কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি
একদা কবিতা তার বুক নগ্ন করেছিল আপনার চোখের সম্মুখে,
আপনি সে নগ্নতায় দেখেছেন নিজেরই মনের সূর্যোদয়।
একদা কবিতা তার স্তনের গোলাপ কুঁড়ি চেয়েছিল দিতে,
আপনি সে গোলাপের উজ্জ্বলতা ছেড়ে
কালবোশেখীর ঝড়ে চকিতে গেলেন ছুটে বাগ্মিতা নামের
দজ্জাল মেয়ের কাছে, যার ক্ষিপ্ত তুমুল নর্তনে স্বপ্নগুলি
পড়ল ছড়িয়ে ভাঙা ঘুঙুরের মতো।
কতদিন হারমোনিয়ামের রিডে নিপুণ আঙুল
তন্ময় নাচেনি আর কতদিন কামিনীর ঠোঁটে
আঁকেননি প্রগাঢ় চুম্বন।
এখন আপনি সেই যাত্রী আত্মভোলা, হঠাৎ যে নেমে পড়ে
ভুল ইস্টিশানে অবেলায়।
তবু আপনার মতো কারুকেই চাই, আজও নজরুল ইসলাম।
সুপ্রভার তরঙ্গিত সুরের মতোই
হাওয়া ছুঁয়ে যায়
অস্তিত্বের তট,
এবং পবিত্র গাঙ্গুলীর দুটি অক্ষিগোলকের প্রসন্ন রশ্মির মতো
দিবালোক আসে,
প্রমীলার হাসির মতোই জ্যোৎস্না ঝরে আপনার
বুকের নির্জন মরু এবং পায়ের অন্তরীপে।
তবুও বুকের মধ্যে কথা
নৈঃশব্দের গভীর মোড়ক-ছেঁড়ে কথা
হয় না এখন উচ্ছ্বসিত।
আপনার মগজের কোষে কোষে মৃত প্রতিধ্বনি কবিতায়?
কোন পুলিনের খুব স্মৃতির বকুল গাছকে
অনেক পেছনে ফেলে ছায়াচ্ছন্ন বারান্দায় শুধায় ফেরারি বুলবুল
কেমন আছেন নজরুল ইসলাম?
কাবেরী নদীর জল, পদ্মার উত্তাল ঢেউ প্রশ্ন করে আজ
কেমন আছেন নজরুল ইসলাম?
বাদুড় বাগান লেন এবং মন্মথ দত্ত রোড
বেলগাছিয়ার
প্রতিটি সকাল আর প্রতিটি সন্ধ্যায় করে প্রশ্ন
কেমন আছেন নজরুল ইসমা?
সারা বাংলাদেশের ব্যাকুল কণ্ঠে সেই একই প্রশ্ন
কেমন আছেন নজরুল ইসলাম?
কী যুগে আমরা করি বাস
কী যুগে আমরা করি বাস। প্রাণ খুলে কথা বলা
মহাপাপ; যদি চেয়ার টেবিল কিংবা দরজার কানে গলা
খাটো করে বলি কোনো কথা, তবে তারাও হঠাৎ
যেন ব’নে যাবে বড় ঝানু গুপ্তচর। এমনকি গাছপালা,
টিলা, নদীনালা
কারুকে বিশ্বাস নেই বাস্তবিক। আমাদের এমনই বরাত।
কী যুগে করি আমরা বাস। এখন প্রতিটি ঘরে
মিথ্যা দিব্যি পা তুলে রয়েছে ব’সে, প্রহরে প্রহরে
পালটাছে জামা জুতো। সারাক্ষণ খাটছে হুকুম
তারই ক্ষিপ্র ব্যস্ততায় পাড়ার মোড়ল, মজলুম।
মহানুভবতা, প্রীতি ঔদার্য বিবেক সবই নিয়েছে বিদায়
ছেলে-বুড়ো ঘুমোনো পাড়ার থেকে করুণ দ্বিধায়।
কী যুগে আমরা করি বাস। কোনো বসন্তের রাতে
যখন ঘনিষ্ঠ যাই পার্কে দুহুঁ, অসংখ্য হা-ভাতে
ভিড় করে আসে চারপাশে। আমাদের চুমোর ওপর
পড়ে দুর্ভিক্ষের ছায়া। মহামারী দিগ্ধিদিক মাথায় টোপর
প’রে ঘোরে সর্বক্ষণ। আমাদের সন্তানের দোলনা দুলছে মৃদু ছন্দে
অসংখ্য লাশের ঘুম-তাড়ানিয়া উৎকট দুর্গন্ধে।
কোন দৃশ্য সবচেয়ে গাঢ় হ’য়ে আছে?
