কতবার ভাবি
কতবার ভাবি তার উদ্দেশে লিখব না আর কবিতা।
প্রতিটি শব্দে ব্যথার তুষার জমিয়ে
কবিতা-মুক্তো কোনো দিন তাকে করব না উৎসর্গ।
সেই কবে তার কেশতরঙ্গে হৃদয় টালমাটাল
নৌকোর মতো প্রহরে প্রহরে নিত্য উঠত দুলে,
সেই আমাদের জীবন-রাঙানো বনভোজনের দিন,
সূর্য ডোবার মুহূর্তে মুদু স্বর দিয়ে প্রাণ ছোঁয়া,
পাহাড়ি পথের ঝরনার ধারে উড্ডীন পাখি দেখা-
এসব খুচরো ঘটনাবলির স্বাক্ষর আজও বই।
আমার ওষ্ঠ তার ওষ্ঠের গাঢ় বন্দরে
ভিড়তে অধীর হয়েছে যখন,
মৃত চড়ুইটা পড়েছিল চুপ মেঝের ওপর,
হাওয়ায় জড়ানো স্তব্ধ শরীর।
নৈঃশব্দের হৃৎপিণ্ডের মতো আমরাও
যুগ্ম দোলায় কেঁপেছি শুধুই।
উথালপাথাল ঢেউয়ের চূড়ায় হৃদয়ের সাঁকো
ভেসেছে চকিতে একদা যখন,
দুপুরের লাল এজলাসে দুলে জারুলের শাখা
করেছিল বুঝি জজিয়াতি খুব।
আমাদের প্রেম ফুলের মতন উঠেছিল ফুটে,
তোমরা বলতে পারো।
আমাদের দেখে সন্ধ্যার মেঘ উঠেছিল জ্ব’লে,
তোমরা বলতে পারো।
কতবার তাকে এই তো এখানে, মানে খোলা এই
বারান্দাটায়
অথবা ঘরের সুশ্রী ছায়ায় চেয়ারে বসিয়ে
হয়েছি নিবিড়।
এই ব’সে থাকা, কথা বলা আর কথা না-বলা,
কিছু বিশ্বাস
কিছু সন্দেহ, কিছু রোমাঞ্চ-এই তো প্রেমের
ভাষান্তরণ।
তার সে বুকের নাক্ষত্রিক অলিন্দ আর
চোখের বাগানে হাতের মহলে অবক্ষয়ের
দারুণ বেলায় কার অধিকার? নেই তথ্যের
মূল্য কী আজ? সময় তো এক তুখোড় পাচক,
সোনালি-রুপালি ল্যাজা-মুড়ো সব হাতায় হাতায়
করে একাকার। আমাকেও তার হাঁড়িতে চাপিয়ে
দিচ্ছে তীব্র জাঁহাবাজ আঁচ। অবান্তরের
আবর্জনায় অনেক কিছুই চাপা প’ড়ে যায়।
সেই জঞ্জালে প্রায়-নিভন্ত অঙ্গার এক
রটায় হাওয়ায় একদা কখনো সে ছিল আমার।
আমার স্বরের ব্যাকুল কোকিল-ভাবি রাত্তিরে মিশে-
কখনো আবার পৌঁছে যাবে কি তার বাসনার নীড়ে?
এই মুহূর্তে সে যদি আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে,
চোখ জ্বেলে রাখে চোখের ওপর, চুন-খসা দেয়ালের
বয়েসী ঘড়ির নিশ্চলতায় জাগবে কি ফের দোলা?
আগের মতোই হৃদয় আমার আরক্ত নাচ হবে?
