সন্ধ্যা
কোনো কোনো সন্ধ্যা যুবতীর জলার্ত চোখের মতো
ছলছল করে আর তখন নিজেকে
দেখি শুয়ে আছি
শবাধারে। ফুলের সম্ভার নেই, কৃষ্ণ গ্রন্থ এক প’ড়ে আছে পাশাপাশি।
মনে হয়, পুরোনো কাগজ, ভাঙা পাত্র,
বিলেতি দুধের শূন্য টিন
ইত্যাকার বাতিল বস্তুর মধ্যে ব’সে আছি একা
শহরতলির হু হু ছায়ান্ধ প্রান্তরে।
তখন কালচে আকাশের পক্ষী-মালাকে ধূসর
বিদায়ী রুমাল বলে মনে হয় শুধু।
সোনার তরী
‘এই রোকো’ বলে কোনো জাঁদরেল ট্রাফিক পুলিশ
পারে না করতে রোধ কখনো তোমার পথ কিংবা
চেকপোস্টে তোমাকে হয় না জমা দিতে পাসপোর্ট
ভিসা; বজ্রে বাজিয়ে মোহন বাঁশি আসো মহারাজ
মায়াবী সসারে অপরূপ অগোচরে। কোনো দিন
ঝকঝকে বাসস্টপে, মাথা-ঝলসিত ফুটপাতে
অথবা পার্কের বেঞ্চে ব’সে জুতোর কাদার দিকে
অনিমেষ তাকিয়ে থাকার ক্ষণে, টেলিফোনে কথা
বলতে বলতে মৃদু এমনকি মফস্বলগামী
ট্রেনের বগিতে ঢুলে, কবিতার কাঙাল আমরা,
অকস্মাৎ পেয়ে যাই তোমার সাক্ষাৎ। প্রতিদিন
তোমার জন্যেই কত দখিন দুয়ার থাকে খোলা।
এ শহরে স্বপ্নের দোকান নেই কোনো, আছে শুধু
দরাদরি, বচসাও অন্তহীন। হলুদ দাঁতের
কিছু লোক, বেসামাল, এমনকি অন্ধ ভিক্ষুকের
দোতারাও নেয় কেড়ে দারুণ আক্রোশে; চৌরাস্তায়
দাপায় লাফায় আর কালো পিরহানে ঢেকে ফেলে
সবগুলো উজ্জ্বল মিনার। উপরন্তু বল্মীকের
উপদ্রবে ক্রমাগত হচ্ছে নোংরা প্রতিটি সোপান।
এরই মধ্যে তুমি আসো কাব্যের মহান সান্তা ক্লস।
নিষ্প্রদীপ ঘরে থাকি রাত্রিদিন। দরজা-জানালা
বন্ধ সবি। বড় শ্বাসকষ্ট হয়; হঠাৎ কখনো
ইচ্ছে করে ‘ত্র্যাম্বুলেন্স চাই’ বলে তারস্বরে দূর
আকাশ ফাটাই। কখনো-বা মাছ শিকারির মতো
ব’সে থাকি, নিবিড় অপেক্ষমাণ। এ বন্ধ ঘরেও
ভিড়ছে সোনার তরী, আপনারা স্বচক্ষে দেখুন।
স্বর্গচ্যুতির পরে
তুই না ডাকলে এ জনাকীর্ণ
নকল স্বর্গে আসত কে?
ঘৃণা করি তোকে যেমন জীর্ণ
অসুস্থ লোক স্বাস্থ্যকে।
রূপ দেখি তোর যেমন দীপ্ত
চাঁদকে গলির খঞ্জটা।
ঈর্ষায় জ্বলি, চির অতৃপ্ত
চক্ষে ঘৃণার ঘনঘটা।
তোর বিচ্ছেদে আত্মহত্যা
করব ভেবেই সুখ পেলি।
কিন্তু এখনও আমার সত্তা
লুটছে দিনের লাল চেলি!
চিন্তার জ্ঞানী জটিল সর্প
আমাকে ফেরায় বাস্তবে।
এত যদি তোর সাধের দর্প,
চুম্বন কেন চাস তবে?
