- বইয়ের নামঃ দুঃসময়ে মুখোমুখি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অতিবর্ষণের পর
অতিবর্ষণের পর ঝলসিত রৌদ্রের স্লোগান
অন্ধকারে টর্চলাইটের মতো। মগ্নতায় দেখি,
হৃদয়ের উঠোনে চন্দনা খাচ্ছে খুঁটে খাদ্যকণা।
আকাশ-গড়ানো রোদ ভালো লাগে, চক্ষুস্থিত আভা
বাতাসে উড্ডীন পায়রার ঝলসানি দেখে আরও
দীপ্তিময় হয়। প্রতিবেশীর কলহ, আপিসের
খাটুনি, গ্রেডের মোহ, খিস্তি, কম্বোডিয়া,
মধ্যপ্রাচ্য, প্রাথমিক শিক্ষককুলের কিছু মুখ,
দুর্ভিক্ষ-শাসিত মুখ, আমার নিজের ছেঁড়া জুতো,
মুদির দোকানে খ্যাঁচামেচি, বাজারের ফর্দ, ভিড়,
বীমার প্রাণান্তকর কিস্তি কেমন তলিয়ে যায়
অদূর পায়রাময় বাতাসের স্নিগ্ধ স্বর শুনে
ভাগ্যিস কয়েক দিন একঘেয়ে বর্ষণের পর
আবার উঠেছে রোদ খিলখিলিয়ে, আকাশের নীল
ব্যানারে কী যেন দেখে চক্ষুদ্বয় প্রীত, হৃদয় তো
প্রজাপতি হতে চায়, মধ্যবিত্ত ছা-পোষা মানস
চায় না বিরোধ কোনো, হাঙ্গামা-হুজ্জতি চক্ষুশূল।
বাজারের থলি হাতে পথ চলি শাক মাছ কিনে
বাড়ি ফিরি, রেশনের লাইনে দাঁড়াই, কখনোবা
ছেলেমেয়েদের ফাঁকি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে সিনেমায়
যাই, রেস্তোরাঁয় খাই। অতিবর্ষণের পর রোদ
কিংবা নীল দেখে মধ্যে মধ্যে খুবই আহ্লাদিত হই।
কখনো চাইনে যুদ্ধ, শবগন্ধময় জনপদ
বিভীষিকা অতিশয়, শ্মশানে নিবাস চায় কেউ?
ব্যাকুল প্রার্থনা করি, পৃথিবীর সব অস্ত্রাগার
কোমল উদ্যান হোক, বোমারু বিমান পারাবত।
অনাবৃষ্টি
আকাশ ভীষণ খাঁ-খাঁ, একরত্তি মেঘ নেই, শুধু
তরল আগুন গ’লে পড়ছে চৌদিকে। এই ধু-ধু
আকাশের দিকে চোখ রাখা দায়। হঠাৎ কখনো
জমে মেঘ; মনে হয়, হয়তোবা বৃষ্টি হবে ঘন,
হৃদয়-ডোবানো বৃষ্টি। কোত্থেকে ডাকাত এসে সব
কালো মেঘ লুট করে নিয়ে যায়; দিগন্ত নীরব।
উঠোনে সজিনা গাছ রৌদ্রাক্রান্ত, আকাশ আবার
বড় খাঁ-খাঁ, দেয়ালে হাঁপায় কাক। বন্ধ্যা রুক্ষতার
অট্রহাসি; এখন আকাশে যদি কোনো গাছ ফুল
ঝরাত অজস্র, ধরো, জুঁই, বেলী, টগর, বকুল্ল
কিংবা কিছু মনোহারি হরিণ করত ছুটোছুটি
তা হলে ঝাঁঝালো রোদে অন্তত জুড়োত চোখ দুটি।
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি-খাতার পাতায় যদি জড়ো
হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল্ল বৃষ্টি। অলস পেনসিল
হাতে, বকমার্কা। পাতা-জোড়া আকাশের খাঁ-খাঁ নীল।
অনিদ্রা
ঘুম,
যেন মা দিলেন ডাক আদুরে মাদুরে,
ঘুম, পিতা দিলেন বুলিয়ে মাথা অলীক আঙুলে।
ঘুম, কারো সুরভিত কালো চুলে চোখ মুখ একান্ত ডোবানো,
ঘুম, গাঢ় গোধূলির থিরথিরে হ্রদ,
ঘুম,
জলজ উদ্ভিদ যেন, ভুল অনন্তের ধু-ধু দিকে ভাসমান।
ঘুরে দেয়ালে মানিপ্ল্যান্ট, উচ্ছ্বসিত রঙিন পাখির
মাতাল ভ্রমণ;
ঘুমের দেয়ালে ডাক-পিয়নের নীল হলদে খাম বিলি,
নিরিবিলি ঘরে ফেরা, কৃপণ উঠোনে
পা রেখে স্পাইয়ের মতো মাটির গভীর থেকে স্মৃতি খুঁড়ে তোলা,
কাউকে কোথাও খুঁজে না পাওয়া কখনো,
অচেনা অথচ অতি মনোরম রাস্তা, টুপি-পরা
একজন স্মার্ট পেঙ্গুইন
দ্রুত যান হাইকোর্টে। ক্যালেন্ডার প্রবল হাওয়ায়
দোলে শুধু দোলে
তারিখবিহীন।
ক্যালেন্ডার থেকে এক ঝাঁক হরিয়াল
চকিতে বেরিয়ে আসে, কারো হাত রাজহংসীর গ্রীবার মতো
হয়ে ফের মিশে যায় গাছের শাখায়।
ঘুমের দেয়ালে তুমি নিবিড় লতানো আসো ভিন্ন অবয়বে,
শিয়ামিজ বেড়ালকে বিলাও আদর, যাও ম্যাজিক লণ্ঠনে,
সেতারের মতো বাজো। হাই সোসাইটি তোলে হাই মধ্যরাতে।
আজকাল কী যে হচ্ছে, ঘুম গৃহস্থের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র, বাস্তুত্যাগী।
চলেছি অজস্র ভেড়া গুনে গুনে, বেড়া ডিঙানোর খেলা, তবু
আবেশে আসে না বুজে চোখ।
অনিদ্রা মরুর খাঁ-খাঁ কিংবা পোড়া ভাদ্রের দুপুর,
অনিদ্রা প্রস্রাবখানা, দারুর দুর্গন্ধে ভেজা, বিচ্ছিরি হলুদ
দেয়ালে অশ্লীল লিপি, চিত্র কদাকার।
অনিদ্রা ভ্যানগগের আত্ম-প্রতিকৃতি
কিংবা কাক-ওড়া ফসলের ক্ষেত,
অনিদ্রা তুমুল নজরুল ইসলামী
পদ্য জ্বালাময়ী
অনিদ্রা কণ্বের তপোবনে
রুদ্র, রুক্ষ, কট্রর দুর্বাসা।
আজকাল কী-যে হচ্ছে, সারারাত ধরে,
শুনছি প্রতিটি শব্দ দেয়ালঘড়ির, শয্যা ছেড়ে
দেখি না আয়নায় মুখ, পাছে বোদলেয়ারের মতো
নিজেকেই অন্য কেউ ভেবে
জানাই অভিবাদন, বলি, ‘হ্যালো, কেমন আছেন?
অনিদ্রা আমার শক্র, তবু তার শক্রতাই ঠেকে সহনীয়
কেননা নিশ্চিত জানি তুমিই জননী অনিদ্রার।
আক্রান্ত হ’য়ে
‘কী আছে তোমার কাছে? বের করো চটপট’ বলে
ক’জন উঠতি গুণ্ডা রাখল রিভলবার বুকের ওপর
আচমকা, আমি প্রায় অকম্পিত স্বরে বললাম, ‘এই তো
এখানে আমার বুকে শ্যামলিম শৈশবের নেবুতলা, নানান রঙের
প্রজাপতি, হৈ-হৈ মেলা
পাখির পেলব বাসা, কারো গাঢ় চুম্বনের রঙিন উষ্ণতা,
উনিশ শো বেয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ, দুর্ভিক্ষের ছায়া,
ব্যক্তিগত নানাবিধ ক্ষুধা,
এবং দ্বিতীয় বিশ্ব সময়কালীন ঝিকঝিক মালুম ইত্যাদি শব্দাবলি;
আমার পাঁজরে বহু লাশ পলাশ রঙের বিভিন্ন মিছিল,
শ্রাবণ-সন্ধ্যায় ভেজা করুণ শহর,
আমার মুঠোয় কতো কান্না, নিয়নের ঝিকিমিকি
এবং হিরোশিমার নিদারুণ লণ্ডভণ্ড ল্যান্ডস্কেপ, দ্বিখণ্ডিত বঙ্গ,
সংখ্যাহীন উদ্বাস্তুর মুখ এবং আপনাদের পিস্তলের
রঙেন মতন তীব্র হতাশা অথবা
রঙিন শার্টের মতো আশা,
কবিতার জন্যে অন্তহীন ভালোবাসা, শুনুন পকেটে
অসমাপ্ত কবিতার পাণ্ডুলিপি, আইবুড়ো বোনের একটি
চিঠি ছাড়া আর কিছু নেই।
এসব ফালতু বস্তু আপনারা নেবেন কি করুণানিধান?’
হঠাৎ ছিটিয়ে থুতু আমার একান্ত নির্বিকার মুখে ওরা
ধাঁ করে উধাও হল ঝাঁ-ঝাঁ ধোঁয়া ছেড়ে কালো জিপে।
আমার ভেতর কিছু শব্দাবলি ম্যাজেশিয়ানের
তাসের মতন নেচে নেচে
কেবলি কবিতা হতে চায়। সটান নির্ভীক হেঁটে চলি পথ
বক্ষলগ্ন অলৌকিক একটি তালিকা নিয়ে অলক্ষ্যে সবার।
আমার ভালোবাসা
সমস্ত নৈরাশ্যের গলায় পা রেখ আনিমার প্রতারণায় ভ্রূক্ষেপ না করে
শিরায় শিরায় লক্ষ তারাময় রক্তের দোলায় আন্দোলিত হয়ে আমি বলছি
আমি বলছি লেখার টেবিল ঘরের চৌকাঠ সাক্ষী রেখে বলছি ঘুরঘুট্রি
অন্ধকারে হাজার পিদিম জ্বালিয়ে বলছি এই সময়ের পাঁকে
ফুটুক আমার ভালোবাসা ফুটুক কালো কারাগারের
দেয়াল ফুঁড়ে খুব হল্লা করে বসন্তের কাঁধে
যারা পেতেছে মেশিনগান তাদের হেলমেট
ফুঁড়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক
সিগন্যালে সাইনবোর্ড বস্তির
জীর্ণ চালায় কবরের কাঁচা
মাটিতে হাসপাতালের নিঃশব্দ
ছাদে হাসপাতালের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্রে
বিনোদের শব্দে আমার
সূর্যমুখী ভালোবাসা
নবজাতকের মতো
চিৎকার করে
অম্লান ফুটুক ফুটুক ফুটুক ফুটুক ফুটুক ফুটুক
আমার ভালোবাসা সবুজ পাতার মতো গান গায় গান গায় গান গায়
আসুন আমরা আজ
আসুন আমরা শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করি আজ,
আমরা সবাই যারা কেমন দৈবাৎ বেঁচে গেছি;
আসুন আমরা আজ নীরব দাঁড়াই যথারীতি
সকাতর কিছুক্ষণ লক্ষ লক্ষ মৃতের সম্মানে,-
আমাদের বহুকাল এমন দাঁড়াতে হবে বুঝি!
