কাল থেকে ফের
বেশ কিছুদিন থেকে এই বৃষ্টিই চাইছিলাম
দিগন্ত-ডোবানো বৃষ্টি। ভুরুতে ঠেকিয়ে হাত আমি
গনগনে আকাশের দিকে কতদিন
তাকিয়েছি বারংবার, পরখ করেছি
নানান রঙের নানা আকাশের মেঘ।
কোন মেঘ বৃষ্টি নামায় এবং
কোন মেঘ জলহীন তার
আন্দাজের মুখে ফুলচন্দন পড়ে না সহজে।
আকাশ যে কীরকম প্রতারক হতে পারে, ঘটা করে
মেঘ-মেঘালির খেলা দেখিয়েও মাটিকে তৃষিত
রাখে দীর্ঘকাল,
এ-কথা অজানা নয়। প্রতীক্ষার পাথর হৃদয়ে
অন্ধের চোখের মতো থাকে
সকল সময়।
এখন আবার আসমান দিয়েছে উপুড় করে তার ভরা
কলস বদান্যতায়। খরাপোড়া খেতে
দাঁড়ানো চাষীর মতো ভিজছি, আমার রোমকূপে
ঝরে বৃষ্টিধারা, গলে যায়
আমার হৃদয়
বৃষ্টির পানির মতো, এই বৃষ্টি আমার আশ্রয়।
বৃষ্টির নূপুর থেমে গেলে কুমড়ো-ফালির মতো
চাঁদ ওঠে, উঁকি দেয় একটি কি দুটি তার আর
অকস্মাৎ একটি ভাবনা ঘুরে দাঁড়ায় ভয়ার্ত
পথিকের মতো-কাল থেকে ফের শুরু হবে না তো
একটানা ধূমায়িত খরা বহুকাল
আমার জমিতে?
কিছু কথা ছিল
চৈত্র সংক্রান্তির দুটি পাশাপাশি থাকা
ঘুড়ির ধরনে খুব কাছাকাছি ছিলাম দু’জন। আমাদের
একজন যে কোন মুহূর্তে সরে যেতে
পারি খর প্যাঁচে,
ছিল ভয় সারাক্ষণ। তোমার ভেতরকার ধু-ধু
নির্জনতা করেছি আকণ্ঠ পান সকল সময়।
যখনই তোমার চোখে চোখ
রেখেছি তখনই মৃত রাজার মিছিল নির্বাসিত
রানীদের মুখ আর রুপালি তাঞ্জাম
দৃষ্টিতে উঠেছে ভেসে। এমনকি রেকাবিতে রাখা
ফলের ভেতর আমি দেখছি তোমার রূপ আর
সর্বদা তোমার
নামের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে কিছু ধ্রুবপদ
করেছি নিবিড় উচ্চারণ।
বেশ কিছু কথা ছিল তোমাকে বলার,
অথচ তোমাকে
ভালবাসি বলার আগেই
হৃদয়কে অমাবস্যা করে নিলে চকিতে বিদায়।
কী ব্যাপক লোভে
সবকিছু খুব শান্ত আশেপাশে; বারান্দায় হাঁটি
একা একা; গৃহকোণে নিমগ্ন গৃহিণী
ভোরের নিঃসীম প্রার্থনায়। কয়েকটি কবুতর
পাশের বাড়ির ছাদে ঘোরে ইতস্তত কিছু আহার্যের খোঁজে।
আকাশে অস্পষ্ট চাঁদ, নিঝুম প্রশান্তি শুয়ে আছে
মেষ পালকের মতো। যেন কেউ দিচ্ছে উপহার
স্মিত হাসি দূর থেকে, একটি তরুণী
খোলা ছাদে, মুখের ভেতরে তার সঞ্চরণশীল টুথব্রাশ।
অকস্মাৎ কি-যে হলো, কবুতরগুলি লহমায়
চৌদিকে ছড়িয়ে পড়ে কিসের ঝাপটায়,
কাকের চিৎকারে চিড় ধরে পরিবেশে;
দেখি, প্রতিবেশী ছাদে খাদ্যান্বেষী বানরের তুমুল দঙ্গল।
দালানের নিভৃত ফোকরে পায়রার গেরস্থালি
তছনছ, সাঁড়াশির মতো হাত ঢুকিয়ে বানর আনে ডিম,
খায় ক্ষিপ্ত ব্যস্ততায়। মনে হলো, আমার আহত কবিতাকে
গিলছে ক্ষুধার্ত কাল কী ব্যাপক লোভে!
