তার সঙ্গে জানাশোনা
তার সঙ্গে জানাশোনা অনেক আগের। মনে পড়ে
প্রথম দেখেছিলাম তাকে
ছেচল্লিশ মাহুতটুলির ছাদে মেঘান্ধ প্রহরে।
তারপর একদিন হার্নি সাহেবের যত্নের বাগানটাকে
আলো করে হেঁটে গেল রক্তজবা গাছের নিকটে।
আরা একবার আহসান মঞ্জিলের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে
দেখলাম, তাকাল আমার দিকে খুব অকপটে;
এবং কিছু না বলে মেতে
উঠল সাঁতারে বুড়িগঙ্গা নদীটির বুক জুড়ে। জলকেলি
আমারই উদ্দেশে ভেবে উৎসবের প্রদীপের মতো
জ্বলে উঠে ক্ষিপ্র মুছে ফেলি
নৈরাশ্যের জুলকালি; সে দৃশ্যকে করেছি লেহন অবিরত।
মনে পড়ে, বায়ান্নর বুলেটে জখমি এ-শহরে
সে এলো বিষণ্ন অথচ কী তেজী ভঙ্গিতে, দাঁড়াল
এলোমেলো ঘরে,
আমার শয্যার পাশে মন্থর বাড়াল
পা, রাখল হাত জ্বরে-পুড়ে-যাওয়া আমার কপালে।
দেখলাম তাকে একদিন খারাপ পাড়ার মোড়ে
আশ্বিন-সকালে।
স্বচ্ছ নগ্ন আকাশের নিচে, আবেগের তোড়ে
অন্ধ ভিখারির মুখে পরে দিতে একটি সোনালি
মাছ; বহুকাল পর দেখা গেল তাকে প্রাণভয়ে
উদ্বাস্তু মিছিলে ত্রস্ত, খালি
পায়ে আর উষ্কখুষ্ক চুলে। দেখি সূর্যোদয়ে
কী সূর্যাস্তে বাহু তার বরাভয় আঁকে
শূন্যতায়; পুনরায় তার সঙ্গে হলো দেখা গায়ে
কাঁটা-দেয়া সময়ের বাঁকে।
ছিল সে লাশের ভিড়ে ব’সে খোলা চুলে, বনচ্ছায়ে
পাথুরে ভাস্কর্য যেন। মাথায় তন্ময়
করবীর গুচ্ছ নিয়ে পা দোলায় ধ্বংসস্তূপে ব’সে নিরালায়,
কখনো আমার ঘরে নিঃশব্দে টাঙিয়ে দেয় গাঁদাফুলময়
রবীন্দ্রনাথের পাশে মনস্বী মার্ক্সের ছবি। যায়, দিন যায়।
পড়ছে বাহুর ছায়া দীর্ঘ হয়ে আমার আয়ুতে ক্রমাগত,
কিন্তু দেখি তার স্বপ্ন-ধাঁধানো শরীরে
বয়স আশ্চর্য মঞ্জরিত স্থির বিদ্যুতের মতো,
প্রাত্যহিকতা অলৌকিক বেজে ওঠে চকিত মুদ্রায় তার মীড়ে মীড়ে।
দুখিনী সাঁথিয়া
মধ্য মার্চ নগরবাড়ির ঘাটে কোকোকোলা, সাদা জিপে চড়ে
পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে গেলাম দুখিনী সাঁথিয়া।
থানার পাশেই ডাকবাংলো,
মন-মরা, কেমন নিষ্প্রভ,-কিন্তু লহমায়
মানবিক আভা বিচ্ছুরণে, হাসি-গল্পে যেন আমি
একটি উজ্জ্বল দ্বীপে ছুটি পেয়ে যাই গোধূলি বেলায়।
কাজলা দিদির মতো সন্ধ্যা আসে আর
চকিতে ঘোমটা টেনে নিত্যকার লোডশেডিং এবং
হ্যাজাক ছাড়াল আলো মঞ্চে, নিমেষে রবীন্দ্রনাথ
নজরুল ইসলাম ব্যাপ্ত মীড়ে মীড়ে
সাঁথিয়ার ব্যাকুল হৃদয়ে। দীপকের কণ্ঠস্বরে
আধুনিক কবি ঠাঁই পান, চকোর কবিতা পড়ে, সুর
মাটি-ঘাস, আল ছুঁয়ে বিলে পৌঁছে যায়। রাত বাড়ে,
ভাটা পড়ে অলৌকিক কলরবে। স্তব্ধতার
মধ্য দিয়ে হেঁটে ফিরে আসি ডাকবাংলোয়। রাত
দেড়টায় শুতে যাই, কিছুতে আসে না ঘুম, চোখ পুড়ে যায়।
জানালার বাইরে আঁধারে কার চোখ জ্বলে? কোত্থেকে অঙ্গার