মরব হারিয়ে নকল স্বর্গ,
জানি ছিল তোর বিশ্বাস।
ঝুলুক নরকে ত্রাসের খড়্গ
সেখানেই নেব নিঃশ্বাস।
হরতাল
(শহীদ কাদরীকে)
প্রতিটি দরজা কাউন্টার কনুইবিহীন আজ। পা মাড়ানো,
লাইনে দাঁড়ানো নেই, ঠেলাঠেলিহীন;
মদ্রার রুপালি পরী নয় নৃত্যপরা শিকের আড়ালে
অথবা নোটের তাড়া গাংচিলের চাঞ্চল্যে অধীর
ছোঁয় না দেরাজ। পথঘাটে
তাল তাল মাংসের উষ্ণতা
সমাধিস্থ কর্পূরের বেবাক।
মায়ের স্তনের নিচে ঘুমন্ত শিশুর মতো এ শহর অথবা রঁদার
ভাবুকের মতো;
দশটি বাঙ্ময় পঙ্ক্তি রচনার পর একাদশ পঙ্ক্তি নির্মাণের আগে
কবির মানসে জমে যে-স্তব্ধতা, অন্ধ, ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্র
থাবা থেকে গা বাঁচিয়ে বুকে
আয়াতের নক্ষত্র জ্বালিয়ে
পাথরে কণ্টকাবৃত পথ বেয়ে ঊর্ণাজাল-ছাওয়া
লুকানো গুহার দিকে যাত্রাকালে মোহাম্মদ যে-স্তব্ধতা আস্তিনের ভাঁজে
একদা নিয়েছিলেন ভরে
সে স্তব্ধতা বুঝি
নেমেছে এখানে।
রাজপথ নিদাঘের বেশ্যালয়, স্তব্ধতা সঙ্গিন হয়ে বুকে
গেঁথে যায়; একটি কি দুটি
লোক ইতস্তত
প্রফুল্ল বাতাসে ওড়া কাগজের মতো ভাসমান।
সবখানে গ্যাসোলিন পাইপ বিশুষ্ক, মানে ভীষণ অলস,
হঠাৎ চমক লাগে মধ্যপথে নিজেরই নিঃশ্বাস শুনে আর
কোথাও অদূরে
ফুল পাপড়ি মেলে পরিস্ফুট শব্দ শুনি;
এঞ্জিনের গহন আড়াল থেকে বহুদিন পর
বহুদিন পর
অজস্র পাখির ডাক ছাড়া পেল যেন।
সুকণ্ঠ নিবিড় পাখি আজও
এ শহরে আছে কখনো জানিনি আগে।
ট্যুরিস্ট দু’চোখ
বেড়ায় সবুজে
সমাহিত মাঠে
ছেলেদের ছায়ারা খেলছে এক গভীর ছায়ায়।
কলকারখানায়
তেজী ঘোড়াগুলো
পাথুরে ভীষণ;
ন্যাশনাল ব্যাংকের জানালা থেকে সরু
পাইপের মতো গলা বাড়িয়ে সারস এ স্তব্ধতাকে খায়।
শহর ঢাকার পথ ফাঁকা পেয়ে কত কী-যে বানালাম হেঁটে যেতে-যেতে
বানালাম ইচ্ছেমতো আঙুলের ডগায় হঠাৎ
একটি সোনালি মাছ উঠল লাফিয়ে,
বড় হতে হতে
গেল উড়ে দূরে
কোমল উদ্যানে
ভিন্ন অবয়ব
খুঁজে নিতে অজস্র ফুলের বুদোয়ারে।
হেঁটে যেতে যেতে
বিজ্ঞাপন এই সাইনবোর্ডগুলো মুছে ফেলে
সেখানে আমার প্রিয় কবিতাবলির
উজ্জ্বল লাইন বসালাম;
প্রতিটি পথের মোড়ে পিকাসো মাতিস আর ক্যান্ডিনিস্কি দিলাম ঝুলিয়ে।
চৌরাস্তার চওড়া কপাল,
এভেন্যুর গলি, ঘোলাটে গলির কটি,
হরবোলা বাজারের গলা
পাষাণপরীর রাজকন্যাটির মতো
নিরুপম সৌন্দর্যে নিথর।
স্তূপীকৃত জঞ্জালে নিষ্ক্রিয় রোদ বিড়ালছানা মৃদু
থাবা দিয়ে কাড়ে
রোদের আদর।
জীবিকা বেবাক ভুলে কাঁচা প্রহরেই
ঘুমায় গাছতলায়, ঠেলাগাড়ির ছায়ায় কিংবা
উদাস আড়তে,
ট্রলির ওপরে
নিস্তরঙ্গ বাসের গহ্বরে,
নৈঃশব্দের মসৃণ জাজিমে।
বস্তুত এখন
কেমন সবুজ হয়ে ডুবে আছে ক্রিয়াপদগুলি
গভীর জলের নিচে কাছিমের মতো শৈবালের সাজঘরে।
চকিতে বদলে গেছে আজ,
আপাদমস্তক
ভীষণ বদলে গেছে শহর আমার!