আমার দুঃখের ভারে
বারবার ভিড়ের গিয়ে প্রতিহত
ফিরে আসি, নত
মুখে গৃহ প্রবেশের অনুমতি চাই
নৈঃসঙ্গের কাছে; সকলেই করে নিরিখ, যাচাই-
পাঠায় আমাকে লখিন্দরের বাসরে,
যত বলি ঠাঁই দাও তোমাদের ঘরে,
ওরা তত সরে যেতে থাকে;
আমি ঘুরি একাকী মান্দাসে স্বত্বহীন বাঁকে বাঁকে।
ভর সন্ধ্যায় ফিরি জতুগৃহে, খর
নদী বয় মনের অতল নিচে, আমাকে জর্জর
করছে স্মৃতির কাঁকড়াবিছে, দোটানায় ভাবি-
কারুর কাছেই কোনো দাবি
করা ঠিক নয় আর। বিনাশ্রয়ে যাবে
দিন যাক; ক্ষতি নেই। আপাতত মারাত্মকভাবে
ছেঁটে ফেলা নিসর্গের কাছাকাছি
ষড়জে নিখাদে বাঁচি।
যখন আমার প্রতি ভীষণ দন্তুর শত আক্রমণ তেড়ে
আসে, নিজ ভূমি ছেড়ে
যাই না; খরিদ করি অতি দীনবেশে
ফুল ও চন্দন আমি তাদের উদ্দেশে,
যারা ক্ষিপ্র আমাকে পাঠাতে চায় পাতালে, রৌরবে।
হৃদয় আচ্ছন্ন হয় বিবাগী সৌরভে,
প্রত্যাখ্যানে জতুগৃহে মিশে থাকে কৌশিক কানাড়া;
আমার দুঃখের ভারে নত হয় শুধু পড়শি ফুলের চারা।
আমার মৃত্যুর পরেও যদি
একটি পাখি রোজ আমার জানালায়
আস্তে এসে বসে, তাকায় আশেপাশে।
কখনো দেয় শিস্, বাড়ায় গলা তার;
আবার কখনোবা পাখাটা ঝাপটায়।
পালকে তার আঁকা কিসের ছবি যেন,
দু’চোখে আছে জমা মেঘের স্মৃতি কিছু;
নদীর স্বপ্নের জলজ কণাগুলি
এখনও তার ঠোঁটে হয়তো গচ্ছিত।
কাউকে নীড়ে তার এসেছে ফেলে বুঝি?
হয়তো নেই নীড়, আকাশই আস্তানা।
তাই তো চোখ তার এমন গাঢ় নীল,
মেললে পাখা জাগে নীলের উৎসব।
যখন লিখি আমি টেবিলে ঝুঁকে আর
পড়তে বসি বই, তখন সেই পাখি
চকিতে দোল খায় আমার জানালায়-
খাতার পাতা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় খুশি।
আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।
আমি এক ভদ্রলোককে
আমি এক ভদ্রলোককে রোজ
দেখি। তিনি কখনো বসে থাকেন চুপচাপ
কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে, কখনো বারান্দায়
দাঁড়িয়ে কয়েকটি জালালী কবুতরের
আসা-যাওয়া দেখেন,
কখনোবা থাকেন ঘুমিয়ে।
এই যে ভদ্রলোককে দেখি, দেখে আসছি
দীর্ঘকাল থেকে, এর মধ্যে সত্যি বলতে কি
কোনো ঝলমলে
চমৎকারিত্ব নেই।যদি তাকে না দেখতাম,
তাহলে
ক্ষতির বান ডাকত বলে মনে হয় না।
ভদ্রলোক কী করেন,
কেমন করে তার সংসার চলে কিংবা
আদৌ তার কোনো সংসার আছে কিনা, এ বিষয়ে
আজ অব্দি আমি কোনো চড়ুই-চঞ্চল
ঔৎসুক্য দেখাইনি। তবে এই ভদ্রলোকটিকে নিয়ে
আমি যে একেবারেই
মাথা ঘামাইনি, এমন নয়। এমনও হয়েছে
ভদ্রলোকের কথা ভাবতে গিয়ে
তার মুখের রেখাগুলিকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।
আর যে কথাটা বলতে গিয়েও
এখনও বলা হয়নি তার সারাৎসার হলো
ভদ্রলোককে দেখলে
আমার ভারি ভয় হয়। তিনি যখন হাওয়ার দিকে
মুখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকেন, অথবা
হাতে তুলে নেন রক্তজবা, তখন আমি ভয় পাই।
কেন এই ভয়, এই প্রশ্নের
কোনো সদত্তর আমার জানা নেই।
