বিউটি বোর্ডিং
আজকাল কোনো কোনো বিকেলে হঠাৎ কী রকম
হয়ে যাই, কী রকম এলোমেলো, যেন
আমার ভেতরে
কালবৈশাখীর মাতলামি, ভুলে যাই ইদানীং
আমার মাথার তিন ভাগ চুলে সাদার পোচড়া
পড়েছে, চোখের আলো বিকেলবেলার
মতোই স্তিমিত। বাসনার স্বপ্ন-ধোওয়া চরে নামে
আচাভুয়া পাখি, মাটি খুঁড়ে বের করে প্রত্ন হরেক রকম।
মনে পড়ে, একদা যেতাম
প্রত্যহ দু’বেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই
বিউটি বোর্ডিং-এ পরস্পর মুখ দেখার আশায়
আমরা ক’জন,
তখন তুমুল সময়কে
দিয়েছি গড়িয়ে স্রেফ চায়ের বাটিতে,
কখনো জ্বলন্ত পুণ্য ঝোপের মতন
মাথা আর জঠররাগ্নি নিয়ে
পড়েছি কবিতা শাপভ্রষ্ট দেবতার স্বরে। কখনও জুটেছে
ফুল চন্দনের ঘ্রাণ, কখনোবা হুল বেশুমার।
কোনো কোনো দিন ডাকে এলে দূর কলকাতা থেকে
বুদ্ধদের বসুর ‘কবিতা’ আমাদের চকচকে
চোখগুলি পড়ত হুমড়ি খেয়ে স্মল পাইকার
নান্দিনিক ভিড়ে আর স্পন্দিত হৃদয়ে দেখতাম কার কার
কবিতা পেয়েছে ঠাঁই কিংবা কার পদ্য
স্বর্গচ্যুত হলো সদ্য-পাওয়া সেই স্বপ্নিল সংখ্যায়।
কাউন্টারে শ্রীযুক্ত প্রহ্লাদ তার একটি খোটো পা
দোলাতেন মৃদু স্বরবৃত্তের মতন, লিখতেন
কালো বেঁটে কলমে লম্বাটে
খাতায় হিসাব আর আমরা কানি বকের ছানার মতো
চায়ের পেয়ালা সামনে রেখে
উঠতাম মেতে
পাউন্ড স্পেংলার টোয়েনবি, মার্বস, উত্তর-রৈবিক
কবিতার দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে প্রত্যাগত
নাবিকের ধরনে এবং আমাদের
কত যে হাসির আলো মিশে গেছে গোধূলির বিনম্র আভায়।
একদিন হঠাৎ সকাল দশটায় শুনি বিউটির গৌর,
যুবক বেয়ারা, যৌন রোগী, ঝুলেছে ফাঁসিতে কাল মধ্যরাতে।
কতকাল যাই না সেখানে আর বিউটি বোর্ডিং-এ।
সেখানে যেতাম যারা আড্ডার সুরায়
চুর হতে, তারা কবে ছিটকে পড়েছে দশর্দিকে,
যেন ভালুকের থাবা
হঠাৎ ফেলেছে ভেঙে তন্ময় মৌচাক। আমি আর
দুরু দুরু বুকে
ঈষৎ কম্পিত হাতে সদ্যলেখা কবিতা কারুকে শোনাই না,
বরং নিজেই শুনি কোনো কোনো তরুণ কবির
আবেগার্ত পদাবলি কখনো-সখনো;
মহিলা কলেজে-পড়া তরুণীর সঙ্গে স্মিত হেসে
কথা বলি, অটোগ্রাফ খাতায় কলের
পুতুলের মতো সই দিই বিয়ে বাড়িতে অথবা
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। হয়তো কেউ কেউ
আমার আড়ালে-আবডালে বলে ফিসফিসে স্বরে
‘ভদ্রলোকে তেমন যুবক নেই আর’।
যারা কথা ভেবে ভেবে একদা আমিও নীল প্যাডে
করেছি উজার থরথর
হৃদয় আমার আজ তাকে ভাবি ভাবলেশহীন,
দৈবক্রমে দেখা হলে তার পুত্র-কন্যার মাথায়
আদর ঝরাতে পারি অবলীলাক্রমে
ওদের পিতার কোনো সুহৃদের মতো।
ক্যান্সারের মতো দ্রুত বর্ধমান বয়স আমার।
কতকাল, কত দীর্ঘকাল
বিউটি বোর্ডিং থেকে নির্বাসিত আমি। কোনো দিন
আবার সেখানে ছুটে যেতে পারব কি
আষাঢ়ের বৃষ্টি-আঁচড়ানো অপরাহ্নে কিংবা কোনো
গনগনে ভাদ্রের দুপুরে? যাই যাই
কোনো কোজাগরী পূর্ণিমায়,
করোটির মতো সেই বিউটি বোর্ডিং-এ,
কৈশোরে আঁধারে ভূত দেখার মতন
ভয়ানক ভয় পাব আমি?
