ডুবসাঁতার
এ কেমন খেলা আমি খেলতে গেলাম সোজাসুজি
বাজি রেখে সব পুঁজি? এখন আমার
সারা গায়ে চন্দনের মতো
লেপা হয়ে গেছে থিকথিকে কাদা। কারা
এ ভূষণ দিলো
আমাকে এমন অবেলায়?
কেউ নয়। কারুর মুণ্ডুর দিকে তর্জনী দেখিয়ে
সাত ঘাটে সাতটি শিখণ্ডী
খাড়া ক’রে মোক্ষলাভ হবে না আমার। খোলাখুলি
কবুল করাই ভালো,
নিজেই ভিজেছি আমি এক হাঁটু পানিতে এবং
সারাক্ষণ দশচক্রে মেতেছি তুমুল ঝাঁপতালে।
নিজের মমির মতো শরীরে বুলিয়ে চোখ ভাবি,
সূর্য ডোবে ডুবুক, এখনো
গহীন নদীতে গিয়ে ডুবসাঁতারের
লগ্ন আছে। পেছনে পেছনে
একটি কুকুর যদি সাঁতরে চলে আসে,
ক্ষতি নেই। তাকে আমি ফিরিয়ে দেবো না।
দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে
নিজের ব্যাপারে বলা যায়, ভালোবাসি ভালোবাসি
বলে আমি ফাটাই নি গলা,
দিই নি শ্লোগান পৌরপথে কোনোদিন। পেশাদার
প্রেমিকের মতো টেরি কেটে, পারফিউম ছড়িয়ে
গায়ে লটপট
করিনি তোমার সঙ্গে। অথচ যকন বৃষ্টি নামে
দিগন্ত ডুবিয়ে আর রৌদ্রের আবীর
ঝরে শরতের ক্ষেতে, শিমুল রাঙিয়ে
দেয় গ্রাম্য পথ, বালকেরা দৌড়ে যায়
শর্ষে ক্ষেতে আনন্দের ঢেউ তুলে, তখন তোমাকে
হৃদয়ের সকল উষ্ণতা
অধীর অর্পণ করি, তোমারই উদ্দেশে নিত্য ফোটাই গোলাপ।
যেদিন তোমার বস্ত্রহরণের পালা
শুরু হলো, তোমার চুলের মুঠি ধ’রে পৈশাচিক
উল্লাসে উঠলো মেতে মদমত্ত বর্বরেরা, সেদিন যাদের
চোখ ক্রোধে রক্তজবা হয়ে উঠেছিল লহমায়,
তোমার গ্লানির কালি মুছে দিতে যারা
হলো শস্ত্রপাণি, আমি তাদের করেছি সমর্থন
সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে। তোমার কান্নার পরে দেখি
বৃষ্টিধোয়া রক্তগোলাপের মতো ফুটে আছো তুমি।
তোমার গোলাপে যারা ছড়িয়েছে কীট
সকল ঋতুতে আর দিনরাত্রি উপহাসে তোমাকে বিঁধেছে
শজারুর কাঁটায় কাঁটায়,
তোমার দুর্দিনে যারা শক্রদের হাতে হাত রেখে
খেলেছে করোটি নিয়ে ভুতুড়ে জ্যোৎস্নায়,
এবং তোমাকে চড়িয়েছে
সোৎসাহে নীলামে,
যেমন অতীতে লোভাতুর বণিকেরা লুণ্ঠিতা রূপসীদের
ক্রীতদাসীদের মতো বেচাকেনা করতো বাজারে
দিনারের বিনিময়ে, তারাই এখন
সর্বদা তোমার সঙ্গে লতকা লতকি করে আর
তোমার সাধের লাল গোলাপের জন্যে যারা হুইল চেয়ারে
পোহায় যৌবন, দ্যাখে অস্তরাগ, তাদের দিয়েছে ঠেলে ব্যাপক
ভাগাড়ে,
সর্বদাই প্রস্তুত তাদের জন্য শত কাঠগড়া।
বিবরে লুকিয়েছিল যারা গির্জের ইঁদুর হয়ে
ইদানীং তারা বনবেড়ালের রূপে
