উপোসী সন্তের মতো
হাতে আর তেমন সময় নেই, কী দ্রুত ফুরিয়ে
আসছে এবং আজকাল
সম্মুখে দেখার চেয়ে পেছনের দিকে
তাকাতেই বেশি ভালো লাগে। উঠোনের রোদ
চারাগাছ, লতাগুল্ম আর
দূর নীলিমায় মেঘে মেঘে বাল্যকাল লেগে থাকে।
কখনো নিজেকে দেখি আরশি নগরে
ঘুরি একা একা
পড়শির ব্যাকুল সন্ধানে।
হঠাৎ কখনো
গভীর ঔদাস্য নামে মনে বটের ঝুরির মতো
পড়ন্ত বেলার দিকে চেয়ে, কখনোবা
আকাঙ্ক্ষার রক্তজবা ফোটে পুনরায়
কিসের মোহন টানে। অনেক নারীর দুর্নিবার সম্মোহনে
সাজিয়েছি হৃদয়ের অর্ঘ্য বারবার,
তবু আজও প্রেমের কাঙাল আমি, নিঃসঙ্গ কাঙাল।
এখন প্রলয়াভাবে পৃথিবীর কোণে কোণে
ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে লুপ্তির অঙ্গার;
উপোসী সন্তের মতো তীব্র আকর্ষণে লাভাস্রোতে
ভেসে যেতে যেতে
বাড়াব যে-কোনো তরুণীর দিকে হাত,
যদি তার চোখে, শরীরের বাঁকে মঞ্জরিত হয় অনুরাগ।
একজোড়া চোখ
একজোড়া চোখ, জ্বলজ্বলে, প্রাচীন রত্নের মতো,
ভেসে এলো ঘরের ভেতরে। চক্ষুদ্বয়
আমার শরীরে সেঁটে থাকে দীর্ঘস্থায়ী
চুমোর ধরনে।
কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে খুব মৌন
সকল সময়; মনে হয়
আমার শয্যার পাশে বসবার অনুমতি চায়, হাত নেড়ে
ডাকলে চকিতে মিশে যায় বায়ুস্তরে।
একজোড়া চোখ পাখি হয়ে
লেখার টেবিলে বসে, ডানা ঝাপটায়; পালঙ্কের
ভাঁজ থেকে অতীত ছড়িয়ে পড়ে রাত্রির মেঝেতে
জুয়াড়ীর খুচরো পয়সার মতো। পাখি ওড়ে চোখের ভেতরে।
এখানে আমার জন্যে অপেক্ষায় ছিল যে কুকুর
তার লকলকে জিভ
আমার শরীর থেকে চেটে নিয়ে ক্লান্তি শুয়ে থাকে
দরজার কাছে, যেন সে অনন্তকালে পেয়েছে আশ্রয়।
কারো স্বপ্নে নেই জানি আমার নিবাস,
যে স্বপ্নে আমার ছায়া পড়ে তা নিমেষে ভেঙে যায়। মেঝে ফুঁড়ে
মাথা তোলে কালো গাছ, তার ছায়া থেকে ক’জন উন্মাদ ঢিল
ছোড়ে আর আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে একজোড়া চোখ।
একটি নিষিদ্ধ মীড়
একটি নিষিদ্ধ মীড় জেগে ওঠে বারবার রক্তের ভিতর,
ডেকে আনে নীল ময়ূরের
শোভা চিদাকাশে আর মোহান্ত বৃক্ষের
কাছে নিয়ে জপায় ফলের লোভনীয় বর্ণমায়া।
সে লোভ দমন করে বৈরাগ্যের গৈরিক ধুলোয়
পাখির ধরনের স্নান সেরে
চলে যাব কীর্তনীয়া আখড়ায়, তেমন ঔদাস্য
