বর্ণ নিয়ে
পুরোটাই দৈবাৎ ঘটনা, বলা যায়। স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ
যেন ক্যারমের ঘুঁটি, বার বার উঠছে লাফিয়ে
আঙুলের ক্ষিপ্র ডগায় আমার; প্রথমেই স্বর-
বর্ণের নকিব মানে আদ্যাক্ষর এলো, তার সঙ্গে
এলো তেড়ে শৈশবের সেই অজগর, যে পুস্তক
ছেড়ে ছুড়ে আচম্বিতে আমার খাতায়
উঠত লাফিয়ে আর খাতা ছেড়ে চলত বঙ্কিম কখনো-বা
হেলে দুলে মগজের তেপান্তর মাঠে। স্বরবর্ণের নিঃসঙ্গ আদ্যাক্ষর
ফুলবাবুটির মতো নিয়ে এলো হাতে
চমৎকার লাঠি মানে একটি আকার। তারপর
ব্যঞ্জনবর্ণের আদ্যাক্ষর এলো ভীষণ বেতালা কা-কা শব্দ
করে এলো, আকারকে ইয়ার বক্সির মতো নিয়ে এলো টেনে।
অনন্তর ক্যারমের সেই মধ্যমণি ঘুঁটিটির
সমস্ত লালিম নিয়ে অন্তঃস্থ বর্ণের
তৃতীয় সদস্য এলো-আমার খাতার পাতা জুড়ে
কেবলি ক্ষুধার্ত চোখ, কেবলি ভিক্ষার পাত্র আর
শুধু ভিড়, তিল তিল ক্ষয়ে-যাওয়া প্রায়
উবে-যাওয়া অস্তিত্বের ছায়ান্ধ মিছিল।
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছ আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলীশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ বলে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁর নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।
আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,
তাই তো ত্রিলোকে আ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে।
গলিত কাচের মতো জলে ফাৎনা দেখে দেখে রঙিন মাছের।
আশায় চিকন ছিপ ধরে গেছে বেলা। মনে পড়ে, কাঁচি দিয়ে
নকশা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে
সেই কবে আমি ‘হাসিখুশি’র খেয়া বেয়ে
পৌঁছে গেছি রত্নদ্বীপে কম্পাস বিহনে।
তুমি আসো, আমার ঘুমের বাগানেও
সে কোন বিশাল
গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসো,
আসো কাঠবিড়ালির রূপে,
ফুল্ল মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড় ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ
মুখের মতোই দুলে দুলে ওঠো তুমি
বারবার কিংবা টুকটুকে লঙ্কা-ঠোঁট টিয়ে হয়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।
আমার স অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখিতারা।
যুদ্ধের আগুনে,
মারীয় তাণ্ডবে,
প্রবল বর্ষায়
কি অনাবৃষ্টিতে,
বারবনিতার
নূপুর নিক্বণে,
বনিতার শান্ত
বাহুর বন্ধনে
ঘৃণায় ধিক্কারে,
নৈরাজের এলো-
ধাবাড়ি চিৎকারে,
সৃষ্টির ফাল্গুনে
হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশশো’ বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছ সগৌরবে মহীয়সী।
সে-ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষমাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
বিকল্প ঘর
কেটে পড়ো, কেটে পড়ো মঞ্চ থেকে’, সেই জমজমাট প্রহরে,
ঝলমলে হলঘরে তীক্ষ্ণ সমস্বরে
শ্রোতারা জানান দাবী। ভাবি, তবে কী করি এখন উলুবনে?
এখুনি পড়ব কেটে সিটি আর বেড়ালের ডাক শুনে? না কি শান্ত মনে
যাব বলে অকম্পিত কণ্ঠস্বরে যা আছে বলার একে একে।
শব্দেরা কাগজ থেকে রঙিন পাখির মতো যায় উড়ে শ্রোতারা থাকেন বেঁকে।
দিয়েছি বিকল্প ঘর, যেখানে বিপুল স্তব্ধতার
স্তন্য পান করে শব্দে বেড়ে ওঠে লীলায়িত স্বাস্থ্যে,
যেখানে দেখাতে পারি কাঁটা-ঝোপ, লতা-পাতা ফুলের বাহার
এবং দেখাতে পারি ল্যাম্পপোস্টে খুব আস্তে আস্তে
খাচ্ছে দোল দেবদূত, অ্যাসেম্বলী হলের মসৃণ ছাদ থেকে
মনোরম বুররাখ যাচ্ছে উড়ে দুলিয়ে যুগল
পাখার এরেড্রোম ছুঁয়ে, খুরে নক্ষত্রের রেণু মেখে
সে ঘরের চতুষ্কোণ দৃশ্যতই সুদূর মুঘল
কক্ষ হয়ে যায়, হয়ে যায় এমনকি পাতালের
জল-ধোয়া অমল প্রাসাদ কিংবা ক্যান্ডিনিস্কি দৃশ্য-
বিমূর্ত গীতল বর্ণে লুকোনো ঘরের ছাদ আর চাতালের
শূন্যতা অথবা প্রাণী, গাছপালা। বস্তুত সীমাহীন সে-ঘরের বিশ্ব।
‘কেটে পড়ো, কেটে পড়ো মঞ্চ থেকে। যা বলছ তার ল্যাজা-মুড়ো
বুঝি না কিছুই’-একজন বললেন হেঁকে নাড়িয়ে শিঙের দুটো চূড়ো,
সঙ্গিনের মতো হাত সিলিং-এর দিকে ভীষণ উঁচিয়ে।
‘ওসব শোনা ধৈর্য আমাদের নেই। কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
মিছে হয়রান করো আমাদের? ফুর্তির ফানুস চাই, চপচপে
কথা আর গান চাই। তোমার ওসব ছাইপাশ জ’পে জ’পে
ক্ষেতে বাড়বে না শস্য’, বলে তাঁরা চকিতে দিলেন ছুড়ে কিছু
নষ্ট ডিম, তুলতুলে টমাটো এবং আমি মাথা করে নিচু
মঞ্চে কোণঠাসা হয়ে ভাবি সে আগন্তুকের কথা, দৃষ্টি যার
প্রত্যুষের মতো আর শ্রুতি প্রতীক পরম সূক্ষ্মতার।
অথচ আজও সে অবয়বহীন, মধু-যামিনীতে
অথবা অমাবস্যায় আসে না শব্দের স্বাদ নিতে।
তবু তাকে লক্ষ্য করে শ্বেত কাগজের শব্দমালা দুলে ওঠে
এবং সবেগে ধায়, যেমন বরফজমা তরঙ্গিনী ছোটে
অকস্মাৎ সূর্যের উদার বুকে লীন হতে। আসে যদি, আগন্তুকটিকে
বসিয়ে বিকল্প ঘরে আমি যাব হরিদ্রাভ বয়সের দিকে।