ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ
তোমার সয়নি তর, ভোরকেই কালসন্ধ্যা ভেবে
সাততাড়াতাড়ি বেপরোয়া
হাঁকালে চাবুক তুমি অস্থির ঘোড়ার পিঠে, গেলে
ছুটে দুর্নিবার
বৈশাখী হাওয়ার বেগে কেড়ে নিতে সোনার মুকুট
সুহৃদের মাথা থেকে। অনেকের ছিল জানা, তোমরা দু’জন
মানে সে রাজন আর তুমি ছিলে দস্তানা এবং
হাতের মতোই লগ্ন সকল সময়।
প্রতীক্ষা শেখোনি তুমি কিংবা শিখলেও
উচ্চাকাঙ্ক্ষা মোরগ-ঝুঁটির মতো হয়েছে ভীষণ আন্দোলিত
মাঝে-মাঝে। ফলত সফল
কোনো শিকারের পরে মোসাহেব আর
হুঁকোবরদার-পরিবৃত হয়ে ছিলে
যখন, তুমি
সে কোন গুহার পেট চিরে এক ঝাঁক
অদ্ভুত নিরালা পাখি এসে কালো করে
তোমার আকাশ কী-যে বলল
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, আস্তিনের সাপ
ছাড়া অন্য কেউ ঘুণাক্ষরে
বোঝেনি সে-ভাষা।
হঠাৎ শিউরে ওঠো কেন? রুটি টুকরো
করার সময়
রুটির ভেতর থেকে রক্ত ঝরে
বুঝি? নাকি মাছের ঝোলের
বাটি এক লহমায়
হয়ে যায় রক্ত সরোবর? একি, তুমি
নিজের ঘরের চার দেয়ালে খাটের
বাজুতে এবং পারসিক গালিচার
রক্তধারা দেখছ নিয়ত। আর যে ছুরি লুকিয়ে
রাখো তুমি সর্বদা কোমরে,
অষ্টপ্রহর সে যাচ্ছে বকে অবিরত
অসুস্থ প্রলাপ।
অবশ্য এখন তুমি বিভোর নিজের
মুকুটিত শোভা দেখে। দর্পণও তোমার, মনে হয় আজ্ঞাবহ
চাটুকার ইদানীং। যে ছবি দেখতে চাও তুমি
নিমেষে সে ছবি ফোটে জমাট পারদে। অতিশয়
বিজ্ঞ তুমি, উপরন্তু নিখুঁত তোমার চাল। তবে
এ-ও সত্য বলে জেনো, ‘কোথায় মুকুট’ বলে তুমি
অকস্মাৎ আর্তনাদ করে উঠবে একদিন দুঃস্বপ্নের ঘোরে,
দেখবে দু’চোখ মেলে কাঁটাতারে মৃত কালো পাখিটার সঙ্গে
ঝুলে আছে অস্তরাগে রক্তাক্ত গৌরব,
ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ। ক্রমাগত রৌদ্রজলে জং ধরে
শিরস্ত্রাণে আর সেখানেই
দুলিয়ে দর্পিত মাথা হাসে রক্তজবা।
নন্দলাল বসুর সঙ্গে কিছুক্ষণ
খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙে অদৃশ্য পাখির গানে,
সে সুর ছড়িয়ে পড়ে ময়ূর রঙের আসমানে।
দূরে নন্দলাল বসুর ছবির মতো
দিগ্বলয় চোখে পড়ে; আমি অভ্যাগত
বত্রিশ বছর আগে যাচ্ছিলাম হেঁটে তাকে নিয়ে
রতন কুঠির পাশ দিয়ে,
অকারণ কত কিছু সযত্নে কুড়িয়ে চলে মন,
অমর্ত্য পাখির মতো গান গায় শান্তিনিকেতন।
খালি পায়ে পথ হাঁটি সকাল ন’টায়, মাটি-ঘাসে
মমতার স্পর্শ পাই, নন্দলাল বসুর নিবাসে
অত্যন্ত স্পন্দিত প্রাণে যাই,
শিল্পীর নিবাস যেন সাধকের ধ্যান, মেলে ঠাঁই
সকলের; জগত সংসার লগ্ন চৌহদ্দিতে। হেসে
তাকালেন, সময়-পেরুনো দৃষ্টি; সাদাসিধে বেশে
আছেন নিমগ্ন ব’সে সুজনি-শোভিত তক্তাপোশে। বসে পড়ি
আমরা ক’জন তাঁকে ঘিরে, দিলেন ভাসিয়ে তিনি শিল্পতরী।
সেই ঘর ভরা
আনন্দের স্বরে, দেখি তাঁর হাতে পোষা পাখির ধরনে ধরা
নিজস্ব প্রিন্টের অ্যালবাম। একটি একটি করে
ছবি মেলে ধরলেন তিনি, দৃষ্টির দুকূল ভরে
আমাদের কেমন সৌন্দর্য এলো-অমরাবতীতে
একটি ছাগল চরে, অজয় নদীতে
পা ডোবায় সাঁওতাল তরুণী; হঠাৎ
অ্যালবাম বন্ধ করে করলেন তিনি ঘরছাড়া দৃষ্টিপাত।
‘আজ এখানেই শেষ, আবার কখনো যদি ফিরে
আসো কোনো দিন অজয় নদীর তীরে,
ছাতিম তলায়, তবে বাকি
