ময়ূরগুলো
আমার বুকে রাতবিরেতে
রাতবিরেতে ময়ূরগুলো
বেড়ায় নেচে।
রক্তে আমার ভীষণ ডাকে
ভীষণ ডাকে ময়ূরগুলো
রাতবিরেতে।
নখর-ঘায়ে বুকের টালি,
হৃদয়পুরের চার কুঠুরি
নাকাল হল।
মাথার ভেতর পেখম তোলে,
চঞ্চু রাখে ঘাড়ে মুখে,
রক্ত মোছে।
চঞ্চু থেকে ঝরায় কী-যে,
ঠুকরে বেড়ায় অনেক কিছু
মাতাল হয়ে।
ব্যগ্র আমার পায়ের ছাপে
একলা ঝোড়ো ঘরের মেঝে
তপ্ত হ’ল।
ঘরকে আমার শ্মশান বলি,
রাতবিরেতে শয্যা যেন
দারুণ চিতা।
বিধবাদের নিদ্রাহারা
প্রহর শুধু আমায় জোরে
দখল করে।
তীব্র চোখের ময়ূরগুলো
খাদ্যাভাবে আমায় ছেঁড়ে
সিক্ত লোভে।
ইচ্ছে করে চেঁচিয়ে উঠি,
ইচ্ছে করে আকাশ ছিঁড়ি
দশটি নখে।
হঠাৎ দেখি মুখ রেখেছি
গন্ধভরা রেশমি ঝোপে;
মত্ত আছি
যমজ ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে।
যুগল টিলা মুঠোয় কাঁপে
অন্ধকারে।
গুপ্ত শিরার লাল মদিরা
ফেনিয়ে ওঠে রাতবিরেতে
বিনোদ চেয়ে।
আমার বুকে, মাথার ভেতর
নেচে বেড়ায় ময়ূরগুলো
ময়ূরগুলো।
যিনি নম্বর ভালবাসতেন
“নম্বরে জীবন ছাওয়া। সেই কবে ইশকুলের রোল নম্বরের
স্মৃতি নিয়ে বেরিয়েছি পথে,
তারপর থেকে ঝাঁক ঝাঁক
নম্বরের দাবি-দাওয়া মেটাতেই জীবনের প্লেন
ফুরিয়ে ফেলেছে পেট্রোলিয়াম বেবাক। কয়েকটি
পলিসি নম্বর আর বাড়ির নম্বর আর গাড়ির নম্বর,
ব্যাংকের খাতার প্রিয় নম্বর ইত্যাদি
কেবলি করেছি জড়ো, অথচ নম্বর
নিকট এসেছে যত মানুষ ততই দূরে গেছে চলে। তবে
আমি নিজেই কি শুধু কতিপয় নম্বরের সমাহার কোনো?
শিখেছি অনেক ঠেকে বহু ঘোল খেয়ে
নম্বরের নেই শ্রুতি, নেই আলাপের কোনো সাধ।“
-বলে তিনি ব্রিফকেস নেড়ে-চেড়ে বসলেন গার্হস্থ্য মোটরে।
গাড়ি তাঁর হুট করে চলে গেল, বাড়ির সুরম্য দরজায়
অভ্যস্ত রীতিতে নেমে দেখেন কাগজ কতিপয়
হাওয়ায় উড়ছে আর ক’জন বালক
পাখির ঝাঁকের মতো একরাশ কাগজের পেছনে-পেছনে
ছুটেছে হুল্লোড় করে। মনে হ’ল তাঁর,
কাগজের ঝাঁক যেন একতাড়া নোট ফুরফুরে
আর তিনি নিজে হৈ-হৈ ছেলেদের সঙ্গে ছুটছেন
উড়ো কাগজের ঠিক পেছনে-পেছনে শৈশবের দিকে ব্যগ্র মুখ রেখে।
“দাড়ি কামানোর পর গালে কিংবা কোমল চিবুকে
যেসব খুচরো কাটা দাগ লেগে থাকে,
তাদের কেমন যেন অন্তরঙ্গ লাগে, বড় ব্যক্তিগত”-বলে তিনি
জরুরি ফাইল কিছু রাখলেন গোপন দেরাজে।
চিরচেনা বাগানের দেশী কি বিদেশী ফুল দেখে,
সতেজ ফুলেরা যেন-ভাবলেন তিনি-চকচকে টাকাকড়ি।
হঠাৎ রক্তের চাপ বাড়ে, বুকে ট্যাক্সির ঝাঁকুনি
আপিসের বন্ধ ঘর, ব্রিফকেস, চেক বই, হৈ-হৈ বালকেরা
বাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি, লিফট-এর স্তিমিত আলো, গোপন দেরাজে,
ব্রিফকেস, চেক বই, প্রসন্ন নোটের তাড়া, জরুরি ফাইল,
লিফট্-এর স্তিমিত আলো, হৈ-হৈ বালকেরা, ব্রিফকেস,
পলিসি নম্বর,
গৃহিণীর পলায়নপত্র যৌবনের অস্তরাগ, চেক বই, আপিসের,
বন্ধ ঘর, টাইপিস্ট মেয়েটির লো-কাট ব্লাউজ, বালকেরা,
ব্রিফকেস, অস্তরাগ, লিফট্-এর স্তিমিত আলো, লো-কাট ব্লাউজ,
পলিসি নম্বর,
ব্রিফকেস, চেক বই, প্রসন্ন নোটের তাড়া, চেক বই, চেক বই, চেক…
বাগানের স্তব্ধতায় পতনের শব্দ আর নিঃশব্দ ভীষণ
বুকের একান্ত ঘড়ি, শূন্য হাত, ঘাসে আধপোড়া সিগারেট,
অদূরে নিশ্চুপ ঝারি।
ওপরে অনেক তারা, একান্ত সেকেলে আশরফি।
রাজকাহিনী
ধন্য রাজা ধন্য
দেশজোড়া তার সৈন্য।
পথে-ঘাটে ভেড়ার পাল!
