মগজে গোধূলি আর হাড়ে রঙিন কুয়াশা
মগজে গোধূলি আর রঙিন কুয়াশা নিয়ে
মলিন চপ্পল পায়ে ফিরে আসি। অন্ধকার ঘরে
(ইদানীং লোড-শেডিং-এর
পেখম ছড়িয়ে পড়ে যখন তখন)
কল্পনায় তোমার সম্ভ্রান্ত মরীচিকা হ’য়ে
আমাকে ভীষণ
লোভাতুর ক’রে তোলে। কিছুক্ষণ পায়চারি ক’রে
সময় কাটিয়ে দিই, আকাশ পাতাল
ভাবি, মনে পড়ে যায় ডিগ্রির সোহাগে
লালিত যৌবন
জনকের সরাই খানায়
কেটেছে একদা কর্মখালি
বিজ্ঞাপন প’ড়ে, মনে পড়ে বলীরেখাময় বয়েসী পিতার
অত্যন্ত বিকৃত মুখ ধিক্কারের ঝড়ে, একা একা
গৃহকোণে জননীর অশ্রুপাত, উদাসীন আমি
তোমারই রূপের ধ্যানে কাটিয়েছি রভসে প্রহর।
এখন গোঙাই শুধু, দুর্বহ বোঝার ভারে পিঠ
বেঁকে আসে; ছা-পোষা জীবনে
বয়ে যায় কবরখানার
বাতাসের মতো দীর্ঘশ্বাস। তুমি যাকে একদা লিখেছো চিঠি
রঙিন কাগজে তাকে আজ এই বিবর্ণ প্রহরে
দেখলে হারিয়ে-যাওয়া প্রেত ভেবে সুনিশ্চিত
দূরে সরে যাবে ভয়ে। তাকে
সারাক্ষণ ঠোকরায় কালবেলা, সঙ্গ দেয় নিঃসঙ্গ বেড়াল;
অসুস্থতা কেবলি জাগিয়ে রাখে তাকে। মাঝে-মাঝে
তোমার সুদূর মুখ নুয়ে আসে মুখের ওপর।
জীর্ণ ঘরে শুয়ে ভাবি
বাবুই পাখির বাসা, অতিদূর শৈশবের সাঁকো,
তোমার নরম হাত কবেকার, আর সেই মানুষটি যার
পকেটে থাকতো টিয়ে পাখি, গাঢ় সবুজ রঙের
পানিফল, স্তব্ধতাকে ভাই ব’লে ডাকতো সে, পাখির ঝাঁকের
ভেতরেই ছিল তার আপন নিবাস।
অপেক্ষা করেছি, কিন্তু আসে নি এমন লগ্ন যার
স্পর্শে বিজ্ঞ হয়ে ওঠে ঘরের দেয়াল, লহমায় গান গায়
আমার ভেতরকার হাড়,
বেলকুঁড়ি হয়ে যায় দূরের চাতক, কুয়াশায়
মাঠ দিয়ে একাকী চাষির মতো হাঁটে,
কুড়ায় ফ্যাকাশে ফল বনের কিনারে নিরিবিলি
ধৈর্যশীল চাঁদ। মাঝে-মধ্যে
আমার পায়ের পাতা হেসে আমাকেই প্রশ্ন করে-
ক’দিন থাকবে আর? আমি শুধু বোকার ধরনে
পায়ের পাতার দিকে চেয়ে থাকি, কিছুতে পাই না
খুঁজে কোনো কথা,
অপেক্ষায় থাকি কোন্ অজ্ঞাত প্রহরে
দাঁতে বিঁধে নিয়ে যাবে আমাকে চকিতে
দ্বিতীয়ার চাঁদ।
রাজা, তুমি
রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
ছিটিয়ে বিস্তর থুতু নিমেষে করেছো নোংরা মোজেইক-করা
মেঝে বারবার, সেই থুতু
তোমার পোশাকে পড়ে মাঝে-মাঝে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ
নেই মোটে, অলিন্দে অলিন্দে
ছোটে শত আমাত্য, নোকর, ভাবে কী ক’রে তোমার
ক্রোধের আগুনে ওরা ঢালবে শীতল জলধারা।
রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
পাঠিয়ে দিয়েছো
তোমার মহল থেকে বাছা বাছা ডালকুত্তাদের,
বৈশাখী ঝড়ের মতো তেড়ে ওরা আসছে আমাকে
ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে পলকে,
যেমন উন্মাদ ফালি ফালি করে ফেলে
জামা কোনো দুঃস্বপ্ন-তাড়িত ক্রোধে। অথচ আমার
কাছে এসে সেই রক্তপিপাসু জন্তুরা
ভেড়ার ধরনে ঘোরে ইতস্তত, করে না কিছুই।
রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
পাঠিয়ে দিয়েছো
ভাড়া-করা তোমার তুখোড়, টগবগে
তলোয়ারবাজদের। চকিতে তাদের অসিধার
ব্রতে ধরে চিড়, ওরা অস্ত্র সমর্পন করে। অথচ আমার
অস্ত্র নেই কোনো, শুধু রাজহংসের পালকে তৈরি
