- বইয়ের নামঃ ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনেকদিন থেকেই
অনেকদিন থেকেই ভাবছি একটা কিছু তাড়াতাড়ি
অদলবদল হওয়া চাই, অথচ এটাও জানি তাড়াহুড়ো
মানে খুব পাকাপোক্ত বাড়ি
বানানোর পুরো
পরিকল্পনায় খুঁত রেখে দেওয়া। তাছাড়া ব্যাপার
হলো এই : এ তো জামা নয়,
অথবা র্যায়পার
তা-ও নয় যে ইচ্ছে হলেই বিন্দুমাত্র কালক্ষয়
না করে পালটিয়ে ফেলা যাবে
ঋতুর চাহিদা মেনে, প্রচলিত রুচির প্রভাবে।
অন্ধকারে মাথা গুঁজে যে ফুল ফোটাচ্ছে, আমি তার
ফুলে ঘ্রাণ পেতে গিয়ে বস্তুত কেবলি
প্রতিহত হই আর
যে ভাবছে আঁধারকে ব্যর্থ করে দিয়ে তারাঞ্জলি
সাজাচ্ছে নিপুণ মুদ্রা এ’কে শূন্যতায়,-
আমি তার অঞ্জলিতে একরাশ রাংতার চকমকি দেখে
লজ্জানত ফিরে যাই। মুগ্ধাবেশে যে বাঁশি বাজায়
ক্রমাগত প্রকৃত নিজস্ব কোনো সুর ব্যতিরেকে,
কী করে বোঝাই তাকে একটা কিছু অদলবদল হওয়া চাই
এক্ষুণি? নইলে ধু-ধু দশদিকে উড়বে শুধু শ্মশানের ছাই।
আমি একটু ভিন্ন ধরনের ফুল ফোটানোর আশা
জ্বেলে প্রতীক্ষায় থাকি। চরাচরে প্রকৃতই তারা
নিমেষে উঠবে জ্বলে, এরকম ভাষা
নিয়ত প্রার্থনা করি। প্রতিদিন উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমার দোতারা
বাজাবে আলাদা সুর, আনবে নিকটে
ডেকে বন্য পশুপাখি নুড়ি ও পাথর
করি দাবি; কত কিছু ঘটে-
শূন্যতায় করে ভর অলৌকিক ঘর।
যেখানে ছিলাম ঠিক সেখানে আছি,
যে রকম শুনেছি বিখ্যাত গল্পে মাঝি
গাছে বেঁধে কাছি
সারারাত দাঁড় টেনে গেছে অবিরত
তাহলে কি আজই
শুরু করতে হবে ফের প্রাথমিক বিদ্যার্থীর মতো?
পুরনো গয়নাগাটি খর নদীতে গচ্ছিত রেখে
যে-নারী নির্ভার হেঁটে যায় দেখি তার কাছ থেকে
কতটুকু শিখে নিতে পারি।
পারব কি? আমার বুকের মধ্যে আছে চিরনারী!