তাকে আমি কোনোদিন কোনো মাহফিলে,
গানের জলসায় দেখিনি। কখনো
সানাই-গুঞ্জরিত বিবাহ মন্ডপে কিংবা
কোনো শবানুগমনে তিনি শামিল হয়েছেন বলে মনে পড়ে না।
একদিন চোখে পড়ল,
রোজ যেখানে
ভদ্রলোককে ব’সে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম,
সেই নির্দিষ্ট জায়গাটা ভীষণ সান্নাটা এবং
ধৃতরাষ্ট্র শূন্যতা আলিঙ্গন করল আমাকে।
এতদিন ভাবতাম, সেখানে সেই ভদ্রলোককে।
দেখতে না পেলেই
আমার ভয় কেটে যাবে। অথচ এখন
কাকতাড়ুয়ার মতো ভয় আরও বেশি ভয়
দেখাতে শুরু করল আমাকে, আমার নিজেরই জন্যে।
ইন্দ্রাণীর খাতা
(নরেশ গুহ বন্ধু বরেষু)
একে একে অতিথিরা বিদায় নিলেন। অকস্মাৎ
মঞ্চ থেকে সব আলো নিভে গেলে, নাটকের কুশীলব আর
দর্শক প্রস্থান করলে যে স্তব্ধতা নামে
যবনিকা পতনের পর, সেরকম
স্তব্ধতা আমার ঘরে প্রতিষ্ঠিত রাত বারোটায়।
শেয়ালের মুখের রোঁয়ার মতো কিছু
চোখে মুখে লাগে
এবং শিশিরভেজা ঘাসের কিরীচ স্পর্শ করে
অনিদ্রাকে। অবসাদ নাভিমূলে পদ্ম-রচনার অছিলায়
আমাকে চকিতে ঠেলে দ্যায় অন্তহীন, কানা গলির ভেতর।
কিশের আঁশটে গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে,
খাবারের প্লেটগুলি আগেই সরানো হয়ে গেছে
কিচেনে। খানিক বাদে
সেডাকশান খেয়ে গৃহিণী গেলেন শুতে,
একা বসে থাকি বারান্দায়। হঠাৎ কে নাড়ে করা
এত রাতে? ঝুঁকে দেখি একটি তরুণী
দরজায় একাকিনী, সাততাড়াতাড়ি
তাকে এনে বসালাম পাশের চেয়ারে। দেখে চেনা
মনে হলো, অথচ সঠিক
কোথায় দেখেছি তাকে এর আগে, মনে পড়ছে না।
অগাধ সৌন্দর্যে তার লেপ্টে আছে অতীতের আভা
তন্বী গাছে ডুক্রে-ওঠা কোজাগবী পূর্ণিমার মতো।
ক্যাসেট প্লেয়ারে
দরবারি কানাড়া গুমরে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, আমি
অপলক চেয়ে থাকি তার দিকে, পেটরোগা মানুষ যেমন
তাকায় থালায় রাখা জ্বলজ্বলে সুখাদ্যের প্রতি।
‘ভীষণ অবাক হয়ে গেছেন, তাই না? মধ্যরাতে
কে যেন সেতারে টোকা দিল। যদি বলতাম তাকে
বিস্ময়ের ঝালর কাঁপেনি
মনের ভেতরে এতটুকু, তবে ভুল বলা হতো।
‘ইন্দ্রাণীকে মনে নেই? এই প্রশ্ন আমার দৃষ্টিকে এ রাতের
অতিথির শরীরের অপরূপ রত্নদ্বীপ থেকে
চকিতে সরিয়ে আনে। কী করে ভুলব তাকে, মানে
ইন্দ্রাণীকে? তিপ্পানোর সাহিত্য মেলায়, মনে পড়ে,
গোধূলি বেলায় স্মিত হেসে
ইন্দ্রাণী একটি খাতা, সুখ-স্বপ্নের মতো আশ্চর্য সোনালি,
দিয়েছিল একজন বিশুদ্ধ কবিকে। আমি শুধু
দূর থেকে কাঙালের ধরনে দেখেছি সে অর্পণ। তারপর
হেঁটে চলে গেছি একা, বড় একা খোয়াইয়ের তীরে
ভাসাতে আমার হৃদয়ের কীটদষ্ট কিছু ফুল।
এতকাল পরে ফের কী ভেবে ইন্দাণী
আজ ব্রহ্মচারিণীর ধরনে এসেছে এ শহরে সঙ্গে নিয়ে বীরভূমের
একরাশ শিমুল,পলাশ? প্রত্যাশায়
রক্তে বাজে সরোদের বোল,
আমি তাকে রুদ্রাক্ষের মালা খুলে নিতে
মিনতি জানাই, অথচ সে নিরাসক্ত কণ্ঠস্বরে তুলে নিয়ে
তিপ্পনোর রেশ বলে, ‘আনিনি সোনালি খাতা, শুধু
আপনাকে দেখতে এসেছি’।