চলুন শামিল হই আজ শোক-মিছিলে সবাই,
পথে মেলি কালো বস্ত্র ‘ভিক্ষা দাও পুরবাসী’ বলে-
শহরে উঠুক বেজে শোকাতুর হারমোনিয়াম।
খোলা ছাদ, কবুতরময় মসজিদের গম্বুজ,
জীর্ণ বাস, গার্বেজের ডাম্প আর পোস্টার, ব্যানার,
নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো, পুরোনো পাঁচিল শোক নয়,
জ্যোৎস্নারাত, ফুটপাত, ডাকবাক্স, পিয়নের খাকি
জামা, নদী-নালা কিংবা পিয়ালের ডাল শোক নয়,
কচুরিপানাও নয়, বাবুইপাখির বাসা, সর্ষেক্ষেত,
নৌকোর নয়ন, ডুরে শাড়ি, অথবা নয়ানজুলি
শোক নয়; শোক জানি বাস্তবিক অবয়বহীন।
তবু শোক হয়ে যায় অকস্মাৎ অনেক কিছুই।
মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমার একান্ত ছায়াখানি
শোক হয়ে ব’সে থাকে এক কোনে, পথ হাঁটে আর
হাতের তালুতে বারবার দেখে নেয় জলোচ্ছ্বাসে
কর্দমাক্ত দ্বীপপুঞ্জ, জনপদ, উদগ্র শকুন।
চাদ্দিকে সতেজ ঘ্রাণ কাফনের; অনেক জায়গায়
দাফনের জন্যে কোনো লোক নেই। আমার পকেটে
দুটি মৃত গ্রাম্য শিশু, গলায় ঝুলছে যুব-লাশ,
আঙুলে জড়ানো লজ্জাবতী বিবস্ত্র বধূর চুল।
আমার হৃদয় হয় অগোচরে রুক্ষ মরুভূমি,
যোজন যোজনব্যাপী অতিশয় উদার শ্মশান।
ভোরে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সংবাদ প’ড়ে
আর ফটোগ্রাফারের একান্ত বাস্তবপ্রীতি দেখে
রেডিওতে কবিতা আবৃত্তি করে ডবকা দুপুরে
পঁয়ত্রিশ টাকার একটি সবুজাভ চেক নিয়ে
সিনেমার বিজ্ঞাপন, নির্বিকার ভিড় দেখে বাড়ি
ফিরি একা প্রতিশ্রুত চকোলেট ছাড়াই উদাস।
খেতে বসি, রাত হলে শুতে যাই, অভ্যাসবশত
নিবিড় জড়াই ক্লান্ত গৃহিণীর নিদ্রাপ্লুত গলা।
অকস্মাৎ খাঁ-খাঁ কাফনের ঘ্রাণে স্বপ্নের মধ্যেই
মেলায় হারিয়ে-যাওয়া বালকের মতো কেঁদে উঠি।
ইলেকট্রিকের তার ছেড়ে
ইলেকট্রিকের তার ছেড়ে গেলে কাক কম্পনের
সৃষ্টি হয়, অতিবর্ষণের পর পথে জমে জল,
কিংবা মিষ্টান্নের ঘ্রাণ পেলে যূথচারী পিপীলিকা
বহুদূর থেকে আসে সম্ভাবনাময় আহরণে,
অথবা পুরোনো কড়িকাঠে প্রজাপতি থাকে সেঁটে
রঙিন কাগজবৎ-এই দৃশ্যাবলির সহিত
তোমার সম্পর্ক আছে? তবুও তো শুধু তোমাকেই
মনে পড়ে, ভেসে ওঠো প্রত্যেকটি প্রত্যঙ্গ সমেত,
তোমাকে ভাবার জন্যে উদ্যমের প্রয়োজন নেই।
গহন রাত্রির পর যেমন ভোরের প্রসন্নতা
আসে অনায়াসে, তুমি তেমনি জেগে ওঠো
বক্ষের একান্ত কক্ষে। আহারের পর হাত ধুয়ে
শোঁকার সময় মৃদু যে-ঘ্রাণ উত্থিত হয়, তারই
অনুরূপ যেন স্মৃতি; কেমন আচ্ছন্ন হয়ে যাই।
অলৌকিক কাউন্টারে গিয়ে চাই একটি টিকিট
হাত পেতে; তুমি থাকো দূরে, আমি ভূতগ্রস্ততায়
ঘুরে মরি দিগ্ধিদিক। আমার জীবনে তুমি আজও
ঠিক হৃৎস্পন্দনের মতোই অপরিহার্য, তুমি।
এক মহিলার ভাবনা
কোনো কোনো মধ্যরাতে কিছু ঘাস, কিছু কালো মাটি
কারুর জীবন্ত অবয়ব হয়ে আমাকে জড়ায়,
মুঠোয় সজোরে ধরে চুল, গালে গাল ঘষে, আমার পাহাড়ে
অরণ্যে উপত্যকায় ঘোরে মাতাল বেঘোর।
একমাত্র মেয়ে
করছে স্বামীর ঘর, ছেলেটা কখন আসে, আবার কখন
ফেরে ঘরে টের পাওয়া দায়। কাছে ধারে কেউ নেই। ‘ওগো’ বলে
ডাকে না এখন কেউ আর। যার সঙ্গে সহবাসে
ছিলাম একান্ত ডুবে বিশটি বছর, হাড় তার
এখন মাটির নিচে ভয়ানক ধবধবে হয়ে গেছে বুঝি
আমার শাড়ির মতো। হায়, যদি পারতাম হতে
লাশবাহী ভেলার বেহুলা!
শয্যায় লাগে না পিঠ কোনো কোনো রাতে,
কখনো বুলোই চোখ বইয়ের পাতায়, জানালার বাইরে তাকাই,
কখনো ফ্লাওয়ার-ভাসে রাখি গাল, কখনো মরুর
মতো সরু বারান্দায় করি পায়চারি, অঙ্গে অঙ্গে
জ্বলে যে অঙ্গার তার দাহ নিরীহ করার ছলে
নির্জন স্নানের ঘরে যাই বার বার। দেয়ালের
ছবিটার দিকে রাখি উষ্ণ দৃষ্টি, আমার স্বামীর
ফটোগ্রাফ কী শীতল, কী সুদূর; এইমাত্র সবুজ পোকার
লোভে বালিরঙ টিকটিক ওঁর প্রজাপতি-গোঁফ ছুঁয়ে গেল।
এ নীরন্ধ্র ঘরে আমি উঠি বসি বসি উঠি, কখনো দাঁড়াই,
কখনো এলিয়ে পড়ি কৌচে, বয়সকে বড় বেশি ঘেন্না করি,
যেমন বিক্ষুব্ধ চাঁদ সদাগর মনসাকে। এ ঘরের অন্ধকার
অথবা বাল্বের অত্যধিক আঁচ-দেয়া দুধের মতন আলো
পারে না কি হতে মানবিক?
সে কেন আমার পুত্র আসে না আমার কাছে, কেন
রাখে না সবল হাত, মুখ তার আমার যুগল থরোথরো
ঊরুর সোফায়? কেন উদ্বেল আমার স্তন তার
মুঠোয় দেয় না ঢেকে, ঢাকত যেমন
শৈশবে আমার পাশে শুয়ে, আমি গাঢ় ঘুমোতাম!
একজন জেলে
সমুদ্রে যাব না আর কোনো দিন, সমুদ্রে হাঙর,
ঘূর্ণি গরকি সেই রাক্ষুসীর পেটে আমার ডাঙর
ছেলেমেয়ে; বউ আর জোয়ান ভাইটা গেছে, শুধু
আমি একা প’ড়ে আছি। মাথার ভেতর কী যে ধু-ধু
করছে ক’দিন ধরে। এদিক ওদিক ছুটি, ভিটেমাটি
কোথাও পাই না খুঁজে। চারদিকে শূন্যতার ঘাঁটি।
সেই ছেলেবেলা থেকে জলের দিকেই ছিল মন;
জলে জলে গেছে বেলা, মুগ্ধতায় যখন তখন
ছুঁয়েছি সাগর-জল আর আয় মাছ ধরি আয়
বলে ভাসিয়েছি ডিঙি নদীতে রঙিলা দরিয়ায়।
এই লোনা সমুন্দুর ছেড়ে আমি কোথাও যাইনি,
অথচ আমারই সব নিল কেড়ে মাতাল ডাইনী।
এসব বলছি কী-যে! না, না, ঘর-দোর সবই আছে।
এই তো ছেলেটা দৌড়ে উঠোন পেরুল, লম্বা গাছে
ডাকছে কুটুম পাখি, বউ রাঁধে, মেয়েটা তেঁতুল
খাচ্ছে আর ভাই জাল দিচ্ছে মেলে। হায়, শুধু ভুল
হয়ে যায়, যেন ফের সামুদ্রিক ঘন কুয়াশায়
হারিয়ে ফেলছি সব, মাথা কেমন গুলিয়ে যায়
আচ্ছা, আপনারা কেউ দয়া করে আমার সঠিক
নামটি দেবেন বলে? কেবলি ঘুরছি দিগ্ধিদিক,
পড়ে না নিজেরই নাম মনে। নিজেকে কী নামে ডাকি?
আমি কি রসিক দাস? বিশু? জগদিন্দ্র মালো? নাকি
আলী মৃধা? কতো না বয়স হল? সবদর গাজী
হয়তোবা এই আমি। আসলে সক্কলই ভোজবাজি।
কী যেন লাফিয়ে ওঠে অগোচরে মনের ভেতর-
অত্যন্ত উজ্জ্বল কিছু, কী করে ভাবব তাকে পর?
ত্রাণসামগ্রীর ঝলকানি? সে যে সু-স্বপ্নের মতো,
একটি বিশাল মাছ সামুদ্রিক, শূন্যে কেলিরত,
এখনও মাছের চিন্তা! ভুলি না জালের কীর্তি, মাছ
আমাকে উড়িয়ে নেয় মেঘে, রাঙা গাঙে, দেখি নাচ
একজন মৎস্যরমণীর, আমাকে কোমল ডাকে।
প্রকৃত আহার্য নয় তারা, স্মৃতিবৎ ভেসে থাকে।
আমি তো জলেরই লোক, চুপচাপ থাকা দায় ঘরে,
ডিঙি বেয়ে বার বার যাব আমি সুনীল সাগরে।
কতো মাই লাই
মাই লাই গ্রাম
তাকে চিনলাম
রক্তপাত আর নারকীয় ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। বারবার
মাই লাই জ্বলে দাউদাউ মগজের মানচিত্রে।
ঘরপোড়া মানুষের লাশ অবিরত
হানা দেয় চেতনার শোকার্ত পাড়ায়।
মাই লাই তার সব বাসিন্দা হারায়
হিংসার সংকেতে;
মৃত্যু কালো বৃষ্টির মতোন ঝরে ঘরে, মাঠে, ক্ষেতে।
মাই লাই গ্রাম
একটি শোণিতস্নাত, ভস্মমাখা নাম।
সেখানে খেলত শিশু বৃদ্ধ, গ্রাম্যজন
কাটাতেন অতীতের সুস্নিগ্ধ জাবর, অঘটন
ঘটলেও রাখতেন আস্থা ভবিষ্যতের ওপর।
পাখির টোপর
দেখে শিশু দিত করতালি, গ্রামবাসী
শ্যামল শান্তির ঘন ছায়ার প্রত্যাশী।
প্রণয়ে বিশ্বাস রেখে যুবক-যুবতী
ভুলেছিল জীবনের খুচরা কিছু ক্ষতি
নানাবিধ। শিশুরা উৎসবে চেয়ে কেক, পুতুলের ভেট
পেল আগুনের জ্বালা, অজস্র বুলেট,
বোমারু প্লেনের কত ঝাঁঝালো ধমক। ভাঙা পাত্র, টিন, ছাই,
চুলের রঙিন ফিতে, পোড়া মাংস, সেফ্টিপিন-এই-ই মাই লাই।
আজকাল যেদিকেই উদাস তাকাই,
বাংলাদেশে দাউদাউ কতো মাই লাই।
কী ক’রে লুকাবে?
কী করে লুকাবে বলো এই সব লাশ?
এই সব বেয়নেট-চেরা
বিষম নাপাম-পোড়া লাশ?
এ তো নয় বালকের অস্থির হাতের
অত্যন্ত প্রমাদময় বানানের লিপি,
রবারে তুমুল ঘষে তুললেই নিশ্চিত
মুছে যাবে। অথবা উজাড় ঠোঙা নয় মিষ্টান্নের,
কিংবা খুব ক্ষ’য়ে-যাওয়া সাবানের টুকরো,
অথবা বাতিল স্পঞ্জ, দূর
ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিলেই বেবাক
চুকে-বুকে যাবে।
কী করে লুকাবে বলো এত বেশি লাশ?
জানতে কি তোমরা
এত লাশ আপাদমস্তক মুড়ে ফেলবার জন্যে
ক’ হাজার গজ
লাগবে মার্কিন
পোড়াতে ক’ মণ কাঠ? তুখোড় চাতুর্যে
ভেবেছিলে এই সব লাশ গাদাগাদি
মৃত্তিকায় পুঁতে রাখলেই
অথবা নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিলেই বেপরোয়া
তোমাদের হত্যাপরায়ণ
দিনরাত্রি মুছে যাবে বিশ্বস্মৃতি থেকে।
যখন রাস্তায় জঙ্গি ছুটে যায়,
আগলে দাঁড়ায় পথ মৃতদের ভিড় সবখানে-
নিরস্ত্র নিরীহ যারা হয়েছে শিকার
মেশিনগানের, মর্টারের। অশ্বারোহী
যেন ওরা, হাওয়ায় সওয়ার,
আবৃত সুনীল বর্মে, পেতে চায় করোটির ট্রাফি।
আদালতে, সরকারি দপ্তরে
বেরোয় দেয়াল ফুঁড়ে অবিরল গুলিবিদ্ধ লাশ,
ঝুলে থাকে গলায় গলায়।
দোকানি সম্মুখে মেলে দিলে
কাপড়ের থান,
আলোকিত পরিপাটি মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে লাশ;
যেনবা লুকিয়েছিল কাপড়ের ভাঁজে।
অথবা বিদেশী প্রতিনিধিদের ভোজসভায় হঠাৎ
প্লেটে ডিশে চিকেন সুপের পেয়ালায়
ন্যাপকিনে নিহত পুরুষ, নারী, শিশু
উদ্ভিদের মতো লেগে থাকে সারাক্ষণ,
রক্তাক্ত নাছোড়।
কী করে লুকাবে বলো এত বেশি লাশ
শোকার্ত মাটির নিচে, গহন নদীতে?