চাষীর গরু, মাঝির হাল,
ঘটি-বাটি, গামছা, হাঁড়ি,
সাত-মহলা আছে বাড়ি,
আছে হাতি, আছে ঘোড়া।
কেবল পোড়া মুখে পোরার
দু’মুঠো নেই অন্ন,
ধন্য রাজা ধন্য!
ঢ্যাম কুড় কুড় বাজনা বাজে,
পথে-ঘাটে সান্ত্রী সাজে।
শোনো সবাই হুকুমনামা,
ধরতে হবে রাজার ধামা।
বাঁ দিকে ভাই চলতে মানা,
সাজতে হবে বোবা-কানা।
মস্ত রাজা হেলে দুলে
যখন তখন চড়ান শূলে
মুখটি খোলার জন্য।
ধন্য রাজা ধন্য।
রৌদ্রে নিয়ে যাও
দ্বিধাকে সরিয়ে দূরে ঘটঘুটে অন্ধকার থেকে
এখন তোমরা তাকে রৌদ্রে নিয়ে যাও। বড় বেশি
অন্ধকারে ছিল এতদিন, দিনগুলি ছিল তার
পেঁচার কোটরাগত। বড় বেশি অন্ধকারে ওরা
রেখেছিল তাকে; অন্তর্জীবনের হল্দে পাতাগুলো
অন্ধকারে ডোবা আর তৃষিত শরীর তার পাকা
আনারের মতো ফেটে পড়তে চেয়েছে প্রতিদিন
রোদ্দুরের আকাঙ্ক্ষায়। হবে সে সূর্যের সেবাদাসী,
আজীবন সাধ ছিল তারও অথচ নিঃসঙ্গ ঘরে
প্রখর চৈত্রের ভরা দুপুরেও বিরূপ আঁধার
হঠাৎ বাদুড় সেজে উদ্ভিন্ন শরীরটাকে খুব
আলুথালু করছে উন্মত্ততায়, তীব্র পাখসাটে।
রৌদ্রকে সে প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো নগ্নতায়
করেছে কামনা আর দুধ-সাদা স্বপ্নের অচেনা
গলিপথে দেখেছে অনেক কাঁটাবন, মরুভূমি,
গহ্বর পেরিয়ে আনা ক্ষুধার্ত বেখাপ্পা কয়েকটি
ক্রুদ্ধ পশু রাত্রিটাকে খুবলে খেতে পরম উৎসাহী-
যেন তারা তাড়াতাড়ি গলিপথে ভোর হোক চায়।
মরীচিকা-প্রতারিত আত্মা তার হরিণের মতো
চেয়েছে রাখতে মুখ রোদ্দুরের হ্রদে কতদিন।
কখনোবা রাত বারোটায় কিংবা একটায়( তাই
অনুমান করা চলে) শরীরে বাড়ির ছায়া নেমে
এলে মৃদু মোমবাতি-আলোকিত চায় দেয়ালের
চুন-সুরকি ভেদ করে কতিপয় সন্ত আর মিহি
সোনালি চুলের দেবদূত আসতেন তার কাছে,
আঁধার শাসিত কণ্ঠে দিতেন পরিয়ে মালা ঠিক
আলোর মুক্তোয় গড়া। নিতেন মাথার ঘ্রাণ আর
রাখতেন অলোকিক হাত তার লাজুক মাথায়
তখন চৈতন্যে দিব্যি উঠত জ্ব’লে আশা ক্ষিপ্রতায়
ভুল সকালের মতো। বড় বেশি অন্ধকারে ছিল
বলে স্বপ্নভঙ্গে খেত থতমত, যেমন সে কাজে
হঠাৎ জলের ঘড়া ভেঙে, ফেলে হত অপ্রস্তুত।
শোনো, মৃত্যু বন্দনায় যুগ যুগ কাটিয়ে দিলেও
ফিরিয়ে দেবে না তাকে আর, তার সত্তার শীতল
অন্ধকার কখনো হবে না দূর। ভীষণ আঁধারে
এতদিন রেখেছিল তাকে ওরা; দয়ালু ব্যক্তিরা
অন্তত এখন তাকে অকৃপণ রৌদ্রে নিয়ে যাও।