আজ অব্দি আয়ত্ত করিনি।
কী গুণ যাপিত মুহূর্তে, সে প্রসঙ্গ না টেনেও
সকালবেলার
অস্পষ্ট চাঁদের মতো কিছু স্মৃতি মনের কার্নিশে
ঝুলে থাকে এবং তুমিই স্মৃতি আজ।
মনে পড়ে, ছিলে দূরে, অত্যন্ত নেপথ্যে, বলা যায়।
কবিতা নিমেষে বড় অনাদৃত সেবাশ্রম থেকে তুলে এনে
তোমাকে আমার বাম পাশে।
বসিয়ে দিয়েছে।
বস্তুত তোমাকে স্বপ্ন-গোধূলিতে আলিঙ্গন করি, চুমু খাই
এবং তোমার হাত ধরে
বাগানে বেড়াই। শোনো, কখনো তোমাকে আমি বলি না মহিলা,
যা বলি কারো তা জানা নেই, তুমিও জানো না।
এখন তো মৃতরাই প্রশ্নশীল
আমি কি এপ্রিলে মুগ্ধাবেশে
তোমাকে রঙিন পোস্টকার্ড, বহুদূর শহরের ছবিঅলা,
পাঠিয়েছিলাম? আজ রাতে
কিছুতেই মনে পড়ছে না। কখনও তন্দ্রার মেঘ
আমার অস্তিত্বে ছেয়ে এলে,
বহু ছবি, মূলত অস্পষ্ট, ভেসে ওঠে এলোমেলো
মনের নানান স্তরে বিমিশ্র স্মৃতিতে।
একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই, আপাতত
ধারাবাহিকতা খুঁজে মেলা ভার। এই সেই মুহূর্ত যখন
একদা যা ঘটেছিল তার
হদিশ মেলে না আর যা ঘটেনি কোনো দিন,
তাকেই নিভাঁজ সত্য ঘটনার প্রতিবিম্ব মনে হয় বস্তুত আমার।
তোমার বাগানে আমি ছিলাম সে-রাতে
গোলাপ গাছের কাছে? আমি কি তোমাকে স্পর্শ করে
উচ্চারণ করেছি শপথ
নিসর্গের নামে, নক্ষত্রের নামে, হৃদয়ের নামে
সে-রাতে বাগানে উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে একাকী?
দেখেছি তোমার
বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে রুপালি পাখি চোখ
হয়ে গেঁথে গিয়েছিল আমার শরীরে? লহমায়
ফুরিয়েছে সে-প্রহর, গাড়িবারান্দায়
বিদায়ের ছায়াচ্ছন্ন ঠোঁটে জমেছিল
ক’ফোঁটা শিশির। নিসর্গের অন্তর্গত
ছিলে তুমি, ছিলে কোনো না-লেখা প্রেমের কবিতায়।
ছিল কি বাগান কোনো গোলাপে সাজানো? বাস্তবিক
ছিলে কি সেখানে তুমি সে-রাতে নবীনা? এক আমাকে বলে দেবে?
একদা জন্মেছি যে-শহরে তার হাড়-পাঁজরা সব
হয়েছে ঝাঁজরা হানাদারদের মর্টারের শেলে, শহরের
আনাচে-কানাচে
আজরাইলের তীক্ষ্ণ নখের আঁচড় অবিরত
পড়েছে ব্যাপক, এমনকি শহীদের করবেও বয়ে গেছে
বুলেটের ঝড়। চৌরাহায় মধ্যরাতে
নেকড়ের চিৎকারের মতো
দুরন্ত হাওয়ায়
হাতে তুলে নিয়েছি পতাকা বেদনার্ত মহিমায়
গুলিবিদ্ধ আমি, নিইনি কি?