কোন দিকে?
কোন দিকে নিয়ে যেতে চাও আমাকে? কোন দিকে গাইড?
আমার পদদ্বয় প্রোথিত স্বপ্নভূমিতে,
আমাকে কেন উপড়ে নিতে চাও?
কেন তোমরা মায়াবৃক্ষের ছায়া থেকে
সরিয়ে নিতে চাও আমাকে? কেন
উদ্বাস্তু করতে চাও স্বপ্নভূমি থেকে?
দিব্যি আছি আলেখ্যবৎ, গায়ে লাগে না ধুলো,
নেই শরীরী অশরীরী কারুরই সাতেপাঁচে।
কেন আমাকে টইটম্বুর সরোবর থেকে
তাড়িয়ে নিয়ে যেতে চাও ঐখানে
যেখানে হাজার হাজার মানুষ
প্রস্তুত হচ্ছে,
পেশি নাচাচ্ছে চরম রৌদ্রে?
আমি মৌমাছি হয়ে ফুলে ফুলে
অলৌকিক সঞ্চয়ে বিভোর হতে চাই,
আমি ছুটতে চাই দরাজ প্রান্তরে,
ধাওয়া করতে চাই পরীদের পেছনে।
কেন তোমরা
আমার সেই গোপন খেলা পণ্ড করতে চাও?
কেন শুনতে চাও না সোনালি রেফারির হুইসিল?
কেন আমার মারহাবা স্বপ্নিল জার্সি খুলে নিয়ে
বিষম নগ্ন করে দিতে চাও আমাকে?
আমি প্রাণপণ ছুটে পালাতে চাই,
তোমাদের মুঠোর মাঠ থেকে
আমি চম্পট দিতে চাই।
বাধা দিও না।
তোমাদের মতো প্রস্তুত নই আমি,
আমার পেশি ঝলসায় না চরম রৌদ্রে।
আমার অক্ষমতার মুখ লুকাতে চাই ঝটপট
পাখির বুকে,
নিপন্ন ঘাসে,
দিঘির শ্যাওলায়,
রেললাইনে,
অনেক উঁচু বাড়ির ছাদে।
কোন দিকে নিয়ে যেতে চাও আমাকে? কোন দিকে গাইড?
শেষ অব্দি
তোমাদের কাট্রি মেরে যেতে পারব তো?
ক্ষমাপ্রার্থী
লতিফ তোমার কাছে হাঁটু মুড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করি।
এখনও এখানে আছ, মনে হয়, এই বারান্দায়,
বৈঠকখানায় কিংবা ছমছমে সিঁড়ির আঁধারে।
লতিফ তোমার হিমশীতল নিঃশ্বাস
আমার জুলফি ছুঁয়ে যায়। কড়িকাঠে,
দেওয়ালে চৌকাঠে কুলুঙ্গিতে,
যেদিকেই তাকাই তোমার
চক্ষুদ্বয় জলের ফোঁটার মতো ঝুলে থাকে বিষম নাছোড়।
না, তুমি অমন করে আমাকে দেখো না,
দেখো না লতিফ।
একদা তোমাকে আমি বড় বেশি ঈর্ষা করতাম;
তোমার সোনার সিগারেট কেস, সুট-টাই, আসবাব দেখে
কেমন টাটাত চোখ, সেসব ব্যসন
করতলগত
করার নচ্ছার লোভ লুকিয়ে শার্টের অন্তরালে,
বুকের তলায়,
আমি হাসতাম, তুমি ‘নাও, সিগারেট খাও’ বলে
সুদৃশ্য সোনালি কেস দিতে খুব ব্যগ্র-হাতে নিপুণ বাড়িয়ে।
অলীক দেরাজ থেকে তোমার বিশদ জীবনের
নীল-নকশা চুরি করে, নিজে ব্যবহার
করতে চেয়েছি কতদিন বস্তুত কাঁথায় শুয়ে।
লতিফ তোমার কাছে হাঁটু মুড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করি।
এই তো তোমাকে আমি কালকেও প্রবল
ঈর্ষা করতাম, আজ সেই
বিচ্ছিরি কুটিল পোকাটাকে নির্দ্বিধায়
দিয়েছি বিদায়।
নিজে বেঁচে আছি বলে তৃপ্তি। আজকেও,
যখন আমার বুক বোমা-ধ্বস্ত শহরের মতো
হুবহু হওয়ার কথা, বৈরাগ্যে অরণ্যে
মুখ লুকানোর কথা আজকেও আমি
আয়নায় নিজের পরিপাটি প্রতিচ্ছবি দেখে সুখে
ঈষৎ হেসেছি; স্ত্রীর সাথে খুনসুটি
করে কিছুকাল গলিত গলির মোড়ে
তোফা ধরিয়েছি সিগারেট।
তুমি আজ সব ঈর্ষা দ্বন্দ্ব সব কলহের পরপারে। তুমি
নিস্পন্দ তোমার খাটে। মনে হয় হয়তো চোখ মেলে
এক্ষুণি এগিয়ে দেবে তোমার সোনালি কেস আমার দিকেই
অবলীলাক্রমে, বলবে, ‘নাও, সিগারেট খাও।‘ নাকি
রয়েছ দাঁড়িয়ে ঝুলবারান্দায় কিংবা বাথরুমে
ধুতে গেছ বাসি মুখ। ইতিমধ্যে তোমার রোরুদ্যমানা স্ত্রী-র
ব্লাউজ-উপচে-পড়া কম্পমান স্তন আড়চোখে
নিলাম বিষম দেখে, অবাধ্য অসভ্য রক্তে ডাকে বার-বার
লালচক্ষু তৃষিত কোকিল।
লতিফ তোমার কাছে হাঁটু মুড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করি।
চেগুয়েভারার চোখ
যেখানেই যাই, অলিতে-গলিতে,
গ্রন্থবিতানে, কাফেটারিয়ার ভিড়ে
কী যেন তীব্র, অপ্রতিরোধ্য
জ্বলজ্বল করে আমার সত্তা ঘিরে।
চুরুট রঙের সন্ধ্যায় মনে
ভেসে ওঠে শুধু দূর বোলিভিয়া-বন।
ভাবি উচাটন বিশ শতকেও
ঈশ্বরহীন সন্ত শহীদ হন।
সন্তের চোখ, শহীদের চোখ
কে যেন দিয়েছে হৃদয়ে আমার সেঁটে,
রক্তাপ্লুত একটি শরীর
সকল সময় কী ঋজু যাচ্ছে হেঁটে।
আমার প্রহর হাঁটু মুড়ে বসে
অবাধ জাগর তাঁর জীবনীর পাশে।
কবিতায় ছুঁই হাত দুটি তাঁর,
আত্মার ঘ্রাণ টেনে নিই নিঃশ্বাসে।
তিনি মৃত তবু জীবিতের চেয়ে
অনেক সজীব এবং কান্তিমান।
ভবিষ্যতের জন্যে হেলায়
দিয়েছেন ছুড়ে আপন বর্তমান।
চোরকুঠরির বাসিন্দা
তার মগজের কোষে মধু নেই ঝরবে যা মৃদু ফোঁটা ফোঁটা
শহরের ঠোঁটে।
পায়ে তার স্পর্শ নেই নক্ষত্রের, দেখামাত্র চমকে ওঠার
মতো নয় কিছু, স্মার্ট সুমসৃণ, রকজ-দুরস্ত
জামা গায়ে, পায়ে চোখা চকচকে জুতো-
প্রফুল্ল পড়শি বলে মনে হবে কিংবা কোনো সুদূর স্বজন।
প্রত্যহ কামায় দাড়ি, বাস স্টপে দাঁড়ায় কখনো,
কখনোবা ঘোরে বাণিজ্যিক এলাকায়, ট্যাক্সি চেপে
হাওয়া খায়, যায় সিনেমায়।
‘এবার শহরে বেশ গোলাপ হয়েছে…ভদ্রলোক
আখের গুছিয়ে নিয়ে ধ্যানস্থ এখন…মাড়ি ফুলে
গেছে ভায়া… মাতাহারি রমণীয় গোয়েন্দা ছিলেন…
সর্দি সারছে না কিছুতেই…
এসব কথার মাছ কেলিরত তারও
মুখের পুকুরে।
কখনো সে স্বপ্ন দ্যাখে-অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
নিজে নেমে যায় ক্রমে। চোরকুঠরির শীতলতা
মজ্জায় প্রবেশ করে। দরজা, জানালা বন্ধ সবি;
গোলকধাঁধায় ঘোরে, ফ্যাকাশে মুখের
ভিড় চতুর্দিকে।
প’ড়ে যায় ঊর্ণাজালে, যেন সে বিপন্ন
মাছির চেয়েও ক্ষুদ্র, অসহায়। কখনো বিস্তর যাত্রাশেষে
পৌঁছে যায় ভুল ঠিকানায়, কখনোবা
ঘুমায় অস্পষ্ট কৌচে মেদুর চাদর মুড়ি দিয়ে।
তীক্ষ্ণ ছোরা তার বড় শোণিতপিপাসু আর তার
পিস্তল ধোঁয়ায় ঘন ঘন।
অথচ আবার সে-ও টববন্দি রজনীগন্ধার
চোখে রাখ চোখ,
কুকুরছানার মুখে দেয় পেতে সুখে
দুধের পাত্তর।
জাল
খুব কালো জাল পড়েছিল ঠিকই চতুর্দিকে, আমি
আটকা পড়িনি ভাগ্যবলে। বোকা হাবার মতন
বেঁচে আছি অপ্রস্তুত। মৃত্যুর প্রতীক্ষা সর্বক্ষণ
জুড়ে রয় চেতনায়। মৃত্যুর আতঙ্কেরই অনুগামী।
এখনও তো বেঁচে থাকাটাই হাস্যকর ভয়ানক।
কখন যে দৃষ্টি থেকে পৃথিবীর সমস্ত আলোক
মুছে যাবে, দেহ থেকে তাপ। কাকের মতোই চোখ
বন্ধ করে জীবন গচ্ছিত রাখি ফাটলে নিছক।
তুমি অন্তর্হিতা
তুমি অন্তর্হিতা, আমি যেন সেই নিঃসঙ্গ ঘোটক,
রিল্কে যাকে সন্ধ্যায় দেখেছিলেন স্তব্ধ রাশিয়ায়।
তুমি অন্তর্হিতা, আমি মানিকবাবুর হারু, সন্দিগ্ধ শেয়াল
মরা শালিকের বাচ্চা মুখে নিয়ে যাচ্ছে ছপছপ,
কিছুই পাচ্ছি না টের। তুমি অন্তর্হিতা,
ঘরপোড়া মানুষের মতো আমি রৌদ্রবৃষ্টি, বাতাসের কুরুণার পাত্র,
একেবারে আর্ত আর নগ্ন।
শহরের সব রাস্তা, লেন-বাইলেন, কী চিত্তির বিচিত্তির
দোকানপাটের ফুল্ল রঙিন সাইনবোর্ড, যাবতীয় সামগ্রী, পোস্টার,
দিনের ট্রাফিক আর রাতের নিয়নমালা, স্বপ্নের মতন বিজ্ঞাপন
সবাই বলছে সমস্বরে?-
তুমি অন্তর্হিতা।
সমস্ত শহর আমি স্যান্ডেলের আঘাতে আঘাতে
বিক্ষত করছি শুধু, হাঁটছি হাঁটছি সঙ্গীহীন।
যে-লোকটা এইমাত্র আমার পাঞ্জাবি ঘেঁষে গেল,
তাকে দেখে মনে হল (হয়তো বা অকারণ এই মনে-হওয়া)
কখনো রবীন্দ্রনাথ লেখেননি এক ছত্র কবিতা অথবা ঋদ্ধ বড়ে
গোলাম আলীর কণ্ঠে কোনো দিন জ্বলজ্বল করেনি খেয়াল
নানা বর্ণে। যে-মহিলা ধাঁধিয়ে অনেক চোখ গটগট হেঁটে
মোটরে আহ্লাদী এক বেড়ালের মতো
বসলেন, তাঁকে দেখে মনে হলো গর্ভপাতে অতীব নিপুণা।
অন্ন চাই, বস্ত্র চাই বলে এক ঝাঁঝালো মিছিল শহরের
প্রধান সড়ক আলো করে এগোচ্ছে কেবলি;
‘তুমি অন্তর্হিতা’, এক নতুন স্লোগান তুলে সেই
মিছিলে শামিল হতে ভারি ইচ্ছে হল।
পোস্টারে পোস্টারে আর প্রতিটি ব্যানারে দেখলাম,-
বড় বড় রক্তাক্ত অক্ষরে আছে লেখা
তুমি অন্তর্হিতা, তুমি অন্তর্হিতা, তুমি অন্তর্হিতা।
ভাদ্রের আকাশ ছিঁড়ে, মাটি খুঁড়ে ভদ্দর লোকের
শৌখিন বাগানে ঢুকে ফুলের গহন অভ্যন্তরে
দৃষ্টি মেলে, দৃষ্টি মেলে আপেলের ত্বকের ভেতর,
গাছতলা, পুকুরের ঘাটে, সতেজ মাছের পেটে,
শহরের প্রতিটি বাড়ির কড়া নেড়ে,
এরোড্রামে, যে-কোনো মার্কেটে,
সকল ঘুপটি কোণ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে অত্যন্ত
লোভ হল। স্বচক্ষে দেখতে চাই তুমি আছো কি না
অন্তরালে লুকিয়ে কোথাও।
ঘরে ফিরে দেখি বন্ধ দরজায়, খোলা জানালায়,
টেবিলে দেয়ালে আছে লেখা
তুমি অন্তর্হিতা।
সমস্ত রহস্য নিয়ে তার রবরবা রাত্রি এলে
পুরোনো টেবিলে ঝুঁকে খাতার পাতার জনপথে
কখনো হোঁচট খাই, থমকে দাঁড়াই দেখে শত হিজিবিজি।
কবিতা রচনাকালে প্রতিটি পংক্তির ফাঁকে ফাঁকে খামোকাই
কে যেন লিখিয়ে নেয় অবিরত, তুমি অন্তর্হিতা।
আমার বর্বর ক্রোধ উঠোনে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানো খয়েরি
পোষা হাঁসটাকে
হঠাৎ মারলো ছুড়ে ঢেলা, হাঁস খোঁড়াতে খোঁড়াতে
যেন তীব্র অভিমানে তাকাল আমার দিকে, লুকাল সভয়ে
মর্চে-পড়া টিনের আড়ালে!
