ভোরের কাগজ
প্রত্যহ হকার এসে ভোরের কাগজ দিয়ে যায়।
কখনো কখনো
লোকটাকে দেখি একটানা কিছুদিন
সাইকেলে আসে,
আবার এমনও হয়, বহুদিন তার সঙ্গে দেখা
হয় না আমার আর কখনো কাগজ
দিতে দেরি করে যদি আমি হেঁটে গিয়ে কিনে আনি
স্টল থেকে। হকারের প্রতি বিরূপতা
মাঝে-মাঝে মাথা তোলে, কিন্তু ঝরে যায়
মাথার খুশকির মতো পুনরায়; ফলত এখনও
সে আমার দরজায় কড়া নেড়ে ভোরের কাগজ
বিলি করে রোজ।
এ-ও এক ভীষণ নাছোড় নেশা, মদ্যপের মতো
হয়ে যাই প্রত্যহ সকালে,
বিশ্ব পান করে
আখেরে কিছুটা স্বস্তি জোটে, শান্তি যদিও এখনও
গৃহত্যাগী পুত্রের ধরনে ঘোরে বিয়াবানে আর
প্রতিধ্বনিময় কত পর্বতগুহায়।
নিউজপ্রিন্টের বুক থেকে হেডলাইন সমেত
সকল খবর লুপ্ত, দেখি সারা পাতা জুড়ে খুব
জ্বলজ্বলে পতাকার মতো
ফেদেরিকা লোরকার রক্তাক্ত শরীর
সময় পোহায়। জীবনানন্দের হাতে গূঢ় পাণ্ডুলিপি
কিছু শঙ্খচিল হয়ে ঝরায় নীলাভ আচ্ছন্নতা,
কখনো আবার নক্ষত্রেরা চাঁদকে স্যালুট করে
কুচকাওয়াজের ঢঙে, নালন্দার প্রকোষ্ঠে একাকী
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান আছেন ব’সে, চোখে তাঁর স্বপ্ন বুনে যায়
কার হাত, কখনোবা তাজিকস্তানের সুন্দরীর
কংকাল গোলাপ ফুটে থাকে বেশুমার, করোটির চক্ষুহীন
কোটরে ঝরায় গজলের অস্তরাগময় সুর
বিগত-যৌবন বুলবুল।
কখনো নজরে পড়ে নিউজপ্রিন্টের বুকে শামুক কুড়ায়
দেহাতি বালক আর বাদামি গোরুর শিঙে কাঁপে
স্বপ্নঝালরের মতো প্রজাপতি আর
রাত দেড়টায় হুড-ঢাকা রিকশায়
একটি অসুস্থ গোলাপের মতো অনিদ্র গণিকা পাক খায়
শহরের পথে পথে। কখনো আবার চোখে পড়ে
আমার না-লেখা
বেবাক অনিন্দ্য কবিতার পঙ্ক্তিমালা,
কিন্তু পরমুহূর্তেই ভুলে যাই শব্দাবলি, ছন্দ দোলা। তারপর
কী আশ্চর্য, ভোরের কাগজে দেখি, একি
দেবশ্রী লাইনো টাইপের অক্ষরের পরিবর্তে দশদিকে
ছড়ানো ছেটানো তপ্ত সিসের খইয়ের মতো অজস্র বুলেট।
মোমবাতি
কখনো কখনো এরকম হয়, দেরাজ, কুলুঙ্গি
খুঁজে পেতে
একটি ডাগর মোমবাতি
বের করি, দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে
পোড়াই সলতে তার, রাখি
লেখার টেবিলে কিংবা মোমবাতিটিকে
যেনবা সোহাগ ভরে হাতে নিয়ে করি
এঘর ও-ঘর, মাঝে মাঝে
বিচ্ছুরিত আলো দেখি একাগ্র দৃষ্টিতে,
যেমন রবীন্দ্রনাথ দেখতেন দিনের প্রথম আলোধারা।
মোমবাতি তপ্ত পানি ফেলে ফোঁটা ফোঁটা,
হাতে পড়লে হাত দ্রুত
সরিয়ে জমাট মোম ঘষে তুলে
ফেলে হাত বুলোই খানিক ছ্যাঁকা-খাওয়ার জায়গাটায়। কখনোবা
টপ-টপ-করে-পড়া জ্বলের আড়ালে
কস্মিনকালেও
না-দেখা তাতার সুন্দরীর অশ্রুপাত লক্ষ্য করে
বড়ই উদাস হই। ঝড়
বইতে থাকে বুকের ভেতর, সেই রোরুদ্যমানা, এলোকেশী
সুন্দরীর কথা ভেবে বড় কষ্ট পাই।
লোডশেডিং-এর ফলে মোমবাতি মহার্ঘ এখন,
তবু কিনি নিয়মিত; অন্ধকারে মোমবাতি জ্বেলে চুপচাপ
বসে থাকা ঘরে,