আমার গলিতে যে-বালক খুব উঠেছিল বেড়ে
তমালের মতো, তাকে ওরা একাত্তরে
চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে কালো বধ্যভূমিতে এবং
যাকে আমি ফ্রক ছেড়ে শাড়ি প’রে হেমন্ত-বিকেলে
বারান্দায় দাঁড়াতে দেখেছি, সে তরুণী
হয়েছে ধর্ষিতা বারংবার
শক্রর শিবিরে আর আমাদের প্রেমও
হয়েছে ভীষণ গুলিবিদ্ধ কোজাগরী পূর্ণিমায়।
অনেকের স্মরণের ল্যান্ডস্কেপে নেই যেন আজ
কোনো বধ্যভূমি, লক্ষ লক্ষ খুলি, স্মৃতিসৌধ কোনো।
আমারও কি নেই? কে আমাকে বলে দেবে?
এখন তো মৃতরাই প্রশ্নশীল বড়।
এরকম কিছু
বাড়িটা সেকেলে, কিন্তু বাসিন্দারা একালের নব্য
সামাজিতায় ঝলমলে,
সান্ধ্য আসরের টানে অনেকেই আসে; গোলাপ ঠুমরী গায়,
শাণিত বুদ্ধির ঝলকানি লাগে কথোপকথনে।
সে ছিল নিঃশব্দে ব’সে এক কোণে তক্তপোশে, তার
রূপ রহস্যের মাতৃভাষা বলে; রত্নের ঝলক
ছিল চোখে, এ ঝলক
নিয়ে যায় বহুদূরে শতাব্দী পেরিয়ে কোনোখানে
দুর্গের দেয়াল-ঘেঁষা সিঁড়িতে এবং
দেখায় প্রাচীন হ্রদ রুশোর চিত্রের মতো রঙিন জঙ্গলে।
অনাবিল গণিতে উজ্জ্বলতা অত্যন্ত একাকী
খেলা করে তার মনের ভেতরে আর
কী এক শুদ্ধতা গান হয়ে
মনীষার আভায় জড়ায় তাকে। হয়তো এরকম
কাউকেই বলা যায়, ‘তোমারই উদ্দেশে
আমার প্রতীক্ষা চোখ বিছিয়ে রেখেছে শূন্য পথে আজীবন’।
মনে পড়ে, তাকে ঘিরে সামাজিক মধুমক্ষিকার
গুঞ্জরন ছিল সারাক্ষণ, দৃষ্টির লেহন ছিল, ছিল বটে
বিয়ারের ভরা গেলাসের মতো উপচানো
আবেগ বিভিন্ন কণ্ঠস্বরে। আমি শুধু দূর থেকে
সৌন্দর্য করেছি পান; আমার দু’চোখ নিরলস
পর্যটক তার শরীরের পাণ্ডুলিপিতে, আমার অভ্যন্তরে
সাময়িক ভালোবাসা বল্মীকের মতো গড়ে ওঠে।
রাত বাড়ে, রাতের গুহায় যেন শেয়ালের ঘ্রাণ জেগে থাকে,
কিছু উদ্ভিদের জিভ ক্রমাগত চাটে আমাকে এবং আমি
কাউকে কিছু না বলে গোয়েন্দা ভঙ্গিতে
নেমে যাই গহন রাস্তায় বড় একা। শিস দিয়ে
তাড়াই মনের বাঘ, আমার ব্যাকুল
অস্তিত্বের ঝোপঝাড়ে অবিরত ডেকে যায় অনিদ্র কোকিল।
কী যে তার নাম, কিছুতেই মনে পড়ে না এখন। সে সন্ধ্যায়
তার সঙ্গে বলেছি কি কোনো কথা? আমিও কি ঝানু
বাচালের মতো আচরণে তার একাকিত্বে খুব
ধরিয়ে ছিলাম চিড় ঠুকরে ঠুকরে? মনে
নেই, ওর দুটি
চোখ ছাড়া আজ আর কিছুই পড়ে না মনে। কোনো
ভনিতা না করে বলি, মনে হয় পুনরায় সেই দুটি চোখ
দেখার আশায় বেঁচে থাকি,
বেঁচে থাকি কলরবময় এই পৃথিবীতে আজও।
সত্যি মনে হয়; নাকি এরকম কিছু ভাবতেই ভালো লাগে?