আপস
প্রতিদিন উদয়াস্ত খুঁজি আমি তাকে,
অন্তর্গত নিভৃত সত্তাকে,
যার মধ্যে পাঁচ জন ঘুমায় সতত
যুগ যুগ ধরে
অবচেতনের স্তরে স্তরে
আসহাবে কাহাফের মতো।
বস্তুত স্বরূপে খুঁজি
অস্তিত্বের প্রকৃত ঠিকুজি।
একদা কৈশোরে আমি গোল্লাছুট আর ফুটবলে
হুল্লোড়ে ছিলাম মেতে বিকেলের মাঠে
হাস্যময় ছেলেদের দলে।
একদিন দ্বিপ্রহরে খেলাচ্ছলে এক ডাকাবুকো
কিশোর একটি পাখি করল শিকার
ঢিল ছুড়ে। তারপর থেকে আর
তার ঘরমুখো
হইনি কখনো আমি। আমাদের সখ্য গেল পাটে।
সেকালের কিশোরেরা বস্তুত এখন
নানাভাবে করে নিত্য
জীবনযাপন।
কেউ বেশুমার বিত্ত
হেলায় করছে জড়ো বাণিজ্যের অশ্বমেধে, কেউবা অকালে
বার্ধক্যের শীর্ণ ডালে
ঝোলে, কেউ কেউ দশটা-পাঁচটা করে রোজ,
মাছি মারে লেজারের পাতায় পাতায়,
কেউবা হাতায়
গৌরী সেনী টাকা, কেউ হয়েছে নিখোঁজ
সেই কবে
আসমানী অলীক বৈভবে
মেতে, কারো কারো পেনশন
শুরু হলো বলে; ওরে মন,
প্রৌঢ় মন, এ এক বিস্ময়-
আমারও খুনির সঙ্গে আজ হাত মেলাতেই হয়।
আমার অজ্ঞতা নিয়ে
এখন মাঝরাস্তায় আমি; দমবন্ধ-করা নিঃসঙ্গতা
একটা মাকড়সার মতো হাঁটছে
আমার চোখে, গালে, কণ্ঠনালিতে,
বুকে, ঊরুতে আর
বেদেনীর ভলা যৌবন হয়ে
অন্ধকারের জোয়ার খলখলিয়ে উঠেছে আমার চারপাশে।
অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয়
এখানে কোথাও তুমি আছ, ডাকলেই
সাড়া দেবে নিমেষে। তলোয়ার মাছের মতো তোমার কণ্ঠস্বর
ঝলসে উঠবে অন্ধকারে।
কণ্ঠে সমস্ত নির্ভরতা পুরে তোমাকে ডাকলাম,
শুধু ভেসে এলো আমার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি।
অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলেছি, যদি হঠাৎ
তোমার দেখা পেয়ে যাই।
ভেবেছি আমার দিকে প্রসারিত হবে
অলৌকিক বৃক্ষশাখার মতো তোমার হাত।
কতকাল প্রতীক্ষাকাতর আমি
তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে, কত পাথর আর কাঁটাময়
পথ পেরিয়েছি তোমাকে একটিবার
দেখব বলে। অথচ আমার সকল প্রতীক্ষা
আর ব্যাকুলতাকে বারংবার উপহাস করেছে
তোমার নীরব অনুপস্থিতি।
অন্ধকারে আমি দু’হাতে আঁকড়ে রেখেছি
একটি আয়না, যাতে দেখতে পাই
তোমার মুখের ছায়া। কিন্তু আয়নায় পড়ে না
কোনো ছায়া, লাগে না নিঃশ্বাসের দাগ।
এখানে কোথাও তুমি আছ, কখনোসখনো এই বিশ্বাস
আমাকে বাঁচায়
অক্টোপাস-বিভ্রান্তি থেকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস নিয়ে
আমি কী করব যা সমর্থিত নয়
জ্ঞানের জ্যোতিশ্চক্রে? উৎপীড়িত মুতাজিলা-মন
আমাকে নিয়ে গেছে সংশয়ের সৈকতে। নুড়ি কুড়াতে কুড়াতে
জেনেছি জ্ঞান আমার উদ্ধার; তারই অন্বেষণে
স্বৈরিণীর মতো অন্ধকার
উজিয়ে চলেছি। এ জন্যে যদি তোমাকে খোঁজার সাধ
মুছে যায় কোনো রাগী পাখির পাখার ঝাপটে,
আমি প্রতিবাদহীন পা চালিয়ে চলে যাব
জ্ঞানের বলয়ে আমার অজ্ঞতা নিয়ে।
আমার অভিযোগের তর্জনী
আমার অভিযোগের তর্জনী এখন তোমার দিকেই
উদ্যত। নিঃসঙ্গতা
জ্বলজ্বলে মণিহারের বদলে লোহার শেকল হয়ে উঠলেই
উত্তুঙ্গ চূড়া ছেড়ে নিচে
নেমে আসতে হবে, এ-কথা
কে বলেছিল তোমাকে? কেন তুমি
প্রাচীন ইরানি চিত্রকরের
ছবির মতো পাখার বৈভব আর চঞ্চুর কিরীচে
স্বপ্নের সওগাত গেঁথে এই নচ্ছার মৃত্যুমাখা
ভাগাড়ে নেমে এসেছিলে?
