাকে ডেকে নিয়ে গেছে
অন্তঃপুরে, সহবাসে বিনোদের ধ্বনি অতঃপর
সামাজিকতায় বেজে ওঠে ঘরে ঘরে।
অন্ধকারে যাব না কখনো, অন্ধকার
আমাকে ভীষণ ক্রুদ্ধ করে, করতেন উচ্চারণ মনে মনে
হয়তোবা; আপনাকে আলোর প্রেমিক
জেনেছি সর্বদা। অন্ধকারে যাবেন না, যাবেন না কোনো দিন
আমরাও বলেছি ব্যাকুল
অথচ পেছনে সীমাহীন অন্ধকার ফেলে, শুধু
কতিপয় গ্রন্থ হয়ে উদাস গেলেন চলে অন্য অন্ধকারে।
ছবি
বনের হরিণ নয়, বক নয়, নয়কো ডাহুক,
ছেলেটা আনল এঁকে খাপছাড়া মানুষের মুখ।
দিব্যি টেরিকাটা চুল, চোখ কান নেই তো কিছুই;
ঠোঁট আছে, খিল-আঁটা। ইচ্ছে করে ছবিটাকে ছুঁই,
আচম্বিতে আঁৎকে উঠি তার সঙ্গে নিজের মুখের
মিল দেখে; ছবিটায় খোঁজ পাই আরও অনেকের।
ছেলেটা পাগল নাকি?
ছেলেটা কখন ফেরে কত রাতে কেউ তা জানে না।
রুক্ষ চুল, মাটিমাখা জুতো পায়ে চেনা
গলিটা পেরিয়ে আসে, ঢোকে ঘরে একা, নড়বড়ে
চৌকি দেয় কোল আর পাশের টেবিলে থাকে প’ড়ে
কড়কড়ে ভাত, ভাজা মাছ (মা জানেন ছেলে তার
খুব শখ করে খায়) এবং পালং শাক, ডাল, পুদিনার
চাটনি কিঞ্চিৎ। অথচ সে পোরে না কিছুই মুখে, হ্যারিকেন
শিয়রের কাছে টেনে বই পড়ে, আর ভাবে কী-কী অহিফেন
জনসাধারণ আজ করছে সেবন বিভ্রান্তির চৌমাথায়।
দ্যাখে সে কালের গতি মার্কস আর লেনিনের প্রসিদ্ধ পাতায়।
সকাল হলেই ফের ব্যাকুল বেরিয়ে পড়ে, মা থাকেন চেয়ে-
দেখেন ছেলের মাথা ঠেকে ঘরের চৌকাঠে, তাঁর চোখ ছেয়ে
চকিতে স্বপ্নের হাঁস আসে নেমে, পাখসাটে কত
ছবি ঝরে সেকালের, ঝরে জ্যোৎস্না স্ফুলিঙ্গের মতো।
ভাবেন এমনি একরোখা, কিছুটা বাতিকগ্রস্ত ছিলেন তিনিও, মানে
যার পরিচয় এই দেহ-দ্বীপ, দুঃখের উপসাগর জানে।
‘ছেলেটা পাগল নাকি? প্রতিবেশী বুড়ো বললেন খনখনে
কণ্ঠে তাঁর। ‘পাগল নিশ্চয়, নইলে ঘরের নির্জনে
কেন দেয়নি সে ধরা’, ভাবেন লাঠিতে ভর দিয়ে বুড়ো, ‘নইলে কেউ বুঝি
মিটিং-মিছিলে যায় যখন-তখন? সব পুঁজি
খেয়ায়, ঘরের খেয়ে তাড়ায় বনের মোষ? জীবনের সকালবেলায়
গোলাপের মতো প্রাণ জনপথে হারায় হেলায়?’
জেদি ঘোড়াটা
জেদি ঘোড়াটা তেজী ঘোড়াটা হাঁপায় ছোড়ে
বারংবার কালো খুরের হল্কা শুধু।
স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে ওঠে প্রাণের তোড়ে,
দু’চোখে তার স্বপ্ন কিছু কাঁপছে ধু-ধু।
জেদি ঘোড়াটা তেজী ঘোড়াটা ছুটছে এই
ছুটছে ঐ শহর-গ্রামে, পরগনায়;
ছুটছে শুধু, দীপ্ত পিঠে সওয়ার নেই।
দেখছে চেয়ে কৌতূহলী দশজনায়।
জেদি ঘোড়াটা তেজী ঘোড়াটা ডাইনে বাঁয়ে
ভীষণ ছুটে ক্লান্ত হলে জুড়োয় পাড়া।
হঠাৎ কারা পরায় বেড়ি ঘোড়ার পায়ে;
স্তব্ধ ঘোড়া, শকুনিদের চঞ্চু খাড়া।
টিকিট
একটি টিকিট আমি বহুকাল লুকিয়ে রেখেছি
সযত্নে বুকের কাছে। আশেপাশে সর্বক্ষণ যারা
ঘুরছে তাদের বড় লোভ এই টিকিটের প্রতি।
এক একটি দিন যায়, সে-টিকিট অলক্ষ্যে সবার
কেবলি সোনালি হয়। হোন্ডায় সওয়ার আঁটো যুবা,
বেসামাল ট্রাক ড্রাইভার, বাস কন্ডক্টার আর
সাদা হাসপাতালের দারোয়ান এবং এয়ার
হোস্টেস সবাই চায় সে-টিকিট আমার নিকট।
সেদিনও জ্বরের ঘোরে দেখলাম, একজন কালো
শিশিটার অন্তরালে সুদুরের কুয়াশা জড়ানো।
শরীরে দাঁড়াল এসে, বাড়াল খড়ির মতো হাত
সাত তাড়াতাড়ি তপ্ত আমার বুকের দিকে সেই
টিকিটের লোভে, আমি প্রবল বাধায় তাকে দূরে
সরালাম। আরো কিছুকাল রাখতেই হবে ধরে
এ টিকিট রাখতেই হবে বুকের একান্ত রৌদ্রে,
জ্যোৎস্নায় বানানো পকেটের হু হু জনহীনতায়।
ডাকছি
ডাকছি ডাকছি শুধু ডেকে ডেকে বড় ক্লান্ত আমি;
দেয় না উত্তর কেউ। সারাক্ষণ করি পায়চারি,
চৌদিকে তাকাই, ডাকি প্রাণপণে, এ-বাড়ি সে-বাড়ি
করি ঘন ঘন তবু পাই না কারুর দেখা। নামি
পথে একা, চৌরাস্তায় ভীষণ চেঁচাই। ফের থামি
আচম্বিতে, যেন কেউ বাস ছেড়ে সাত তাড়াতাড়ি
আসছে আমারই দিকে। আমি তাকে কী এলোপাতাড়ি
বলতে গিয়েই বোবা। পথে শূন্যতার মাতলামি।
যেন মৃত্যু অকস্মাৎ এ শহরে সব ক’টি ঘরে
দিয়েছে বাড়িয়ে হাত, শহরের প্রত্যেকটি ঘড়ি
হয়েছে বিকল আর শোক পালনের মতো কেউ
এখন কোথাও নেই। ভয়ানক নৈঃশব্দের ঝড়ে
শহর-মরুর বুকে একটি কাঁকড়া শুধু তড়ি-
ঘড়ি যাচ্ছে ঠেলে ঠেলে ক্রমাগত শূন্যতার ঢেউ।