গ্রন্থস্বত্ব
আমাকে চমকে দিয়ে কখনো কখনো
আমার ভেতরে কেউ একজন হো-হো হেসে ওঠে,
মাছে মাঝে নিঝুম গুমরে কাঁদে নিভৃত আড়ালে,
কাঁদে একা একা।
আমাকে কিছু না বলে অকস্মাৎ গহন রাত্তিরে
গৃহত্যাগী গৌতমের মতো
চলে যায় হেঁটে বহুদূরে, যেন সব
সম্পর্ক চুকিয়ে চলে যায়। কোথায় যে
যায় কত ধু-ধু বাঁক পেরিয়ে, জানি না।
যখন সে করে না বসত আর আমার ভেতর,
তখন স্মৃতিতে তার ছায়া
বড় বেশি আনাগোনা করে। দীর্ঘকাল
প্রতীক্ষায় থাকি তার; কিন্তু আসে না সহজে সেই পর্যটক
আমার ইচ্ছাকে দিতে একান্ত পুষ্পিত উপহার।
আবার এমনও হয়, এত্তেলা ছাড়াই
ধুয়ে মুছে কায়ক্লেশ ওজু করে স্বপ্নের ভেতরে বেদনায়।
তার চোখে রহস্যের ভাষা
ভাষতীত বোধ বুনে দেয়। অকস্মাৎ সে পড়শি
তর্জনী উঁচিয়ে
আমার সকল গ্রন্থস্বত্ব দাবি করে। আর গূঢ়
অনিবার্য উচ্চারণ শুনে
বিস্ময়ের পাখি ঠোকরায় আমাকে এবং আমি
ধন্দে পড়ে যাই।
ঘৃণা, তুই
ঘৃণা, তুই তোর ভ্রূকুঞ্চন,
ঠোঁটের বক্রতা আর দাঁত ঘষটানি
ফিরিয়ে নে। দ্যাখ চেয়ে গোলাপ কেমন
হেসে তোর দিকে
তাকিয়ে রয়েছে, বন পায়রার ঝাঁকি নম্র এসেছে নেমে
টিনশেডে, চকোলেট রঙের তরুণ পাখি তার
হৃদয় উজাড় করে সুর
ঢেলে স্নান সস্নেহে করাচ্ছে-হ্রদয়কে। এই তো দাঁড়াল বারান্দায়
কলেজ সুন্দরী, তার চুল ওড়ে উদ্দাম হাওয়ায়,
ঘৃণা তুই, তোর তূণ থেকে সব তীর ছুড়ে ফেলে দে মাটিতে।
ঘৃণা, তুই যাকে শক্র ভেবে এতদিন বারবার
চোখ থেকে ঝরালি আগুন,
করেছিস খুন স্বপ্নে তৃতীয় প্রহরে আর দুর্বাসার মতো
কমণ্ডলু ছুড়ে তপোবনে অকস্মাৎ
ভীষণ ভয়ার্ত করে তুলেছিস হরিণ শিশুকে,
প্রকৃত প্রস্তাবে
কখনো সে নয় শক্র তোর, বরং দয়ার কুঁড়ি
ফোটাবার জন্যে সে হয়েছে অন্তরালে
কিছুটা নির্দয়। শোন মিনতি আমার, পুনরায় ভালোবেসে
ঘৃণা তুই মুখ থেকে খুলে ফেল ঘৃণার মুখোশ।
ছায়াসঙ্গীর উদ্দেশে
শাবাস জনাব, আপনার ধৈর্যের মুখে
ফুল চন্দর পড়ুক। সেই কবে থেকে আপনি
আমার পেছনে পেছনে ঘুরছেন।
আমি বাড়ি থেকে না বাড়ালেই
আপনি আমার সঙ্গে জুড়ে যান। সবসময় যে স্পষ্ট
আপনাকে দেখতে পাই, তা নয়।
তবে বুঝতে কষ্ট হয় না,
কেউ একজন আছে আমার পিঠের খুব কাছে,
কখনো কখনো তার নিঃশ্বাস এসে লাগে
আমার ঘাড়ে। ঘুরে দাঁড়ালেই দেখতে পাব তাকে।
আমি ডান দিকে ঘুরলে আপনিও ঘুরে দাঁড়ান ডানে,
যখন আমি বাঁ দিকে এগিয়ে যাই
হনহনিয়ে, তখন আপনিও
চমৎকার কায়দার চলতে শুরু করেন বাঁয়ে।
আর এই তো সেদিন
রৌদ্রের ঝালরময় আরমেনিয়ান গির্জের কাছে আপনি প্রায়
ধরা পড়ে গেলেন আমার চোখে।
আর সেই মুহূর্তে চেহারায় এমন ভঙ্গি ফুটিয়ে
তুললেন, মনে হলো, আপনি আমাকে
এই প্রথমবারের মতো দেখলেন। কী জানেন,
এরকম মুখভঙ্গি শুধু পাকা অভিনেতাই আয়ত্ত করতে পারে।
