একটি বালকের জন্যে প্রার্থনা
ভীষণ বুড়িয়ে গেছি ইদানীং আমরা সবাই,
বেশ জবুথবু লাগে নিজেদের বেলা-অবেলায়।
আমরা সবাই বুড়ো। কেউ পঙ্গু বাতে, শয্যা কারো
মালিশের গন্ধে ভরা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত কেউ আর
আদিম গুহার মতো দন্তহীন মুখ খুলে কেউ
বিড়বিড় বকে সারাক্ষণ-বকুনির আগাগোড়া
বাপের আরবি ঘোড়া দাদার ইরানি তাঞ্জামের
ঝিলিমিলি জুড়ে রয়। বারান্দার দাঁড়বন্দি তোতা
সেই বকবকানির ধৈর্যশীল শ্রোতা। তার কী-বা
দায়, ঝুঁটি নাড়ে, ছোলা খুঁটে খায়, বহুবার শোনা
কাহিনীর করে কথকতা। বুকে টুকটুকে ঠোঁট
গুঁজে রাখা, ঘুম পেলে। নিজেদের মতো হতে চেয়ে
ক্রমান্বয়ে শুধু অন্য কারুর মতোই হয়ে যাই
নিজেরই পার্টের বদলে ভুল পার্ট আওড়াতে
আওড়াতে ক্লান্ত হই। যতই ভুগি না কেন বাতে,
রক্তচাপে, রক্তে রক্তে শর্করার প্রকোপ যতই
যাক বেড়ে, জীবনকে প্রতিদিন মনে হয় তবু
হাড়হিম শীতে সুশোভন পশমের কম্ফর্টার
গলায় জড়ানো, তাই সকালে বিকালে প্রকৃতির
খোলামেলা দরবারে আয়ুর মেয়াদ বাড়ানোর
ব্যাকুল তদ্বির নিয়ে যাই। ভদ্রয়ানা মজ্জাগত
এবং প্রজ্ঞার ভারে দু’হাটুতে ঠেকে সাদা মাথা,
অথচ চৌদিকে কী-যে ঘটে দিনরাত কিছুতেই
ঢোকে না মাথায়। অভ্যাসের দাস বলে প্রতিদিন
সংবাদপত্রের ভাঁজ খুলি আর চোখের অত্যন্ত
কাছে নিয়ে হেড লাইনের মায়ায় বেবাক ভুলি!
লাঠি যেন প্রাণাধিক পুত্র, তাই কম্পমান হাত
কেবলি তাকেই খোঁজে। পাড়ায় হাঙ্গামা বাধলেও
তেমন পাই না টের, আজকাল শ্রুতির প্রাখর্য
বলতে কিছুই নেই। বরং কালাই বলা চলে,
বদ্ধ কালা! হামেশাই খুব পুরু কাচের চশমা
পরি, তবু লোকজন, ঘরবাড়ি, পাড়া কি বেপাড়া,
অলিগলি, গাছপালা স্পষ্ট আর দেখি না কিছুই।
আমরা সবাই বুড়ো, দৃষ্টির স্বচ্ছতা নেই কারো।
আমরা সবাই আজ একটি বালক চাই যার
খোলা চোখে রাজপথে নিমেষেই পড়বে ধরা ঠিক
সেই রাজসিক মিহি কাপড়ের বিখ্যাত ছলনা।
একপাল জেব্রা
এই ঘরের শব্দ আর নৈঃশব্দকে সাক্ষী রেখে,
সাক্ষী রেখে আস্তাবলের গন্ধ, দক্ষিণের তাকে রাখা
শূন্য কফির কৌটো, বারান্দায় শুকোতে দেয়া হাওয়ায়
দবলে ওঠা সাদা শার্ট, যে শার্টের কলার একবার
কোনো বেজায় সাংস্কৃতিক মহিলার লিপস্টিক ভূষণে
সজ্জিত হয়েছিল, উজাড় মানি-ব্যাগ
আর দর্পণের সুহৃদকে সাক্ষী রেখে লিখি কবিতা।
নিপুণ গার্ডের মতো হুইসিল বাজাতে বাজাতে সবুজ ফ্ল্যাগ
ওড়াতে ওড়াতে একটি কবিতার শাঁ শাঁ ট্রেনকে
অন্তিম স্টেশনে পৌঁছে দিতে না দিতেই
কিছু পঙ্ক্তি পেয়ে বসে আমাকে আবার। দুর্দান্ত
এক পাল জেব্রার মতো ওরা আমার বুকে ধুলো উড়িয়ে বারংবার
ছুটে যায়, ফিরে আসে।
ক্ষমা করুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার মহান মায়াবী শৈলাবাস থেকে,
ভুল বুঝবেন না নজরুল, আপনার হারমোনিয়ামের আওয়াজে
মধুর মজলিশ আর হাসির হুল্লোড় থেকে,
কিছু মনে করবেন না জীবনানন্দ, আপনার সুররিয়ালিস্ট হরিণেরা
যেখানে দৌড়ে যায়, সেখান থেকে,
মাফ করবেন বিষ্ণু দে, আপনার স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ থেকে
অনেক দূরে যেতে চায় সেই দামাল জেব্রাগুলো।