এর যথার্থ উত্তর দিতে আমার ভীষণ বাধে।
এ-যুগে শুনছি, রটায় সবাই, হৃদয় থাকাটা বিপজ্জনক;
ভালোই হয়েছে, সুনীল নেকড়ে ছিন্নভিন্ন করেছে হৃদয়।
অতীত-প্রেতের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় শিহরিত ঘাস; মরা পাখিদের
ভয়ানক সাদা কংকাল নিয়ে খুব খসখসে কাগজের মতো
এলোমেলো আর ছেঁড়া-খোঁড়া সব পাখা নিয়ে মাঠে হাহাকার হয়।
কতবার ভাবি তার উদ্দেশে লিখব না আর কবিতা,
তবু তার প্রেত অতনু স্মৃতির রুমাল ওড়ায়
আমার রচিত শব্দ,
গন্ধ বিলায় ছন্দে।
কবিতা
কখন যে ছেড়ে যাবে হঠাৎ আমাকে, কখন যে…
সেই ভয়ে রক্ত জমে যায় দইয়ের মতন।
যখন নিঃসঙ্গ
ব’সে থাকি ঘরে, বই পড়ি, শার্টের বোতামগুলো ছুঁই কিংবা
এলাহি ডবল ডেকারের পেটে ঢুলি,
এমনকি ঘুমের মধ্যেও
সেই ভয় ভীষণ ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর।
যখন আমার চোখে চোখ রাখো, বাগানের তাজা
ফুলগুলো বাড়ায় আমার দিকে মুখ, ঝরনা নেচে
ওঠে হাতে, পাখি আসে খুব কাছে, তোমার চুম্বনে
জন্ম নেয় কত পদাবলি
হয়তো খেলছি ব্রিজ, হয়তো গিয়েছি ইস্টিশানে,
হয়তো, পুরছি মুখে খাদ্য,
হয়েছি শামিল কোনো শবানু গমনে,
অকস্মাৎ সেই ভয় ঝানু জাদুকরের মতন
কালো পর্দা দিয়ে
ঢেকে ফেলে আমাকে সম্পূর্ণ
কখন যে ছেড়ে যাবে হঠাৎ আমাকে, কখন যে…
কবিয়াল রমেশ শীল
কিন্নর কণ্ঠের খ্যাতি ছিল না তোমার, কোনো দিন
জলকিন্নরীর ধ্যানে, ঈশ্বরের বিফল সন্ধানে
কাটেনি তোমার বেলা। কুলীন ড্রইংরুমে কিংবা ফিটফাট রেস্তোরাঁয়
হওনি কখনো তর্কপরায়ণ সাহিত্যের শৌখিন আড্ডায়।
ছিল না তোমার মন জমকালো শিল্পের মহলে, আলোকিত
প্রভাতবেলায় তুমি যে-শিল্পের পেয়েছিলে দেখা
ভীষণ তামাটে তার গ্রীবা রৌদ্রের সুতীব্র আঁচে।
স্বদেশকে প্রিয়ার একান্ত নাম ধরে ডেকে ডেকে
অগ্নিবলয়ের মধ্যে গড়েছিলে প্রেমের প্রতিমা
নিজে পুড়ে পুড়ে।
তোমার প্রেমার্ত স্বর পঞ্চান্ন হাজার
একশো ছাব্বিশ বর্গমাইলে আনাচে-কানাচে
পৌঁছে গেছে। বাউলের গেরুয়া বস্ত্রের মতো মাটি, মাছ আর আকাশের কাছে
নদীর বাঁকের কাছে, মজুরের ক্ষিপ্র, পেশি অত্যাচারী শাসক-দপুরে
কৃষকের হাল-ধরা মুঠোর কাছেই তুমি শিখেছিলে ভাষা।
বস্তুত এখানে বড় বেশি আমরা সবাই যাত্রা ভালবাসি,
এমনকি নিজেরাই ‘অধিকারী পার্ট দাও’ বলে
সমস্বরে ভীষণ চেঁচাই,
সহাস্য বাড়াই মুখ রঙচঙে মুখোশ পরার লোভে আর নিজেদের
কাপ্তান কাপ্তান লাগে কিনা দেখে নিই আড়চোখে
বিকৃত আয়নায়, ঘাড়ে মুখে আলতো বুলিয়ে নিয়ে পাউডার
পরস্পর খুব করি খুনসুটি। ইদানীং আমরা সবাই
অন্ধ, মূক আর বধিরের পার্ট ভালবাসি। অথচ তোমার
ভূমিকা সর্বদা ছিল ভিন্নতর। অন্ধকারে থেকে, মনে পড়ে,
দেখতাম রুদ্ধবাক প্রধান যাত্রার তুমি রাজপুত্র, নিঃশঙ্ক, সুকান্ত,
সোনার কাঠির স্পর্শে নিদ্রিতা সত্যকে
অক্লেশে জাগাতে চাও, অভিশপ্ত রাজ্যের উদ্ধারে
কোষমুক্ত করো তরবারি। তুমি পাষাণপুরীর
প্রতিটি মূর্তির স্তব্ধতায় চেয়েছিলে ছিটোতে রুপালি জল।
চোখ বুজলেই দেখি, হু-হু মাঠে, কুটিরে, খোলার ঘরে, দুঃখ-ছাওয়া শেডে,
সুস্থির দাঁড়িয়ে আছ সুদিনের কর্মিষ্ঠ নকিব।