বিবেচনা
সেদিনও কি এমনি অক্লান্ত ঝরঝর বৃষ্টি হবে এ শহরে?
ঘিনঘিনে কাদা
জমবে গলির মোড়ে সেদিনও এমনি,
যেদিন থাকব প’ড়ে খাটে নিশ্চেতন,
নির্বিকার, মৃত?
আলনায় খুব
সহজে থাকবে ঝুলে সাদা জামা। বোতামের ঘরগুলো যেন
করোটির চোখ, মানে কালোর গহ্বর। জুতো জোড়া
রইবে প’ড়ে এক কোণে, যমজ কবর। কবিতার
খাতা নগ্ন নারীর মতোই চিৎ হয়ে
উদর দেখিয়ে
টেবিলে থাকবে শুয়ে আর দেয়ালের টিকটিকি
প্রকাশ্যেই করবে সঙ্গম।
হয়তো কাঁদবে কেউ, আশা করা যেতে পারে; আত্মীয়-স্বজন
কেউ কেউ শোকে ধোবে সত্তা। ঘরে পুড়বে আগরবাতি আর
কোরানের পুণ্য সব আয়াতে আয়াতে
হবে গুঞ্জরিত চতুষ্কোণ। বাজারে ছুটবে কেউ
চাটাই, বাঁশের খোঁজে; কেউবা ফুঁকবে সিগারেট
ঘন ঘন, কেউ মৃদু বলবে অদূরে, প্রতিবেশী একজন
‘লোকটা নাস্তিক ছিল, শরিয়তে মোটেই ছিল না
মন, মসজিদে তার সাথে কখনো হয়নি দেখা,
এবং নিষিদ্ধ দ্রব্যে ছিল তার উৎসাহ প্রচুর।
কিন্তু তবু কেন জানি বাস্তবিক কখনো ভুলেও
পারিনি করতে ঘেন্না তাকে।
মারেনি লাঠির বাড়ি মাথায় কারুর
কোনো দিন, উপরন্তু ছিল সদালাপী।
যেদিন মরব আমি, সেদিন কি বার হবে, বলা মুশকিল।
শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?
যেবারই হোক,
সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা
না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে পথঘাট,
পুণ্যবান শবানুগামীরা বড় বিরক্ত হবেন।
বিড়ম্বনা
ভেবেছি তোমাকে পার্কে নিয়ে যাব, অথচ সেখানে
উঠতি গুণ্ডার টাঙ্কি, শিস।
ভেবেছি তোমাকে নিয়ে দু’দণ্ড বসব রেস্তোরাঁয়,
সেখানেও হ্যাংলা আর ফড়েদের ভিড়ে টেকা দায়।
ভেবেছি তোমাকে নিয়ে রাস্তায় ঘুরব চমৎকার,
অথচ প্রতিটি পথে ক্ষুধার্তের ভীষণ চীৎকার।
ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বৈকালিক নৌকো বিহারের
আনন্দ কুড়াব ঢের,
কিন্তু বন্যাস্ফীত জলে ভাসে মৃত মানুষ, মহিষ।
ব্যাকুলতা
আমার সিঁড়ি আগলে থাকে
ব্যাকুলতা।
পেছনে থেকে চুল টানে সে
হঠাৎ বাঁধে আলিঙ্গনে,
আমার সিঁড়ি আগলে থাকে
ব্যাকুলতা।
হাওয়ায় ঘোরায় চাবির গোছা,
যেন আমার ঘরণী সে;
দুপুরবেলা কখন খাটে
দেয় এলিয়ে শরীরটাকে,
ব্যাকুলতা।
বাসের ভিড়ে দোকান-পাটে
পার্কে ধূসর বেঞ্চিটাতে
আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে
ব্যাকুলতা।
যখন লিখি কিংবা খুলি
সদ্য কেনা বইয়ের পাতা
তখন পিঠে নিঃশ্বাস ফ্যালে
ব্যাকুলতা।
রোদ-খেলানো ফসফরাসে
কিংবা বুড়িগঙ্গা তীরে
আচম্বিতে আমার বুকে
দ্যায় তুলে সে ছদ্মবেশী
দুঃখ সুখের শিল্পকলা
ব্যাকুলতা।
মা
ছিলেন নিভৃত গ্রামে। সর্বক্ষণ সংসারের খুঁটিনাটি কাজে