তুমুল ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তির চাতালে,
যখন তখন
বসায় নখর দাঁত জায়মান সৌন্দর্যের গোলাপি গ্রীবায়।
এখন লুকাতে চাই আমি
আরো অনেকের মতো মেঘের আড়ালে,
মেঘনার তলদেশে, শস্যের ভেতরে রাত্রিদিন।
এই উল্টোরথ দেখে, শপথ তোমার
প্রেমের, আমার আজ বড় বেশি দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে।
ধৈর্যশীল চোখ
ঋতুতে ঋতুতে সূর্য ঠোকরায়, বৃষ্টি আঁচড়ায় যথারীতি
বাড়িটাকে, ছাদের কার্নিশে
পাখি এসে বসে, ডাকাডাকি
করে, ঘরে লেখে একজন,খাতার পাতায় তার
অদৃশ্য মঞ্জীর
বেজে যায়, ঝরে কত নিবিড় আবীর। ট্যাপ থেকে
পানি পড়ে গোসলখানায়, পরীক্ষার্থী পদ্য পড়ে,
কেউ চুল মোছে সদ্য-কেনা তোয়ালেতে, খেতে বসে
ব্রেকফাস্ট কেউ,
কেউ-বা কামাচ্ছে দাড়ি সাত তাড়াতাড়ি, অফিসের
তাড়া আছে। আজকের কাগজটা কই?
আধুনিক কবিতার বই টেবিলে প্রহর যাপে।
ফেরিঅলা ডেকে যায় দুপুরকে উদাস বিধুর
ক’রে দিয়ে, কোনো দরজায় চলে
দর কষাকষি, লেখা ছেড়ে উঠে পড়ে
সেই একজন, বেলা বাড়ে, রেডিওতে হাসন রাজার গান;
মনের ভেতরে তার ভিন্ন ঘরবাড়ি,
লতাগুল্ম ঢাকা,
ছাদ আর দেয়ালবিহীন, মাথা তোলে
দেবতার মতো।
সে যায় নিঃশব্দে হেঁটে বারান্দায়, তাকায় দূরের
আকাশে এবং নীলিমাকে ছন্দের ধরনে করে
বিশ্লেষণ, তার হৃদয়ের কাছে কারো
হাত নুয়ে পড়ে, যেন পুকুরের ছলছলে জলে তন্বী ডাল।
বাড়িটার বয়স অনেক হলো নাকি? ছেড়ে চলে
যেতে হবে কে জানে কখন। বারান্দাটা ঠিকই আছে
আগেকার মতো, মাঝে মাঝে চাপা কান্না বেরোয় দেয়াল থেকে;
ছাদ থেকে পানি পড়ে, ভরা
বর্ষায় আগেও ভেসে যেতো মেঝে, দরজা জানালা
তেমনি আছে, কুলুঙ্গিতে তোলা থাকে কুপি,
শাড়ি নড়ে চৈত্রের দুপুরে;
শুধু যে জানালাটায় চকিতে উঠতো
ভেসে রোজ কোমল মুখশ্রী,
সে আর দেয় না খুলে তার বুক হাট ক’রে সকাল-সন্ধ্যায়;
অথচ সেদিকে তবু চেয়ে থাকে একজোড়া ধৈর্যশীল চোখ।
পুকুর
পুকুর শুকিয়ে গেলে কাদা জমে কিমামের মতো,
উধাও সকল মাছ। বস্তুত তখন বড়শি বাওয়া
অবান্তর; যদি ফের কোনোদিন কানায় কানায়
ভরে ওঠে সে পুকুর, জাগে বুড়বুড়ি মাছেদের
তাহ’লেই ছিপ ফেলে সুখ; নইলে রোদে পুড়ে আর
বৃষ্টির আঁচড়ে খুব ক্লান্ত হয়ে রিক্ত বেলা যাবে।
মাঝে মাঝে মধ্যরাতে ভয় পেয়ে জেগে উঠে ভাবি
অন্ধকারে চোখে মেলে, অকস্মাৎ আমার পুকুর
বেবাক শুকিয়ে যায় যদি, তবে কী হবে আমার?