পরমুহূর্তেই আমি তাকে খুঁজে নিয়ে
দিলাম ব্যান্ডেজ বেঁধে আর্ত লাল পায়ে,
অথচ আমার ক্ষত র’য়ে যায় অন্তরালে শুশ্রূষাবিহীন।
সে-ক্ষতের প্রতি রক্তবিন্দু ঝরে ঝরে
বলে বারবার-
তুমি অন্তর্হিতা,
তুমি অন্তর্হিতা,
তুমি অন্তর্হিতা…
তোমাকে দেখে
এই তো আবার তুমি আগুন রঙের শাড়ি প’রে
দাঁড়ানো অথবা
ছড়িয়ে যুগল ঊরু ব’সে আছ গৈরিক ডিভানে,
তুমি, শুধু তুমি।
তোমার গ্রীবার জ্বলজ্বলে কালো তারা,
ঠোঁটের কার্নিশে জমে মদির শিশির।
চতুর্দিকে বস্তু ধু-ধু, চেয়ার টেবিল, বইপত্র
পোশাক-আশাক,
জানালায় হলদে পর্দা, রেডিওর নিস্পৃহ ঘোষক
রটাচ্ছে খবর মধ্যপ্রাচ্য, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ ভিয়েতনাম,
সহসা সুকর্ন মৃত, মহান প্রেমিক।
এই তো আবার সেই তুমি, সব বস্তু, সব কিছু
ছাপিয়ে উঠেছ তুমি, নাইছ নিয়নে খুব, কোনো রাঙা
মিলনাঙ্গুরীয়
এগিয়ে দিইনি তবু মিলনের ইডেনে দুজন।
হৃদয় উজাড় করে তোমার একান্ত নাম ধরে
ডেকে ডেকে ডেকে ডেকে ওস্তাদের মতো
সারা পৃথিবীকে বস্তুহীন
একটি প্রগাঢ় সুরে মুঞ্জরিত করে দিতে ভারি
ইচ্ছে হয়েছিল। আমাদের
চৌদিকে বস্তুর ভিড়-বস্তুই তো মাঝে মাঝে মানবের
সংযোগ সাধনে
ঐন্দ্রজালিকের মতো অনুপম চাতুর্য দেখায়।
তোমাকে দেখছি আমি নিষ্পলক, তুমি
এখনও দাঁড়ানো;
যেন উদ্যানের সবচেয়ে তন্বী গাছটিকে কেউ
করেছে রোপণ এই তকতকে ফ্লোরে।
পুরো রাতদিন ধরে শুধু একটি শব্দের জন্যে
অশ্রান্ত ভ্রমণ করে একটি কবিতা কিছুতেই
শেষ করতে না-পারার দুঃখ,
বিকেল বেলায় কোনো হুলুদ বাড়ির কাছে একটি পাখিকে
শুকনো, মৃত প’ড়ে থাকতে দেখার দুঃখ,
সারাদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে ঘুরে কারুর কাছেই
একটি পায়সাও ধার না পাওয়ার দুঃখ,
বিদেশী দূতাবাসের কাছে
একটি ছাত্রকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখে দুঃখ,
একজন বালককে পুকুরের কালো জলে ডুবতে দেখেও
তাকে বাঁচানোর ক্লীব উদ্যমহীনতা,
তার জন্যে দুঃখ,
নিমেষে গেলাম ভুলে তোমাকে দেখেই।
তোমার নাম
তোমার নাম মেয়ে গহন রাত্তিরে
ছাদের কার্নিশে শব্দ শিশিরের।
তোমার নাম মেয়ে শান্ত ভোরবেলা
মাটিতে ঝরে-পড়ে লাজুক শিউলির।
তোমার নাম মেয়ে পাখির বুকে যেন
প্রেমিক বাতাসের ব্যাকুল নিঃশ্বাস
তোমার নাম ধু-ধু সদ্য-জাগা চরে
জাগর জোছনার মদির শেক নাচ।
তোমার নাম ডালে চকিতে নুয়ে পড়া
রক্তগোলাপের গোপন শিহরণ।
তোমার নাম খাঁ-খাঁ অনিদ্রায় দুটি
চোখের পাতা-জোড়া ঘুমের গুঞ্জন।
তোমার নাম সাদা বিপুল ক্যানভাসে
চিত্র-জাগানিয়া রঙের চুম্বন।
তোমার নাম মেয়ে গুণীর বেহালায়
ছায়ার নিরালায় গভীর কোনো গৎ।
তোমার নাম মেয়ে টেবিলে ঝুঁকে-থাকা
কবির উদ্বেল বুকের স্পন্দন।
তোমার নাম খর-দুপুরে নির্জনে
তৃষিত পথিকের ব্যগ্র জলপান।
তোমার নাম ঝাঁ-ঝাঁ বোশেখি রোদ্দুরে
ব্যাপ্ত পতাকার হিরণ হিল্লোল।
তোমার নাম কালো জেলের খুপরিতে
আঁধার-তাড়ানিয়া আলোর অভিষেক।
দুঃসময়ে মুখোমুখি
বাচ্চু তুমি, বাচ্চু তুমি, চলে যাও, চলে যাও সেখানে
ছেচল্লিশ মাহুৎটুলীর খোলা ছাদে। আমি ব্যস্ত, বড় ব্যস্ত
এখন তোমার সঙ্গে, তোর সঙ্গে বাক্যলাপ করার মতন
একটুও সময় নেই। কেন তুই মিছেমিছি এখানে দাঁড়িয়ে
কষ্ট পাবি বল?
না, তোকে বসতে বলব না
কস্মিনকালেও,
তুই যা, চলে যা।
দেখছিস না আমার হাতে কত কাজ, দু’-ঘণ্টায় পাঠক-ঠকানো
নিপুণ সম্পাদকীয় লিখতেই হবে, তদুপরি
আছে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় দেশ-বিদেশের বহু চিঠির জবাব
এবং প্রুফের তাড়া নিত্য-নৈমিত্তিক
কবিতার সোনালি তাগিদ।
স্ত্রী-পুত্র-কন্যার জন্য কিছু ঘণ্টা
বাঁচিয়ে রাখতে হয়, আমার সময় প্রতিদিন
সুমিষ্ট পিঠের মতো
ভাগ করে নিয়মিত খাচ্ছে হে সবাই।
তোর সঙ্গে বাক্যালাপ করার মতন, বাচ্চু তুই
বল তো সময় কই? কতক্ষণ থাকবি দাঁড়িয়ে,
রাখবি ঝুলিয়ে ঠোঁটে দুষ্টু হাসি?
তুই তো নাছোড় ভারি, গোঁয়ার্তুমি ছেড়ে
এক্ষুণি চলে যা
শরৎ চক্কোত্তি রোডে, ছেচল্লিশ মাহুৎটুলীর খোলা ছাদে।
চকোলেট দেব তোকে, দেব তালশাঁস,
তুই যা, চলে যা।
অবুঝ তুই না গেলে আমার সকল কাজ রইবে প’ড়ে।
পাশের বাড়ির তেজপাতা-রঙ বুড়িটার ঘরে
মাঘের সকালে
মায়ের কল্যাণী হাতে-বোনা হলদে সোয়েটার প’রে
যেতাম কিনতে পিঠা মোরগের ডাক-সচকিত
চাঁপা ভোরে, তোর মনে নেই?
মেহেরের সঙ্গে, নতুন মামির সঙ্গে নানির সাধের
আচারের বৈয়ম করেছি লুট দুপুর বেলায়,
তোর মনে নেই?
চকবাজারের ঘিঞ্জি গলির কিনারে
ম্যাজিকঅলার খেলা দেখেছি মোহন সন্ধেবেলা,
তোর মনে নেই?
মিছিলে নাদিরা ছিল, আমি তাকে দেখে চটপট
মিছিলের আলো নিতে হলাম আগ্রহী, চৌরাস্তায়
সুদিনের জন্যে ব্যগ্র দিলাম শ্লোগান অবিরাম,-
তোর মনে নেই?
আমিও সাঁকোর ধারে গোধূলি বেলায়, সঙ্গী পিতা।
চকিতে অদৃশ্যে সাঁকো, জায়গাটা ভীষণ ফাঁকা, খাঁ-খাঁ
মনে হল, যেমন অত্যন্ত শূন্য লাগে ক্যানভাস
চিত্রকর ফেললে মুছে ভুল ছবি তার।
চিকন দিগন্তে হাম্বা রব, বলুন তো পাড়াতলি কতদূর?
সঙ্গে তিনি, হেঁটে যেতে যেতে দিতেন ফুলের নাম বলে;
বলতেন ঐ যে ছোট্র খরগোশ, অনেক দূরের বিল থেকে
সদ্য-আনা শিকারের বোঝাটা নামিয়ে
রঙবেরুঙের পাখিগুলো
শনাক্ত করতে ভিন্ন ভিন্ন নামে কী যে মজা পেতেন শিকারি।
দীর্ঘকাল সত্যি আমি মসজিদে যাইনি, শৈশবে
বাজান যেতেন নিয়ে হাত ধরে মনে পড়ে। ইমামের সূরা
অবোধ্য ঠেকত বলে ঝাড়লণ্ঠনের
শোভা কিংবা দেয়ালে শোভন লতাপাতা, ঠাণ্ডা টালি
দেখে, হৌজে রঙিন মাছের খেলা দেখে
কাটত সময় মসজিদের, তোর মনে নেই?
কখনো ঝড়ের রাতে উথালপাথাল রাতে, ব্যাকুল বাজান
দিতেন আজান, যেন উদাত্ত সে স্বর রুখবেই
অমন দামাল ঝড়, বাঁচাবে থুত্থুড়ে ঘরবাড়ি-তোর মনে নেই?
কী বললি? এসেছিস দেখতে আমাকে?
এখন কেমন আছি? কত সুখে আছি? নাকি তুই
চতুর ছুতোয়
আমার ইন্টারভিউ নিতে চাস এতদিনে পর?