মগ্ন, আসমানে রৌদ্র কাঁপে, মেঘের পানসি ভাসে, কখন যে ক’টা বাজে
থাকে না খেয়াল কিছু। দৃশ্য খুবই চেনাশোনা, মৃদু রঙমাখা,
নানা সূক্ষ্ম সূত্রে গাঁথা; চুলায় চাপানো হাঁড়ি পুঁইশাক-ঢাকা
মাছ পড়ে গোটা দুই শিক্ষক স্বামীর পাতে। লাউয়ের মাচায়
কখনো রাখেন চোখ, কাঁঠাল গাছের ডালে হলদে পাখি লেজটি নাচায়
ঘন ঘন, বেলা বাড়ে। ইঁদারার পানিতে গোসল সেরে কাঁচা-পাকা চুলে
চালান কাঁকই দ্রুত আর ভাবেন খোকন স্কুলে
নামতা মুখস্থ করে। বৈয়মে রাখেন নকশি পিঠা, মনে পড়ে
বড় ছেলেটির কথা, চোখ যার বড় বেশি জ্বলজ্বলে, পড়াশোনা করে যে শহরে।
এ বাড়ির গণ্ডি ছাড়া কোথায়ও পড়ে না তাঁর পায়ের পাতার
কালো ছাপ, সারাক্ষণ থাকেন আড়ালে আ খসে না মাথার
কাপড় ভুলেও কারো সমুখে কখনো। বেঁচে নেই বাপজান
আম্মাও ওপারে আজ, তবু মাঝে-মাঝে প্রাণ করে আনচান।
ক্রুদ্ধ দেবতার মতো তোলে মাথা সারা দেশ।
কত যে খবর আসে, কত আত্মদান
রাঙায় দেশের মাটি; সন্তানের রক্তমাখা জামার আহ্বান
টানে গ্রাম্য জননীকে। অনেক পেছনে রইল প’ড়ে
লাউয়ের সবুজ মাচা, নদী, মাঠ,
কলাইয়ের ক্ষেত আর পুকুরের ঘাট।
পড়ছে পায়ের ছাপ আজ তাঁর জনপথে, আনাচে-কানাচে, সবখানে
মেলালেন পুত্রহীন হৃদয়ের দীপ্ত কান্না স্লোগানে, স্লোগানে।
মাতামহের মৃত্যু
অনেক পায়ের নিচে তিনি;
মাটির পালঙ্কে শুয়ে অবসর ভোগ
করছেন যেন আরামের
সুশান্ত চাদরে ঢেকে আপাদমস্তক।
আমরা ওপরে স্তব্ধ, প্রায়-স্তব্ধ, নিচে তিনি। আমার পিতার
কালো আচকানটার, দেখলাম, একটি বোতাম নেই; ঢোলা
পাজামায় ভেজা মাটি।
আমার নতুন হাফপ্যান্টে
হঠাৎ কাদার ফুল ফুটেছে দেখেই মনমরা
হলাম কেমন।
আমাদের পায়ের তলায় মাতামহ,
মাটির গভীরে মাতামহ,
মাতামহ এক খণ্ড হুহু সাদা কাপড়ের মোড়কে জড়ানো,
যেন প্রেরিতব্য সওগাত কোনো, যাবেন সুদুরে।
একজন ফেরেস্তা গাছের মগডালে, নাক তার মাতামহের ফরসির
নলের মতন আর চুল আগুনের ঝোপ, গোঁফে
প্রজাপতি বাঁধা পড়ে গেছে; হাতে টফির রঙিন বাক্স নিয়ে
বিড়বিড় পড়ছে দরুদ।
কান্না-ক্লান্ত কিছু মুখ। কেউ শূন্য দৃষ্টি মেলে চায়,
চেয়ে থাকে দূর মসজিদের মিনারে, কেউ খুব
মগ্ন হয়ে দেখে নেয় কবর তৈরির শিল্প। আমার নিজের
কান্না পাচ্ছিল না বলে লজ্জা বোধ হ’ল। মধ্যে মধ্যে
শুধু মাতামহের ঘরের মালিশের ঝাঁ ঝাঁ গন্ধ এলো ভেসে (পক্ষাঘাত পঙ্গু করেছিল তাঁকে) উজিয়ে অনেক ঘর, বিশীর্ণ হলুদ গাছপালা,
ঊর্ণাজাল। তাল তাল মাটি ঝরে পড়ে মাতামহের ওপর,
সবাই মাটির ঢেলা সাগ্রহে দিলেন ছুড়ে তাঁর
প্রতি, যেন কী এক খেলায় উঠলেন মেতে আর
আমি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তখন
আইসক্রিমের কথা শুধু ভাবছিলাম আড়ালে।