কোন দৃশ্য সবচেয়ে গাঢ় হয়ে আছে
এখনও আমার মনে? দেখেছি তো গাছে
সোনালি-বুকের পাখি, পুকুরের জলে
সাদা হাঁস। দেখেছি পার্কের ঝলমলে
রোদ্দুরে শিশুর ছুটোছুটি কিংবা কোনো।
যুগলের ব’সে থাকা আঁধারে কখনো।
দেশে কি বিদেশে ঢের প্রাকৃতিক শোভা
বুলিয়েছে প্রীত আভা মনে, কখনো-বা
চিত্রকরদের সৃষ্টির সান্নিধ্যে খুব
হয়েছি সমৃদ্ধ আর নিঃসঙ্গতায় ডুব
দিয়ে করি প্রশ্ন এখনও আমার কাছে
কোন দৃশ্য সবচেয়ে গাঢ় হয়ে আছে?
যেদিন গেলেন পিতা, দেখলাম মাকে-
জননী আমার নির্দ্বিধায় শান্ত তাঁকে
নিলেন প্রবল টেনে বুকে, রাখলেন
মুখে মুখে; যেন প্রিয় বলে ডাকবেন
বাসরের স্বরে। এখনও আমার কাছে
সেই দৃশ্য সবচেয়ে গাঢ় হয়ে আছে।
কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম
ডিমের খোলের অন্তস্থলে যেতে ভারি ইচ্ছে হয়।
সেখানে প্রস্থান করি যদি,
কেউ জানবে না,
কখনো আমার কোনো ক্রিয়ার খবর পৌঁছুবে না
কারুর কাছেই।
সেখানে একান্তে বসবাস করবার প্রিয় সাধ
কেবলি লতিয়ে ওঠে হলহল করে
বিভিন্ন প্রহরে।
ফিরিয়ে উদ্বেগ-বিদ্ধ মুখ অত্যাচারী শব্দ থেকে
কুমারী নীরবতার বুক দেখে নেব নাচিকেত চৈতন্যে চকিতে।
ভাঙব না নৈঃশব্দের ধ্যান। করব এমন কাজ, যখন যেমন খুশি,
যা’ লংঘন করে না কখনো
শব্দহীনতার সীমা-যেমন জামার
আস্তিন গোটানো কিংবা চেয়ে থাকা অপলক, অথবা জুতোর
ফিতেটাকে ফুল সযত্নে বানিয়ে তোলা,
স্মৃতির নিকুঞ্জে
কোনো মনোহর শশকের প্রত্যাশায় ব’সে থাকা।
মধ্যে-মধ্যে নীরব থাকতে ভালো লাগে; নীরবতা
ফুল্ল ঊরু মেলে দিলে, মুখ রাখি তার নাভিমূলে।
তখন শব্দের ডাকাডাকি অত্যন্ত বিরক্তিকর,
এমনকি কবিতা লেখাও
ক্লান্ত বারবনিতার সঙ্গে সঙ্গমের মতো ঠেকে,
বুঝি তাই কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম লেখার সময়
বড় লজ্জাবোধ হয়।
কোনো রমণীর জন্যে সারারাত ঘুমোতে পারি না,
সৌরভের মদে চুর দূরে বোহেমিয়ান বাগান,
শহরে সার্কাস পার্টি এলো বহুদিন পর আর
স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে সন্ন্যাসী সটান হেঁটে যান
দুপুরুক্ষ বেলায় চেলার খোঁজে কোন আখড়ায়,
কোথাও লাইনসম্যান প্রাণপণে দোলাচ্ছে কেবলি
রাঙা বাতি তার,
অথবা আমার বুকে ঝারির মুখের মতো বহু ফুটো আছে-
কী এমন কথামালা এসব যাদের তন্তুগুলো
চাপিয়ে কাব্যের তাঁতে বুনে যেতে হবে রাত্রিদিন?
‘এই যে যাচ্ছেন হেঁটে শরীর খদ্দরে ঢেকে, চোখে পুরু চশমা,
মাথায় পাখির বাসা, ইনি কবি; মানে,
করেন শব্দের ধনে প্রচুর পোদ্দারি’…শুনলেই পায়ে পায়ে
জোর লাগে ঠোকাঠুকি, কামড়ায় বিছে…
যেন খুব সাধ্বী দিবালোকে এভেন্যুর চৌমাথায়
প্রকাশ্যে ইজের খুলে দ্রুত
প্রস্রাব করতে গিয়ে ধরা প’ড়ে গেছি
পুলিশের হাতে।
শব্দ, রাজেন্দ্রানী শব্দ কেবলি পিছলে যায়, যেমন হাতের
মুঠো থেকে স্তন,
তবু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে
নিতম্ব বুলিয়ে তার নিয়ে আসি ঘরে।
পায়চারি করে আর সিগারেট পুড়িয়ে এন্তার,
গরম কফির পেয়ালায় ব্যাকুল চুমুক দিয়ে ঘন ঘন
একটি কবিতা শেষ করে সুখে কোনো কোনো দিন
শিরোনাম লিখতে গিয়েই আচমকা ভারি লজ্জাবোধ হয়।