একটি কলম আছে যার
ওপরে রাক্ষস নয়, দেবদূত করে ভর মায়াবী প্রহরে।
রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
পাঠিয়ে দিয়েছো ছদ্মবেশী জ্ঞানী-গুণীদের যারা
আমাকে সবক দিয়ে তোমার সাধের
বাগান বাড়িতে নিয়ে যেতে
এসেছেন, যাতে আমি বুঁদ হয়ে তোমার পায়ের কাছে
হামাগুড়ি দিই কিংবা কুঁই কুঁই করি সারাক্ষণ।
কিন্তু রাজা, আমি
কস্মিনকালেও সেই বাগান বাড়িতে
যাবো না অথবা মোজেইক-করা তোমার মেঝেতে
কুকুরের মতো গড়াগড়ি
দেবো না নিশ্চিত। আমি মাথা উঁচু ক’রে
দাঁড়াবো তোমার মুখোমুখি। দ্বৈরথে শরিক হতে আসবোই।
শেষ উপদেশ
(রফিক আজাদ প্রীতিভাজেনষু)
বলতো অমন ক’রে কেন তাকাচ্ছিস বারবার
আমার এখনকার দিকে? না, যা ভাবছিস
তা নয় মোটেই; সেই সোনালি তরল
আগুনের একটি ফোঁটাও
নামে নি আমার কণ্ঠনালি বেয়ে, না ওসব ঝুট
ঝামেলা এখন নেই। ভিন্ন এক মদ, ভয় বলা যায় তাকে,
প্রহরে প্রহরে
আমাকে মাতাল ক’রে রেখেছে সম্প্রতি।
মনে পড়ে, প্রথম যেদিন আমি সদ্য-কিনে-আনা
দোলনায় তোকে ফাইয়াজ
দুলিয়েছিলাম শরতের অপরাহ্নে ঘরের ভেতরকার
স্বর্ণাভায়, মনে হয়েছিল
দোলাচ্ছি ছড়ার ছন্দে আমার নিজের শৈশবকে। আর আজ
সমস্ত জীবনটাই দুলছে ভীষণ;
ইচ্ছে হয় সমুখে যা পাই তা-ই ধ’রে একটু সামলে নিই,
ইদানীং তোর দাদাজানের লাঠিটা, মজবুত নকশাদার,
বড় বেশি স্বপ্নে দেখি আর
অন্ধকারে তোর হাত খুঁজি কী ব্যাকুল।
এখন তুষার-ঢাকা জঙ্গলের মতো মাথা নিয়ে
বেঁচে আছি। বসন্তকালীন
শহুরে সুন্দরীদের আনাগোনা কমেছে, এখন
আমাকে এড়িয়ে চলে ওরা, ভাবে আমি যেন
সমাধি ফলক এক, যার গায়ে শুকনো পাতা ঝরে,
ঘাস চুমো খায়, হাওয়া।
বয়ে যায়। ফলত আশ্বস্ত তোর খুব ঈর্ষাকাতর জননী,
না কি এই ভাঁটার টানেও
গোপন বিদ্রোহী পূর্ণিমায় জোয়ারের আশঙ্কায়
পদ্মার ভাঙন জাগে তার জীবনের
নিদারুন মোহনায়।অমন ধারালো দৃষ্টি প্রত্যাহার কর।
তুই কি এখন দেখছিস খোকা আমি যা দেখছি?
শুনছিস অবিকল আমি যা শুনছি? কণ্ঠে তোর
মানুষের বোধ্য কোনে কথা
মঞ্জরিত হলে কি এখন? ওরে শোন,
আমাদের শহরকে করেছে রাহুর মতো গ্রাস
ভয়াবহু মহামারী এক; এ শহরে যত লোক
চোখে দ্যাখে, কানে শোনে আর কথা বলতে সক্ষম,
তাদের আঙ্গুলে গোনা যায়।
মদ্যপের বমির মতোই উপদেশ
উগরে দিয়েছি আমি তোর প্রতি অবেলায়। কিছু তার
কানে গেছে তোর, হয়তো মর্মমূলে বিঁধেছে কোনোটা,
সিংহভাগই পেয়েছে উপেক্ষা। কিন্তু খোকা
আমার মিনতি রাখ, আজকের এই উপদেশ
আমার ব্যর্থ না হয় যেন।
আমার শ্রবণশক্তি ত্যাগ করে গেছে
আমাকে দৃষ্টিও অস্তমিত, বলা যায়;
আমার বেবাক কথা কেবলি জড়িয়ে যাচ্ছে ওরে
পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের মতো। এখনো সময় আছে,
এখনি তুই যা একমাত্র
হে পুত্র আমার, অভিশপ্ত এ শহর থেকে দূরে, বহুদূরে
পালিয়ে যা। নাকি তুই আজো
থাকবি কামড়ে মাটি এখানেই, যেমন উদ্ভান্ত
যুবা থাকে তার পূর্বপুরুষের কবরখানায়,
ঘোরে আশেপাশে, বিড় বিড় ক’রে কাহিনী শোনায়
বিস্মৃত প্রেতের মতো, কিছুই দ্যাখে না নিজে কিংবা ঠারে ঠোরে
কারুকে দেখাতে কিছু পারে না কখনো।