দেখুন, কখনো কখনো ইচ্ছে
আপনাকে সাফ বলে দিই, ‘আপনার নষ্ট করার মতো
প্রচুর সময় যদি থাকে,
তাহলে যত ইচ্ছে আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করুন
আমি বারণ করব না। ভিড় ঠেলে ঘেমো মানুষের
গন্ধ শুঁকে শুঁকে সকাল-সন্ধ্যা
কিংবা মধ্যরাত অব্দি আমার আশেপাশে
মনের সাধ মিটিয়ে
ঘোরাফেরা করুন, আমার একরত্তি আপত্তি নেই।
এই যে আপনি শিকারি কুকুরের ধরনে
আমার চলার পথ শুঁকে বেড়াচ্ছেন অষ্টপ্রহর,
কী এর উদ্দেশ্য
আমার একেবারে অজানা নয়। বিশ্বাস করুন,
আপনি আমার কাছে যা পেতে চান,
যা আমার কাছে আছে বলে আপনি এবং আপনার
প্রভুরা কল্পনা করেন-
আপনাদের কল্পনাশক্তি কবিদেরও হার মানায়-
সেসব কিছুই পাবেন না।
বরং আমার মুখোমুখি হলে
আপনাকে আমি চটজলদি একমুঠো বেলফুল,
কতিপয় রঙিন বেলুন,
কিংবা টাকার মতো চকচকে কিছু নক্ষত্র দিতে পারি।
ট্রেনের জানালা থেকে
সতেজ সকালবেলা সবুজ আড়ালে
ডুরে-শাড়ি-পরা
যৌবন দাঁড়িয়ে ছিল একাকিনী, খুব দ্রুতগামী
ট্রেনের জানালা থেকে দেখলাম। তার
গোড়ালির গন্ধ শুঁকে
একটি গুবরে পোকা ঢুকে পড়ে ঘাসের ভিতরে।
অকস্মাৎ ধবধবে বক উড়ে যায়
দাবার ছকের মতো ক্ষেতের ওপর দিয়ে, আসমানী প্রসাধন চলে
জলের আরশিতে। শূন্য নৌকা
ডাঙায় কুঁড়েমি করে, কী যেন কুড়ায় পথে বিশীর্ণ বালক।
পিত্রালয়ে ফিরোল্টা যাবার আশা পলাশের আভা
ছড়িয়ে তার চোখে, নাকি
প্রবাসী স্বামীর প্রত্যাবর্তনের পথ-চেয়ে-থাকা
ফোটায় অজস্র তারা রক্তকণিকায়,
নাকি ওর হৃদয়ের গহন দুপুরে
মোহন চক্কর দিতে দিতে ডেকে যায় শঙ্খচিল।
হয়তো কেউ তাকে ডেকে নিয়ে গেছে নিকানো উঠোনে,
ধান ভানা বাকি আছে, আছে
ইঁদারার কাছে যাওয়া, বাসী কিছু বাসন-কোসন
মেজে ঘষে ধুয়ে মুছে
সাজিয়ে রাখতে হবে। শিকায় ঝোলানো
খয়েরি বৈয়ম থেকে গুড
এখুনি নামিয়ে দিতে হবে, গাছ-পাকা
পেঁপে কেটে দিতে হবে
অতিথির পাতে, সে এখন মিশে যাবে সংসারের
শত কাজে, যেমন দিঘির সুনসান
পানিতে সহজে ভেসে যায়
মাটির কলস।
ভোরবেলাকার ট্রেন হুইসল্ বাজাতে বাজাতে
ছুটে যাচ্ছে, গাছগাছালির আড়ালবর্তিনী ডুরে-শাড়ি-পরা
যৌবন দাঁড়িয়ে আছে আমার ভিতরে।
কী-যে তার নাম,
বিবাহিতা অথবা অনূঢ়া,
নাকি উপস্থিত রজস্বলা নাকি সদ্য গর্ভধারিণী, এসব
কিছুই না জেনে দ্রুত চলেছি একাকী
শহুরে মানুষ। একদিন
সবুজ আড়ালে-থাকা ডুরে-শাড়ি-পরা
যৌবন নিশ্চিত মুছে যাবে,
যেন জলরঙ; আপাতত আমি খুব চুপচাপ
ট্রেনের জানালা থেকে লঙ শটে দেখে নিচ্ছি জলমগ্ন মাঠ,
নিবিড় লাঙল-ঠেলা কৃষকের রোদ্দুরে-পিছলে-পড়া পিঠ,
আনন্দ-বলয় থেকে আসা পাখি, তারে-বসা, শুদ্ধচারী মেঘ
এবং ভাবছি তাকে, বানাচ্ছি প্রতিমা তার স্মৃতির ভিতরে,
নাম ধাম যার
সর্বদা থাকবে ঢাকা বেজায় বেগানা কুয়াশায়।