চিঠির খামের গায়ে আমার নামের আগে ‘জবান’ দেখে কি
তোর খুব পাচ্ছে হাসি? শোন,
আমি শামসুর রাহমান, মানে ভদ্রলোক, দিব্যি
ফিটফাট, ক্লিন গাল ব্লেডের কৃপায়
আর ধোপদুরস্ত পোশাকে
এখানে-সেখানে করি চলাফেরা বড় ঝলমলে
সামাজিকতায় ভরপুর,
কখনো উদাস ঘুরি চোরকুঠরিতে।
আমি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক, ক্ষিপ্র ভাষ্যকার;
আমি শামসুর রাহমান, মানে কি…
আইডিয়াভিযানে আমিও
কখনো সমুদ্রে ভাসি, পর্বতশিখরে আরোহণ
করি কখনোবা, পার হই রুক্ষ মরুভূমি, মেরুপথে পুঁতি
আপন নিশান।
একটি অদ্ভুত ঘোড়া আমাকে পায়ের নিচে দ’লে
চলে যায় দূরে তার কেশর দুলিয়ে,
কখনো শিকার করি, হরিণ শিকার করি ঘরে।
আমার অ্যানিমা স্বপ্নে সুদর্শনা হয়ে
আমাকে অনেক কাছে ডাকে মত্ত নদীর ওপারে। আমি তার
সান্নিধ্যের লোভে
আপ্রাণ সাঁতার কাটি। তীরে প্রেতভূমি, সুদর্শনা
অকস্মাৎ পেঁচা হয়ে উড়ে যায়। নদী পেরুনোর
শক্তি লুপ্ত, কেমন তলিয়ে যাই পরিণামহীন।
চিনতিস তুই যাকে, সে আমার মধ্য থেকে উঠে অন্তরালে
চলে গেছে। তুই বাচ্চু, তুই বড় ছেলেমানুষ, অবুঝ।
কী বললি? শামসুর রাহমান নামক ধূসর
ভদ্রলোকটির
সমান বয়সী তুই? তবে কোন ইন্দ্রজালে আজও
অমন সবুজ র’য়ে গেলি, র’য়ে গেলি এগারোয়া হাঁ রে?
এই যে আমাকে দ্যাখ, ভালো করে দ্যাখ, দ্যাখ
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে-
আমার জুলফি সাদা দীর্ঘশ্বাসে ভরা, দন্তশূলে
প্রায়শ কাতর হই, চশমার পাওয়ার
দ্রুত যাচ্ছে বেড়ে…
এখন এই তো আমি, ব্যস্ত অবসন্ন, বিশ্রামের
নেই মহলত।
উজার মাইফেলের প্রেত ঘুরি হা-হা বারান্দায়।
এখন আমিও খুব সহজে ঠকাতে পারি, বন্ধুর নিন্দায়
জোর মেতে উঠতে লাগে না দু-মিনিটও; কখনোবা
আত্মীয়ের মৃত্যুকামনায় কাটে বেলা, পরস্ত্রীর
স্তনে মুখ রাখার সময় বেমালুম ভুলে থাকি
গৃহিণীকে। আমাকে ভীষণ ঘেন্না করছিস, না রে?
এখন এই তো আমি। চিনতিস তুই যাকে সে আমার
মধ্য থেকে উঠে
বিষম সুদূর ধু-ধু অন্তরালে চলে গেছে। তুইও যা, চলে যা।
দোলনা নয়
দোলনায় নয় কিংবা নয় মুখরিত খেলাঘরে,
পেয়ারা গাছের নিচে কাজল মাটিতে আছে প’ড়ে,
যেনবা পুতুল কোনো, ফেলে যাওয়া। নখভরা ধুলো,
হয়তো মাটির কাছে চেয়েছিল স্নেহকণা। হুলো
বেড়াল দেখলে অকস্মাৎ পেত ভয়, কিংবা কোনো
পেঁচার আঁধার-চেরা ডাকে কেঁদে উঠত কখনো।
অথচ এখন তার বেয়নেট-বিদ্ধ শরীরের
লোভে ঝোপ থেকে ক্ষিপ্র বেরুচ্ছে শেয়াল। খোকা টের
পাচ্ছে নাকো কিছুতেই। কে জানত এমন অনড়
হয়ে যাবে এই রাঙা চঞ্চলতা? শূন্য সারা ঘর,
সারা গ্রাম, শক্ত মৃত্তিকায় শুধু সে রয়েছে প’ড়ে।
তার তো থাকার কথা সস্নেহ কবোষ্ণ মাতৃক্রোড়ে।
না, আমি উন্মাদ নই
না, আমি উন্মাদ নই, বিড়বিড় করছি ভাবেন
সর্বক্ষণ? এ আমার মুদ্রাদোষ, বন্ধুরা বলেন।
দেখুন সযত্নে আজও কামিয়েছি দাড়ি, আফটার
শেভ লোশনের ঘ্রাণ গণ্ডময়; দুটো চ্যাপটার
গোগ্রাসে গিলেছি আজও বাস্তবিক আগাথা ক্রিস্টির।
আমি তো জনৈক স্টাফ রিপোর্টার, ধ্বংসের সৃষ্টির
বিচিত্র সংবাদ আহরণে অতিশয় দক্ষ, তাই
নানান মহলে খ্যাত। প্রায়শ এয়ারপোর্টে যাই
ভিআইপি-দের বাণী টুকি কিংবা এঁদো মফস্বলে
ছুটি সংবাদের লোভে কালেভদ্রে। ঝিলে কি জঙ্গলে
খবর শিকার করি। কখনো জমাই পাড়ি জেটে…
রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সোভিয়েতে।
কখনো নেতার ঘরে, কখনো দুর্গত এলাকায়
খবরের ঘ্রাণ শুঁকে আমার অনেক বেলা যায়।
এবারও গেলাম যথারীতি ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড
উপকূলে; কত চরে, জনপদে, অতি দূর গণ্ড-
গ্রামে খুব শান্ত গ্রামে দৈনিক পত্রের লোভী পাতা
ভরিয়ে তুলবো বলে, কিন্তু খাঁ-খাঁ করে ঝানু খাতা।
যে বাতাস সাগ্রহে মানুষ টেনে নেয় বুকে তার,
যে জলে ডোবায় গলা, আঁকে নকশা, কাটে সে সাঁতার
ছিটিয়ে জলজ ফুল, নৌকা যায়, জাল ফ্যালে; হায়
হঠাৎ দারুণ রোষে তারাই জল্লাদ হয়ে যায়।
কোথায় এলাম আমি? পোড়া চোখে একি দেখলাম?
যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু শব; কার কী যে নাম
জানি না কিছুই; নয় ওরা শব নয়; রাশি রাশি
ভারা ভারা গলিত ফসল যেন। ভীষণ আগ্রাসী
শক্তি উন্মত্ত তাথৈ নাচে সব মিসমার। ভগ্নী-ভ্রাতা,
পিতা-মাতা, বরবধূ আছে পড়ে, নেই কোনো ভ্রাতা।
বধূটির মেহেদির রঙ তখনো হয়নি ফিকে,
ভেলায় ভাসছে কত গলিত বেহুলা চতুর্দিকে।
বয়েসী পিতার লাশ থেকে ক্ষিপ্র ছিনিয়ে কাপড়
লজ্জা ঢাকে বেবস্তর উদ্ভ্রান্ত সন্তান সকাতর।
আমি তো জনৈক স্টাফ রিপোর্টার; জনহীনতার
কণ্টকিত বিস্ময়কে মগজের কোষে পুরে তার-
বার্তা কিছু পাঠাই সংবাদপত্রে; এবং পুনরায়
এ শহরে আসি ফিরে; ভিড়ে মিশি, সময় গড়ায়
যথারীতি। না, আমি উন্মাদ নই, হয়তো বেল্লিক,
কে যেন কলার চেপে বলে শুধু ধিক, তোকে ধিক।
না, আমি উন্মাদ নই; আজো সুস্থদের মাঝে ঠাঁই
রয়ে গেছে, শব্দ লিখি অফুরান, আশ্চর্য এটাই।
পালা
আমরা সবাই দেখি, গ্রাম্যজন, ক্ষিপ্র নাগরিক,
সবাই প্রত্যহ দেখি একই পালা। চির-চেনা সব
কুশীলব, পোশাকের বেবাক ভাড়াটে জেল্লা আর
স্টেজময় পায়চারি, মুখভঙ্গি, কোমরে ঝুলন্ত
তলোয়ার, সিংহাসন ইত্যাদি ইত্যাদি দেখে দেখে
এমন মুখস্থ হয়ে গেছে সব-কে কোথায় কত
উঁচিয়ে-নামিয়ে পর্দা গদ্যে-পদ্যে জুড়বে সংলাপ
কতক্ষণ, ঠিক বলে দিতে পারি আমরা সবাই।
বস্তুত সবাই দেখি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের
পালা রোজ। কেউ দিই শিস, কেউ ফুঁকি খাকি বিড়ি,
হাই তুলি মাঝে-মাঝে। বিশ্রামের ঘণ্টা বাজলেই
বাইরে বেরিয়ে এসে কখনো ফুলুরি কিনি, খিস্তি
খেউরে ভীষণ মাতি, প্রস্রাব ছিটিয়ে ঝোপেঝাড়ে
ফিরে আসি, পুনরায় একই পালা বাদ্যসহকারে
শুরু হয়, বস্ত্রহরণের পালা। এই পালা আর
বেশিদিন, বুঝেছ হে অধিকারী, দেব না চলতে
বলে গনগনে কেউ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পুড়ে বুক
টান করে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখি
লোকটাকে, মনে হয়, দুঃশাসন পালাবে এক্ষুণি।
পাশাপাশি
চুপচাপ ব’সে আছি শোভিত ড্রইংরুমে একা
এবং স্নানের ঘরে তুমি
শাওয়ারের নিচে নগ্ন। কব্জি-ঘড়িটার দিকে চোখ
বারবার রাখছি ব্যাকুল, আমি নিজের মনের
একপ্রস্থ খসখসে পোশাক খুলেই
সার্কাস দেখার মজা পেলাম পেল্লায়।
শো-কেসে গান্ধারা মুণ্ডু, জাপানি পুতুল, একজন
ব্রোঞ্জ মূর্তি, দেবী-টেবী হবে, হয়তোবা
মহেঞ্জোদারোর নটী কোনো।
কতদিন এইরূপ ছিমছাম পরিবেশে বসবার সুযোগ পাইনি।
হয়তো স্নানের ঘরে নিজেকে দেখছ অনাবৃতা,
জানালার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টিভেজা নর্তকীর মতো
গাছটিকে তীব্র দেখছিলাম তখন।
সাবানে ঘষছ তুমি বগলের সবুজাভ ভূমি
সরার মতন স্তন, নাভিমূল, ঊরু
এবং ত্রিকোণ মাংসপিণ্ড, কী মঞ্জুল।
আমি কাল সারা রাত জেগে লেখা কবিতার কিছু
অত্যন্ত বিরক্তির, ক্লান্তিকর পংক্তি
তুমুল মার্জনা করে নিচ্ছিলাম মনের ভেতর।
যখন আঁটছো তুমি ব্রেসিয়ার, আমি
আমার দারুণ নগ্ন ইচ্ছাকে আবৃত
করার চেষ্টায় ক্লান্ত হচ্ছিলাম বড়।
যখন সুদীর্ঘ চুল বাঁধছিলে তুমি চূড়ো করে,
এলোমেলো ভাবনাগুলোর মধ্যে দ্রুত
ধবল চিরুনি চালাচ্ছিলাম কেবল।
তুমি এলে গুনগুনিয়ে, সারা ঘরে বিদেশী পারফিউম; বললে,
বলো তো কখন থেকে ব’সে আছ? তারপর
সোফায় বসলে চমৎকার, শাড়িতে সবুজ লতা,
খোঁপায় গোলাপ টকটকে, চলে হার্দিক সংলাপ; এরই মধ্যে
হঠাৎ পড়লে মনে, স্যান্ডেল বগলদাবা করে
বন্যার আবিল জল ঠেলে যেতে হবে, যেতে হবে বহুদূর।
বহু কিছু থেকে ছুটি
বহু কিছু থেকে ছুটি নিতে পারি কখনো-সখনো।
আপিসের কাজকম্ম, রক আর সরব রেস্তোরাঁ,
রাস্তার অথই ভিড়, মনোহারি দোকান, ব্যাংকের কাউন্টার,
ইয়ারবকসির আড্ডা, আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়তম শব্দাবলি
রেডিও, টেলিভিশন, ব্রিজ থেকে বক্তৃতার মঞ্চ কিংবা কবিতা পাঠের
স্মার্ট আসরের শোভা; সিনেমা সার্কাস
ইত্যাদি ইত্যাদি থেকে ছুটি নিতে পারি নির্দ্বিধায়;
অথচ তোমার কাছে আজীবন ক্ষণিক ছুটির
দরখাস্ত পারব না করতে দাখিল।
একদা শৈশবে গাঢ় গোধূলি বেলায় কোনো রঙিন মেলায়
একটি পুতুল থেকে কিছুতেই বহুক্ষণ ফেরাতে পারিনি
দুটি চোখ, এত ভালো লেগেছিল। এবং তোমার ভাবনায়
নিমগ্ন হলেই, হে স্বদেশ; সেই পুতুলের মুখ মনে পড়ে।
তোমার রূপের খ্যাতি পরাক্রান্ত প্রবাদের মতো
এখনও ছড়িয়ে আছে হাটে মাঠে ঘাটে; এখনও তোমার মুখ,
সর্ষে ক্ষেতের মতো মুখ,
সোনলী আঁশের মতো চুল,
জেলের ডিঙির মতো ভুরু,
মেঘনার মতো কালো টলটলে চোখ
আনন্দ জোগায় মনে এবং জীবনানন্দ তোমার সংসর্গ
ছেড়ে অন্য কোথাও চাননি যেতে। এমনকি আধুনিক তুখোড় কবির
উচ্ছল রক্তেও বাজে অপরূপ তোমার নূপুর মাঝে মাঝে।
তোমাকে নিবিড় ভালোবাসে অনেকেই।
সংখ্যায় ক’জন তারা? কী লাভ বলো-না এই হিসেব-নিকেশে?
