বুড়ো সুড়ো একজন
বুড়ো সুড়ো, জবুথবু একজন, তবু জীবনকে
ঘরের দেয়াল ভেবে চুপচাপ দেয়ালের প্রতি নির্নিমেষ
দৃষ্টি রেখে প্রত্যহ থাকেন ব’সে একা
পুরানো সোফায়। বাকপটু বলে খ্যাত
একদা, এখন সব
ঝলমলে বাক্য তাঁকে ত্যাগ ক’রে নিয়েছে আশ্রয়
স্তব্ধতায়। চায়ের পেয়ালা খুব আস্তে সুস্থে তুলে
নেয়ার সময় হাত কাঁপে, শূন্য দৃষ্টি, যেন চোখে
স্বপ্ন দেখবার
ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে চিরস্থায়ী গোধূলির জালে
বন্দি সর্বক্ষণ, পায়ে তাঁর, মনে হয়,
অগণিত নুড়ি এলিজির রূপ ধ’রে ঝরে যায় নিরিবিলি।
দেয়াল, ফ্লাওয়ার ভাস, জানালার পর্দা, বিছানার
চাদর, সোফার রঙচটা
হাতল, পায়ের কাছে আলস্যের মতো শুয়ে-থাকা
কুকুরের ঈষৎ জিজ্ঞাসু চক্ষুদ্বয়-
প্রতিটি বস্তুর কাছে শব্দের গভীর প্রার্থনায়
থরো থরো সমগ্র অস্তিত্ব তাঁর শব্দহীনতার মরুভূমি
পাড়ি দেয়। কখনো-সখনো ঠোঁট নড়ে,
যেন সিনেমার
নির্বাক যুগের অভিনেতা। পুরানো বাড়ির ছায়া
নেমেছে আত্মায় তাঁর, কবে শূন্য নৌকো
দূলবে নদীর বুকে, জানা নেই। মাথার ভেতর
সূর্যাস্ত গলছে ক্রমাগত, অন্য এক
আচাভুয়া পাখি
ওড়ার চেষ্টায় শুধু পাক খেয়ে পড়ে বিরানায়।
গৃহিনী ভোগেন উচ্চ রক্তচাপে, এক পুত্র তাঁর
মুক্তিযুদ্ধে নিহত, অন্যটি মধ্যপ্রাচ্যে ভাগ্যান্বেষী,
এবং আরেকজন গৃহত্যাগী, এক মাত্র কন্যা দিগন্তের
স্বর্ণাভায় চোখ রেখে প্রহর কাটায়,
হৃদয়ের সরোবরে তার
পত্রালি-শোভিত স্বপ্ন নুয়ে আসে। টেবিলে সাজানো
বাদামি বাকরখানি ডিম, অস্ট্রলিয়ান আপেল,
অবশ্য সম্প্রতি তাঁর রোচে না আহার।
অকস্মাৎ মনে হয় তাঁর ঘরময় অজস্র রঙিন প্রজাপতি
চাঞ্চল্যের চিত্র হয়, ঠোঁটে
চকিতে ফিরিয়ে আনে কবেকার চুম্বনের স্বাদ। লহমায়
মগজের ধূসরতা, অনেক হলুদ পাতা সরে যায়। একটি বিকেল
এবং একটি সন্ধ্যা পুরাণের পুনর্জন্মের মতোই জেগে
উঠে মনে ছড়ায় মোহের বীজ। বেলাশেষের রোদ্দুর পায়ে
লোটে আর এক ধরনের নিস্তব্ধতা
ঠুকরে ঠুকরে তাকে ক্রমশ ক্ষইয়ে দিতে থাকে। কিয়দ্দুরে
শূন্য নৌকো দূলে ওঠে, হঠাৎ চৌদিকে
নেমে আসে দিনান্তের কী ব্যাপক বিজন কুয়াশা।
ভাগ্যিস মৃত্যুর সঙ্গে
কী রকম হয় যদি আমি নিউ মার্কেটে অথবা সিনেমায়
না গিয়ে এখন উপকূল এলাকায়
চলে যাই? মনে-মনে যাই নি কি চলে? যদি বলি
টলটলে ঠাণ্ডা জলে নিজের ধূসর তেষ্টা মেটাবার সময় কেবলি
আমার পড়েছে মনে লবণাক্ত ধু ধু উপকূল
এলাকার মর্মমূল-
ছেঁড়া পিপাসার কথা তবে
মিথ্যে বলা হবে?
এই যে রয়েছো প’ড়ে ঝড়ে-ওপড়ানো
গাছের মতোই কিংবা স্ফীতকায়, সম্বিত-হারানো
জলদেবতার মতো, কী তোমার নাম? অসিমদ্দী, আকমল
অথবা গজনফর আলী, নাকি যোগেশ মণ্ডল?