এলো এত রাতে? ঝোপ থেকে
মানুষখেকোর গন্ধ ভেসে আসে যেন,
আই ইজিচেয়ারে নিশ্চুপ
গা এলিয়ে দিয়েছেন জিম করবেট। সহচর
রাইফেল পাশে স্তব্ধ প্রহর পোহায়।
বিনিদ্র পাখির ডানা ঝাড়ার শব্দের মতো একটি আওয়াজ
ভেসে আসে, তাকে মনে পড়ে। কাকে? একটি দুপুর
এবং একটি সন্ধ্যা আমার অধীর অঞ্জলিতে
জমা রেখে যে এখন জিম্মি অন্য কোনোখানে, তাকে।
কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙে। কতকাল
শুনিনি কোকিলকণ্ঠ। রোদ এসে শিমুলের রঙে
রাঙিয়ে দিয়েছে ডাকবাংলোকে। বাসি
মুখ ধুই, ফিরে যাব। একটু পরেই
আসবেন ওরা-অধ্যাপক, ছাত্র, সাংবাদিক
কেউ কেউ, সাধারণ মানুষ কজন, সর্বোপরি
কৌতূহলী বালক-বালিকা। ফিরে যাব,
ক্যামেরায় স্নিগ্ধ গাছপালাসহ স্মৃতিময় ছবি, ক্লিক, কবি
এত তাড়া কিসের? বলিনি গাড়ি ঠিক
সময়েই এসে যাবে? কোনো দিন ফের দেখা হবে।
ঈশ্বরদীতে ধরব প্লেন। কিছু উদ্ভিদের স্পর্শ, কিছু
মেঠো ঘ্রাণ কতিপয় মুখ, গল্পে-গানে ঝলমলে,
হৃদয়ের শেকড়ে
থাকবে জড়িয়ে। সাঁথিয়ার প্রতি ওড়াব রুমাল যথারীতি।
আবার শহুরে আড্ডা, টাইপরাইটারের দ্রুত
চটপটে শব্দে মতো অস্থির ব্যস্ততা, অতিকায়
মৌচাকের গুঞ্জরণ, হেনরি মিলার সাক্ষী, এয়ারকুলার
দুঃস্বপ্ন ছড়িয়ে দেবে বহুতল দালানের আনাচে-কানাচে।
কখনোসখনো
হৃদয়ে কোকিল হয়ে ডেকে যাবে দুখিনী সাঁথিয়া।
দ্য গেম ইজ ওভার
অকুণ্ঠ স্বীকার করি, তুমি বেশ তুখোড় খেলুড়ে।
যারা উড়ে এসে জুড়ে
বসে তুমি তাদের কাপ্তান প্রতিনিধি নও; আমি
যে-দলে নিয়ত খেলি, সে দলেরই খুব অগ্রগামী
একজন হয়ে দিব্যি খেলে যাচ্ছ সকল ঋতুতে। কোন লক্ষ্যে
নিবদ্ধ তোমার দীপ্ত চোখ, প্রকৃত আমার পক্ষে না বিপক্ষে
খেলছ, বোঝাই মুশকিল।
অন্ধকারে ঢিল
ছুড়েছি অনেক; ঐন্দ্রজালিকের মতো
সহজে সেসব তুমি করেছ গায়েব ক্রমাগত।
সন্দেহের মেঘ তাই জমেনি কখনো মনে, বরং তোমার ড্রিবলিং, ব্যাক ভলি, ডজ, পুশ দেখে গুলজার
করেছি নরক প্রশংসায়। তুমি হেসে,
কখনো একটু কেশে
পুড়িয়েছ এন্তার সিগ্রেট, আর ধূম্রকুণ্ডলীর
মতো পাকিয়েছ দল ধীর,
স্থির আর কখনো-বা কপট স্তুতির ঘোরে
বস্তুত করেছ নিন্দা আমার নিপুণ ঠারে ঠোরে।
অথচ তোমাকে আমি প্রায়শই জুগিয়েছি বল
বারংবার নিজেকে পেছনে রেখে, চেয়েছি উজ্জ্বল
হোক খেলা যৌথ ভাবে। কিন্তু তুমি একা
চেয়েছ অত্যন্ত ঝলসাতে, এমনকি ভব্যতার সীমারেখা
নিখুঁত দিয়েছ মুছে; শুনেও শুনিনি
উড়ো কথা, বরং তোমার কাছে ঋণী
ভেবেছি সর্বদা নিজেকেই।
এমন ছেড়েছ দান অন্তরালে, হারিয়েছি খেই।
কাকের কর্কশ ধু-ধু ডাকের মতোই খুব পুরানো এ খেলা
দেখে যায় বেলা।
চতুর্দিকে নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার;
দ্য গেম ইজ ওভার মাই ফ্রেন্ড, হে সখা আমার।