ছবি দেখা যাবে ফের একসঙ্গে আরেক সকালে’। দূরে পাখি
ডেকে ওঠে, উৎসব ফুরাল লহমায়,
পান করে পদ্মবন, পলাশ ও শিমুলের মেলা,
গোপাল ক্ষ্যাপার নাচ পথ চলি, গাছের মধ্যেই দেখি শিব, বাড়ে বেলা।
এ কেমন খেলা দেখালেন শিল্পচার্য? কিছু অন্তরালে রেখে,
নান্দনিক উন্মোচনে মেতে কিছু এঁকে
ফোটান ত্রিলোক তিনি; তবুও পায় না সম্পূর্ণতা
শিল্প চরাচরে; নদী, পাখি, তরুলতা,
বারবার ফিরে আসে রঙ রেখায়। আর কত
বছর কী দ্রুত কেটে গেল, নিজের ছবিরই মতো
এই তো আছেন ব’সে নন্দলাল নন্দন সিঁড়ি জুড়ে। চলো যাই,
কাছে ডাকে রোদের ঝালর প’রে ক্ষীণাঙ্গী খোয়াই।
নিরন্তর দোটানায়
নিরন্তর দোটানায় আজ আমি ক্লান্ত, হতাশ্বাস;
এক স্তূপ বেদনার মতো পড়ে আছি এক কোণে,
এবং আমার স্বপ্ন ছেঁড়া পাতা, মনের গহনে
ঘোরে শুধু প্রেতচ্ছায়া নিত্যদিন। সকল বিশ্বাস
ছিন্নমূল; দর্শনে পাই না স্বস্তি, বিজ্ঞানেও আর
নিখাদ উৎসাহ নেই, যখন সভয়ে দেখি, হায়,
জাগর বিজ্ঞানপুষ্ট শক্তির সংহারী মত্ততায়
দ্রৌপদী সভ্যতা দ্যাখে নিরুপায় সর্বনাশ তার।
পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে কোনোকালে,
এইমতো অর্বাচীন গালগল্পে ধরেছে ফাটল,
এ-কথা কবুল করি, অনেক আগেই। দ্বিধাহীন
বলি তবু, আমি বন্দি হয়েও ভ্রান্তির ঊর্ণাজালে
সৃষ্টির বন্দনা করি মাঝে-মধ্যে; কেননা অতল,
রমণীয় দৃষ্টি, ঝরনা স্বর্ণচাঁপা আজও অমলিন।
বহুদিন পর মাকে
সুরমা রঙের মেঘে রোদ্দুরের পাড়, চরাচরে
চকিতে ছড়িয়ে পড়ে সুর,
হৃদয়ের ভোরবেলাকেই ভরে তোলে, পিছুডাক;
আসমানে চিলের পাখার ঝলসানি।
বারান্দার জায়ানামাজের মখমলে প্রজাপতি,
এককোণে তসবি ধ্যানস্থ,
হঠাৎ কী ভেবে তিনি ঘরের ভেতর
গেলেন আমার আম্মা। চৌকাঠে লুটায়
রোদ্দুর, শিশুর হাসি। বহুদিন পর
মাকে দেখলাম তাঁর
আলমারি গোছাতে, একটা ঘ্রাণ, পুরানো দিনের,
সারা ঘরে গুণীর তানের মতো ব্যাকুল ছড়ানো।
আমি অগোচরে;
নানা কাপড়ের ভাঁজে কী যেন তন্ময়
খুঁজছেন; ঘরে ওড়ে প্রজাপতি। ফটোগ্রাফ থেকে
আমার পিতার চক্ষুদ্বয়
চেয়ে থাকে, যেনবা আবৃত্তি করে জন্মদিন। কারুকাজময়
আলমারি থেকে
একটি গোলাপি বানারসী শাড়ি হাতে
নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন কিছুক্ষণ,
তাকিয়ে লাজুক চোখে এদিক ওদিক
জড়ালেন গায়ে।
অকস্মাৎ রঙধনু, তাঁর সমগ্র সত্তায়, যেন
তিনি পুনরায় নববধূ অতীতের
চন্দ্রিল বাসর ঘরে। বৈধব্যের গোধূলিতে একটি গোলাপি
বানারসী শাড়ি হাতে
দাঁড়ানো আমার আম্মা। চোখে
তাঁর বাইফোকাল চশমা,
এবং স্খলিত দাঁত, সময়ের নখের আঁচড়ে
উৎকীর্ণ অস্তিত্বময়, যেন কবিতা লিখতে গিয়ে
কিছু হিজিবিজি এঁকে ফেলেছি খাতায়। আজ এই
সত্তরেও দেখি
যৌবন আনত তাঁর কাছে।
‘এর আগে এমন সুন্দর আমি দেখিনি তোমাকে’,
মনে মনে উচ্চারণ করে অন্তরালে
সৌন্দর্য লুণ্ঠনকারী সরে যাই সে বাসর থেকে।
সুরমা রঙের মেঘে রোদ্দুরের পাড়, কতিপয়
কবুতর রেলিঙ-এ আতিথ্য নেয়, গম
পাবে; মা আমার
দাঁড়ানো দরজা ঘেঁষে, তাঁকে
কী এক উৎসব
ত্যাগ করে গেছে, মনে হয়। আলগোছে
নেবেন কুড়িয়ে তিনি ফিরোজা তসবি
একটু পরেই-
কখন যে মদির গোলাপি বানারসী হয়ে যায়
পশ্চিম আকাশ আর তিনি
আছেন দাঁড়িয়ে
একাকিনী; প্রতীক্ষার কাতর প্রতিমা।