কেউ তারস্বরে; কেউ মৃদু
মনে মনে তোমাকেই জপে; সঁপে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল
তোমার একান্ত ঘাটে। অনেকের মতো
আমিও সহজে পারি হাজার হাজার শব্দে, জ্বলজ্বলে শব্দে
তোমার স্ততির মালা গেঁথে দিতে। কিন্তু আমি শুধু
নিঃশ্বাসের মতো লৌকিকতাহীন মা বলে ডাকতে
ভালোবাসি তোমাকেই হে দেশ আমার।
তোমাকে দেখলে মন আজকাল হয় উচাটন।
তোমার সুদীর্ঘ চুল ভাসে জলে, তুমি ভাসো সরলা সুন্দরী,
কখনো অত্যন্ত মৃদু সুরে গাও গান, স্তব্ধ হও কখনোবা,
যেন ওফেলিয়া ।
বারবার ফিরে আসে
বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে-হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।
আবার আসব ফিরে’ বলে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
স্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোর আকাশ হয়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার-উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হয়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝরে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র করবে।
বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
উনিশ শো ঊনসত্তরের
তরুণ চিৎকৃত রৌদ্রে যে-ছেলেটা খেলত রাস্তায়,
বানাত ধুলোর দুর্গ, খেত লুটোপুটি নর্দমার ধারে
বিস্ময়ে দেখত চেয়ে ট্রাক, জিপ,
রাইফেল, টিউনিক, বেয়োনেট, বুট, হেলমেট,
এখন সে টলমল পদভরে শরিক মিছিলে।
লজনম্র যে-মেয়েটি থাকত আড়ালে সর্বক্ষণ,
যে ছিল অসূর্যম্পশ্যা, এখন সে ঝলসায় মিছিলে মিছিলে।
তাদের পায়ের নিচে করে জ্বলজ্বল নীল-নকশা নব্য সভ্যতার।
বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হতাশাকে লাথি মেরে, ভয়কে বেদম লাঠিপেটা করে
সবখানে স্লোগানের ফুলকি ছড়াই।
বারবার আমাদের হাত হয় উদ্দাম নিশান,
বারবার ঝড়ক্ষুব্ধ হই আমরা সবাই।
আমাকেই হত্যা করে ওরা বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে,
আমাকেই হত্যা করে ওরা
ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে,
একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই,
আমাকেই হত্যা করে ওরা
পথের কিনারে
এভেন্যুর মোড়ে,
মিছিলে, সভায়-
আমাকেই হত্যা করে ওরা, হত্যা করে বারবার।
তবে কি আমার
বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?
বিচ্ছন্ন
এখন তোমরা কেউ আমার কথায় করবে না কর্ণপাত।
এখন তোমরা কবিতার লেজ ধরে
আছড়াতে আছড়াতে অলৌকিক বিস্ফোরণ চাও
রুটিন মাফিক।
এখন তোমরা কেউ আমার কথায় করবে না কর্ণপাত।
এখন তোমরা সব পাড়ায় পাড়ায়
ক্রোধের আগুন জ্বেলে কেবলি উঠছ মেতে গার্হস্থ্য কলহে,
মস্তানি হননে
ফেলে যাচ্ছ রক্তাপ্লুত লাশ
প্রকাশ্যে রাস্তায়।
এখন তোমরা কেউ আমার কথায় করবে না কর্ণপাত।
এখন তোমরা তোমাদের ভুবনকে
দুগ্ধপোষ্য কিন্ডারগার্টেন করে ধূর্ত কোনো হেডমাস্টারের
ছত্রচ্ছায়া চাও।
‘ডালপালা, লতাপাতা, কীটপতঙ্গকে কাছে ডাকে
বলেই না তারা রাঙা আমন্ত্রণ রক্ষায় তৎপর
হয়ে ওঠে ভোর-সন্ধে বুকে নিয়ে’-আমার এ অসমাপ্ত বাক্য
কাঁপে থরথর। ‘থামো হে গাড়ল’ বলে
আমাকে নিক্ষেপ করো গার্বেজ ডাম্পের অন্ধকারে।
আড়ালে হাঙর জেগে ওঠে নানাবিধ,
মাংস কণ্টকিত।
এখন তোমরা কেউ আমার কথায় করবে না কর্ণপাত।
গেরেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে
ছুটছ করুণা প্রেম প্রমুখের পেছনে পেছনে,
সোৎসাহে পরাচ্ছ হাতকড়া কল্যাণকে
ফাঁসি-মঞ্চে লটকাচ্ছ বিবেককে, শান্তিকে করছ একঘরে।
দূরের আকাশ থেকে আসে হাঁস, তাকে
টেনে নিয়ে বুকে ভাবি, বরং শেখাব
ভালোবাসী হয়ে যাবো দূর যৌথ স্মৃতির মায়ায়; বৃক্ষ দেখে
জাগবে নিবিড় ভ্রাতৃভাব।
হায়,
পাথর, পতঙ্গ, গাছ, পশুপাখিদের যা বলি বোঝে না তারা,
তারাও বলে না কিছু আমাকে কখনো।
ম্যাজিক
হচ্ছে, হতে থাকবে দিনের পর দিন, এইমতো,
কখনো ভিন্ন রকম।
লোকটা চায়ের দোকানে বসবে, চা খাবে, সঙ্গে
দুটো খাস্তা বিস্কুট,
ওল্টাবে খবরের কাগজ, দেখবে ম্লান হাতঘড়ি।
তরতাজা তরকারি নিয়ে ছুটবে মুটে, কাক
খুঁটে খুঁটে খাবে ইঁদুর।
সিঁদুর-রাঙা শার্ট-পরা একজন যাবেন এই পথে
রোজকার মতো,
যার কাছে দিন আর রাত্রির ব্যবধান লুপ্ত, সময়
অচিহ্নিত, তার
মনের ভেতর নানান মন্টাজ। এখানে ফাটবে
টিয়ার গ্যাসের শেল, গুলির শব্দ হবে,
মন্ত্রোচ্চারণের মতো
কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে ফিরবে স্লোগান। কেউ
মুখ থুবড়ে পড়বে রাস্তায়,
কারুর স্যান্ডেল যাবে ছিঁড়ে হঠাৎ চিৎকারে
চমকিত গলির মোড়ে।
হচ্ছে, হতে থাকবে দিনের পর দিন, এইমতো,
কখনো ভিন্ন রকম।
কাঁদবো,
কাঁদাবার লোক থাকবে বিপুল বেরাদরিতে।
হাসব,
হাসাবার লোক থাকবে বিপুল বেরাদরিতে।
আমার শহরে, আগে যেখানে ছিল মাঠ কিংবা
কালো জঙ্গল,
এখন সেখানে আলিশান দরদালান, পিঠাপিঠি।
আমার পাড়ায়, আগে যেখানে ছিল গ্রন্থবিতান,
এখন সেখানে হেয়ার-কাটিং সেলুন,
সস্তা রঙিন শাড়ির মতো
সাইনবোর্ড দাঁত কেলিয়ে হাসে সর্বক্ষণ।
আমার মা, আগে, বহুদিন আগে, সংসার
নিকিয়ে বিকেলে
চুল আঁচড়াতেন হাড়ের কাঁকই দিয়ে।
এখন তিনি
প্লাস্টিকের চিরুনিতেই অভ্যস্ত।
আমার মাথার বস্তিতে আগে ছিল কালোর
একচ্ছত্র আধিপত্য,
এখন সেখানে ওড়ে সাদা নিশান।
টেবিলে প্রাচীন একটা মুখোশ-কোথাকার
কবেকার, কে জানে-
একবার দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায় পুনরায়।
আমার চেনা এক ভদ্রলোক, একদা ছিলেন
দীক্ষিত অহিংসায়,
এখন তাঁর মুখে শুনি ‘হিংসা ইতিহাসের ধাত্রী’
ইত্যাকার বাণী।
মনের গভীরে জোনাকি-অচেতন,- দেখি
প্রাচীন এক শয্যায়
আছেন শুয়ে এক রাজা, অসুস্থ,
হীনবল আর বুড়ো।
বদলে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে অনেক কিছু-
পায়রাময় স্টেজ,
স্টিকের ডগায় টকটকে গোলাপ কখনোবা
মাটিতে কিশোরের
মুণ্ড, কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন, আবার লাগে জোড়া।
ম্যাজেশিয়ান
কী ম্যাজেস্টিক বলে দিচ্ছি হাততালি। হঠাৎ
স্টেজের পর্দা আসবে নেমে
বন্ধ হবে চেল্লানি, হাততালি, সিটি ইত্যাদি
যাবে থেমে,
থেমে যাবে, থেমে যাবে, থেমে যাবে সব ম্যাজিক।
রাজহংসী
একজন রাজহংসী, যেন সে ডেসডেমোনা, এলো
আমার অত্যন্ত কাছে। শুনল কাহিনী অগণিত
বললাম যেসব তাকে। শব্দ গেঁথে গেঁথে বানালাম
তার জন্যে ত্র্যাডভেঞ্চারের এক অলৌকিক ভোজ।
রইল চেয়ে মুগ্ধতায়; গাছের পাতারা গান গেয়ে
ওঠে, পাখি হয় ফুল, চতুর্দিকে গহন উদ্যান
বহু জায়গা জুড়ে রয়। কী করে দস্যুর জাহাজের
নিশান ছিঁড়েছি কিংবা শুনেছি সমুদ্রে বরফের
নেকড়ে-চিৎকার-জানালাম তাকে সবি একে একে।
বাড়ালো মদির চঞ্চু রাজহংসী, জড়াল আমাকে
গাউনের মতো ফুল্ল ডানায় ডানায়। আমি তার
বুকে মুখ রেখে রাঙা উষ্ণতায় হলাম মাতাল।
হঠাৎ একটি কাক, ধূর্ত আর বেজায় হিংসুটে,
স্নিগ্ধ রুমালের মতো সবচেয়ে সুন্দর পাতাটি
ছিঁড়ে নিয়ে গেল উড়ে। ‘আমারই রুমাল’ বলে আমি
দারুণ চিৎকারে নৈঃশব্দকে করলাম তছনছ;
যেন মস্ত হল-এ ঝাড়লণ্ঠনের দীর্ণ হাহাকার!