তোমার পাখায় ছিল নীলমণির মতো আকাশের
নিঃসীম উল্লাস, চারণ কবির
মেঠো গাথার মতো বন্দনা-মুখর সহজ সৌন্দর্য,
আর সুকণ্ঠ মুয়াজ্জিনের আজানের মতো অনাবিল আহ্বান।
তোমার চোখে আশ্রয় পেয়েছিল
সেই বিল্পবীর অন্বেষা, যে তার চিরকালীন ঘর ছেড়ে
ঘুরে বেড়ায় পথে পথে ভ্রষ্ট পথিকদের
অভীষ্ট উদ্যানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
তোমার এই নিরুপম ঐশ্বর্য ভীষণ বেমানান
এখানে, এখন এ-কথা
তোমার বুঝতে বাকি নেই নিশ্চয়। মড়াখেকেদের ভিড়ে
কী গান গাইবে তুমি? ইতিমধ্যেই কি আবর্জনায়
রুদ্ধ হয়ে আসেনি তোমার কণ্ঠনালি?
তোমার হৃৎপিণ্ড কি বেরিয়ে আসতে চাইছে না
এক দুঃসহ চাপে,
যার উৎস দুর্বিনীতের আস্ফালন, নির্বোধের ক্রোধ?
ইচ্ছে হলেই এখন তুমি তোমার চিত্রিত পাখা মেলে
ফিরে যেতে পারবে না দূরের আকাশে,
যেখানে তুমি সাঁতার কাটতে পারো স্বচ্ছন্দে নানা রঙের
মেঘের রেণু ওড়াতে ওড়াতে।
যেখানে পবিত্রতার মতো শূন্যতা ছড়িয়ে আছে
তবকে তবকে। বস্তুত এই মুহূর্তে তোমার
পাখা দুটোকে ছন্দিল করে তোলার
কোন উপায় নেই। কেননা তোমার পদদ্বয়
আর পাখা শোচনীয়ভাবে আটকে গিয়েছে
রাশি রাশি তারের মতো নাড়িভুঁড়িতে।
আস্তে আস্তে চতুর্দিকে থেকে এগিয়ে আসছে
শেয়াল কুকুরে পাল,
আর তোমার বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকার,
যেমন কোন শহরে চড়াও হয় দখলদার সেনাবাহিনী।
এক্ষুণি ওরা ঘিরে ধরবে তোমাকে। এই আগ্রাসী
ব্যূহ ভেদ করবার সাধ্য তোমার নেই।
তোমার একদিকে মাথা-ডোবানো গলিজ জঞ্জাল,
অন্যদিকে ক্ষমাহীন শক্রতা। বলো, হে স্বপ্নলালিত সৌন্দর্য
কোথায় পালাবে তুমি? কোথায়
তোমার পরিত্রাণ?
আমি দেখতে পাচ্ছি
ডানদিকে শোকের মতো ছড়ানো
তোমার ছেঁড়া-খোঁড়া যাবতীয় পালক, বাঁয়ে
গড়াগড়ি যাচ্ছে তোমার মুন্ড আর তখনও-স্পন্দিত
হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ শেয়ালের দাঁতে আর
নিষ্পত্র গাছে বসে হাসছে কতিপয় শকুন।
শ্মশানের ঠা ঠা রৌদ্রের মতো সেই অট্রহাসি
ব্যাপ্ত হলো দিগন্ত থেকে দিগন্তে
এবং আমার অভিযোগের তর্জনী এখন তোমার
ধ্বংসাবশেষের দিকে উদ্যত। কে তোমাকে
উদার আকাশের মেঘমালার সঙ্গ ছেড়ে,
পর্বতচূড়ার সখ্য ছেড়ে
এই ভাগাড়ে নেমে আসতে বলেছিল?