কেড়ে নেবে ওরা
তোর কাছ থেকে কেড়ে নেবে ওরা এক এক করে
সকল পালক। অশ্বমেধের ঘোড়ার মতোই
দশদিক ঘুরে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবি তুই,
তখন সবাই দুয়ো দেবে তোকে। কেউ পদাঘাত
করবে হঠাৎ, কেউ ঘামে-ভেজা নমিত কেশর
লহমায় ছেঁটে তুড়ি মেড়ে ছুটে তারিফের বুড়ি
ছোঁবে আহ্বাদে আটখানা হয়ে। কেউবা হেলায়
তোর দিকে চোখ মেলে অবেলায় পর্ষদে পেশ
করবে নিখুঁত প্রস্তাব তার : ‘এ বোঝা হটাও,
কবরে নামাও; তাহলেই চুকেবুকে যাবে সব’।
এই নিগৃহীত মুখ বুজে তুই
মেনে নিবি আজ?
এর জন্যেই ঊষর জমিনে ফোটালি গোলাপ,
জুঁই ও চামেলি? করলি শূন্যে এত কারুকাজ?
পুষলি বুকের রক্ত ঝরিয়ে সুবচনী হাঁস
এর জন্যেই? তুখোড়, চতুর কতিপয় লোক
খাঁচায় বদ্ধ জন্তুর মতো খুঁচিয়ে বেড়ায়
অসহায় তোকে যখন তখন, খুব ঝলমল
আড্ডায় তোর নিন্দা রটায় নিভাঁজ রগড়ে,
তুই শুধু পড়ে থাকবি ধুলায়। আজ পথে কাঁটা,
কাল মুখ ফের ফুল চন্দন। থোড় বড়ি খাড়া,
খাড়া বাড়ি থোড়, অবিরাম এই পুনরাবৃত্তি।
গাঁওবুড়াদের মুখে
সে-কথা প্রথম শুনি গাঁওবুড়াদের
মুখে; তাঁরা গোধূলিতে পুকুরের পাড়ে বসে প্রবীণ গলায়
গাজী কালু চম্পাবতী পুঁথি সুরের
আমেজ মিশিয়ে বলেছিলেন সে-কথা, মনে পড়ে।
বালক বয়সে সবকিছু সহজে বিশ্বাসযোগ্য
হয়ে ওঠে তাই
ওদের সে-কথা শুনে তাকাতাম উত্তরের দিকে।
কেননা সেদিক থেকে তিনি আসবেন,
এ ধারণা তাদের কথায়
প্রশ্রয় পেয়েছে বারবার। বহুদিন
আমি হেঁটে চলে গেছি বহুদূরে উত্তর দিকের
নিশানা স্মরণে রেখে। অনেক পুরনো দীঘি, জামতলা আর
পাতা-ছাওয়া পথ পাড়ি দিয়ে
আবার এসেছি ফিরে, যদিও পাইনি দেখা তার,
যার কথা বলে
গাঁওবুড়াদের চোখ হতো স্বপ্নাকুল গোধূলিতে
অথবা সকালবেলা। কেউ কেউ থাকতেন খুব চুপচাপ
হুঁকো হাতে, কেউ কেউ খড়মের শব্দে তুলে যেতেন অন্দরে।
শহরেও শুনেছি সে-কথা কিছুকাল পরে; যারা
চাখানায় কিংবা আস্তাবলে
মারতেন সরস আড্ডা দিনরাত, তাদের ভেতর
কেউ কেউ গল্পচ্ছলে বলতেন তাঁর কথা, যিনি
আসবেন উত্তরে পথ বেয়ে। কেমন দেখতে তিনি আর
কীরকম পোশাক-আশাক
শোভা পাবে গায়ে তাঁর, এসব কিছুই
থাকত না সেই প্রিয় কিসসায় তাদের।
কিস্সাই বলব একে, যেহেতু আসার কথা যাঁর
তিনি তো আসেননি আজও, শুধু
কিছু কথা ভ্রমরের গুঞ্জরণ হয়ে ওষ্ঠে ওষ্ঠে
ঘোরে মাঝে-মাঝে, আমি আগেকার মতো
গভীর আগ্রহে আর শুনি না সে-কথা।
কখনো নিঃশব্দে হাসি, উদাস তাকাই কখনোবা,
চায়ের পেয়ালাটিকে ঠোঁটের নিকটে নিয়ে যাই।
আমার সংশয়ী মন যদিও এখন
উত্তরের দিকে আর নজর করে না, তবু কোনো কোনো দিন
কী-যে হয়, আমি তাঁর কথা ভাবি, আসবেন যিনি,
যিনি এদেশের মৃত্তিকার মতো, নদীর পানির মতো,
চৌরাহায় বিশাল বৃক্ষের মতো। আমি
গল্পের ভিতরে ধৈর্য ধরে আরেক কাহিনী খুঁজি।