‘কী করে পেল সে ওই আমার নিজস্ব রুমালের
অধিকার?’ বলে রাজহংসীটির দিকে তাকালাম,
আমার দু’চোখ জুড়ে সবুজ আগুন। অকস্মাৎ
সাঁড়াশির মতো চেপে বসে রাজহংসীর গ্রীবায়
আমার দু’হাত আর ছিন্নভিন্ন নিজেরই হৃৎপিণ্ড
অদৃশ্য বর্শায়; দেখি, কী দারুণ নীল গলা তার,
চোখে নিদ্রা তীব্র এঁটে দিয়েছি, গাউন ছেঁড়াখোঁড়া।
শয্যায়
তাসের তাঁবুর মতো ঘরের দেয়ালগুলি খসে,
আমাদের শয্যা যায় উদোম উঠোনে, শহরের
শীর্ষে চুরুটের আগুনের মতো নক্ষত্রবাসরে।
একটি কেমন সাপ, তুমি শুয়ে চিত্রবৎ খাটে।
মেঘময়তায় দেখি ঝুঁকে তোমার মুখের দ্বীপে,
আমার তন্ময় চক্ষুদ্বয় হয় নব্য ক্রুসো; তুমি
এমন উদ্যান এক যেখানে পাখিরা সহজেই
নির্ভয়ে আশ্রয় পারে নিতে, মৃদু ঠোঁটে খড়কুটো
সযত্নে সাজাতে পারে। সুগভীর গীত জেগে ওঠে
অকস্মাৎ, লয়-তানে ঝংকৃত স্নায়ুর ঝোপঝাড়।
কান পেতে শুনি, ভাবি, তোমার শরীর সেই গীত-
উত্থিত সংগীতে বেজে উঠি, কভুবা সাঁতার কাটি
বিস্ময়-জাগানো সুরে, সেই গীত টেনে নেয় দ্রুত
আমাকে তোমারই দিকে। যুগগলবন্দিতে ক্রমাগত
শিশিরের সৃষ্টি হয় আর অবগাহনকালীন
তুমি তো মাংসল পুণ্য ক্রুশে বিদ্ধ, যিশু হও নারী।
সফেদ পাঞ্জাবি
শিল্পী, কবি, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
খদ্দের, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবিকা,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানি,
সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন
দুর্গত এলাকা-প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী
কী বলেন। রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু,
যেন মহাপ্লাবনের পর নুহের গভীর মুখ
সহযাত্রীদের মাঝে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাড়ি
উত্তুরে হাওয়ায় ওড়ে। বুক তাঁর দক্ষিণ বাংলার
শবাকীর্ণ হু-হু উপকূল, চক্ষুদ্বয় সংহারের
দৃশ্যাবলিময়; শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা
নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার। জনসমাবেশে
সখেদে দিলেন ছুঁড়ে সারা খাঁ-খাঁ দক্ষিণ বাংলাকে।
সবাই দেখল চেনা পল্টন নিমেষে অতিশয়
কর্দমাক্ত হয়ে যায়, ঝলছে সবার কাঁধে লাশ
আমরা সবাই লাশ, বুঝিবা অত্যন্ত রাগী কোনো
ভৌতিক কৃষক নিজে সাধের আপনকার ক্ষেত
চকিতে করেছে ধ্বংস, প’ড়ে আছে নষ্ট শস্যকণা।
ঝাঁকা-মুটে ভিখিরি, শ্রমিক, ছাত্র, সমাজসেবিকা,
শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, ফিরিঅলা, গোয়েন্দা, কেরানি,
সমস্ত দোকান-পাট, প্রেক্ষাগৃহ, ট্রাফিক পুলিশ,
ধাবমান রিকশা ট্যাক্সি, অতিকায় ডবল ডেকার,
কোমল ভ্যানিটি ব্যাগ আর ঐতিহাসিক কামান,
প্যান্ডেল টেলিভিশন, ল্যাম্পপোস্ট, রেস্তোরাঁ, ফুটপাত
যাচ্ছে ভেসে, যাচ্ছে ভেসে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরে।
হায়, আজ একী মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী!
বল্লমের মতো ঝল্সে ওঠে তাঁর হাত বারবার
অতি দ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয়, মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি,
যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব
বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।
সহজে আসে না কেউ
সহজে আসে না কেউ আজকাল আমার নিকট,
একদা আসত অনেকেই। তথ্যে তত্ত্বে কিংবা গল্পে
কেটেছে প্রচুর বেলা, সারা ঘরে কখনো সমৃদ্ধ নীরবতা।
এখন আসে না কেউ, বড় ব্যস্তবাগীশ সবাই-
কেউবা পতিতালয়ে, কেউ মত্ত তাসের আড্ডায়,
মাতায় পাঁচটি পাড়া পিটিয়ে নিজের ঢাক কেউ,
কেউ কেউ গ্রন্থদাস, কেউ রাজনীতির কুমার
রাখছে সোনার কাঠি সন্তর্পণে বঙ্গের শিয়রে।
সহজে আসে না কেউ আজকাল আমার নিকট,
যেন আমি চিহ্নিত চাঁড়াল। দৃষ্টিপথে দেয়ালের
ছবি, ঘড়ি, আসবাবপত্র সব ম্লান হয়ে এলে
চোখ বুজে বসে থাকি। কখন একটি খাপছাড়া
সারস তারার মতো করে, আমি উচ্ছ্বসিত পালক নিকুঞ্জে
তার জ্বলজ্বলে নগ্নতায় করি চকিতে প্রস্থান।
অত্যন্ত বরদ হ্রদ আছে এক, যেখানে পাখির বংশাবলি
পালক ঝরিয়ে গেছে যুগে যুগে, সেখানে শব্দেরা
ধ্যানী, জাতিস্মর, আমি তার বুকে কাটবো সাঁতার
এবং পুলিনে তার পাতবো আসন সিদ্ধার্থের।
আমার হ্রদয় ফুঁড়ে জেগে ওঠে জলজ প্রাসাদ,
চিত্রিত মিনারে যার বয় শুধু বাতাসের স্বর,
ঝরে নীল। শূন্যে গাছ, শূন্যে টেলিগ্রাফ তার, ভুরুর সাঁকোয়
ক্ষুধিত পাখিরা শুধু নিরুপম সূর্যাস্তকে খায়,
নিঃসঙ্গতা অবিরাম আমাকে গভীর করে চায়।
সাঁকো
বাঁধতে পারিনি কোনো সাঁকো,
যখনি উদ্যমে থরোথরো আমি সাঁকো
বাঁধতে গিয়েছি ফাঁকা জায়গায় কখনো
সাজ-সরঞ্জামে টান প’ড়ে গেছে সকল সময়।
বানর অথবা কাঠবিড়ালির পাইনি মদদ
কোনোদিন। সাঁকো
নিপুণ বাঁধতে গিয়ে আমি শুধু ব্যর্থ হয়ে যাই,
বার বার ব্যর্থ হয়ে যাই।
বাঁধতে পারিনি কোনো সাঁকো
অথচ আমার আশেপাশে
সাঁকো নেই বলে আমি মূক হয়ে থাকি,
নিজেকেই প্রিয়-সম্ভাষণে করি প্রীত, নিজের হাতেই
হাত রাখি। কিন্তু শুধু অয়নায় নিজের মুখ দেখে,
নিজের সঙ্গেই মেতে কথোপকথনে
নিজেকে আদর করে চাদরে সর্বাঙ্গ ঢেকে সকল সময়
থাকা দায়। অন্য কারো হাত
ছোঁয়া চাই, শোনা চাই অন্য কারো স্বর-
মানে সাঁকো থাকা চাই।
অথচ বাঁধতে গিয়ে সাঁকো
আমি শুধু ব্যর্থ হয়ে যাই,
বার বার ব্যর্থ হয়ে যাই।
উদাস ডাকছি আমি বিপন্ন গলায় বারবার,
যদি কেউ ছুটে আসে, কথা বলে অন্তরঙ্গতার
প্রশস্ত সুচারু রোদে চেয়ারের মসৃণ হাতলে হাত রেখে
অথবা পা নেড়ে মৃদু হেসে।
বুঝব কি তার ভাষা?
সে আমার কথার গলির
পাবে কি হদিশ কোনো? দ্রুত খুলে যাবে কি জানালা সবদিকে?
কী করে বানাব সাঁকো শূন্যে
এক লহমায়?
আমি তো ম্যাজিকঅলা নই।
বর্ণমালা শব্দাবলি দিয়ে চমৎকার স্বপ্নময়তায় সাঁকো
বাঁধা যায় হাসতে হাসতে,
কুলকুচো করতে করতে।
নিপুণ বাঁধতে গিয়ে সাঁকো তবু আমি
ব্যর্থ হয়ে যাই,
বার বার ব্যর্থ হয়ে যাই…
সাধ
ওষুধের শিশি, থার্মোমিটার ইত্যাদি অপসৃত
আমার শিয়র থেকে। রৌদ্রের বার্নিশে ঝকমকে
সারা ঘর, ছাদের কার্নিশে পরগাছা, কী প্রফুল্ল,
ছড়ায় আপন শোভা। খবরের কাগজের পাতা
টেবিলে দিয়েছে মেলে সারা বিশ্ব। হাওয়া ফিসফিসিয়ে
বলে কানে কানে, ‘তারপর কী খবর? যাক, ফাঁড়া
এ যাত্রা কেটেছে তবে। সাদা পাঁউরুটির মাংসের
ভেতরে প্রবেশ করে রোদ, করে হৃদয়ে আমার।
স্মিত কাঁচা-পাকা চুল কুড়ায় আদর চিরুনির
মধ্য-দিনে, আয়নায় দেখছি সদ্য-রোগমুক্ত মুখ,
পথ্য-সমর্থিত। কী একটা শব্দ হল অকস্মাৎ,
হয়তো পাশের ঘরে। সজনে গাছের কাছে কেউ
দাঁড়িয়ে রয়েছে বুঝি। মাঝে মধ্যে দ্বৈত গুনুনের
ঢেউ ছোঁয় আমার সত্তাকে আপাতত নিরিবিলি
নিজেকে রেখেছি মুড়ে কবিতায় আপাদমস্তক
‘কাল ধর্মঘট হবে’, কখনো মাইকে র’টে যায়,
কখনোবা মিছিলের কলরব রাস্তার ওপারে।
হঠাৎ তোমাকে দেখি, নিবিড় দাঁড়িয়ে আছ একা,
শরীরে মোহন ঋতুরাজ; হয়তো তোমার ঘাটে
এখনও বসেনি কেউ, ভরেনি আঁজলা রাঙা জলে
উল্লসিত ব্যগ্রতায়। এখন তোমাকে দেখে ফের
সদ্য-যুবকের মদির সাহস পেতে সাধ জাগে।
সাধারণ বাড়ি
কাকপক্ষী, প্রজাপতি, পারাবত, পেলব বেড়াল
ইত্যাদির প্রতি আমি ঈর্ষান্বিত, কেননা তোমার
বাড়িতে তাদের গতি উন্মুক্ত অবাধ; কিন্তু আমি
সেখানে পারি না যেতে নির্দ্বিধায় যখন-তখন
হলেও ইচ্ছায় সকাতর। ইচ্ছা কুকুরের মতো
লোভী আর এমন সুদৃঢ় চেন, বকলস নেই
যা দিয়ে বাঁধবো তাকে, রাখবো স্ববশে। ইচ্ছা হয়,
ভারি ইচ্ছা হয় যাই তোমার বাড়িতে বার বার।
সেখানে ড্রইংরুমে নেই সুশোভন টিভি,
দামি আসবাবপত্র কিছু নেই, এমনকি হায়
চায়ের বাটিও ঠুঁটো, ডানাভাঙা নিঃসঙ্গ মৃন্ময়ী
পরী তাকে, যেনবা বালিকাবধূ সংকোচে দাঁড়ানো।
তবুও তো সে-বাড়ির চতুঃসীমা, কৃপণ উঠোন,
সংকীর্ণ বিবর্ণ ঘর বড় ভাল লাগে, বার বার
চৌকাঠে দাঁড়াতে চাই, ব্যাকুল দেখতে চাই তুমি
হাসলে কেমন হাসো, কাঁদলে বালিশ কতটুকু
ভিজে ওঠে ব্যথাবাষ্পে, মেজাজের তেজিমন্দি তো-ও।
আমার ইচ্ছাকে আমি কিছুতেই পারি না দমাতে।
সে-বাড়িতে তুমি থাকো বলে অতি দরিদ্র উঠোন
নিমেষে উদ্যান হয়, ক্ষয়রোগীর মুখের মতো
কাঠের দরজা রাজ-তোরণের স্বপ্নময়তায়
কথা বলে অলৌকিক এবং কলের বিন্দু বিন্দু
জল কৃশ সাধকের জপমন্ত্র; সমস্ত বাড়িটা
জ্যোতিষ্কের বর্ণকৃতি পেয়ে যায়, দূর থেকে দেখি।
স্কুটার ড্রাইভার
স্কুটার চালানো কাজ। মিটারের ওঠা-নামা খিস্তি-
খেউড়, বচসা, দৌড় ইত্যাদি নিয়েই বেলা যায়।
নিত্য ওঠে কতজন আমার স্কুটারে, ক্ষণিকের