বুঝলে হে জগন্নাথ
হুম, বুঝলে হে জগন্নাথ,
আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ থেকে
তোমাকে কিছুই আর করতে হবে না। না, হঠাৎ
খেয়ালের বশে কিছু করিনি, অনেক ভেবেচিন্তে, নকশা এঁকে,
যাকে বলে সর্বসম্মতিক্রমে এই হলো, দেনা
শোধের বালাই নেই, ধার-
তা-ও আর বুঝলে হে জগন্নাথ, করতে হবে না।
এতে যদি কেউ বলে ফেলে তোমার মাথায় বাজ
পড়েছে, তাহলে বড্ড বাড়াবাড়ি হবে। সবই ফাঁকি, ফক্কিকার।
কী বললে? আপন হাতই জগন্নাথ? ছেঁদো কথা, ওসব চলে না
আর আজকাল।
নিজ চোখে দেখছ না এই জমানার হালচাল?
তোমার হাতের কাজ বন্ধ হলো বটে, তবে চোখ
দুটো তো আছেই, তুমি চেনা
সেই উপনিষদের দ্বিতীয় পাখির মতো শুধু চেয়ে চেয়ে
দেখবে, অন্যেরা সবকিছু করবে সকল ঋতুতে। যার ঝোঁক
রয়েছে যে-দিকে সেদিকেই যাবে দড়িবাঁধা রথ, তুমি মুখ
খুলবে, সে-পথ খোলা রাখিনি, বরং চুপচাপ খেয়ে দেয়ে
যাতে দিন নির্বিঘ্নে কাটাতে পারো, সুখ
চেখে তৃপ্ত হতে পারো, ব্যবস্থা নিয়েছি, অর্থাৎ যা যা পেতে
তা-ই পাবে অবিকল, এ ব্যাপারে পান থেকে চুন
খসবে না। ভাগ্যিস তোমাকে ঠা ঠা রোদে পুড়ে ক্ষেতে
লাঙল ঠেলতে বলা হয়নি, অথবা উঁচুনিচু পথে টেনে নিতে গুণ।
তাই বলি, অভিমানে মুখ অন্ধকার করে পথের কিনারে
একা বসে থেকো না, নিজের কর্মফল
ভেবে মেনে নাও সব। তোমাকে ভাগাড়ে
আমরা দিয়েছি ছুড়ে, এমন নাহক অভিযোগ
আমাদের পরম শক্রও করবে না। আর ধর্মের কল
বাতাসে নড়ে না ইদানীং; উপরন্তু বাঘের ঘরেই ঘোগ
বাসা বাঁধে, এসবও তামাদি হয়ে গেছে বহুদিন।
এভাবে তাকাচ্ছে কেন? তোমার হাতের স্রেফ দুটো,
বুঝলে হে জগন্নাথ, কব্জি কেটে ঠাঁটো
বানিয়েছি বৈ তো নয়। মিছেমিছি মুখ তুমি করো না মলিন।
বেলা পড়ে আসে
সকালের খবর কাগজে পড়ি কতিপয় কৃষ্ণাঙ্গ অক্ষর
এবং একটা ফটোগ্রাফ দেখি প্রথম পাতায়।
সেই সব অক্ষরের অভ্যন্তর থেকে
এক ঝাঁক প্রজাপতি, মাছরাঙা, পুকুর পারের হাঁস আর
জলপিপি, সোনালি নূপুর,
অনেক পুরানো হলদে পাণ্ডুলিপি উড়ে
এসে বসে ছাদের কার্নিশে। বেদনার বনস্থলী