প্রত্যহ পড়বে চোখে ফুল্ল গাছপালা, গানে গানে
হবে গুঞ্জরিত দশদিক আর অন্তর্গত হাড়ে
বয়ে যাবে সূর্যাস্ত ঢেউয়ের মতো; অথচ আমার
বুক দীর্ণ হাহাকারে রাত্রিদিন, থিকথিকে কাদা
ছেনে যাবে দীর্ঘ বেলা, হাতে নেচে উঠবে না মাছ।
বন্দনার পাখি
অন্ধকার তড়িঘড়ি পাততাড়ি গুটিয়ে চলেছে,
যেমন উত্তাল গণআন্দোলনের তোড়ে স্বৈরাচারী
শাসক। আকাশে সেজদায়-যাওয়া
মানুষের মতো চাঁদ
ঝুলে রয়েছে তখনও। আমি পায়চারি করছি
খোলা বারান্দায়, আমার মনের ভেতর
স্মৃতির ফিসফিসানি আর না-লেখা কবিতার গুঞ্জরণ।
সূর্য উঠছে, যেন রঙিন বল,এক ঝাঁক
বুনো কবুতর এসে বসে টিন শেডে
গমের লোভে, হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায়
লাল কাঁকরময় একটি পথ, কুয়াশার ঘোমটাটানা গ্রাম আর
অখ্যাত স্টেশনে লাইনসম্যানের বাতি দোলানো।
তখুনি অসমাপ্ত কবিতার মতো একটি
উদ্ভাসিত তুমি। তোমার শরীরে
সুরমা রঙের বাহার, ভোরের স্পর্শ লাগা সোনালি বাহু
ঝিকিয়ে ওঠে, যখন তুমি সিমেন্ট ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসা লম্বা শিক ধরে দাঁড়াও। তোমার মুখ
ভোরবেলাকার চাঁদের মতোই
অস্পষ্ট আমার কাছে, তোমার নাম আমি জানি না।
তবু মনে হয়, সৌন্দর্য তোমার যৌবনে
দোল খায় সারাক্ষণ মৃত্যু উপেক্ষা ক’রে। এখন তোমাকে ঘিরে
কতিপয় প্রজাপতির রঙিন চাঞ্চল্য,
একটি স্বপ্নের নিস্তব্ধ ঝালর আর
একটি স্পর্শকাতর হৃদয়ের স্পন্দন এবং অজস্র অদৃশ্য চুম্বন।
ভাবনার কোন গলি-ঘুপচিতে
তুমি ঘুরছো এখন? হয়তো খুন-হয়ে –যাওয়া কিছু ফুল
কিংবা ঘূর্ণমান পাখার ব্লেডে নিহত
একটি চড়ুই তোমার মনে বুনে দিয়েছে বিষাদ।
আমার কথায় মঞ্জরিত তোমার ভাবনা,
এমন অসম্ভব দাবি আমি করবো না, তবু তোমার খোঁপায়
আমি পরিয়ে দিয়েছি আমার নিঃসঙ্গতা,
আমার আত্মার হাহাকার
জড়িয়ে দিয়েছি তোমার স্তনে, গ্রীবায়, নাভিমূলে, এবং
বন্দনার পাকি বারবার উড়িয়ে দিই তোমার উদ্দেশে।
এই যে ভোরবেলা তোমার যৌবনের আহ্বান
এসে পৌঁছলো আমার কাছে, তুমি জানলে না।
তুমি যখন নেই আমার দৃষ্টিপথে, তখন
শূন্যতায় পাখা ঝাপটাতে থাকে চম্কে-ওঠা
বন্দনার পাখি এবং
আমি উদ্ভিদহীন এক বাগান দেখি সেখানে।