শিখাটির দিকে অপলক চেয়ে-থাকা
কিছুক্ষণ, অথবা সিঁড়িতে, বারান্দায়, কম্পমান
আলোর সংসর্গে ঘোড়া গথিক উপন্যাসের কোনো
চরিত্রের মতো, ভালো লাগে। ভালো কোনো
মোমবাতি-প্রসূত আলোয়
গহন প্রহরে কবিতাকে ডেকে আনা, কবিতায়
তাকেই আবৃত্তি করা, যাকে ঈষৎ ভুলেছি সময়ের ধোপে।
লোকে তার কথা বলে
লোকে তার কথা বলাবলি করে,
গ্রামে ও শহরে।
শোনা যায়, লোকালয়ে থেকে বহুদূরে নদীতীরে
এবং পাহাড়ে বন-বনান্তরে ঘুরে ঘুরে সে এসেছে ফিরে
আপন নিবাসে। ভেবেছিল নির্জনতা
শান্তি দেবে তাকে, লতা-
গুল্ম, নদী, পাখি, পাহাড়ের চূড়া তার সত্তা থেকে
ফেলবে গ্লানির কালি মুছে, দেবে ঢেকে
খানাখন্দ আহত মনের। মানুষের আচরণ, বলা যায়,
বড় বেশি ক্লান্ত করেছিল তাকে, তাই অসহায়
ব্যক্তির ধরনে
করেছে সে পর্যটন জনহীন মাঠে আর বনে।
আখেরে ভেঙেছে তার ভুল।
এবং সবাই দ্যাখে সে এখন লোকালয়ে ফুল
তোলে, কেনাকাটা করে দোকানে এবং ঝকঝকে
সেলুনের ছাঁটায় চুল, রকে
আড্ডায় শামিল হয়, বলে
নানা কথা বস্তুত সেসব কথা সঙ্গীদের কানের বদলে
মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। কারো কারো হাত
অকস্মাৎ
হয়ে ওঠে অতিশয় ঝোড়ো দাঙ্গাবাজ।
ফলত সে আজ
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, হয় না বিমুখ
তবু মানুষের প্রতি। ভাবে ভুলচুক
এই মর্ত্যবাসীদেরই হয়
আর ব্যান্ডেজের ঘেরাটোপ থেকে তার চক্ষুদ্বয়
স্বপ্নের মতোই জেগে থাকে, জ্বলজ্বলে। মাঝে-মাঝে গল্পচ্ছলে
শহরে ও গ্রামে লোকে তার কথা বলে।
স্বপ্ন অভিভাবকের মতো
স্বপ্ন অভিভাবকের মতো আমার জীবনে তার
নিয়ন্ত্রণ রাখে প্রায় সকল ঋতুতে। হেঁটে যাই
অন্ধকারে, আদিম জলের গান শুনি, স্তব্ধতার
বুক-চেরা, পাথরের নানান গড়ন দেখে চোখ
শিল্পী হয় এবং পাথরে বসে গাঢ় স্পর্শ পাই
আত্মীয়ের, মনে পড়ে দূর কথা, ভুলি শত শোক।
স্বপ্নের ভেতর থেকে উঠে এসে কে আমাকে ডাকে
ছায়াচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে? সুপ্রাচীন লতাগুল্ম ঢাকা
অবয়ব তার, ধু-ধু মাঠে, পাহাড়ে নদীর বাঁকে
কিংবা কোনো লোকালয়ে কখনো দেখিনি তাকে। মনে
হয়, ছিল বুঝি তার পরনে বিবর্ণ আংরাখা,
হয়তো তার সঙ্গে হয়েছিল দেখা অখ্যাত স্টেশনে।
এমনও তো হয় বসে আছি দপ্তরের কামরায়
বড় একা, স্মৃতিক্লান্ত-হঠাৎ কে একজন এসে
ঢুকে পড়ে এত্তেলাবিহীন আর দু’হাত বাড়ায়
সোজাসুজি আমার দিকেই, কী-যে বলে অনুরাগে
বুঝি না কিছুই, চেয়ে থাকি অপলক, স্বপ্নাবেশে
ভাবি, গনিষ্ঠতা ছিল বুঝি অনেক শতাব্দি আগে।
আমি কি নিদ্রার আকর্ষণে দপ্তরের ভেতরে দপ্তরে
নিভৃতে গিয়েছি চলে? স্বপ্নের গহন পথ বেয়ে
এসেছিল সে কি তবে এ ধূসর ঘরে স্তরে স্তরে
পদচ্ছাপ রেখে, প্রাণে জাগিয়ে অতীত শিহরণ?
প্রত্যহ যা দেখি তাতে কী সুদূর মায়া আসে ছেয়ে
আজও জানি না তো নিদ্রা কাকে বলে, কাকে জাগরণ?