আমি কথা বলাতে চাই
আমি কথা বলাতে চাই,
কথা বলাতে চাই আমার ঘরের আসবাবপত্রকে,
ছাদের কার্নিশ আর জানলাকে, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে যে-গাছ,
গাছের ডালে লাফাচ্ছে যে-কাঠবিড়ালি,
আর আস্তাবলে ঝিমোচ্ছে বুড়োটে যে-ঘোড়া,
তাদের আমি কথা বলাতে চাই।
গাছের যত পাতা, আকাশের যত নক্ষত্র,
নদীর ঢেউ, হাওয়ার প্রতিটি ঝলক,
প্রতিটি ফুল, শিশিরের প্রতিটি বিন্দু,
আমার চোখের মণি, আমার হাত-গাছ,
ওদের সবাইকে আমি কথা বলাতে চাই।
কী ওরা বলবে, এক্ষুণি বলা মুশকিল।
সবাই কি বলবে একই কথা
ঘুরে ফিরে? না কি প্রত্যেকেই বলবে নিজস্ব কথা
অনন্য উচ্চারণে!
ওরা কি শোনাবে কোনো তত্ত্বকথা?
বলবে কি হাইড্রোজেন বোমার জন্মকাহিনী?
বলবে কি হিরোশিমা ভয়াবহভাবে
পঙ্গু হওয়ার পর
কী করে আধুনিক চৈতন্যে জমলো দুঃস্বপ্নের ভিড়?
ওরা কি দেবে স্বৈরতন্ত্রী মিথ্যার একনিষ্ঠ বিবরণ?
ওরা বলুক যে যার কথা, যেমন ইচ্ছা, যেমন ইচ্ছা বলুক।
সত্যাগ্রহের আগেই
ওদের সবাইকে আমি বাক-স্বাধীনতা দিতে চাই।
আসাদের শার্ট
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্মতায়;
বর্ষিয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে-কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
ইচ্ছা
যদি বাঁচি চার দশকের বেশি
লিখব।
যদি বাঁচি দুই দশকের কম
লিখব।
যদি বেঁচে যাই একটি দশক
লিখব।
যদি বেঁচে যাই দু’চার বছর
লিখব।
যদি বেঁচে যাই একমাস কাল
লিখব।
যদি বেঁচে যাই একদিন আরও
লিখব।
ঋণী
পুরোনো ঢাকার নেড়ি গলি ছেড়ে আজিমপুরের
তেতলার ফ্ল্যাটে যাই বস্তুত আড্ডার লোভে, খানিক হাঁপাই।
ক্লান্তির কফিন ঢাকা শরীর এলিয়ে কৌচে নিঃশব্দে দূরের
আকাশে বুলাই চোখ এবং বৈশাখী গরমেও স্বস্তি পাই
বন্ধুর সুহাস মুখে; উপরন্তু ভাগ্যবলে ফাহ্মিদা এখানে অতিথি
আজ রাতে। আমাদের প্রহর সমৃদ্ধ হবে, রাবীন্দ্রিক সুরে
নানান বিন্যাসে অবিরাম দুলবে সত্তার মৌন ঝাউবীথি,
জাগবে আনন্দলোক তেতলার ফ্ল্যাটে সরকারি আজিমপুরে।
ফাহ্মিদা সুর ভাঁজে-এ-ও এক বৃষ্টি অপরূপ,
অস্তিত্ব ডুবিয়ে নামে। গীতবিতানের কিছু নিভৃত নিশ্চুপ
পাতা ওড়ে অলৌকিক কলরবে, গাংচিলের মতো ওড়ে, ঘোরে সারা ঘরে
প্রাণের ঊর্মিল জল ছুঁয়ে যায় কতো ছলভরে।
ফাহ্মিদা কণ্ঠে সুর তুললেই ঘরে রৌদ্র ওঠে, মেঘে মেঘে
বাজে বাঁশি, ভাসে ভেলা, শ্রাবণের ধারা ঝরে, গাছ হয়; হাট-
ফেরা লোক মিলায় সোনার মেঘে এবং চোখের দ্বারে ধ্যানের আবেগে
নদীর সুদূর পাড়ে যায় দেখা ঘাট।
কখন যে রাত্রি বাড়ে আলো-আঁধারিতে তেতলায়,
কিছুই পাই না টের সুরে ভেসে, ফ্ল্যাটে ফাহ্মিদার গলায়
আমার সোনার বাংলা ঝলমল করে ওঠে। ঋণী তারই কাছে
আজীবন, কণ্ঠে যার বারবার রবীন্দ্রনাথের গান বাঁচে।
এ যুদ্ধের শেষ নেই