দৃশ্যত নিউজপ্রিন্টে ফুটে ওঠে চলিত ভাষায়।
তাঁকে চিনতাম, বলা যায়; তাঁর কীর্তিমালা ছিল
পরিচিত আমার নিকট,
সংক্ষিপ্ত জীবনী তাঁর জেনেছি নানান সূত্রে; কবি
ছিলেন, যদিও কাব্যলক্ষ্মী
অনেক আগেই তাঁকে নথের ঝামটা মেরে তাঁর
ভিটে ছেড়ে চলে যান। পরিত্যক্ত কেয়ুরের দিকে
কখনো কখনো তাকাতেন প্রেরণারহিত কবি বড় নীল
কুয়াশা-জড়ানো চোখে পড়ন্ত বেলায়।
মেজাজে চৈত্রের দাহ ছিল তাঁর, কেউ কেউ তাঁকে
দুর্বাসা বানিয়ে ভারি মজা পেত এবং রটাত
কেউ স্বাদ, আড্ডায়, সালুনে নুন কিছু কম হ’লে তিনি নাকি
রাঁধুনিকে করতেন তিরস্কার চার ঘণ্টা, সজারুর মতো
কাঁটা খাড়া করে উঠতেন মেতে যুক্তিতর্কে গল্পে। শোনা যায়,
ঢেঁড়স, গাজর, বীট, ফুলকপি, পালঙ ফলাতে গিয়ে তিনি
গোলাপ, টগর, জুঁই, রজনীগন্ধার প্রতি খুব
অবহেলা করেছেন অনেক ঋতুতে।
প্রাণবন্ত যৌবনের গোলদীঘিটির চতুর্দিকে
ঘুরেছেন তিনি যতবার,
ততবারই একটি পাকুড় গাছ তাঁকে দিয়েছে নির্দেশ
দীঘিতে গোসল সেরে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্যে যেতে
রহস্যের নিবাসে যেখানে কেউ থালা
সাজিয়ে রয়েছে ব’সে হাতপাখা নিয়ে;
মাধুর্যের প্রতি নয়, রুক্ষতার পঞ্চ ব্যঞ্জনের
প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেড়েছে নিয়ত।
যতদূর জানি,
শেষ অব্দি বাজত শরীরে তাঁর ঝিঁ ঝিঁ ডাকের মতো এক
শাক্ত ভাব, আশৈশব ভালোবাসতেন
দূর-থেকে-ভেসে-আসা ঘণ্টাধ্বনি, যার
কথা আছে তাঁর এপিটাফে। চরাচরে
একটি সোনালি ঘণ্টা বাজে শব্দহীন, কেবলি রাজতে থাকে
বুকের ভেতর, রেকাবিতে
শিউলি বিষণ্নতায় ম্লান হয় প্রহরে প্রহরে।
না-খোলা একটি চিঠি, আধপড়া কবিতার বই
লেখার টেবিল পড়ে আছে; শেষ লেখা
ডায়েরির নিভৃত পাতায় ফ্যালে দীর্ঘশ্বাস, ঘরে
যেন গজিয়েছে বন অকস্মাৎ, তাঁর
ফটোগ্রাফে প্রজাপতি কী নির্ভার সময় পোহায়। এরপর
কখনো লেখার ফাঁকে চা জুড়াবে বলে
কেউ তাড়া দেবে না; এখন ঘরে হেমন্তের বেলা পড়ে আসে,
বেলা পড়ে আসে বৃদ্ধ কবির নমিত জানাজায়।