অতিথি সবাই। ভাড়া চুকিয়ে যে যার ঠিকানায়
নেমে পড়ে-পার্কে, মাঠে, সিনেমায়, রাস্তায়, দপ্তরে
কেউবা পাড়ায় কেউ বেপাড়ায়। কারুর গন্তব্য
নিয়ে মাথা ঘামাই না কোনো দিন। পকেট উজ্জ্বল
হলেই আমার দিন আহ্লাদিত, রাত্রি উছ্বসিত।
কখনোবা একেকটি মুখ খুব মনে গেঁথে যায়,
কিছুতেই পারি না ভুলতে। রগরগে ফিল্মে হর-
হামেশা যেসব মেয়ে নাচে গায় বাগানে পাহাড়ে
রুপালি ঝর্নার ধারে, এমনকি গোরস্থানে-যেন
তাদের মতোই কেউ আমার স্কুটারে ফিসফিস
কথা বলে উদ্বেল সঙ্গীর কাঁধে ঢ’লে। হাবুডুবু
খাচ্ছে প্রেমে হয়তো দুজন। সত্যি প্রেম? নাকি শুধু
বিছানায় একসাথে ঘুমোনোর জন্যই এমন
ঢলাঢলি, এত খুনসুটি? বাদ দিন, আমি ছাই
কী বুঝি প্রেমের? ইতরামি, খচরামি, মাজাকির
সমাহার এ জীবন। কখনো বিবির পান-রাঙা
ঠোঁট রক্তে জাগায় বলক, ছোট্র মেয়েটার হাসি
আমার ক্লান্তির কালি করে সাফ, দোস্তের দরাজ
দিল বুকে কেমন ভরসা দেয়, ফিল্মি গান গাই।
স্কুটার চালানো কাজ। শালা, দুনিয়াটা নাট আর
বল্টুর সংযুক্ত কেরামতি। কোনো দিন একজন
বুড়ো-সুড়ো যাত্রী, দেখি, ভীষণ চিন্তিত, জীর্ণ-প্রায়
জুতোর সোলের মতো গালের খোঁচা খোঁচা পাকা দাঁড়ি,
চশমাটা নাকের ডগায়, তার ছোঁড়া পাঞ্জাবিটা
চোখে পড়তেই ফের ঘরের বেড়ার কথা মনে
হল; বিড়বিড় করে লাঠি হাতে নামলেন তিনি
কেমন অন্যমনস্ক। একদিন একটি মহিলা,
কান্না-ভেজা চোখ তার, হাত নেড়ে ডেকেও স্কুটারে
ওঠেননি; বিরক্তিতে পাড়লাম গাল। বুঝি তার
কনস্কামনার ভীরু হরিণ হারিয়ে গেছে এই
শহরের ভিড়ে; মাঝে-মাঝে বিছানায় শুয়ে ভাবি-
নানা মুখ ভিড় করে আসে চোখের সম্মুখে, যেন
মেলায় ঘুরছি আমি। ওরাও ঘুরছে সর্বক্ষণ
ক্ষণিক অতিথি সব, যদি পারতাম সবাইকে
সব সমাধানের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে কোনো দিন।
স্বাধীনতা একটি বিদ্রোহী কবিতার মতো
সে এক সময় ছিল আমাদের, সন্ত্রাসের কণ্টকিত হাতে
সমর্পিত সারাক্ষণ। আমরা কখনো
আহত পশুর মতো নিজস্ব গুহায় স্বেচ্ছাবন্দি, কখনোবা
পলাতক গ্রাম-গঞ্জে, মফস্বলে, নদীতীরে, রাইফেল আর
বেয়নেট থেকে দূরে। গেরস্ত কুটিরে, স্কুলঘরে গাদাগাদি
অনেক সংসার একাকার। দুর্বিপাকে
হয়তো এমনই হয়। কোথাও নিস্তার নেই; খাকি
সন্ত্রাসে আচ্ছন্ন হয় নদীতীর, সর্ষেক্ষেত, তাল-সুপুরির
গাছ, বাঁশবন, বেতফল আর বাবুইপাখির বাসা। প্রহরে প্রহরে
রাইফেল গর্জে ওঠে, যেন বদমেজাজী মোড়ল
ভীষণ শাসাচ্ছে অধস্তন পাড়া-পড়শিকে। আবার গুটিয়ে
পাততাড়ি ফিরে আসি বিকলাঙ্গ শহরেই যূথচারী লেমিং যেমন
ছুটে যায় দুর্নিবার ধ্বংসের চূড়ায়।
সে এক সময় ছিল আমাদের। লুপ্ত স্বাভাবিক
কথোপকথন, হাসি তামাশা ইত্যাদি।
কেবল ভয়ার্ত চোখে চাওয়া,
কড়িকাঠ গোনা,
অন্ধকার ঘরে
কখনো নিঃশব্দ ব’সে থাকা, কখনোবা
রুলিপরা একটি হাতের
বন্দরে ভিড়িয়ে
ঝঞ্ঝাহত নিজের একলা হাত আবার চমকে ওঠা অভ্যাসবশত-
সে এক সময় ছিল আমাদের ভয়ানক আহত ঢাকায়।
তখন খেলার প্রতি ছিল বড় বেশি উদাসীন
বালক-বালিকা;
করাল বেলায় নিমজ্জিত
আপাদমস্তক
সন্ত্রাসে ওরাও যেন আমাদের সমান রয়সী!
আমাদের দিনগুলি, আমাদের রাত্রিগুলি শেয়াল-শকুন
ক্রমাগত খেল চেটেপুটে
দিব্যি সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
একটি গণ্ডার, শিং যার রক্তমাখা, বারবার
হানা দেয় ঘরে,
দরজা-জানালা ভাঙে; আসবাবপত্র
করে তছনছ,
চালায় ধারালো শিং উদরে আমার;
বন্য পদতলে, হায়, দলিত সন্তান,
দ্বিখণ্ডিতা জীবন-সঙ্গিনী।
পরদিন সে গণ্ডার আবার উদিত হয় সগৌরবে সব
সংবাদপত্রের
প্রথম পৃষ্ঠায় চমৎকার ফটোরূপে,
ফটোর তলায় নামাঙ্কিত টিক্কা খান।
কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে,
মনে হয়, ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।
দিনদুপুরেই জিপে একজন তরুণকে কানামাছি করে
নিয়ে যায় ওরা;
মনে হয়, চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।
বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গা কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে;
মনে হয়, স্বাধীনতা লখিন্দর যেন,
বেহুলাবিহীন,
জলেরই ভেলায় ভাসমান।
যখন শহরে ফাটে বোমা, হাতবোমা, অকস্মাৎ
ফাটে ফৌজি ট্রাকের ভেতর,
মনে হয়, স্বাধীনতা গর্জে ওঠে ক্রোধান্বিত দেবতার মতো।
এরই মধ্যে মৃত্যুগন্ধময় শহরে যখন খুব
কুঁকড়ে থাকা কোনো শীর্ণ গলির ভেতর
আঁধারের নাড়ি ছেঁড়া নবজাতকের
প্রথম চিৎকার জেগে ওঠে,
মনে হয়, স্বাধীনতা একটি বিদ্রোহী
কবিতার মতো
তুমুল ঘোষণা করে অলৌকিক সজীব সংবাদ।
স্যামসন
ক্ষমতামাতাল জঙ্গি হে প্রভুরা ভেবেছ তোমরা,
তোমাদের হোমরা চোমরা
সভাসদ, চাটুকার সবাই অক্ষত থেকে যাবে চিরদিন?
মৃত এক গাধার চোয়ালে, মনে নেই ফিলিস্তিন,
দিয়েছি গুঁড়িয়ে কত বর্বরের খুলি? কত শক্তি
সঞ্চিত আমার দুটি বাহুতে, সেও তো আছে জানা। রক্তারক্তি
যতই কর-না আজ, ত্রাসের বিস্তার
করুক যতই পাত্রমিত্র তোমাদের, শেষে পাবে না নিস্তার।
আমাকে করেছ বন্দি, নিয়েছ উপড়ে চক্ষুদ্বয়।
এখন তো মেঘের অঢেল স্বাস্থ্য, রাঙা সূর্যোদয়
শিশুর অস্থির হামাগুড়ি, রক্তোৎপল যৌবন নারীর আর
হাওয়ার স্পন্দিত ফুল পারি না দেখতে। বার বার
কী বিশাল দৃষ্টিহীনতায় দৃষ্টি খুঁজে মরি। সকাল সন্ধ্যার
ভেদ লুপ্ত; মসীলিপ্ত ভূগর্ভস্থ কারাকক্ষে চকিতে মন্দার
জেগে উঠলেও অলৌকিক শোভা তার থেকে যাবে নিস্তরঙ্গ
অন্তরালে। এমনকি ইঁদুরও বান্ধব অন্তরঙ্গ
সাম্প্রতিক, এমন নিঃসঙ্গ আমি। নিজ দোষে আজ
চক্ষুহীন, হৃতশক্তি, দুঃস্বপ্নপীড়িত। এখন আমার কাজ
ঘানি ঠেলা, শুধু ভার বওয়া শৃঙ্খলের। পদে পদে
কেবলি হোঁচট খাই দিনরাত্রি, তোমরা অটল মসনদে।
শক্র-পরিবৃত হয়ে আছি; তোমাদের চাটুকার
উচ্ছিষ্ট-কুড়ানো সব আপনি-মোড়ল, দুস্থ ভাঁড়
সর্বদাই উপহাস করছে আমাকে। দেশবাসী
আমাকে বাসে তো ভালো আজো-যাদের অশেষ দুঃখে কাঁদি হাসি
আনন্দে। পিছনে ফেলে এসেছি কত যে রাঙা সুখের কোরক,
যেমন বালক তার মিষ্টান্নের সুদৃশ্য মোড়ক।
আমাকে করেছ অন্ধ, যেন আর নানান দুষ্কৃতি
তোমাদের কিছুতেই না পড়ে আমার চোখে। স্মৃতি
তাও কি পারবে মুছে দিতে? যা দেখেছি এতদিন-
পাইকারি হত্যা দিগ্বিদিক রমণীদলন আর ক্ষান্তিহীন
রক্তাক্ত দস্যুতা তোমাদের, বিধ্বস্ত শহর, অগণিত
দগ্ধ গ্রাম, অসহায় মানুষ, তাড়িত, ক্লান্ত, ভীত
-এই কি যথেষ্ট নয়? পারবে কি এসব ভীষণ
দৃশ্যাবলি আমূল উপড়ে নিতে আমার দু-চোখের মতন?
দৃষ্টি নেই, কিন্তু আজো রক্তের সুতীব্র ঘ্রাণ পাই,
কানে আসে আর্তনাদ ঘন ঘন যতই সাফাই
তোমরা গাও না কেন, সবকিছু বুঝি ঠিকই। ভেবেছো এখন
দারুণ অক্ষম আমি, উদ্যানের ঘাসের মতন
বিষম কদম-ছাঁটা চুল। হীনবল, শৃঙ্খলিত
আমি, তাই সর্বক্ষণ করছ দলিত।
আমার দুরন্ত কেশরাজি পুনরায় যাবে বেড়ে,
ঘাড়ের প্রান্তর বেয়ে নামবে দুর্দমনীয়, তেড়ে-
আসা নেকড়ের মতো। তখন সুরম্য প্রাসাদের সব স্তম্ভ
ফেলব উপড়ে, দেখো, কদলী বৃক্ষের অনুরূপ। দম্ভ
চুর্ণ হবে তোমাদের,সুনিশ্চিত করব লোপাট
সৈন্য আর দাস-দাসী অধ্যুষিত এই রাজ্যপাট।
হে বঙ্গ
হে বঙ্গ তোমার মুখ নিবিড় ফটোজেনিক বলে
সবাই তুলতে চায় ছবি নানা পোজে, কেউ চায়
নামুক চুলের ঢল অমল শ্যামল গ্রীবা বেয়ে,
কেউবা টিপের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী। কস্তাপেড়ে
শাড়িতে তোমাকে খুব মানাচ্ছে সম্প্রতি ভেবে কেউ
ক্যামেরা বাগায় পটু ব্যগ্রতায়, ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক।
মাইরি বিষম তাক লেগে যায় কেরদানি দেখে,
আমি তো তুলি না ফটোগ্রাফ কোনো, দেখি শুধু দেখি।
তোমার উদ্দেশে ভাব-গদ্গদ কতজন ইনিয়ে-বিনিয়ে
লেখেন সুচারু পদ্য রাশি রাশি, অনেক নিপুণ
চিত্রকর রাতারাতি ব’নে যান পটুয়া তোমার।
আমি তো লিখি না পদ্য, পটে রঙ মাখি না কখনো।
অক্ষম বিবর্ণ আমি, ক্লান্ত এবং গৌরবছুট-
কেবলি তোমাকে দেখি চোখ ভরে, তোমাকেই দেখি।
তুমি কি প্রান্তর ধু-ধু অথবা কাজল দিঘি শুধু?
কিংবা বনরাজিনীলা? না কি প্রেতভূমি? তুমি ধান
ভানো, গাও গান ঘুমপাড়ানিয়া নিঝুম রাত্তিরে,
প্রত্যহ ভাসাও ঘড়া, এলেবেলে গল্প করো ঘাটে,
কখনো বানাও পিঠা, কখনোবা কঙ্কালপ্রতিম
অভুক্ত সন্তান নিয়ে তোমার দুঃখের বেলা যায়।
তোমার শরীর দেখি ছিঁড়ে খায় শকুন শেয়াল,
তোমার উদাস বুকে পদধ্বনি শোকমিছিলের।
কখনো তোমার খাঁ-খাঁ বিবস্ত্র শরীর ঢেকে দেয়
পতাকা ব্যানারে ওরা লজ্জাতুর তোমার সন্তান।
মারিতে মরোনিত তুমি, ম্যাক্সিম গোর্কির জননীর
মতো তুমি সংগ্রাম ও শান্তি করো হৃদয়ে ধারণ।