আমি একলা প্রান্তরের মতো প’ড়ে থাকি। জেব্রাগুলো তুমুল
উদ্দামতায় মেতে ওঠে, তাদের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে
আমাদের হৃদয়ের অন্তর্লীন তৃণরাজি শিখার উজ্জ্বলতা পায় কখনো,
ফিরে আসে না আর। আমি একলা প্রান্তরে ডাকতে ডাকতে
ক্লান্ত হয়ে পড়ি, ওরা ফিরে আসে না তবু। প’ড়ে থাকি
অসহায়, ব্যর্থ। তখন দুক্ষোভে নিজেরই হাত
কামড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়, আমার প্রিয়তম স্বপ্নগুলোর
চোখে কালো কাপড় বেঁধে গুলি চালাই ওদের হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে।
নিপুণ গার্ডের মতো হুইসিল বাজাতে বাজাতে, সবুজ ফ্ল্যাগ
ওড়াতে ওড়াতে একটি কবিতার শাঁ শাঁ ট্রেনকে
অন্তিম স্টেশনে পৌঁছে দিতে না দিতেই আবার এক পাল জেব্রা
তুমুল ছুটোছুটি করে বাতাস চিরে রৌদ্র ফুঁড়ে আমার বুকের আফ্রিকায়।
ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা
এ রৌদ্রে কেমন করে দাঁড়াও অটল? দেখলাম, অতীতের
মুখের ওপর ঝাঁপ বন্ধ করে কেমন সহজে
এলে তুমি সাম্প্রতিক সদর রাস্তায়।
বেণী-নামা পিঠে জমে ঘামের শিশির,
আঁচলে প্রবল হাওয়া, উচ্ছ্বসিত হ্রদের মতন
তোমার রুপালি স্বরে করে ঝলমল নানা মনীষীর পাতা।
সামান্যে শিল্পিত বেশ, চলায় বলায় সর্বক্ষণ
রুচির মোহন ছোঁওয়া। কখনো চকিতে মঞ্চে ওঠো জ্বলজ্বলে
পদক্ষেপে, শিরদাঁড়া ঋজু থরো থরো
ফ্ল্যাগ বয়ে নিয়ে যাও পল্টনের মাঠে, কখনো-বা
এভেন্যুর মোড়ে। কলেজের
সংস্কৃত প্রাঙ্গণ, বস্তি, পথঘাট অলংকৃত তোমারই ছায়ায়।
সামাজিক বিকারের কুকুরগুলোকে কোন রাঙা
মাংস দিয়ে রাখো শান্ত করে?
কী করে প্রখর দীপ জ্বালছ মশালে,
এ বিস্ময় ঠোকরায় এখনও আমাকে।
দেখছি তোমাকে আমি বহুদিন থেকে, দেখছি এখনও তুমি
বিকেলের বারান্দায় ব’সে
প্রবীণা মায়ের চুলে চালাও চিরুনি স্মৃতি জাগৃতির লগ্নে
পুরানো গায়ের সুর ভাঁজতে, কখনো-বা
ভায়ের শার্টের গর্ত ভরে তোলো শৈল্পিক নিষ্ঠায়,
কখনো পিতার সঙ্গে তর্কে মাতো এ-যুগের মতিগতি নিয়ে,
কখনো তুমুল ভাসো গণউত্থানের গমগমে তরঙ্গমালায়।
ব্যক্তিগত প্রেম আছে তোমারও গহনে
যে-প্রেম তোমাকে নিয়ে যায় তীব্র আকর্ষণে বহু জীবনের
কল্লোলিত মোহনায়। বুঝি তাই ঊর্মিল আবেগে
ছুটে যাও ভাসমান গ্রামে কি শহরে। ভদ্রয়ানা
আড়ালে রেখেই হও এককাট্রা শোকের শরিক।
কখনো রিলিফ ক্যাম্পে ভাবো চুপচাপ, উন্নয়ন
সুনীল কাগজে আসে আলাদা আদলে। কখনো-বা
নিজের গভীরে দাও ডুব, ভাবো ব’সে তারই কথা,
যে আনে প্রাণের টানে স্বপ্নের উদ্দাম
ভাগীরথী কারখানায় এবং খামারে।
শুধুই আবেগ নয় বুদ্ধির শাণিত রৌদ্র করে ঝলমল
অস্তিত্বে তোমার আর প্রচুর গ্রন্থের পাকা রঙ
লাগে মনে, মনেন সমৃদ্ধ তুমি ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা;
সর্বোপরি বাস্তবের ঘনিষ্ঠ সংসর্গে
পেয়েছ বাঁচার সূত্র কর্ম আর ধ্যানে।
প্রথার কৃপণ মাপে সুন্দরী যে-জন
তুমি সে কখনো নও, অথচ তোমারও
নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, যে-সৌন্দর্য ঝড়ের ঝাপটায়
সুতন্বী গাছের সাহসের,
যে-সৌন্দর্য মানবিক বোধের প্রেমের, জীবনের।