না যা-ই হোক, কী-বা আসে যায়, মৃত্যু কোনোদিন
করে না বিচার ধর্মগোত্র, ক্ষমাহীন
হাতে ছিঁড়ে নেয় অকস্মাৎ
প্রাণের গোলাপ কুঁড়ি। দ্বীপ দীপান্তরে কী ব্যাপক অপঘাত।
যখন প্রকৃতি রুদ্র দেবতার মতো ফেটে পড়ে
ক্রোধে ঘরে ঘরে
ওঠে রোল মরণ কান্নার আর এক লহমায়
জলের অক্ষরে লেখা কবিতার মতো মুছে যায়
অসহায় অসংখ্য জীবন, কিন্তু কী লাভ বলো না দোষ দিয়ে নির্বিকার
প্রকৃতিকে, যখন মানুষই আজ মানুষের সহজ শিকার।
তোমার হৃদয় আজ ফ্রিজে রাখা ফল,
অথচ তোমার ছিল ভালোবাসা, পথের সম্বল
যৎসামান্য, ছিল কিছু গৃহকাতরতা,
আর কিছু বলবার কথা
ছিল প্রিয় বন্ধুকে তোমার। কিন্তু মুখ
থুবড়ে রয়েছো প’ড়ে কী স্বচ্ছ জলের নিচে সব ভুলচুক
অথবা অসুখ ভুলে গিয়ে, জলময় এমন নিঃসঙ্গতায়
আমার চোখের পানি ঝরে অবিরল, মিশে যায়।
পেলে ঠাঁই সাপ্তাহিক টাইমের রঙিন প্রচ্ছদে, আচানক
পেয়েছো সম্মান প্রায় রাষ্ট্রপ্রধানের। অনেকেই খুব শক
পেয়ে থাকবেন গুম হয়ে কিছুক্ষণ
উত্তরে দক্ষিণে, তারপর যথারীতি দেবেন সহজে মন
নিজ নিজ খুঁটিনাটি কাজে।
শুধু মাঝে মাঝে
চলবে ড্রইংরুমে, সম্মেলনে আলোচনা বিরান চরের।
ঘুরবে তোমার এই সুদাসলে-খাটা লাশ বিশ্বময় ঢের
দামী মানুষের হাতে হাতে, ঘরে, ঘরে,
ভাগ্যিস মৃত্যুর সঙ্গে উড়ে গিয়েছিলে ঘূর্ণিঝড়ে।
ভেসে যায় সৌরলোকে
এর পরে কিছু নয়, কিছুই না। পুরানো কবরে
প্রহরে প্রহরে
পাতা ঝরে, ঘাস দীর্ঘ হয়। নতুন কবরে কেউ কী নিবিড়
একটি পুষ্পিত ডাল গুঁজে
দেয়, বাতি জ্বালে, বিড় বিড়
আয়াত আবৃত্তি করে। কেউ কেউ খুঁজে
নিতে চায় কিছু আশেপাশে।
রুদ্রাক্ষের মালা
অথবা তসবিদানা, গলায় ঝোলানো ক্রুশ তীব্র অন্তর্জালা
পারে না মেটাতে ঘাসে ঘাসে
কুয়াশার মতো নীরবতা নেমে আসে;
মেলে না সান্ত্বনা কোনো ধোঁয়াটে আশ্বাসে।
গেছে দলে দলে, যাবো আমিও প্রবাসে। কিন্তু এই
প্রবাস কথাটা লিখে ফেলে একরত্তি স্বস্তি নেই;
কী করে প্রবোধ দিই নিজেকে এখন? বাস্তবিক
দেখি না আমার ঘরে স্বর্গের প্রদীপ। দিগ্বিদিক
ছুটে মরি, সবগুলো খুঁটি
লুপ্ত আজ, ছিঁড়ি কুটি কুটি
বাতিল দলিল;
মহাজনী কূটকচালের ভাষা, মিল ও অমিল
ভেসে যায় সৌরলোকে, পায়ের তলায়
মাটি কাঁপে সর্বক্ষণ, যায় সবই যায়।
ফিরবো না; মিনিবাসে পথ চলা, ছায়ায় দাঁড়ানো
এবং হারানো
ফুলের সুগন্ধ পেয়ে সন্ধ্যেবেলা দূরে চেয়ে-থাকা,
শহরতলীতে তালপাখা,
আষাঢ়ে মাটির ঘরে মধ্যাহ্ন ভোজন,
যোজন যোজন
দূরে তার হাতে হাত রেখে
ঝকঝকে দুপুর বেলায়
গল্পের ভেলায়
ভেসে-যাওয়া, পড়শির দেনা
থাকবে না।
অতর্কিতে ঘরে কি বাইরে দেবে হানা
মেলে কৃষ্ণ ডানা সে অজানা,
নিমেষে ফেলবে ঢেকে
সত্তা, তাই গাছের রসাল ফল এবং তৃষ্ণার টলটলে
জল ঝলমলে
পাশের ফ্ল্যাটের সদ্য যুবকের গিটার বাজানো,
তারায় সাজানো
আকাশ, রোদ্দুরে স্মিত গলি, পরস্পর মেশামেশি
ছুটির দুপুরে আর ভিডিও ক্যাসেটে ফিল্ম দেখে হাসাহাসি
এবং চায়ের কাপে বিলাসী চুমুক ভালোবাসি
আরো বেশি।