এ যুদ্ধের শেষ নেই। প্রতি পল অনুপল শুধু
গোলা বর্ষণের ধুম, ক্রুদ্ধ এরোপ্লেনের ছোঁ মারা
চলে অবিরাম, চূর্ণ ব্রিজ। সাবমেরিন হঠাৎ
ফুটো করে জাহাজের তলা। ট্রেঞ্চ খুঁড়ি প্রাণপণে,
কখনো মাইন পাতি সুকৌশলে একান্ত জরুরি
শক্রকে ঘায়েল করা ছলে বলে। দিগন্ত-ডোবানো
চিৎকারে চমকে উঠি, প্রেতায়িত পড়ে থাকে কত
মাটি-মগ্ন হেলমেট, শতচ্ছিন্ন টিউনিক, হাড়।
রাজত্ব জয়ের নেশা শিরায় তুমুল নাচে আজও
ঝাঁঝাল জ্যাজের মতো। কিন্তু জানা নেই সে-রাজ্যের
মৌলিক সীমানা। শুধু জানি ভীষণ ছুটতে হবে,
বিশ্রাম ওকেল্পনীয়, অসম্ভব রণে ভঙ্গ দেয়া।
কখনো নিঃসঙ্গ ট্রেঞ্চে রসদ ফুরিয়ে আসে, এক
টুকরো সিগারেট ফুঁকি কত বেলা। শূন্য টিন আর
উজাড় মগের দিকে চেয়ে থাকি সতৃষ্ণ, কাতর।
কখনো জ্বরের ঘোরে দেখি, ওরা আসে উদ্ধারের
প্রবল আশ্বাস নিয়ে-বিশেষণ বিশেষ্য এবং
ক্রিয়াপদ, আমার আপন সেনা, ওরা আসে; কিন্তু
তারাই আমার শক্র, অতর্কিতে করে আক্রমণ-
ঘামে-ভেজা ক্লান্ত চোখে দোলে জয়, দোলে পরাজয়।
এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?
এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?
তেমন যোগ্য সমাধি কই?
মৃত্তিকা বলো পর্বত বলো
অথবা সুনীল সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই।
তাই তো রাখি না এ লাশ আজ
মাটিতে পাহারে কিংবা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।
এ শহর
এ শহর ট্যুরিস্টের কাছে পাতে শীর্ণ হাত যখন তখন,
এ শহর তালিমারা জামা পরে নগ্ন হাঁটে, খোঁড়ায় ভীষণ।
এ শহর রেস খেলে, তাড়ি গেলে হাঁড়ি হাঁড়ি, ছায়ার গহ্বরে
পা মেলে রগড় করে আত্মার উকুন বাছে, ঝাড়ে ছারপোকা।
কখনো-বা গাঁট কাটে, পুলিশ দেখলে
মারে কাট। টকটকে চাঁদের মতন চোখে তাকায় চৌদিকে,
এ শহর বেজায় প্রলাপ বকে, আওড়ায় শ্লোক,
গলা ছেড়ে গান গায়, ক্ষিপ্র কারখানায়
ঝরায় মাথার ঘাম পায়ে।
ভাবে দোলনার কথা কখনো-সখনো,
দ্যাখে সরু বারান্দায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির রূপ।
এ শহর জ্যৈষ্ঠে পুড়ে এবং শ্রাবণে ভিজে টানে
ঠেলাগাড়ি, রাত্রি এলে শরীরকে উৎসব করার
বাসনায় জ্ব’লে সাত তাড়াতাড়ি যায় বেশ্যালয়ে।
এ শহর সাদা হাসপাতালের ওয়ার্ড কেবলি
এপাশ ওপাশ করে, এ শহর সিফিলিসে ভোগে,
এ শহর পীরের দুয়ারে ধরনা দেয়, বুকে-হাতে
ঝোলায় তাবিজ তাগা, রাত্রিদিন করে রক্তবমি,
এ শহর কখনো হয় না ক্লান্ত শবানুগমনে।
এ শহর দারুণ দুক্ষোভে ছেঁড়ে চুল, ঠোকে মাথা
কালো কারাগারের দেয়ালে,
এ শহর ক্ষুধাকেই নিঃসঙ্গ বাস্তব জেনে ধুলায় গড়ায়;
এ শহর পল্টনের মাঠে ছোটে, পোস্টারের উল্কি-ছাওয়া মনে
এল গ্রেকো ছবি হয়ে ছোঁয় যেন উদার নীলিমা,
এ শহর প্রত্যহ লড়াই করে বহুরূপী নেকড়ের সাথে।